গণরুম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরই অযাচিত এবং অসমীচীন পদক্ষেপের প্রতিফলন

  • Update Time : ১২:৫২:১০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১ নভেম্বর ২০২১
  • / 265

একটি তাৎপর্যপূর্ণ সময় অতিবাহিত করছে বাঙালি জাতি। এ বছর, বাংলাদেশ যখন পদার্পণ করলো স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে, ঠিক তখনই এ দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ, ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পৌঁছে গিয়েছে তার শততম বর্ষে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী তার সাথে যুক্ত করেছে বাড়তি মাত্রা। তবে এই আনন্দের সময়ের চ্যালেঞ্জও কম নয়। করোনা মহামারীতে একদিকে ভেঙ্গে পড়েছে দুর্বল অর্থ ব্যবস্থা, অন্যদিকে ধর্মের নামে দেখা গেছে কতিপয় নরপিশাচের ঘৃণ্য নিষ্ঠুরতা। শতবর্ষের গৌরবকে ম্লান করতে অন্য সকল বছরের চেয়ে অবনতি দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং -এও ৷ করোনার প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে দীর্ঘ প্রায় ১৮ মাস পর আবারও শুরু হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কার্যক্রম। এই দোদুদ্যমানতার অধীর সময়ে বাংলাদেশের ‘সেকেন্ড পার্লামেন্ট’ হিসেবে পরিচিত ডাকসু এবং হল সংসদের নেতৃবৃন্দের চিন্তা-ভাবনাকে জানতে এবং তা জনসাধারণের কাছে তুলে ধরতে বিডি সমাচার আয়োজন করেছে নিয়মিত সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান, – “কী ভাবছেন তাঁরা? “

এরই ধারাবাহিকতায় বিডি সমাচার সম্প্রতি মুখোমুখি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ছাত্র সংসদের (সাবেক) জি এস মো. মেহেদী হাসান মিজান -এর। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, মুহাম্মদ ইমাম-উল-জাননাহ

জাননাহ : হাজারো স্বপ্ন নিয়ে একজন নবীন শিক্ষার্থী পা রাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, অভিভাবকরা তাকিয়ে থাকেন তাদের সন্তানের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে। প্রথম বর্ষে আপনি কী স্বপ্ন দেখতেন?

জি এস মিজান  : সবারই নিজ নিজ স্বপ্ন থাকে। সকলের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমার স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ণের পাশাপাশি বিভিন্ন রকম কারিকুলামে যুক্ত থাকা, সেই কারিকুলামে যুক্ত থাকার অংশ হিসেবেই আমি হলে ডিবেটিং করেছি, রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার মাধ্যমে আমি আমার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে চলছি।

জাননাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত কোনো ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বলে অনুভূত হয়েছে কী ?

জি এস মিজান  : প্রথম বর্ষ থেকে এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব বেশি দৃশ্যমান পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তা বলা যাবে না ৷ তারপরও আমরা আশা রাখছি, কেননা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি ‘শতবর্ষের মাস্টারপ্ল্যান’ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে যেটির মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ই উঠে আসবে এবং সেগুলো সমাধান করা হবে।  এর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য সম্পূর্ণরূপে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়,  তাদের থাকা -খাওয়ার সুব্যবস্থা, তাদের একাডেমিক বিষয় সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর সমাধান হবে এবং শিক্ষা-মানের প্রকৃত উন্নতি ঘটবে বলে আশা প্রকাশ করছি।

জাননাহ : প্রথম বর্ষে অন্যন্য শিক্ষার্থীদের ন্যায় আপনাকেও গণরুমেই উঠতে হয়েছিল নিশ্চয়ই ?

জি এস মিজান  : হ্যাঁ।

জাননাহ : একসময়ের গণরুমের নবীন শিক্ষার্থী এবং পরবর্তীতে মুহসীন হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে গণরুম ও গেস্টরুম কালচারকে কীভাবে দেখছেন?

জি এস মিজান  : গণরুম এবং গেস্টরুম কালচার নিয়ে যে ধরনের ভীতিজনক কথা আমরা শুনে থাকি, আমি আমার ব্যাক্তিগত উপলব্ধি এবং অভিজ্ঞতা থেকে এতটুকু বলতে পারি সেরকম ভীতিজনক কিছু নয়,  তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তবতায় যদি গণরুম থেকেই যায়,তবে সেই গণরুম ব্যবস্থাপনা আরও কতটা সুন্দর হতে পারে, শিক্ষার্থীবান্ধব হতে পারে এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই যথাযথ ভাবে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে৷ প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা শিক্ষার্থীরা আবাসন সংকটের কারনে গাদাগাদি করে গণরুমে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। সুতরাং এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই ভাবতে হবে, কীভাবে নার্সিং করলে, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা একজন শিক্ষার্থী দেশ ও জাতির কল্যাণে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। এবং তাকে ‘দেশের সম্পদ‘ হিসেবে গড়ে তোলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব । আমরা আশা রাখছি, মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা এ সমস্ত সুবিধার আওতাধীনে চলে আসবে৷

 জি এস মো. মেহেদী হাসান মিজান
                                                                   জি এস মো. মেহেদী হাসান মিজান

জাননাহ : দীর্ঘ ২৮ বছর পর,  ২০১৯ সালের ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছে ডাকসু নির্বাচন। নির্বাচনে আপনি হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে জয়ী হয়েছেন৷ ডাকসু এবং সকল হল সংসদের নবনির্বাচিত সকল নেতৃবৃন্দকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক গণভবনে বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হয়। কেমন ছিল তখনকার অনুভূতি?

জি এস মিজান  : আসলে এটি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা, বাঙালির আশা আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক। তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিতে বাংলাদেশ উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে৷ আমরা ছাত্রসমাজ যেটি করতে পারি, সেটি হচ্ছে আমরা আমাদের লেখাপড়াটা ভালো মতো করে,  একাডেমিক এবং স্কিল ডেভলপিং করে দেশকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখা। কেননা আমরা নিজেদের জায়গায় যদি ভালো কিছু করি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটিও তাঁর অর্জনের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী এবং আমরা অবশ্যই আহবান জানাবো, আমাদের বাজেটের আরও বেশি অংশ যেন শিক্ষা খাতে ব্যায় করা হয়।  কেননা শিক্ষায় বিনিয়োগে আমরা হয়তো তাৎক্ষণিক সুবিধা পাবো না, কিন্তু দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই

জাননাহ : ২৮ বছর পরের প্রথম নির্বাচিত ডাকসু কমিটি কতটা সফল ছিল বলে মনে করেন?

