স্বাধীনতার স্মারক ছয় দফা
- Update Time : ০৪:৫৫:২৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ জুন ২০২২
- / 355
আশিকুর রহমান অমি:
মুক্তিযুদ্ধ মহাকাল্লোলের অমর কাব্য প্রলয় পেরিয়ে ভূলোক কাঁপিয়ে যে তর্জনীর শাসন সেই মহাশাসকের গর্জন গ্রীক পৌরাণিকের জিউস, যুদ্ধদেবতা এরিস, ইতালির রেনেসাঁসের চেয়েও প্রকট আকার ধারণ করেছিল বৈকিই তাঁকে বিশ্ববন্ধু বলা হয় কিনা তা আমার জানা নেই তবে গোপালগঞ্জের গিমাডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সেই শিশু মুজিবই তিলে তিলে নিজেকে দেশের তরে মহানায়কে রূপান্তরিত করেছিলেন।স্বকীয় ও অনন্য মেধা সম্পন্ন হওয়ায় তিনি বরাবরই ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং ন্যায়ের প্রশ্নে আপোষহীন, সেজন্যই হয়তো মুসলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফিরিয়ে নেওয়ার মতো কপটতা তিনি দেখাননি।
ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নোর নির্বাচন, সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে এবং জীবনে বড় একটি সময় কারাগারে থেকে বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের দুঃখ ও বঞ্চনার তল খুঁজে পেয়েছিলেন। সেই বঞ্চনার প্রকোষ্ঠে চপেটাঘাত করার সমরাস্ত্র ছিল তাঁর উত্থাপিত ঐতিহাসিক ‘ছয়দফা ‘। পাকিস্তানি জোঁকদের শোষণে রক্তশূন্য হয়ে পড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতি তখন মৃতপ্রায়, ঠিক এমন একটি সময় বাঁচার স্বপ্ন দেখালেন বাংলার সব্যসাচী জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
পরাহত বাঙালিকে প্রাণের বাণী শোনালেন।
দেশজুড়ে আলোড়ন জেগে উঠলো, জেগে উঠতে শুরু করলো আশাহত জাতি। এক চিরন্তন মুক্তির আশায় বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাঁড়া দিল বাংলার আপামর জনতা। ব্রিটেনের ঐতিহাসিক ‘ম্যাগনা কার্টার আদলেই পরাধীন বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশেও রচিত হয়েছিল নূতন এক ‘ম্যাগনা কার্টা।’ ভাগ্যাহত নিপীড়িত বাঙালি জাতির সেই ‘ম্যাগনা কার্টা হলো বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ঐতিহাসিক ‘ছয় দফা’।
পাকিস্তানি শাসনের আঠারো বছরের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং সর্বোপরি পাক-ভারত যুদ্ধের পটভূমিতে আওয়ামী লীগের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত হয়। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রণীত ছয় দফা কর্মসূচি আকস্মিক কোনো ঘটনা ছিল না। ছয় দফা কর্মসূচিতে যে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপিত হয়েছিল তার প্রেক্ষাপট এক দিনে রচিত হয়নি। স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ আঠারো বছরের সংগ্রামের পটভূমিতে এ কর্মসূচি গৃহীত হয়। বস্তুত এ ঘোষণা ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোর অধীনে বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ যৌক্তিক ও ন্যায্য দাবি আদায়ের সন্ধিক্ষণ। ছয় দফার প্রতিটি দফা প্রণয়নে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও সুদূরপ্রসারী চিন্তার পরিচয় লক্ষণীয়।
বঙ্গবন্ধু নিজেই তার ছয়দফা নিয়ে বলেছিলেন সাঁকো দিলাম সেতুও দিলাম স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার। বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ছয় দফাকে সহজে মেনে নেবে না। এজন্য তিনি ছয় দফার সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জনসভায় বক্তৃতা দেন এবং ছয় দফাকে জনগণের কাছে তুলে ধরেন। ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ থেকে ৮ মে পর্যন্ত পঞ্চাশ দিনে ৩২টি জনসভায় ভাষণ দিয়ে তিনি ছয় দফা ব্যাখ্যা করেছিলেন।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা কর্মসূচি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে কতটা শঙ্কিত করে তুলেছিল তা সেসময়ে আইয়ুব খানের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া থেকেই অনুধাবন করা যায়। জেনারেল আইয়ুব খান ছয় দফাকে ‘হিন্দু আধিপত্যাধীন যুক্তবাংলা গঠনের ষড়যন্ত্র’ বলে আখ্যা দেন। তিনি ছয় দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী, বিদেশি মদদপুষ্ট, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, ধ্বংসাত্মক ইত্যাদি আখ্যায়িত করেন এবং এর প্রবক্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ‘১ নম্বর দুশমন’ হিসেবে চিহ্নিত করে ছয় দফার সমর্থকদের ‘অস্ত্রের ভাষা’ প্রয়োগের হুমকি দেন।
তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষাপটের দৃশ্যপটের বর্ণনা দিতে গেলে বাস্তবিক অর্থে ঠিক এমনভাবে বলা যায় যে – একটি গাভী সতেজ সবুজ ঘাস খাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে, আর সেই গাভীটির দুধ দোহন হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে। পাকিস্তানে পূর্ব বাংলার মানুষ কীভাবে শোষিত-বঞ্চিত হচ্ছে, ছয় দফার প্রচারকালে এমন এক পোস্টারে তা প্রতীকী অর্থে দেখানো হয়েছিল। সহজ ভাষায় একবার ছয় দফা বুঝাতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর হাতের তিনটে আঙ্গুল দেখিয়ে বলেছিলেন, আমার আসলে তিন দফা। কত নিছো? কবে দিবা? আর, কবে যাবা?
