শতবর্ষে শক্তিশালী চীনা কমিউনিস্ট পার্টি
- Update Time : ০২:৫৬:৪০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ জুন ২০২১
- / 217
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আগামী ১ জুলাই। দলটি সবসময় নিজেদের ‘মহৎ, গৌরবময় এবং সঠিক’ বলে দাবি করে। জন্মের দ্বিতীয় শতকে পা দেয়ার মুহূর্তেও তারা যে প্রভাব-প্রতিপত্তি ধরে রেখেছে, তাতে চীনা কমিউনিস্টদের এই দম্ভকে খুব একটা অনাহূত বলে মনে হবে না। সমালোচকদের মুখে ছাই দিয়ে দলটি শুধু দীর্ঘ সময় টিকে রয়েছে তা নয়, বরং এর শক্তি দিন দিন বেড়ে চলেছে।
১৯৯১ সালে কমিউনিস্ট পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়, তখন অনেক পণ্ডিতই বলেছিলেন, এরপর চীনাদের অবস্থা ওরকম হবে। তবে তারা যে কতটা ভুল ছিলেন, তার প্রমাণ বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মন্তব্য। চীন যুক্তরাষ্ট্রের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী এটা শুধু স্বীকার করাই নয়, চীনা কমিউনিস্টদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় গণতন্ত্র টিকবে কি না তা নিয়েও সম্প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তিনি।
ভোটারদের সম্মতি না নিয়ে টানা ৭২ বছর চীন শাসন করছে কমিউনিস্ট পার্টি। তবে এটি দীর্ঘ একদলীয় শাসনের একমাত্র উদাহরণ নয়। লেনিন ও তার উত্তরসূরীরা মস্কোর ক্ষমতা এর চেয়েও বেশিদিন ধরে রেখেছিলেন। একই কাহিনী উত্তর কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টিরও। তবে আর কোনো স্বৈরতন্ত্র দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশকে পুরোপুরি বদলে দিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি করে তুলতে পারেননি, যেমন করেছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। এদিক থেকে তারাই বিশ্বের সবচেয়ে সফল স্বৈরশাসক বলা যায়।
চীনা কমিউনিস্টদের এই সাফল্যের পেছনে তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, তারা নির্দয়। ১৯৮৯ সালে তিয়ানানমেন স্কয়ারে বিক্ষোভকারীদের ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেয়ার আগে এই দলটিও কেঁপে উঠেছিল। তবে ঘটনাক্রমে কমিউনিস্ট শাসকরা জনতার প্রতিবাদের জবাব গুলি ছুড়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে।
ওই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে চীনা নেতাদের এখনো অনুতপ্ত বোধ করার লক্ষণ নেই। বরং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের দাবি, মস্কোর নেতাদের যথেষ্ট সাহস না থাকার কারণেই সোভিয়েত ভেঙে পড়েছিল। যাকে অন্যভাবে বললে দাঁড়ায়: নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর আমাদের মতো মেশিনগান দিয়ে গুলি ছোড়ার সাহস ছিল না তাদের।
দ্বিতীয় কারণ, দলীয় নেতাদের আদর্শগত ক্ষীপ্রতা। ১৯৭৬ সালে মাওয়ের মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যেই ডেং জিয়াওপিং প্রয়াত চেয়ারম্যানের ‘জনসংযোগ’ নীতি বিলুপ্ত করেন। তিয়ানানমেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পরিপ্রেক্ষিতে ডেং কট্টর মাওবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন এবং পুঁজিবাদের পক্ষ নেন। এতে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় এবং বেসরকারিকরণ বেড়ে যায়। লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারালেও চীনের অর্থনীতি টগবগিয়ে ওঠে।