জি এস মিজান  : মুহসীন হল ছাত্র সংসদের জি এস হিসেবে এটি মূল্যায়ন করা আমার জন্য সমীচীন হবে না। হলের শিক্ষার্থীরাই এটি ভালো বলতে পারবে৷ তবে আমি যতটুকু বলতে পারি, হলগুলোতে সুপেয় পানির সুব্যবস্থা ছিল না, আমারা এসে আমাদের হলে ১৮ টি বড় ফিল্টার লাগানো হয়েছে, হলের গেস্টরুমটি জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল সেটি আমরা সংস্কার করেছি,  হলের শিক্ষার্থীদের খেলাধূলার জন্য যে আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র প্রয়োজন : ক্যারম,  টেবিল টেনিস ইত্যাদি শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করেছি৷ রিডিং রুমের উন্নয়ন করেছি, ক্যান্টিন ব্যবস্থার উন্নয়ন করেছি৷ হলের দোকান গুলোর হাইজিন সিস্টেম এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থার উন্নতি করেছি৷ এছাড়া হলের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক বিষয়গুলোর পাশাপাশি ডিবেটিং এবং অন্যন্য সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি৷ এছাড়া আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যে রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা কাটিয়ে উঠে একজন শিক্ষার্থী যেন তার সর্বোচ্চ অধিকারটুকু গ্রহণ করতে পারে সেটি আমারা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করেছি৷

জাননাহ : করোনা মহামারীর কারণে দীর্ঘ ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর খুলল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘ দিন ধরে হল এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকা,  ছাত্র রাজনীতির বিকাশে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়েছে কি না?

জি এস মিজান  : আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত থেকেই রাজনীতি করে। যার কারণে এটি ছাত্র রাজনীতির উপরে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে বলে আমি মনে করি না৷ শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে, তারপর রাজনীতি করে৷ রাজনীতি তাদের সচেতনতার অংশ৷ যে সময়টাতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল তখন শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবারের সাথে সময় কাটিয়েছে,  তাদের ব্যাক্তিগত জীবনে সময় দিয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পর তারা আবার ছন্দে ফিরেছে এবং রাজনৈতিক সচেতনতার অংশ হিসেবে তারা ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হবে বলেই আমি আশা করছি।

জাননাহ : অর্থাৎ হল বা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকা ছাত্র রাজনীতির উপরে তেমন কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলেনি?

জি এস মিজান  : বিরূপ প্রভাব ফেলেনি৷

জাননাহ : শতবর্ষে পদার্পণ করলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষার্থী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কে যেভাবে দেখতে চেয়েছিলেন সে পর্যায়ে পেয়েছেন কী ?

জি এস মিজান  : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের লিডিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৷ সেই হিসেবে রয়েছে অনেক আক্ষেপের গল্প। অর্জনের গল্প এখন অতীত। সমসাময়িক কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসাধারণ কোনো অর্জন আমরা দেখতে পাচ্ছি না। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়কে কীভাবে বিভিন্ন সেমিনার- সিম্পোজিয়াম, গবেষণার মাধ্যমে এগিয়ে নেওয়া যায় সম্মানিত শিক্ষক মহোদয় ও ঢাবি প্রশাসন কে সেটি ভাবতে হবে৷

দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে পরিমাণ গবেষণা হওয়া দরকার সেটি হচ্ছে না। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে গবেষণার পরিমাণ বৃদ্ধি করে শতবর্ষে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হতে পারবো বলে আশা করি৷

জাননাহ : ক্যাম্পাসে আজ ক্ষমতাসীল রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন,বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পূর্ণাঙ্গরূপে ক্রিয়াশীল। কিন্তু নেই তেমন কোনো বিরোধী দলীয় ছাত্র সংগঠনের কর্মসূচি। হলগুলোতে তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই বললেই চলে। সুষ্ঠু ছাত্র রাজনীতির বিকাশের ক্ষেত্রে, বিরোধী দলীয় ছাত্র সংগঠনগুলোর অনুপস্থিতির বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

জি এস মিজান : ছাত্র রাজনীতি ছাত্র নির্ভর হবে এটিই সত্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ, বিভিন্ন বাম ছাত্র সংগঠন যেমন ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট সমস্ত সংগঠনই ক্রিয়াশীল আছে। আর ছাত্র শিবির একটি নিষিদ্ধ সংগঠন হওয়ায়, তাদের রাজনীতি করার সুযোগ নেই। অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের মধ্যে রয়েছে ছাত্রদল। ছাত্রদলের মধ্যে আপনি খেয়াল করে দেখবেন তাদের বেশিরভাগেরই ছাত্রত্ব নেই, সুতরাং যাদের ছাত্রত্ব নেই তাদের হলে অবস্থানই তো প্রশ্নবিদ্ধ। আর তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতার কারনেই তারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না। কেননা অছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের থেকে বিচ্ছিন্ন। এ কারনেই তাদের কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা সেভাবে আমরা দেখতে পারি না। যার কারনে হয়তো মনে হতে পারে আমরা তাদেরকে যথার্থ স্পেস দিচ্ছি না, তাদের রাজনীতি করার সুযোগ নেই । তারা নিয়মিত মধুতে(মধুর ক্যান্টিন) আসে। কিন্তু তাদের সেরকম কর্মী সংখ্যা নেই, কারন যারা আসে তাদের অধিকাংশেরই ছাত্রত্ব নেই। সুতরাং আমরা তাদেরকে আহবান জানাবো, ছাত্র সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে ছাত্র রাজনীতিতে তারা ফিরে আসুক৷ জাতীয় রাজনীতির এক্সটেনশন হিসেবে যেন তারা ব্যবহৃত না হয়

জাননাহ : তবে হলগুলোতে বিরোধী দলীয় ছাত্র সংগঠনের যে অনুপস্থিতি তার পিছনে বরাবরের মতো তারা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগলকেই দায়ী করে আসছে।  এ ব্যাপারে মুহসীন হল সংসদের একজন সিনিয়র নেতা হিসেবে আপনার বক্তব্য কী?

জি এস মিজান : আমি আমার মেয়াদকালের কথা বলতে পারি ;- কোনো শিক্ষার্থী হলে উঠতে চেয়েছে অথচ আমরা অসহযোগিতা করেছি এমন কোনো নজির নেই। বিদ্যমান বাস্তবতায় যে শিক্ষার্থী ই হলে উঠতে চেয়েছে আমরা হল প্রশাসনের সঙ্গে তাদের কথা বলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। সিনিয়র শিক্ষার্থী হলে সে অ্যটাচমেন্টও পেয়ে গিয়েছে এবং হলে থাকার ব্যবস্থাও হয়েছে।

সুতরাং এগুলো হলো গতানুগতিক কিছু প্রশ্ন তুলে তাদের নিজেদের দুর্বলতা লুকানোর অপপ্রচেষ্টা মাত্র

মুহসীন হলে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট সহ সাধারণ শিক্ষার্থীরাও অবস্থান করছে। সুতরাং হলে অবস্থান করার জন্য আগে যেটি প্রয়োজন তা হলো ছাত্র হতে হবে,  ছাত্রত্ব না থাকলে, হলে অবস্থান অবশ্যই অসমীচীন এবং প্রশ্নবিদ্ধ 

জাননাহ : তাহলে আপনি বলছেন তাদের ছাত্রত্ব নেই বিধায়ই তারা হলে থাকতে পারছেন না?

জি এস মিজান : হ্যাঁ,  অধিকাংশেরই ছাত্রত্ব নেই। যারা লিডিং পর্যায়ে রয়েছে, যারা কর্মীদের নার্সিং করবে,  যাদের ভরসায় একজন কর্মী হলে অবস্থান করবে তাদেরই ছাত্রত্ব নেই।

আমি এখন মাস্টার্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী। আমার চেয়েও পাঁচ বছরের সিনিয়ন একজন তো কোনোভাবেই ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। যখন অছাত্ররা ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হবে তখন সেখানে ছাত্ররা আকর্ষিত হবে না৷ কেননা সেখানে ছাত্র সংশ্লিষ্ট বিষয়ের চেয়ে ব্যাক্তি স্বার্থ, অন্যান্য স্বার্থ বা অন্য জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার প্রবণতাই অধিক।

জাননাহ : সম্প্রতি ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল প্রায় সকল ছাত্র সংগঠন, হলের গণরুম বন্ধের ব্যাপারে একমত পোষণ করেছে। ২১ শতকে এসেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে গণরুম বিলুপ্ত করতে না পারা কে বড় ব্যর্থতা হিসেবে দেখেছেন ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব সাদ্দাম হোসেন। হাজী মুহসীন হলে গণরুমের পরিস্থিতি বর্তমানে কী?

জি এস মিজান  : আমাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কতজন শিক্ষার্থী ভর্তি হবে এটি কোনো ছাত্রসংগঠন নির্ধারণ করে দেয় না,  এটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই নির্ধারণ করে৷ কতজন শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে পারবে এ তথ্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট রয়েছে৷ সুতরাং কতজন শিক্ষার্থীকে প্রতি বছর ভর্তি করানো যাবে এটি যেহেতু তারা জানে, দ্যাট মিনস তারা তাদের সীমাবদ্ধতা জানার পরও অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি করাচ্ছে৷ এরই বাস্তবিক প্রতিফলন হচ্ছে আবাসন সংকট৷ সুতরাং এটি কোনো ছাত্রসংগঠনের সৃষ্ট কোনো সংকট নয়,  এটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরই সৃষ্ট৷ এবং আমরা মনে করি বিদ্যমান বাস্তবতায়, গণরুম,  বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরই অযাচিত এবং অসমীচীন পদক্ষেপের প্রতিফলন ।

একজন শিক্ষার্থী গ্রামাঞ্চল থেকে এসে তার মাথা গোজার ঠাঁই খোঁজে৷ এখন যে ছাত্রসংগঠনই তাদেরকে ভালোবেসে টেনে নিয়ে একসঙ্গে হলে থেকে যাওয়ার আহবান জানাবে, তারা সেই ছাত্রসংগঠনকে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চেয়ে আরও ভালো চোখে দেখবে৷ কেননা, তার মাথা গোজার ঠাঁই প্রয়োজন৷ সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে, তারা যতজন শিক্ষার্থীর জন্য পূর্ণাঙ্গ আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করতে পারবে ততজন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করানো৷ বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ভাগাড় নয়, এখানে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে একটা জগাখিচুরি পাকালাম, এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে প্রকৃত শিক্ষা, সেটি আসলে ব্যাহত হচ্ছে৷ শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন রকম বিড়ম্বনায় পড়ছে৷ সুতরাং আমার ব্যাক্তিগত মতামত, গণরুম যেহেতু কোনো ছাত্রসংগঠনের সৃষ্ট ব্যবস্থা নয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই গণরুম তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম ভূমিকা রাখতে হবে। কেননা গণরুম ব্যবস্থা তুলে দিতে গেলে এই শিক্ষার্থীদেরকে আবাসনের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই আগে প্রস্তুত করতে হবে৷

জাননাহ : দেশ ও জাতির কল্যাণে অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অসামান্য অবদান রেখেছে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আজও স্বতন্ত্র মর্যাদায় রেখেছে৷ বলা হয়, একটি দেশ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলে,  কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরে গড়ে উঠেছে স্বাধীন সার্বোভৌম বাংলাদেশ৷ অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সকলের সত্যের জন্য, ন্যায়ের সংগ্রামে যে আত্মোৎসর্গ করার যে মানসিকতা লক্ষ্য করা যেত, আজও সেরকম মানসিকতার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় কী ?

জি এস মিজান  : এটি আসলে গভীর আবেগ অনুভূতির বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক আমাদের সকলের পবিত্র আবেগ-অনুভূতি রয়েছে। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত রয়েছে। আমরা সেটি নিয়ে গর্ববোধ করি৷ একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতায় আন্দোলন-সংগ্রাম কেন্দ্রিক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আমরা আর চাই না। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ  স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছে, আমরা চাই একসময় আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন দেশের মানুষকে পথ দেখিয়েছে, এবার শিক্ষার আন্দোলনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ দেশকে একটি মডেল শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনে আনতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে

জাননাহ : অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জ্বলন্ত মশাল হিসেবে যে ছাত্রলীগ আত্মপ্রকাশ করেছিল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্যায়ের সাথে কোনোরূপ আপোষ না করার ফলে জীবনভর যে জেল-জুলুম সহ্য করেছেন এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন, সেই অন্যায়ের সাথে কোনোভাবেই আপোষ না করার যে দৃপ্ত প্রত্যয়, আজকের ছাত্রলীগের মধ্যে তা আপনি কতটা অনুভব করছেন ?

জি এস মিজান  : বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পরিচালিত হয় আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের উপর ভিত্তি করে । আমরা কিছুদিন আগেও লক্ষ্য করেছি,  আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের বন্ধুদের, তাদের শারদীয় দুর্গোৎসব পালন করতে গিয়ে তারা গুটি কয়েক জায়গায় হামলার শিকার হয়েছে৷ আর দেশে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগই প্রথম গর্জে উঠেছে এবং এর বিরুদ্ধে অবস্থান করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাকে অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আওয়াজ তুলেছে, – এদেশ না হিন্দুর, না মুসলমানের না বৌদ্ধের না খ্রিস্টানের, এদেশ বাঙালির। আমাদের মনে রাখতে হবে, ধর্ম মানে বিশ্বাস। এ বিশ্বাস ভালো থাকার, ভালো রাখার। যারা ভালো থাকতে দিবে না,  যারা ভালো রাখতে চায় না তাদেরই কোনো ধর্ম নেই, তারাই বিধর্মী। আর তারাই ধর্মের নামে অরাজকতা সৃষ্টি করছে এবং আমি মনে করি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশ ছাত্রলীগের এখন পর্যন্ত আদর্শের ধারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে চেতনায় আমাদের দেশ স্বাধীন করেছিলেন, যে চেতনায় আমাদের পরিচালিত করেছেন আমরা সেই চেতনার পথেই রয়েছি এবং সেই পথেই অগ্রসর হচ্ছি যে পথ তিনি দেখিয়েছিলেন।

জাননাহ : ছাত্ররাজনীতির সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল এবং আলোকিত যে সময়টি ছিল তখন, ছাত্রসংগঠনগুলো রাজনৈতিক দল থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে নিজেদের স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত করতো। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, ছাত্র সংগঠনগুলোর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ‘ফ্রন্ট অর্গানাইজেশন’ হিসেবে কাজ করার যে সংস্কৃতি তা পূর্বে ছিল না এবং এটি সামরিক সরকার কর্তৃক সূচিত হয়েছে যা ছাত্র রাজনীতিকে বহুলাংশে ধবংস  করেছে৷ এই যে, ছাত্ররাজনীতি কে দলীয় সম্পৃক্ততা থেকে মুক্ত করে স্বাধীনভাবে পরিচালিত করা- ছাত্রলীগের মধ্যে এধরনের কোনো চেতনা কাজ করে কি না?

জি এস মিজান  : সময়ের সাথে সাথে পরিবেশ পরিস্থিতির ও অনেক পরিবর্তন হয়৷ আমরা ছাত্র রাজনীতির এ বিষয়টি কে এভাবেই দেখছি৷ ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আছে। ছাত্রসংঠন হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ক্রিয়াশীল আছে, অন্যান্য ছাত্রসংগঠন ক্রিয়াশীল আছে। কিন্তু বিগত ১২ বছরে রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কখনও বন্ধ হয়েছে এটি কেউ দেখাতে পারবে না৷ সুতরাং ছাত্র রাজনীতির এখন যে ধারা চলছে তা নিয়ে আমি ততটা নিরাশ নই,  বরং আশাবাদী। গত এক দশকে রাজনৈতিক কারনে বিশ্ববিদ্যালয় একদিনও বন্ধ ছিল না, শিক্ষার্থীদের মাঝে রাজনৈতিক সহিংসতার কোনো ঘটনা নেই । একারনে আমি মনে করি রাজনীতির ধারা যেটিই থাকুক না কেন সেটি যেন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট হয় শিক্ষার্থী বান্ধব হয় এটিই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত

জাননাহ : শেষ প্রশ্ন, একজন নবীন শিক্ষার্থী, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তার রাজনৈতিক মূল্যবোধ এবং ব্যাক্তিত্বের বিকাশের মাধ্যমে ভবিষ্যতে দেশের হাল ধরার স্বপ্ন দেখছে, হাজী মুহসীন হল ছাত্র সংগঠনের সাধারন সম্পাদক হিসেবে তার প্রতি আপনার কী পরামর্শ থাকবে?

জি এস মিজান  : বর্তমানে সমসাময়িক ছাত্র রাজনীতিতে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে৷ তবে, সত্য, সুন্দর এবং ন্যায়ের যে ছাত্র রাজনীতি, সেই কক্ষপথে থেকে একজন শিক্ষার্থী তার রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারবে।তার সামনে সুযোগ থাকবে। এটি রাজনীতির সূচনা মাত্র। জাতীয় রাজনীতি এখনও বেশ দূরে৷ ছাত্র রাজনীতির কর্মী হিসেবে আমরা ট্রাকে আছি। ছাত্র রাজনীতির পাঠ চুকিয়ে আমরা একসময় জাতীয় রাজনীতিতে ফিরবো, আঞ্চলিক রাজনীতিতে ফিরবো, সেই পথটি যদিও কণ্টকাকীর্ণ, পথটি যদিও মসৃণ নয়, কিন্তু রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সে যদি সততার পরিচয় দিতে পারে, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের কর্মীদেরকে যতটুকু ভালোবাসা দেন তাতে আমরা আশাবাদী যে আমরা একসময় জাতীয় রাজনীতিতে ফিরতে পারবো এবং জাতীয় রাজনীতির অংশ হয়ে দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে তার হাতকে শক্তিশালী করতে সক্ষম হবো।

অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিও আমাদের আহবান থাকবে তাদের ছাত্র সংগঠনের কর্মীরাও সঠিক রাজনীতি করার মধ্য দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করুক এবং দেশ গড়ার মহান অবদানে তারাও শামিল হোক।

জাননাহ :  আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য বিডি সমাচারের পক্ষ থেকে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

জি এস মিজান  : আপনাকেও ধন্যবাদ।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


গণরুম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরই অযাচিত এবং অসমীচীন পদক্ষেপের প্রতিফলন

Update Time : ১২:৫২:১০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১ নভেম্বর ২০২১

একটি তাৎপর্যপূর্ণ সময় অতিবাহিত করছে বাঙালি জাতি। এ বছর, বাংলাদেশ যখন পদার্পণ করলো স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে, ঠিক তখনই এ দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ, ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পৌঁছে গিয়েছে তার শততম বর্ষে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী তার সাথে যুক্ত করেছে বাড়তি মাত্রা। তবে এই আনন্দের সময়ের চ্যালেঞ্জও কম নয়। করোনা মহামারীতে একদিকে ভেঙ্গে পড়েছে দুর্বল অর্থ ব্যবস্থা, অন্যদিকে ধর্মের নামে দেখা গেছে কতিপয় নরপিশাচের ঘৃণ্য নিষ্ঠুরতা। শতবর্ষের গৌরবকে ম্লান করতে অন্য সকল বছরের চেয়ে অবনতি দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং -এও ৷ করোনার প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে দীর্ঘ প্রায় ১৮ মাস পর আবারও শুরু হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কার্যক্রম। এই দোদুদ্যমানতার অধীর সময়ে বাংলাদেশের ‘সেকেন্ড পার্লামেন্ট’ হিসেবে পরিচিত ডাকসু এবং হল সংসদের নেতৃবৃন্দের চিন্তা-ভাবনাকে জানতে এবং তা জনসাধারণের কাছে তুলে ধরতে বিডি সমাচার আয়োজন করেছে নিয়মিত সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান, – “কী ভাবছেন তাঁরা? “

এরই ধারাবাহিকতায় বিডি সমাচার সম্প্রতি মুখোমুখি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ছাত্র সংসদের (সাবেক) জি এস মো. মেহেদী হাসান মিজান -এর। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, মুহাম্মদ ইমাম-উল-জাননাহ

জাননাহ : হাজারো স্বপ্ন নিয়ে একজন নবীন শিক্ষার্থী পা রাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, অভিভাবকরা তাকিয়ে থাকেন তাদের সন্তানের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে। প্রথম বর্ষে আপনি কী স্বপ্ন দেখতেন?

জি এস মিজান  : সবারই নিজ নিজ স্বপ্ন থাকে। সকলের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমার স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ণের পাশাপাশি বিভিন্ন রকম কারিকুলামে যুক্ত থাকা, সেই কারিকুলামে যুক্ত থাকার অংশ হিসেবেই আমি হলে ডিবেটিং করেছি, রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার মাধ্যমে আমি আমার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে চলছি।

জাননাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত কোনো ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বলে অনুভূত হয়েছে কী ?

জি এস মিজান  : প্রথম বর্ষ থেকে এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব বেশি দৃশ্যমান পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তা বলা যাবে না ৷ তারপরও আমরা আশা রাখছি, কেননা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি ‘শতবর্ষের মাস্টারপ্ল্যান’ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে যেটির মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ই উঠে আসবে এবং সেগুলো সমাধান করা হবে।  এর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য সম্পূর্ণরূপে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়,  তাদের থাকা -খাওয়ার সুব্যবস্থা, তাদের একাডেমিক বিষয় সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর সমাধান হবে এবং শিক্ষা-মানের প্রকৃত উন্নতি ঘটবে বলে আশা প্রকাশ করছি।

জাননাহ : প্রথম বর্ষে অন্যন্য শিক্ষার্থীদের ন্যায় আপনাকেও গণরুমেই উঠতে হয়েছিল নিশ্চয়ই ?

জি এস মিজান  : হ্যাঁ।

জাননাহ : একসময়ের গণরুমের নবীন শিক্ষার্থী এবং পরবর্তীতে মুহসীন হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে গণরুম ও গেস্টরুম কালচারকে কীভাবে দেখছেন?

জি এস মিজান  : গণরুম এবং গেস্টরুম কালচার নিয়ে যে ধরনের ভীতিজনক কথা আমরা শুনে থাকি, আমি আমার ব্যাক্তিগত উপলব্ধি এবং অভিজ্ঞতা থেকে এতটুকু বলতে পারি সেরকম ভীতিজনক কিছু নয়,  তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তবতায় যদি গণরুম থেকেই যায়,তবে সেই গণরুম ব্যবস্থাপনা আরও কতটা সুন্দর হতে পারে, শিক্ষার্থীবান্ধব হতে পারে এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই যথাযথ ভাবে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে৷ প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা শিক্ষার্থীরা আবাসন সংকটের কারনে গাদাগাদি করে গণরুমে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। সুতরাং এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই ভাবতে হবে, কীভাবে নার্সিং করলে, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা একজন শিক্ষার্থী দেশ ও জাতির কল্যাণে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। এবং তাকে ‘দেশের সম্পদ‘ হিসেবে গড়ে তোলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব । আমরা আশা রাখছি, মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা এ সমস্ত সুবিধার আওতাধীনে চলে আসবে৷

 জি এস মো. মেহেদী হাসান মিজান
                                                                   জি এস মো. মেহেদী হাসান মিজান

জাননাহ : দীর্ঘ ২৮ বছর পর,  ২০১৯ সালের ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছে ডাকসু নির্বাচন। নির্বাচনে আপনি হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে জয়ী হয়েছেন৷ ডাকসু এবং সকল হল সংসদের নবনির্বাচিত সকল নেতৃবৃন্দকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক গণভবনে বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হয়। কেমন ছিল তখনকার অনুভূতি?

জি এস মিজান  : আসলে এটি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা, বাঙালির আশা আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক। তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিতে বাংলাদেশ উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে৷ আমরা ছাত্রসমাজ যেটি করতে পারি, সেটি হচ্ছে আমরা আমাদের লেখাপড়াটা ভালো মতো করে,  একাডেমিক এবং স্কিল ডেভলপিং করে দেশকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখা। কেননা আমরা নিজেদের জায়গায় যদি ভালো কিছু করি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটিও তাঁর অর্জনের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী এবং আমরা অবশ্যই আহবান জানাবো, আমাদের বাজেটের আরও বেশি অংশ যেন শিক্ষা খাতে ব্যায় করা হয়।  কেননা শিক্ষায় বিনিয়োগে আমরা হয়তো তাৎক্ষণিক সুবিধা পাবো না, কিন্তু দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই

জাননাহ : ২৮ বছর পরের প্রথম নির্বাচিত ডাকসু কমিটি কতটা সফল ছিল বলে মনে করেন?

জি এস মিজান  : মুহসীন হল ছাত্র সংসদের জি এস হিসেবে এটি মূল্যায়ন করা আমার জন্য সমীচীন হবে না। হলের শিক্ষার্থীরাই এটি ভালো বলতে পারবে৷ তবে আমি যতটুকু বলতে পারি, হলগুলোতে সুপেয় পানির সুব্যবস্থা ছিল না, আমারা এসে আমাদের হলে ১৮ টি বড় ফিল্টার লাগানো হয়েছে, হলের গেস্টরুমটি জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল সেটি আমরা সংস্কার করেছি,  হলের শিক্ষার্থীদের খেলাধূলার জন্য যে আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র প্রয়োজন : ক্যারম,  টেবিল টেনিস ইত্যাদি শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করেছি৷ রিডিং রুমের উন্নয়ন করেছি, ক্যান্টিন ব্যবস্থার উন্নয়ন করেছি৷ হলের দোকান গুলোর হাইজিন সিস্টেম এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থার উন্নতি করেছি৷ এছাড়া হলের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক বিষয়গুলোর পাশাপাশি ডিবেটিং এবং অন্যন্য সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি৷ এছাড়া আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যে রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা কাটিয়ে উঠে একজন শিক্ষার্থী যেন তার সর্বোচ্চ অধিকারটুকু গ্রহণ করতে পারে সেটি আমারা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করেছি৷

জাননাহ : করোনা মহামারীর কারণে দীর্ঘ ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর খুলল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘ দিন ধরে হল এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকা,  ছাত্র রাজনীতির বিকাশে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়েছে কি না?

জি এস মিজান  : আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত থেকেই রাজনীতি করে। যার কারণে এটি ছাত্র রাজনীতির উপরে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে বলে আমি মনে করি না৷ শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে, তারপর রাজনীতি করে৷ রাজনীতি তাদের সচেতনতার অংশ৷ যে সময়টাতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল তখন শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবারের সাথে সময় কাটিয়েছে,  তাদের ব্যাক্তিগত জীবনে সময় দিয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পর তারা আবার ছন্দে ফিরেছে এবং রাজনৈতিক সচেতনতার অংশ হিসেবে তারা ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হবে বলেই আমি আশা করছি।

জাননাহ : অর্থাৎ হল বা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকা ছাত্র রাজনীতির উপরে তেমন কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলেনি?

জি এস মিজান  : বিরূপ প্রভাব ফেলেনি৷

জাননাহ : শতবর্ষে পদার্পণ করলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষার্থী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কে যেভাবে দেখতে চেয়েছিলেন সে পর্যায়ে পেয়েছেন কী ?

জি এস মিজান  : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের লিডিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৷ সেই হিসেবে রয়েছে অনেক আক্ষেপের গল্প। অর্জনের গল্প এখন অতীত। সমসাময়িক কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসাধারণ কোনো অর্জন আমরা দেখতে পাচ্ছি না। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়কে কীভাবে বিভিন্ন সেমিনার- সিম্পোজিয়াম, গবেষণার মাধ্যমে এগিয়ে নেওয়া যায় সম্মানিত শিক্ষক মহোদয় ও ঢাবি প্রশাসন কে সেটি ভাবতে হবে৷

দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে পরিমাণ গবেষণা হওয়া দরকার সেটি হচ্ছে না। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে গবেষণার পরিমাণ বৃদ্ধি করে শতবর্ষে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হতে পারবো বলে আশা করি৷

জাননাহ : ক্যাম্পাসে আজ ক্ষমতাসীল রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন,বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পূর্ণাঙ্গরূপে ক্রিয়াশীল। কিন্তু নেই তেমন কোনো বিরোধী দলীয় ছাত্র সংগঠনের কর্মসূচি। হলগুলোতে তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই বললেই চলে। সুষ্ঠু ছাত্র রাজনীতির বিকাশের ক্ষেত্রে, বিরোধী দলীয় ছাত্র সংগঠনগুলোর অনুপস্থিতির বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

জি এস মিজান : ছাত্র রাজনীতি ছাত্র নির্ভর হবে এটিই সত্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ, বিভিন্ন বাম ছাত্র সংগঠন যেমন ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট সমস্ত সংগঠনই ক্রিয়াশীল আছে। আর ছাত্র শিবির একটি নিষিদ্ধ সংগঠন হওয়ায়, তাদের রাজনীতি করার সুযোগ নেই। অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের মধ্যে রয়েছে ছাত্রদল। ছাত্রদলের মধ্যে আপনি খেয়াল করে দেখবেন তাদের বেশিরভাগেরই ছাত্রত্ব নেই, সুতরাং যাদের ছাত্রত্ব নেই তাদের হলে অবস্থানই তো প্রশ্নবিদ্ধ। আর তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতার কারনেই তারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না। কেননা অছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের থেকে বিচ্ছিন্ন। এ কারনেই তাদের কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা সেভাবে আমরা দেখতে পারি না। যার কারনে হয়তো মনে হতে পারে আমরা তাদেরকে যথার্থ স্পেস দিচ্ছি না, তাদের রাজনীতি করার সুযোগ নেই । তারা নিয়মিত মধুতে(মধুর ক্যান্টিন) আসে। কিন্তু তাদের সেরকম কর্মী সংখ্যা নেই, কারন যারা আসে তাদের অধিকাংশেরই ছাত্রত্ব নেই। সুতরাং আমরা তাদেরকে আহবান জানাবো, ছাত্র সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে ছাত্র রাজনীতিতে তারা ফিরে আসুক৷ জাতীয় রাজনীতির এক্সটেনশন হিসেবে যেন তারা ব্যবহৃত না হয়

জাননাহ : তবে হলগুলোতে বিরোধী দলীয় ছাত্র সংগঠনের যে অনুপস্থিতি তার পিছনে বরাবরের মতো তারা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগলকেই দায়ী করে আসছে।  এ ব্যাপারে মুহসীন হল সংসদের একজন সিনিয়র নেতা হিসেবে আপনার বক্তব্য কী?