বঙ্গবন্ধু ছয়দফাকে বাঙালির বাঁচার দাবি হিসেবে মুক্তি আকাঙ্ক্ষী বাঙালির কাছে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। ঐ ছয় দফার ভেতরেই বাঙালির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির বীজ বুনেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।সোনার বাংলা শ্মশান কেন আওয়ামী লীগের সেই কালজয়ী পোস্টারও এই ছয় দফার চেতনা থেকেই উৎসারিত। দুই আর্থনীতির ভিত্তিও এই ছয় দফা। এই ছয় দফার ভিত্তিতেই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উদ্ভব হয়। সেই গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারেই স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের মসনদ ভেসে যায় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধুতে রূপান্তরিত হন।তাই সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি এই ছয়দফার পক্ষে গণরায় দেয়।ভোটে জিতেই বঙ্গবন্ধু আওয়ামীলীগের সকল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথ পাঠ করান এই ছয় দফার পক্ষে অবিচল থাকার জন্য। ছয় দফার মূল ভাবনাকে সংবিধানে কী করে প্রতিস্থাপন করা যায় সে বিষয়টি নিয়েই তিনি কাজ করছিলেন তাঁর সহ নেতা ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে।আর সে সময়ই ইয়াহিয়া খান ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেন।এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।
আসলে এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব। এই আন্দোলন চলমান থাকা অবস্থায় ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ তৎকালীন রমনা রেসকোর্সে এক বিরাট জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু মাত্র ১৮ মিনিটের ভাষণে বাঙালির মুক্তির ডাক দেন এরপরই মুক্তিকামী বাঙালি স্বাধীনতার বারুদে উদ্বেলিত হয়ে দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ শেষে দেশকে স্বাধীন করে।
কিন্তু নিয়তির নির্মম আবছায়া স্বাধীন দেশে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে যখন বঙ্গবন্ধু সেই ছয় দফার অন্তর্নিহিত চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারে তিলে তিলে গড়ে তুলছিলেন সে সময়েই ইতিহাসের কালপঞ্জিকায় হিংস্র হায়েনা রূপে জাতির পতাকা খামচে ধরে একদল শকুন।বাংলার দিগ্বিজয়ী সেই সেনানায়ককে পরাজিত করিতে পারেনি পাকিস্তানী ঐ শোষকগোষ্ঠী।ঠিক তেমনিউ ৭৫ এর সেই তিমির রাত্রিতে দেশের সেই জাত পিশাচ কুলাঙ্গারদের সামনেও জাতির পিতা পরাজিত হলেন না। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত যেন তার তর্জনী শাসন করে চলেছিল বাংলার বুকে ছেয়ে যাওয়া সেই বিশ্বাসঘাতক দুষ্ট চক্র শকুনদের। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন চিরঞ্জীব নক্ষত্র, আজও বাংলার আকাশে বাতাসে বঙ্গবন্ধুর অমর বাণী প্রতিধ্বনিত হয়।
আজ জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা বাংলার মানুষের দেখভালের দায়িত্বপালন করছেন, ঠিক যেমনটি পিতা মুজিব করেছিলেন। অন্ধ গর্ভ হতে এদেশকে মুক্তির কেতনে বহমান রাখতে বঙ্গবন্ধু কন্যা যখন ১৯৮১ সালে এদেশে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা জাতির তমসাচ্ছন্ন সময়ে এসে একাহাতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সারথি হয়ে আলোর আকাশবাণী ছুড়ে দিয়েছেন। বিজয়ের নৌকা ভাসিয়ে বিশ্ববাসীর বুকে বাংলাদেশকে চিরজাগরুক করে তুলেছেন। বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধির সোপানে চির উন্নত মম শির হয়ে রয়েছে। পিতা মুজিবের লালিত স্বপ্নের ঠিকানায় বঙ্গবন্ধু কন্যা যেন এভাবেই সুদীর্ঘ কাল বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের হয়ে তার সংগ্রাম জারি রাখতে পারে, আজকের দিনে আমার এতটুকুই প্রত্যাশা।
লেখক: শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।