মূল ধারার রাজনৈতিক দলের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করা দাসত্ব গ্রহণ করার সমান
- Update Time : ১২:৫৭:৪৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ নভেম্বর ২০২১
- / 373
একটি তাৎপর্যপূর্ণ সময় অতিবাহিত করছে বাঙালি জাতি। এ বছর, বাংলাদেশ যখন পদার্পণ করলো স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে, ঠিক তখনই এ দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ, ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পৌঁছে গিয়েছে তার শততম বর্ষে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী তার সাথে যুক্ত করেছে বাড়তি মাত্রা। তবে এই আনন্দের সময়ের চ্যালেঞ্জও কম নয়। করোনা মহামারীতে একদিকে ভেঙ্গে পড়েছে দুর্বল অর্থ ব্যবস্থা, অন্যদিকে ধর্মের নামে দেখা গেছে কতিপয় নরপিশাচের ঘৃণ্য নিষ্ঠুরতা। শতবর্ষের গৌরবকে ম্লান করতে অন্য সকল বছরের চেয়ে অবনতি দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং -এও ৷
করোনার প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে দীর্ঘ প্রায় ১৮ মাস পর আবারও শুরু হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কার্যক্রম। এই দোদুদ্যমানতার অধীর সময়ে বাংলাদেশের ‘সেকেন্ড পার্লামেন্ট’ হিসেবে পরিচিত ডাকসু এবং হল সংসদের নেতৃবৃন্দের চিন্তা-ভাবনাকে জানতে এবং তা জনসাধারণের কাছে তুলে ধরতে বিডি সমাচার আয়োজন করেছে নিয়মিত সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান, – “কী ভাবছেন তাঁরা ?” ।
এ পর্বে অতিথি হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হল ছাত্র সংসদের (সাবেক) সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার । সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, মুহাম্মদ ইমাম-উল-জাননাহ ।
সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় অংশ :
জাননাহ : দীর্ঘ ২৮ বছর পর, ২০১৯ সালের ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছে ডাকসু নির্বাচন। যে ডাকসু কমিটি বিজয়ী হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল রাজনৈতিক দল-মতের উর্ধ্বে উঠে সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সাধারণ শিক্ষার্থীর একটি ভালোবাসার কমিটি হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছে বলে আপনার মনে হয় কী ?
মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : আসলে ডাকসু কিংবা হল সংসদের যে ভূমিকা শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজন ছিল,সেটি করতে আমরা অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছি৷ এবং এই ব্যর্থতা কে আমরা কিন্তু বিশ্লেষণ করেছি, বিশেষ করে আমি বিশ্লেষণ করেছি যে ; – এটার পিছনে কারণ কী ?
দুইটা কারণ যদি আপনি ধরেন, তাহলে প্রথম হলো যে, আমাদের লেসন না থাকা, আমি জানি না যে ছাত্রনেতা হিসেবে – ছাত্রলীগের হোক বা যারা অন্যান্য দল থেকে এসেছিলেন তারা হোক, সবার ক্ষেত্রেই এই কথাটা প্রযোজ্য ; নির্বাচিত ছাত্রনেতার ভূমিকা কী, আমাকে কীভাবে কাজ করতে হবে,সে বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট অজ্ঞতা ছিল এবং সেক্ষেত্রে আমরা আমাদের পূর্বতন যে নেতৃবৃন্দ ছিলেন,তাঁদের সাথে যোগাযোগ করে হয়তো আমরা সমস্যাটার সমাধান করতে পারতাম, কিন্তু কোনো এক কারণে এটা করা হয় নি – এক।
আর দ্বিতীয় যে সমস্যাটা হয়েছে,সেটা হচ্ছে আমাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যারা অনেক উচ্চাভিলাষী ছাত্রনেতা, যারা আসলে একটি পদ অর্জন করার পরে আরও উচ্চ কোনো পদ অর্জনের জন্য তারা হয়তো বা একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন৷ তারা যে পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই পদকে আবর্তন করে তার যে দায়-দায়িত্ব সেটি পালনে তারা খুব বেশি মনোযোগ দেন নাই।
জাননাহ : সম্প্রতি দি ডেইলি স্টার কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, ছাত্র সংগঠনগুলোর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ‘ফ্রন্ট অর্গানাইজেশন’ হিসেবে কাজ করার যে সংস্কৃতি, তা পূর্বে ছিল না এবং এটি সামরিক সরকার কর্তৃক সূচিত হয়েছে যা ছাত্র রাজনীতিকে বহুলাংশে ধবংস করেছে৷ আপনার কাছে কী মনে হয় ? দলীয় সম্পৃক্ততায় আসার ফলে কী ছাত্র রাজনীতি নষ্ট হয়েছে না কি অন্য কোনো কারণ আছে?
মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : না, বক্তব্যের যে তথ্য সেটি শতভাগ ঠিক। তথ্যের দিক থেকে উনি সঠিক তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু এই সত্য তথ্যের সাথে আরও কিছু সত্য আছে। সেটা হচ্ছে, ছাত্র রাজনীতি যদি আপনি মুক্ত রাখতে চান, তাহলে ছাত্র নেতারা কার কাছে জবাবদিহি করবে? মানে, ছাত্র রাজনীতিতে আপনার তো অভিভাবক প্রয়োজন।
এখন আমিও বিশ্বাস করি, মূল ধারার রাজনৈতিক দলের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করা দাসত্ব গ্রহণ করার সমান। একটি ছাত্র সংগঠন যখন একটি মূল ধারার রাজনৈতিক দলের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করছে একই সাথে সে দাসত্বও গ্রহণ করছে, সে ছাত্র নেতা হিসেবে ভূমিকা পালন করার থেকে মূল দলের লাঠিয়াল হিসেবে ভূমিকা পালনে বেশি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ছে৷ কিন্তু সে কখন সুষ্ঠু ধারায় থাকবে? আপনি যদি তাকে মুক্ত রাখেন, মুক্ত রাখলে তো ভয় টা আরও বেশি, যে, সে কোনো হঠকারী কাজ করবে কি না, তার দ্বারা কোনো রকমের অপরাধ সংগঠিত হবে কি না ; তো, সেটি তদন্ত করার জন্য হলেও বা পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখতে হলেও আপনার একটি অভিভাবক দরকার আছে৷ আমি সেটার কথাই বলছি। তাহলে মূল দলের অভিভাবক কে? মূল দলের অভিভাবক হচ্ছে গণতন্ত্র। আমাদের দেশে একটি দল চাইলেই যে একটি হঠকারী কাজ করে না বা করতে পারে না, কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাকে কিন্তু জবাবদিহি করতে হয় মানুষের কাছে, অর্থাৎ তিনি আত্মরক্ষার জন্যই যা ইচ্ছে তাই করেন না। তো, ছাত্র রাজনীতিতেও গণতন্ত্রের যে অভাবটি রয়েছে,সারা দেশব্যাপী এত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে কোথাও কোনো ছাত্র সংসদ নাই। তো একজন ছাত্রনেতা কার কাছে জবাবদিহি করবেন, তিনি আসলে কার নেতা? আজকে আপনি একটা সংগঠন করেন,সংগঠনের প্রধান আপনাকে ঘোষণা করবেন যে, “তুমি ছাত্রনেতা ” ;- এই আপনি ছাত্রনেতা হচ্ছেন।
জাননাহ : তবে আপনি যে বললেন, – জবাবদিহিতার জন্য হলেও রাজনৈতিক দল প্রয়োজন, ছাত্র সংগঠগুলোর কোনো হঠকারী বা অনৈতিক কার্যকলাপকে প্রতিরোধ করার জন্য। তবে এটা কিন্তু আমরা ইদানীং ভিন্ন ভাবেও লক্ষ্য করছি, ব্যাপক ভাবে যে, ছাত্র সংগঠনের নেতারা – আপনি যেটি বললেন তাদের(রাজনৈতিক দলের নেতাদের) লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হচ্ছে এবং তারাই(রাজনৈতিক দলের নেতারা) দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে এবং এই জবাবদিহিতার বিষয়টি সম্পূর্ণ উল্টে গিয়ে দেখা যাচ্ছে ;- তারা ছাত্রনেতাদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছেন, যাতে ছাত্রনেতারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন । তো এই বিষয়টিও বিবেচ্য নয় কী ?
মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : না, অবশ্যই বিবেচ্য৷ আমি যেটা বললাম, এটা একটা তাত্ত্বিক ব্যাপার। অবশ্যই তাদের অভিভাবক থাকা উচিত। কিন্তু আমি বলছি অভিভাবক কোনো দল হওয়া উচিত নয়,অভিভাবক হবে গণতন্ত্র। অর্থাৎ একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিই প্রত্যেকটি দলের অভিভাবক হবে এবং ঐ সংগঠন নিজের মতো করে নিজেকে প্রকাশ করবে৷
এখন যেহেতু গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি রয়েছে সেহেতু তাদের অভিভাবকত্ব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে – তৃতীয় একটি শক্তির। সেটি হচ্ছে মূল ধারার রাজনৈতিক দল। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি তারা যে মূল ধারার রাজনৈতিক দলের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছে, যে দাসত্ব তারা গ্রহণ করেছে, এই দাসত্ব বরণ করে থাকার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে গণতন্ত্র না থাকা৷
কারণ যেকোনো ছাত্রনেতাই বা যেকোনো ছাত্র সংগঠনই কোন দাবিতে বা কোন অধিকারে ছাত্র সংগঠন হিসেবে টিকে থাকবে ? তার স্বীকৃতি কে দিবে ? এটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু যদি আপনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নিয়ে আসেন, তখন যেকোনো ব্যাক্তির, এখানে তার নেতৃত্বের গুণাবলি প্রকাশের মাধ্যমে, শিক্ষার্থীদের কে সেবা করার মাধ্যমে, শিক্ষার্থীদের সমর্থনে নেতা হওয়ার সুযোগ থাকতো৷
তো সেই ক্ষেত্রে এই রকম একটি স্বাধীন-স্বতন্ত্র নেতাকে আপনি সহজেই দাসে পরিণত করতে পারবেন না। এবং যেহেতু তিনি একটি গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্য দিয়ে নেতা হয়েছেন সেহেতু তিনি নিজেও হঠকারী কাজ করবেন না। অর্থাৎ গণতন্ত্রের যে অভিভাবকত্ব, মানুষের অধিকার রক্ষার অভিভাবকত্ব হচ্ছে গণতন্ত্রের। সেই অভিভাবকত্ব কার্যকর হবে কখন? যখন আপনি সেটার চর্চা অব্যাহত রাখবেন।
জাননাহ : এখানে বেশ কিছু কথা আপনি বলেছেন। তবে স্বীকৃতির যে বিষয়টি, যেহেতু আমরা এখানে আমরা ইতিহাসের কথা বললাম, অতীতে ছাত্র সংগঠনগুলোর যে কালচার ছিল – নব্বইয়ের দশকের আগে, সেই কথাগুলো বললাম, তখন দেখা যেত ছাত্র সংগঠনগুলো কিন্তু স্বতন্ত্রভাবেই নিজেদের পরিচালিত করছে এবং তারা যে ছাত্রনেতা এবং তখন যে ছাত্রলীগ ছিল, আওয়ামী লীগ ছিল এবং ১৯৬৬ সালে যখন জাতির জনক ৬ দফা ঘোষণা করলেন, ছাত্র সংগঠনগুলো কিন্তু ৬ দফার অবিকল সমর্থনে না গিয়ে ১১ দফা ঘোষণা করেছিল –
মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : ১১ দফা ঘোষণা করেছিল এবং ছাত্রলীগেরও একাংশ ৬ দফার বিরোধিতাও করেছে। সেই সুযোগটি তখন ছিল।
জাননাহ : সেটি ছিল। কিন্তু বর্তমানে দেখেন, যদি ছাত্র সংগঠনগুলো, যেমন : ছাত্রলীগ যদি আওয়ামী লীগের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় সেই পরিস্থিতি কিন্তু বর্তমানে হয়তো হতো না।
মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : আমি সেটাই আপনাকে বলছি, আপনি যে সময়টির কথা বলছেন – ৯০ এর আগ পর্যন্ত। ৯০ পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক চর্চা ছিল। ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো ছিল এবং যেহেতু গণতান্ত্রিক চর্চা ছিল সেহেতু কোনো বিশেষ ব্যাক্তির অনুগ্রহের উপরে ছাত্রনেতারা নির্ভরশীল ছিলেন না৷ কিন্তু এখন আপনি যদি দেখেন, যে, গণতান্ত্রিক চর্চাটিকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে বা হারিয়ে গিয়েছে।
স্বৈরাচার সরকারের সময়ে, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময়ে যে ছাত্র রাজনীতি টা আমাদের দেশে হয়েছে, সেটা যদি আপনি বিশ্লেষণ করেন, তাহলে আপনি দেখবেন, প্রত্যেকটি ছাত্র নেতাই কিন্তু স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে যে ভূমিকাটা তারা রেখেছেন – সেটা মূল দলের নির্দেশনায় নয়৷
অর্থাৎ, হ্যাঁ উদ্দেশ্য এক হতে পারে যে, আমিও স্বৈরাচার বিরোধী আমার মূল দলও স্বৈরাচার বিরোধী। কিন্তু তাদের দাবি তাদের প্রতিক্রিয়া, তাদের বিরোধিতা – এক ছিল না। তারা তাদের মতো করে শক্তি অর্জন করেছেন, তারা তাদের মতো করে বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু আপনি এই স্বাতন্ত্র্য এখন আর খুঁজে পাবেন না। কারণ কী? উনি নিজেই বিশ্বাস করেন না যে তিনি নেতা। একজন ছাত্রনেতা নিজে বিশ্বাস করেন না তিনি নেতা এবং আপনি যে টাইমফ্রেমটা দিয়েছেন , এটা খুব দারুণ হয়েছে। আমি মনে করি এটা নিয়ে লেখা উচিত পত্রিকায়, টাইমফ্রেম দিয়ে যে, নব্বই সাল পর্যন্ত চর্চাটা এরকম স্বাধীন ছিল, পরবর্তীতে সেই স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। এবং খর্ব হওয়ার পিছনের কারণই হচ্ছে ছাত্র রাজনীতিতে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকা।
জাননাহ : অর্থাৎ এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে হয় ?
মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই আমার কাছে মনে হচ্ছে।
জাননাহ : তাহলে আপনি যে কথাটি বললেন, গণতন্ত্র চর্চা নেই বলে ছাত্রসংগঠন গুলোর স্বীকৃতির জন্য রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া প্রায় অপরিহার্য হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যদি গণতন্ত্র চর্চা যথাযথভাবে বিদ্যমান থাকতো, সেই ক্ষেত্রে ছাত্র সংগঠনগুলোর স্বতন্ত্র ভাবে পরিচালিত হওয়াই কী আপনার কাছে যথার্থ হতো বলে আপনার মনে হয় ?
মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : হ্যাঁ, আমি মনে করি যে গণতন্ত্র চর্চা যদি অব্যাহত হয়, তাহলে আমরা ছাত্র সংগঠনের যে স্বাধীনতার কথা বলছি, যে স্বাতন্ত্র্যের কথা বলছি, যে হ্যাঁ তুমি একই আদর্শের হতে পারো, কিন্তু ঐ সংগঠন থেকে তুমি স্বতন্ত্র। তুমি তার পার্ট না, অংশ না। তো এই যে তার যে স্বাতন্ত্র্য, সেই স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারবে যদি গণতান্ত্রিক চর্চা শুরু হয়। এখন সাংবিধানিকভাবে কিন্তু অনেক সংগঠনই মূল দল থেকেই স্বতন্ত্র। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে থাকলে কী লাভ হবে ? ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন না। ছাত্র ইউনিয়ন সিপিবি এর অঙ্গসংগঠন না।
কিন্তু এটা তো আমাদের সামনে দিবালোকের মতো সত্য, যে, কাগজে বা জন্মসনদে যাই লেখা থাকুক না কেন, সংবিধানে যাই লেখা থাকুক না কেন, আমরা অংশই ৷
জাননাহ : একই সংগঠনভুক্ত বলেই দেখতে পাচ্ছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে অগণিত ছাত্র সংগঠন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীদের রয়েছে জেলা সংগঠন, উপজেলা সংগঠন এবং এগুলোর ব্যাপক সক্রিয়তাও লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তারপরেও আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এত অগণিত সংগঠন থাকার পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা কেন প্রয়োজন বলে আপনার মনে হয়েছিল ?
মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করার পরে, পরিচয় হিসেবে, মানে, যে পরিচয়টি প্রধান হয়ে উঠেছিল আমার কাছে, সেটা হলো- আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সবার কাছে নিশ্চয়ই, আমি বিশ্বাস করি যে, এই পরিচয়টিই প্রথমে প্রধান হয়ে ওঠে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরে নানা কারনে এখানে আমার পরিচয় হয়ে যায় যে, আমি টাঙ্গাইলের ছেলে, আমি নোয়াখালীর ছেলে। এখানে আমার পরিচয় হয়ে যায়, আমি অমুক দলের ছেলে, তমুক দলের ছেলে। এই যে আমাদের ভেতরে নতুন নতুন পরিচয় আমরা গ্রহণ করি, এই পরিচয় গ্রহণ করার পেছনে আসল কারণ যাই থাকুক না কেন ; এটার ফলাফল কী? এটার ফলাফল হচ্ছে আমি, আমার;- পাশের বন্ধুটি থেকে দূরে সরে যাওয়া।
প্রথম দিন যেরকম ছিলাম যে, আমিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি সেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ; কিন্তু পরের দিন কিন্তু হয়ে গেলাম আমি টাঙ্গাইলের ছেলে, সে নোয়াখালীর ছেলে। কারণ যাই হোক না কেন, কারণ রাজনৈতিক হতে পারে, অরাজনৈতিক হতে পারে। কিন্তু ফলাফল হচ্ছে আমি তার কাছ থেকে দূরে সরে গেলাম। তার আর আমার মাঝখানে একটি দুরত্বের দেয়াল সৃষ্টি হয়েছে। এখন আমরা যদি বলতে চাই যে এখানে এসে কোনো শিক্ষার্থী কোনো সমস্যায় পড়লে সেই সমাধান করার জন্য আমরা যে একচ্ছত্রভাবে কাজ করতে পারি না, তার পেছনে কারণ এইটাই ; – যে, আমি তো পূর্বে থেকেই নিজেকে আলাদা মনে করি। আমার কাছে মনে হয়েছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি পরিবার, যে পরিবার যদি নিজেরা বিভাজিত হয়, তাহলে এর দ্বারা আমরা নিজেরা এবং আমাদের জাতি উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গতকাল আমাদের এস এম হল ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ড. ফরাসউদ্দিন এসেছিলেন। আমি তাকে একটা প্রশ্ন করেছি, যে, স্যার আপনি, অনেকেই অনেক রকমভাবে বলে যে বাংলাদেশের যে স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতার আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ – এগুলোর মূল হচ্ছে আমাদের সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়, পলাশীর যুদ্ধে আমাদের পরাজয়। কিংবা অনেকে মনে করেন যে, প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন, যেটাকে নাম দেওয়া হয়েছে সিপাহি বিদ্রোহ, সেটা। আপনি কী মনে করেন ?
বলছেন যে, সেগুলা থেকে হয়তো আমরা প্রেরণা পেতে পারি, কিন্তু সেখান থেকে আমরা রস সংগ্রহ করি নাই। সেখানে আমাদের কোনো মূল নাই।
বাংলাদেশ যে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, সেই আত্মপ্রকাশ করার যে ক্ষমতা সেই আত্মপ্রকাশ করার যে মূল প্রেরণা, সেই আত্মপ্রকাশ করার যে প্রধান প্রাণশক্তি সেটি সূচিত হয়েছিল ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
অর্থাৎ আমাদের স্বাধিকার আন্দোলন,মুক্তিযুদ্ধ, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের যে প্রতিষ্ঠা এই সবকিছুর মূল প্রাণশক্তি হিসেবে তিনি দেখছেন যে এখানে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলেই আমরা পেরেছি। তা না হলে ঐ পলাশীর যুদ্ধ ঐ সিপাহি বিদ্রোহ এগুলো গুরুত্বপূর্ণ হলেও ঐতিহাসিকভাবে আমরা একটি রাষ্ট্র নির্মাণ করতে পারতাম না৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্র নির্মাণের ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখেছে, সেই রাষ্ট্রটি পরিচালনার জন্য অপার সম্ভাবনাও এ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে পারে। কিন্তু আমরা যদি পরস্পর থেকে বিভাজিত হতে থাকি, তাহলে আমরা পারব না। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি প্লাটফর্ম তৈরি করা যেখানে দল-মত-অঞ্চল নির্বিশেষে আমাদের একটি পরিচয়ই হবে, সেটা হলো- আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আমার যেন আর কোনো পরিচয় আরেকজন ভাইয়ের কাছে বা বোনের কাছে না দিতে হয়। এটিই যেন যথেষ্ট পরিচয় হয়৷ এবং আমার মনে করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তেত্রিশ হাজার শিক্ষার্থী এখন আমাদের সাথে যুক্ত আছেন। যখন আমাদের সদস্য সংখ্যা কম ছিল, যখন আমাদের সদস্য সংখ্যা এগার হাজার ছিল তখন আমরা একটি সার্ভে করেছিলাম, যেখানে দশ হাজারের উপরে মানুষ মতামত দিয়েছে (এগার হাজারের মধ্যে) তার মধ্যে ১৩ জন বাদে প্রত্যেকেই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করার ফলে তারা উপকৃত হয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠান টির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে৷ এবং এর ভিতর যারা মতামত দিয়েছেন তারা বলেছেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের সেরা সংগঠন হয়েছে এটি ; যেখানে দল-মত-অঞ্চল নির্বিশেষে আমরা আমাদের আত্মপরিচয় – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিচয়, সেই পরিচয়েই আমরা আরেকজনের সাথে পরিচিত হতে পারি।
জাননাহ : সম্প্রতি বহিরাগতদের দ্বারা হেনস্তার শিকার হয়ে অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট অভিযোগ না জানিয়ে অভিযোগ জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চের কাছে৷ এই হেনস্তা প্রতিরোধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ কী পদক্ষেপ নেবে?
মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : একটি বিষয় আমি আগে পরিষ্কার করি যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি শিক্ষার্থীদের এই অনাস্থাটা ছিল। মানে, প্রশাসনের প্রতি যে ঘোরতর অনাস্থা তা কিন্তু আমরা আমাদের সংগঠন শুরু করার আগেই ছিল।
দ্বিতীয় ব্যাপার হচ্ছে, আমরা আস্থা অর্জন করতে পেরেছি, মানুষের। এখন এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা কী করবো তা নিয়ে আমরা কথা বলছি, আমাদের সঙ্গে যারা কাজ করেন, বিশেষ করে আমাদের যারা পরামর্শ দেন। কথা বলে আমরা কিছু সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। তার মধ্যে একটা হচ্ছে, একটা নির্দিষ্ট সময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যান চলাচল বন্ধ রাখতে হবে৷ বিশেষ করে ধরেন সকাল ৯ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত। তারপরে হয়তো বা কিছু বাইরের গাড়ি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর দিয়ে পাস করতে পারে৷ কিন্তু যখন একাডেমিক কার্যকলাপ অব্যাহত থাকবে সেসময় বাইরের গাড়িগুলো যেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে না যায়৷ এটা হলো একটা সমস্যা – যান চলাচল।
আর বহিরাগতদের নিয়ে যে সমস্যাটা আছে সেই সমস্যা নিরসনের ক্ষেত্রে আমরা নিজেরাও এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি নি, যে এটাকে আমরা কীভাবে রোধ করবো। এখন আপনারা যারা গণমাধ্যমে আছেন তারা যদি আমাদেরকে একটু সহযোগিতা করেন, অর্থাৎ বাহিরের যারা এসে বিশ্ববিদ্যালয় কে পার্কের মতো ব্যবহার করছে, তাদেরকে প্রথমে নিরুৎসাহিত করতে হবে ;- আপনারা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যে এটা করেন, তা এখানে না করে আপনারা রমনা পার্কে যান। বিকালেও কিন্তু সে পার্কগুলো খালি পড়ে থাকে৷ বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে ভরপুর জমজমাট একটি বিনোদন কেন্দ্র। আমরা চাচ্ছি আমরা নিরুৎসাহিত করার একটি প্রোগ্রাম হাতে নিব যেখানে বাহিরের লোকজন আসলে তাদেরকে আমরা নিরুৎসাহিত করবো, যে, আপনারা এটিকে পার্ক হিসেবে ব্যবহার করবেন না৷
জাননাহ : আপনি যান চলাচল বন্ধ করার কথা বললেন এমন একটি সময়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি তে মেট্রোরেলের স্টেশন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ মেট্রোরেলের স্টেশন হওয়ার পর, আপনি যদি যান চলাচল বন্ধও করেন, তা কী খুব একটা ফলপ্রসূ হবে ? টিএসসি তে মেট্রোরেলের স্টেশন বানানোর সিদ্ধান্তকে কতটা যুক্তিযুক্ত মনে করছেন ?
মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : যখন মেট্রোরেলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে হয়, -আমি এখনও জানি না তথ্যের সত্যতা কতটুকু, আমি শুনেছি প্রথমে পরিকল্পনা ছিল ঢাকা ক্লাবের সামনে দিয়ে যাবে। কিন্তু পরবর্তীতে সেটা আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে গেল, কারণ ঢাকা ক্লাবের নেতৃবৃন্দ মনে করেছেন, যে, তাদের সামনে দিয়ে গেলে তাদের প্রতিষ্ঠানের সম্মুখভাগের যে সৌন্দর্য সেটি কিছুটা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে৷ তখন থেকেই আমি খুব ব্যাথিত হয়ে আমি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে আমার মহলে, আমার মহল তো তখন অনেক ছোট ছিল, সেটা নিয়ে আমি ব্যাপক ক্রিয়াশীল ছিলাম, যেন এটা না হয় এবং আমি এভাবেও লিখেছি যে জাতির জন্য একটা ক্লাব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল ; ঢাকা ক্লাব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে ! এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের যে সভাপতি আছেন ( এ.কে. আজাদ সাহেব), হয়তো তখন ছোট ছিলাম, ভাষার নিপুন ব্যবহার শিখিনি, তাকে আমি এটা বলেছি আজকে ঢাকা ক্লাবের সভাপতি সরকারের উপর এত প্রভাব বিস্তার করতে পারেন, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের সভাপতি, তার তো ঢাকা ক্লাবের সভাপতির চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাধর হওয়ার কথা বলে আমি নিজে মনে করি। এফবিসিসিআই এর সভাপতি যদি গভমেন্টের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ হন,ঢাকা ক্লাবের সভাপতি, গুলশান ক্লাবের সভাপতিরা যদি সরকারের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ হন, মিলিটারি সার্ভিসের যে এসোসিয়েশন আছে, রাওয়া ক্লাব, রাওয়া ক্লাবের সভাপতি যদি এত গুরুত্বপূর্ণ হন সরকারের কাছে, তাহলে আমাদের অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের সভাপতি, যেখানে আমাদের দেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ সদস্যই কিন্তু অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের মেম্বার, সেখানে তিনি কেন ভূমিকা রাখতে পারছেন না ? না কি তিনি নিজেও চান যে ঢাকা ক্লাবই রক্ষা হোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় ?
আমি সেরকম কিছু প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, কিন্তু শক্তির যে একটা নিজস্ব সামর্থ্য আছে, সেই সামর্থ্যের কাছে আমাদের সামর্থ্য ক্ষুদ্র হওয়ার কারণে সেটি তখন বাস্তবায়িত হয় নি। কিন্তু আমি এখনও মনে করি, যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর দিয়ে মেট্রোরেল স্থাপন এবং এখানে একটি স্টেশন স্থাপন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হয় নি ৷
জাননাহ : একজন নবীন শিক্ষার্থীর কাছে একজন তরুণ এবং সফল উদ্যোক্তা বা সংগঠক হিসেবে আপনি ইতোমধ্যেই জনপ্রিয় হয়েছেন। তবে,আপনাকে যদি প্রশ্ন করি, উদ্যোক্তা বা সংগঠক হওয়ার পিছনে কার অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন, সর্বপ্রথম আপনার কার নামটি স্মরণ হবে?
মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : আমি সবসময় যেটা বলি, আমার গুরু শংকর দাশ। শংকর দাশের নামটিই প্রথমে আসবে৷ শংকর দাশ সম্পর্কে যদি আমি সংক্ষেপে একটু বলি, তিনি ১৯৭০-৭১ সালে প্রথম সার্বজনীন ডাকসু নির্বাচন যখন হয়, তার আগে কিন্তু ডাকসু নির্বাচন হতো – সার্বজনীন না, হলে হলে হতো, হল থেকে নেতা সেলেক্ট করে ডাকসুর নেতা করে ডাকসুর নেতা নির্বাচিত করে দেওয়া হতো৷ তার মানে হচ্ছে, আপনি তোফায়েল আহমেদকে যে ডাকসুর ভিপি দেখেন, উনি কিন্তু সার্বজনীন নির্বাচনে ভিপি না, উনি একটি হলের ভিপি, উনাকে ডাকসুর ভিপি হিসাবে মনোনীত করা হয়েছে। সার্বজনীন ডাকসু নির্বাচন প্রথম হয় ১৯৭০-৭১ সালে। যেটাতে আ স ম আব্দুর রব ভিপি হন, আব্দুক কুদ্দুস মাখন জিএস নির্বাচিত হন৷ সেই সংসদে অধ্যাপক শংকর দাশ, আমার গুরু, তিনি সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র জনপ্রিয় ছাত্রনেতা যিনি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠিত ছাত্রনেতার লেজুড় ছিলেন না। অর্থাৎ লেজুড়বৃত্তি না করেই তিনি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের কাছে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন এবং একজন স্বাধীন, স্বতন্ত্র নেতা হিসেবে তাঁর যে অস্তিত্ব ছিল, সেই অস্তিত্বের প্রমাণই হচ্ছে তিনি সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন৷ তাঁর কাছ থেকে আমি, সকল ধরনের, যদি বলেন, প্রেরণা, সে প্রেরণা পাই। আর আমি নিজেও ২০০৯ সাল থেকে ছাত্ররাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত আছি৷ যেহেতু জড়িত আছি, সেহেতু আমারও দীর্ঘদিন কাজ করার ফলে, সবকিছু মিলে যে একটি মিশ্র অভিজ্ঞতা, সে মিশ্র অভিজ্ঞতা অনেক সময় কাজে লাগে।
তবে আপনি যদি এক কথায় বলতে চান, তাহলে গুরু শংকর দাশই হচ্ছে আমার সমস্ত কাজের প্রধান অনুপ্রেরণা। তাঁর পরামর্শই হচ্ছে, আমার কাছে, ধরেন বেদবাক্য। এবং যেকোনো সাধারণ বিষয়েও তিনি আমাকে যেভাবে প্রস্তুত করেছেন, সেই প্রস্তুতিকেই আমি বেশি গুরুত্ব দেই৷
জাননাহ : সম্প্রতি আত্মপ্রকাশ করেছে “গণ অধিকার পরিষদ” নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল। সাবেক ডাকসু ভিপি নুরুল হকের এই নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন ?
মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : খুবই ধন্যবাদ এবং এটা আসলে আমাদের রাজনীতির মাঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ বলে আমি মনে করি, এই কারণে, সম্ভবত বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এত অল্প বয়সে একটি রাজনৈতিক দলের সূচনা মনে হয় কেউ করেন নাই ; আমার জানামতে , আমি জানি না আর কি৷ সবচেয়ে তরুণ, সবচেয়ে কম বয়সে নুরুল হক নুরই হয়তো একটি নতুন রাজনৈতিক দলের সূচনা করলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি অভিভূত হয়েছি ঠিকই, কিন্তু অন্যদলের হলেও, তিনি রাজনৈতিক ভাবে ভিন্ন আদর্শের হলেও আমি তাকে নিয়ে গর্বিত হতে পারছি না।
রাজনৈতিক দল গঠন, তিনি যাদেরকে নিয়ে চেষ্টা করলেন, দীর্ঘদিন যাবৎ ই তো তিনি চেষ্টা করছেন, তিনি যাদেরকে নিয়ে প্রথমদিকে চেষ্টা করেছেন, সেই সব ব্যাক্তিবর্গের প্রতি বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু অনেক পূর্বেই অনাস্থা স্থাপন করেছেন, তারা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত রাজনীতিবিদ এবং তিনি শেষ পর্যন্ত যাদেরকে নিয়ে শুরু করেছেন – এখন বর্তমান সময়ে, সেই সব ব্যাক্তিরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন, তাদের ব্যাক্তিগত জীবনের যে চর্চা সেটি সম্পর্কেও আমি অবগত। তারা তাদের ব্যাক্তিগত জীবনে যথেষ্ট সততার প্রমাণ দিতে পারেন নাই৷ সেজন্য আমি তাদের এই রাজনৈতিক দলটি নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী না৷
আর আপনি যদি বলেন,যে, আপনি আশাবাদী না হয়তো, কিন্তু রাজনীতির মাঠে তো, যেটাকে বলা চলে একটি ভ্যাকুয়াম আছে, যে শূন্য জায়গা আছে, বিএনপি কাজ করছে না, নুইয়ে পড়েছে, জাতীয় পার্টি ধরতে গেলে আওয়ামী লীগেরই একটি লেজুড়, তো সেই মূহুর্তে মাঠ তো পুরা খালি। তো সেইখানে নুরুল হক নুর তার সংগঠনটি নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারবে কি না? আসলে মাঠ যদি খাল থাকে, আপনার কাছে যদি বল থাকে, সেটা কিন্তু গোল করার জন্য যথেষ্ট না৷ নুরুল হকের কাছে খালি মাঠ আছে, যেটিকে রাজনীতিতে আমি বলছি শূন্যতা, নুরুল হক নুরের কাছে প্লেয়ারও আছে, মানুষ তার কাছে যাচ্ছে। নুরুল হক নুরের কাছে একটা বলও আছে। তার বলটা হচ্ছে সরকার বিরোধিতা।
কিন্তু তার মাঠ, টিম এবং বল তিনটা থাকা সত্ত্বেও তিনি কোনোদিন গোল করতে পারবেন না; কারণ মাঠে কোনো গোলপোস্ট নাই৷ গোল করতে গেলে আপনার গোলপোস্ট লাগবে৷ তিনি তার দলকে নিয়ে যে রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করেছেন, এই কৌশল অবলম্বন করে কখনই রাষ্ট্রকে সেবা করার রাজনীতি করা যায় না। তার রাজনীতির প্রধান – আপনি দেখবেন,বিদেশি শক্তির সাথে আলোচনা নির্ভর তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন৷ ভিন্ন দেশীয় শক্তির সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন,ভিন্ন দেশীয় শক্তির পরামর্শে তার দলে তিনি পদ বন্টন করবেন এবং ভিন্ন দেশীয় শক্তির ইচ্ছানুযায়ী তার মন্তব্য, তার কাজকে তিনি পরিবর্তিত করবেন,সেই নেতার কাছ থেকে এই জাতি কিছু পাবে না৷ এবং আমাদের দেশের মানুষের, আমরা হয়তো অনেক সময়ই মানুষকে মূর্খ মনে করি, কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ একটা জায়গাতে খুব দৃঢ়, সেটা হলো বিদেশি শক্তির দালালকে মানুষ তার হৃদয়ে স্থান দেয় না৷
নুরুল হক নুর খালি মাঠ পেয়েছেন, তিনি কিছু মানুষ পেয়েছেন, তার কাছে রাজনীতি করার যে বল সেটিও আছে। কিন্তু গোলপোস্টতো আসলে মানুষের হাতে৷ গোলপোস্টে যে গোলকিপার, ঐ গোলকিপার কিন্তু আওয়ামী লীগ না, গোলপোস্টের গোলকিপার কিন্তু মানুষ,সাধারণ মানুষ । তিনি যেটা ভাবছেন, তার মাঠের দর্শক হচ্ছে সাধারণ মানুষ, উনি ভুল ভাবছেন। তার মাঠের গোলকিপার হচ্ছে সাধারণ মানুষ এবং এই মানুষ তাকে কোনোদিন গোল করতে দিবে না। কারণ তিনি প্রতিনিয়ত তার কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে প্রমাণ করছেন যে,তিনি বিদেশি একটি শক্তির দ্বারা পরিচালিত হচ্ছেন।
এদেশের মানুষ রক্ত দিয়ে এ দেশ স্বাধীন করেছে৷ এদেশের মানুষ বিদেশি শক্তির দালালকে কখনও রাষ্ট্র ক্ষমতায় নিবে না৷
জাননাহ : আপনি যেটি বললেন, -কোনো গোলপোস্ট নেই ! আসলে খেলার চূড়ান্ত লক্ষ্যই যেখানে গোলপোস্ট, সেখানে গোলপোস্ট না থাকা মানে চূড়ান্ত কোনো উদ্দেশ্য না থাকা । অর্থাৎ তার কোনো চূড়ান্ত সৎ উদ্দেশ্য নেই, এটিই বোঝাতে চেয়েছেন কী ?
মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : এটিই বোঝাতে চাচ্ছি৷
জাননাহ : অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের যে জ্বলন্ত মশাল হিসেবে ছাত্রলীগ আত্মপ্রকাশ করেছিল এবং সারা জীবনের তার যে ইতিহাস, রাজনৈতিক সংগ্রাম,সমস্ত অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর ছাত্রাবস্থা থেকেই অন্যায়ের সাথে কোনোরূপ আপোষ না করার ফলে জীবনভর যে জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, তাঁর যে ত্যাগ-তিতিক্ষা; আজকের ছাত্রলীগের মধ্যে তার কতটা প্রতিফলন লক্ষ্য করছেন ?
মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : এটা আসলে একটা বিশ্লেষণী উত্তর দিতে হবে৷ তারপরও আমি যদি মোটাদাগে বলি, মানে ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে যদি আমি বলি, আসলে ছাত্রলীগ তার প্রতিষ্ঠার যে প্রেক্ষাপট, যে উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই জায়গা থেকে ছাত্রলীগ সরে এসেছে বললে ভুল হবে৷ ছাত্রলীগ সেই জায়গা থেকে আসলে বিচ্যুত হয়েছে৷ মানে, একদমই পড়ে গেছে, বিচ্যুত হয়েছে। তবে এটার পিছনে যে মূল কারণটি আমি বলবো সেটা হলো, বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকেই নেতা মেনে আমরা আজ পর্যন্ত রাজনীতি করি। কিন্তু ছাত্রলীগ দেখভালের দায়িত্ব একেক সময় একেক নেতার হাতে ছিল৷ এখনও আপনি জানেন যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংবিধানিক অভিভাবক হলেও, তিনি কিন্তু ছাত্রলীগকে দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছেন তার দলের অন্যান্য চারজন নেতার উপরে৷ কিন্তু দ:খজনক ভাবে এই চারজন নেতা ছাত্রলীগকে তাদের ঐতিহাসিক পথে পরিচালিত করার জন্য, আমার মনে হয়, মোটেই উদ্যোগ গ্রহণ করছেন না৷ তারা মোটেই তাদেরকে সেভাবে পরিচালিত করার চেষ্টা করছেন না বরং তারা ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতাকর্মীকে তাদের নিজস্ব লেজুড় বানানোর ক্ষেত্রে বেশি মনোযোগী বলে আমার মনে হয়৷
যে চারজন নেতা ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত, শেখ হাসিনার অভিভাবকত্বকে, সেই নেতারা আমার মনে হয়, নিজস্ব বাহিনী তৈরি করার কাজেই বেশি ব্যবহার করছেন৷ সেজন্য ছাত্রলীগের বিশেষ কোনো গুণগত পরিবর্তন আমি অন্তত পক্ষে নিকট ভবিষ্যতে আশা করছি না।
জাননাহ : ইতোমধ্যে আমরা এটি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম; – দলীয় সম্পৃক্ততার বিষয়টি । এবং দেখা গেল দলীয় সম্পৃক্ততার বর্তমানে নেতিবাচক দিকটিই প্রতীয়মান হচ্ছে।
তো, সকল দল-মতের উর্ধ্বে উঠে এই যে আপনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে একটি ভালোবাসার আশ্রয়স্থল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন, নিজেকে এরকম আস্থার প্রতীক ভাবতে কেমন অনুভূত হয় ?
মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : আমরা যারা রাজনীতি করি, সে যে চরিত্রের রাজনীবিদই হোক না কেন,মানুষ যদি তাকে ভালোবাসে, ভালোবাসা পেতে কার না ভালো লাগে? আমি যদি বলি, আমার সফলতা কী? আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অনেক মানুষের ভালোবাসা লাভ করতে সক্ষম হয়েছি। আর আমি যদি আমার ব্যর্থতার কথা বলি – যে পরিমাণ ভালোবাসা আমি মানুষের কাছ থেকে পেয়েছি, এত পরিমাণ আমি তাদেরকে ভালোবাসতে পারি নাই৷
এটাই সফলতা যে আমি অনেক বেশি ভালোবাসা গ্রহণ করেছি, আবার এটাই ব্যর্থতা যে তার জন্য যে পরিমাণ প্রতিদান দেওয়া দরকার সেটা আমি দিতে পারি নাই।
জাননাহ : অত্যন্ত সুন্দর একটি সময় কাটলো। বিডিসমাচারের পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : আপনাকেও ধন্যবাদ।