জি এস মিজান : আমি আমার মেয়াদকালের কথা বলতে পারি ;- কোনো শিক্ষার্থী হলে উঠতে চেয়েছে অথচ আমরা অসহযোগিতা করেছি এমন কোনো নজির নেই। বিদ্যমান বাস্তবতায় যে শিক্ষার্থী ই হলে উঠতে চেয়েছে আমরা হল প্রশাসনের সঙ্গে তাদের কথা বলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। সিনিয়র শিক্ষার্থী হলে সে অ্যটাচমেন্টও পেয়ে গিয়েছে এবং হলে থাকার ব্যবস্থাও হয়েছে।

সুতরাং এগুলো হলো গতানুগতিক কিছু প্রশ্ন তুলে তাদের নিজেদের দুর্বলতা লুকানোর অপপ্রচেষ্টা মাত্র

মুহসীন হলে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট সহ সাধারণ শিক্ষার্থীরাও অবস্থান করছে। সুতরাং হলে অবস্থান করার জন্য আগে যেটি প্রয়োজন তা হলো ছাত্র হতে হবে,  ছাত্রত্ব না থাকলে, হলে অবস্থান অবশ্যই অসমীচীন এবং প্রশ্নবিদ্ধ 

জাননাহ : তাহলে আপনি বলছেন তাদের ছাত্রত্ব নেই বিধায়ই তারা হলে থাকতে পারছেন না?

জি এস মিজান : হ্যাঁ,  অধিকাংশেরই ছাত্রত্ব নেই। যারা লিডিং পর্যায়ে রয়েছে, যারা কর্মীদের নার্সিং করবে,  যাদের ভরসায় একজন কর্মী হলে অবস্থান করবে তাদেরই ছাত্রত্ব নেই।

আমি এখন মাস্টার্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী। আমার চেয়েও পাঁচ বছরের সিনিয়ন একজন তো কোনোভাবেই ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। যখন অছাত্ররা ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হবে তখন সেখানে ছাত্ররা আকর্ষিত হবে না৷ কেননা সেখানে ছাত্র সংশ্লিষ্ট বিষয়ের চেয়ে ব্যাক্তি স্বার্থ, অন্যান্য স্বার্থ বা অন্য জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার প্রবণতাই অধিক।

জাননাহ : সম্প্রতি ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল প্রায় সকল ছাত্র সংগঠন, হলের গণরুম বন্ধের ব্যাপারে একমত পোষণ করেছে। ২১ শতকে এসেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে গণরুম বিলুপ্ত করতে না পারা কে বড় ব্যর্থতা হিসেবে দেখেছেন ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব সাদ্দাম হোসেন। হাজী মুহসীন হলে গণরুমের পরিস্থিতি বর্তমানে কী?

জি এস মিজান  : আমাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কতজন শিক্ষার্থী ভর্তি হবে এটি কোনো ছাত্রসংগঠন নির্ধারণ করে দেয় না,  এটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই নির্ধারণ করে৷ কতজন শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে পারবে এ তথ্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট রয়েছে৷ সুতরাং কতজন শিক্ষার্থীকে প্রতি বছর ভর্তি করানো যাবে এটি যেহেতু তারা জানে, দ্যাট মিনস তারা তাদের সীমাবদ্ধতা জানার পরও অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি করাচ্ছে৷ এরই বাস্তবিক প্রতিফলন হচ্ছে আবাসন সংকট৷ সুতরাং এটি কোনো ছাত্রসংগঠনের সৃষ্ট কোনো সংকট নয়,  এটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরই সৃষ্ট৷ এবং আমরা মনে করি বিদ্যমান বাস্তবতায়, গণরুম,  বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরই অযাচিত এবং অসমীচীন পদক্ষেপের প্রতিফলন ।

একজন শিক্ষার্থী গ্রামাঞ্চল থেকে এসে তার মাথা গোজার ঠাঁই খোঁজে৷ এখন যে ছাত্রসংগঠনই তাদেরকে ভালোবেসে টেনে নিয়ে একসঙ্গে হলে থেকে যাওয়ার আহবান জানাবে, তারা সেই ছাত্রসংগঠনকে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চেয়ে আরও ভালো চোখে দেখবে৷ কেননা, তার মাথা গোজার ঠাঁই প্রয়োজন৷ সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে, তারা যতজন শিক্ষার্থীর জন্য পূর্ণাঙ্গ আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করতে পারবে ততজন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করানো৷ বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ভাগাড় নয়, এখানে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে একটা জগাখিচুরি পাকালাম, এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে প্রকৃত শিক্ষা, সেটি আসলে ব্যাহত হচ্ছে৷ শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন রকম বিড়ম্বনায় পড়ছে৷ সুতরাং আমার ব্যাক্তিগত মতামত, গণরুম যেহেতু কোনো ছাত্রসংগঠনের সৃষ্ট ব্যবস্থা নয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই গণরুম তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম ভূমিকা রাখতে হবে। কেননা গণরুম ব্যবস্থা তুলে দিতে গেলে এই শিক্ষার্থীদেরকে আবাসনের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেই আগে প্রস্তুত করতে হবে৷

জাননাহ : দেশ ও জাতির কল্যাণে অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অসামান্য অবদান রেখেছে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আজও স্বতন্ত্র মর্যাদায় রেখেছে৷ বলা হয়, একটি দেশ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলে,  কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরে গড়ে উঠেছে স্বাধীন সার্বোভৌম বাংলাদেশ৷ অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সকলের সত্যের জন্য, ন্যায়ের সংগ্রামে যে আত্মোৎসর্গ করার যে মানসিকতা লক্ষ্য করা যেত, আজও সেরকম মানসিকতার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় কী ?

জি এস মিজান  : এটি আসলে গভীর আবেগ অনুভূতির বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক আমাদের সকলের পবিত্র আবেগ-অনুভূতি রয়েছে। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত রয়েছে। আমরা সেটি নিয়ে গর্ববোধ করি৷ একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতায় আন্দোলন-সংগ্রাম কেন্দ্রিক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আমরা আর চাই না। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ  স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছে, আমরা চাই একসময় আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন দেশের মানুষকে পথ দেখিয়েছে, এবার শিক্ষার আন্দোলনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ দেশকে একটি মডেল শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনে আনতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে

জাননাহ : অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জ্বলন্ত মশাল হিসেবে যে ছাত্রলীগ আত্মপ্রকাশ করেছিল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্যায়ের সাথে কোনোরূপ আপোষ না করার ফলে জীবনভর যে জেল-জুলুম সহ্য করেছেন এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন, সেই অন্যায়ের সাথে কোনোভাবেই আপোষ না করার যে দৃপ্ত প্রত্যয়, আজকের ছাত্রলীগের মধ্যে তা আপনি কতটা অনুভব করছেন ?

জি এস মিজান  : বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পরিচালিত হয় আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের উপর ভিত্তি করে । আমরা কিছুদিন আগেও লক্ষ্য করেছি,  আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের বন্ধুদের, তাদের শারদীয় দুর্গোৎসব পালন করতে গিয়ে তারা গুটি কয়েক জায়গায় হামলার শিকার হয়েছে৷ আর দেশে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগই প্রথম গর্জে উঠেছে এবং এর বিরুদ্ধে অবস্থান করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাকে অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আওয়াজ তুলেছে, – এদেশ না হিন্দুর, না মুসলমানের না বৌদ্ধের না খ্রিস্টানের, এদেশ বাঙালির। আমাদের মনে রাখতে হবে, ধর্ম মানে বিশ্বাস। এ বিশ্বাস ভালো থাকার, ভালো রাখার। যারা ভালো থাকতে দিবে না,  যারা ভালো রাখতে চায় না তাদেরই কোনো ধর্ম নেই, তারাই বিধর্মী। আর তারাই ধর্মের নামে অরাজকতা সৃষ্টি করছে এবং আমি মনে করি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশ ছাত্রলীগের এখন পর্যন্ত আদর্শের ধারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে চেতনায় আমাদের দেশ স্বাধীন করেছিলেন, যে চেতনায় আমাদের পরিচালিত করেছেন আমরা সেই চেতনার পথেই রয়েছি এবং সেই পথেই অগ্রসর হচ্ছি যে পথ তিনি দেখিয়েছিলেন।

জাননাহ : ছাত্ররাজনীতির সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল এবং আলোকিত যে সময়টি ছিল তখন, ছাত্রসংগঠনগুলো রাজনৈতিক দল থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে নিজেদের স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত করতো। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, ছাত্র সংগঠনগুলোর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ‘ফ্রন্ট অর্গানাইজেশন’ হিসেবে কাজ করার যে সংস্কৃতি তা পূর্বে ছিল না এবং এটি সামরিক সরকার কর্তৃক সূচিত হয়েছে যা ছাত্র রাজনীতিকে বহুলাংশে ধবংস  করেছে৷ এই যে, ছাত্ররাজনীতি কে দলীয় সম্পৃক্ততা থেকে মুক্ত করে স্বাধীনভাবে পরিচালিত করা- ছাত্রলীগের মধ্যে এধরনের কোনো চেতনা কাজ করে কি না?

জি এস মিজান  : সময়ের সাথে সাথে পরিবেশ পরিস্থিতির ও অনেক পরিবর্তন হয়৷ আমরা ছাত্র রাজনীতির এ বিষয়টি কে এভাবেই দেখছি৷ ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আছে। ছাত্রসংঠন হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ক্রিয়াশীল আছে, অন্যান্য ছাত্রসংগঠন ক্রিয়াশীল আছে। কিন্তু বিগত ১২ বছরে রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কখনও বন্ধ হয়েছে এটি কেউ দেখাতে পারবে না৷ সুতরাং ছাত্র রাজনীতির এখন যে ধারা চলছে তা নিয়ে আমি ততটা নিরাশ নই,  বরং আশাবাদী। গত এক দশকে রাজনৈতিক কারনে বিশ্ববিদ্যালয় একদিনও বন্ধ ছিল না, শিক্ষার্থীদের মাঝে রাজনৈতিক সহিংসতার কোনো ঘটনা নেই । একারনে আমি মনে করি রাজনীতির ধারা যেটিই থাকুক না কেন সেটি যেন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট হয় শিক্ষার্থী বান্ধব হয় এটিই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত

জাননাহ : শেষ প্রশ্ন, একজন নবীন শিক্ষার্থী, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তার রাজনৈতিক মূল্যবোধ এবং ব্যাক্তিত্বের বিকাশের মাধ্যমে ভবিষ্যতে দেশের হাল ধরার স্বপ্ন দেখছে, হাজী মুহসীন হল ছাত্র সংগঠনের সাধারন সম্পাদক হিসেবে তার প্রতি আপনার কী পরামর্শ থাকবে?

জি এস মিজান  : বর্তমানে সমসাময়িক ছাত্র রাজনীতিতে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে৷ তবে, সত্য, সুন্দর এবং ন্যায়ের যে ছাত্র রাজনীতি, সেই কক্ষপথে থেকে একজন শিক্ষার্থী তার রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারবে।তার সামনে সুযোগ থাকবে। এটি রাজনীতির সূচনা মাত্র। জাতীয় রাজনীতি এখনও বেশ দূরে৷ ছাত্র রাজনীতির কর্মী হিসেবে আমরা ট্রাকে আছি। ছাত্র রাজনীতির পাঠ চুকিয়ে আমরা একসময় জাতীয় রাজনীতিতে ফিরবো, আঞ্চলিক রাজনীতিতে ফিরবো, সেই পথটি যদিও কণ্টকাকীর্ণ, পথটি যদিও মসৃণ নয়, কিন্তু রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সে যদি সততার পরিচয় দিতে পারে, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের কর্মীদেরকে যতটুকু ভালোবাসা দেন তাতে আমরা আশাবাদী যে আমরা একসময় জাতীয় রাজনীতিতে ফিরতে পারবো এবং জাতীয় রাজনীতির অংশ হয়ে দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে তার হাতকে শক্তিশালী করতে সক্ষম হবো।

অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিও আমাদের আহবান থাকবে তাদের ছাত্র সংগঠনের কর্মীরাও সঠিক রাজনীতি করার মধ্য দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করুক এবং দেশ গড়ার মহান অবদানে তারাও শামিল হোক।

জাননাহ :  আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য বিডি সমাচারের পক্ষ থেকে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

জি এস মিজান  : আপনাকেও ধন্যবাদ।