শি জিনপিংয়ের আমলে কমিউনিস্টদের আরও একবার আদর্শগত পরিবর্তন আসে। তার উত্তরসূরীরা বিরোধীমতের প্রতি কিছুটা নমনীয় থাকলেও এক্ষেত্রে রীতিমতো চড়াও হন নতুন প্রেসিডেন্ট। ফের মাওবাদী সুর জোরালো হয়ে ওঠে। তৃণমূল পর্যায়ে দল পুনগর্ঠিত করেন জিনপিং। ব্যবসা-বাণিজ্যও লাইনে চলে আসে। চীনা সমাজব্যবস্থায় এমন কড়াকড়ি আগে খুব একটা দেখা যায়নি।
কমিউনিস্ট পার্টি টিকে থাকার তৃতীয় কারণ, চীন সরাসরি ক্লেপ্টোক্রেসির দিকে যায়নি। এ প্রক্রিয়ায় ধনকুবেররা রাজনীতির ছত্রছায়ায় অর্থসম্পদ শুষে নেয়। চীনে দুর্নীতি বেড়েছে ঠিকই, ক্ষমতাধর পরিবারগুলো আরও ধনী হয়েছে, তবে বাকি লোকেরা মনে করেন, তাদেরও জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে। জনসাধারণের চাহিদা মেটাতে কমিউনিস্ট পার্টি যোগ্য কৌশল নিয়েছে বলেই বিশ্বাস করেন তারা।
তাছাড়া অনেকেই কমিউনিস্টদের শক্ত পদক্ষেপেরও পক্ষে। তাদের মতে, পশ্চিমা বিশ্ব যেখানে এখনো হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে চীন কত দ্রুত করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলেছে। এর মাধ্যমে চীনের গৌরব আরও বেড়েছে বলে বিশ্বাস জন্মেছে তাদের মনে।
অন্যদিকে, চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে দাঙ্গা এবং বন্দুকহামলার দেশ হিসেবে দেখানো হয়। সারাক্ষণ বোঝানো হয়, একদলীয় শাসনের বিকল্প মানেই অরাজকতা। এর বিরোধীমত খুব বেশি ছড়ানোর আগেই উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে দ্রুততম সময়ে তা দমন করছেন শি জিনপিং। চীনের রাস্তাঘাট ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যারযুক্ত সিসি ক্যামেরায় ভরা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রয়েছে কড়া নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি। কেউ ভিন্নমত প্রচার করলেই চাকরি-স্বাধীনতা উভয় হারানোর শঙ্কা রয়েছে। অর্থাৎ, বর্বরোচিত দমন-পীড়নের ওপর টিকে রয়েছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির এই গৌরবজ্জ্বল সাফল্য।
কোনো দলই চিরস্থায়ী নয়
বলা হয়, জিনপিংয়ের সবচেয়ে বড় হুমকি জনতার মধ্যে নয়, লুকিয়ে রয়েছে তার নিজ দলের মধ্যেই। তার সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কমিউনিস্টদের মধ্যে দলবাজি, অসততা এবং আদর্শিক জড়তা তৈরি হয়েছে। গত কয়েক দশকের মধ্যে এখনই সবচেয়ে বেশি অন্ধকারাচ্ছন্নতায় ভুগছে চীনা রাজনীতি। জিনপিংয়ের অন্তহীন প্রচেষ্টাগুলো বোঝাচ্ছে, তার আরও অনেক গোপন শত্রু রয়েছে।
এমন অস্থির পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত উত্তরসূরী নিয়ে অনিশ্চয়তা। শি জিনপিংয়ের পরে কে বা কোন ধরনের সরকার ক্ষমতায় আসবে তা কেউ জানে না। ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট পদে মেয়াদের সীমা তুলে দিয়ে জিনপিং পরিষ্কার ইঙ্গিত দিয়েছেন, তিনি অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় থাকতে চান। এটি ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে। যদিও কমিউনিস্টদের এই সংকট হয়তো গণতন্ত্রপ্রেমীদের ক্ষমতাগ্রহণের স্বপ্ন অতিসত্ত্বর পূরণ করবে না, তবে কোনো একটি পর্যায়ে এই শাসকগোষ্ঠীর ঠিকই পতন হবে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট