পরমপুরুষ অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজের আবির্ভাব তিথি আজ
- Update Time : ০১:৩১:২০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ মে ২০২১
- / 909
চন্দন দেব নাথ:
যুগবতার, শিবকল্পতরু,পরমপুরুষ শ্রীমৎ স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ ১৯০৩ সালের ১৯ই মে চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী থানার অন্তর্গত বাণীগ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। মোগল সম্রাট শাহ্জাহানের পুত্র শাহ্ সুজার আমলে নদীয়ার কৃষ্ণনগরের চৌধুরী বংশ কালক্রমে বাণীগ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। এই গ্রামে বিভিন্ন সময়ে ভারতের নানা প্রান্ত থেকে অনেক মহাত্মা সাধক মহাপুরুষদের আগমন ঘটে।
চৌধুরী বংশেও পুরুষানুক্রমে নন্দরাম, রামদুলাল প্রভৃতি সিদ্ধ সাধকের আবির্ভাব ঘটে। এই ধারাবাহিকতায় পরমভাগবত প্রতাপচন্দ্র ও শচীদেবীর জ্যেষ্ঠপুত্র রূপে ১৩১১ বাংলার ৪ জ্যৈষ্ঠ মঙ্গলবার, ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মে শুভলগ্নে এক দেবশিশু জন্মগ্রহণ করেন।
.
প্রতাপচন্দ্রের গুরু প্রভুপাদ শ্রীমৎ নিত্যানন্দের ত্রয়োদশ বংশধর শ্রীপাদ অমৃতলাল গোস্বামী। তিনি জন্মের পূর্বে এই শিশুর আগমন বার্তা জানিয়ে “অদ্বৈত” নাম রাখতে বলেন। জন্মের পর থেকে তাঁর মধ্যে অধ্যাত্মভাবের স্ফুরণ ঘটে। বিদ্যার্থী হিসাবেও তিনি মেধার স্বাক্ষর রাখেন। সাত বছর বয়সে অদ্বৈতের নিগূঢ় আকর্ষণে শিবতম মহাযোগী শ্রীমৎ স্বামী জগদানন্দ পুরী পরমহংস বাণীগ্রামে আসেন।
.
তিনি অদ্বৈতের ব্রহ্মজিজ্ঞাসা দিব্য দর্শনের মর্মকথা ও রহস্য ভেদ করে দেন। শ্রীগুরু জগদানন্দ অদ্বৈতকে যোগদীক্ষা প্রদান করেন। গুরু সান্নিধ্যে সাধনার পথে নানা শিখর তিনি অতিক্রম করে যান। তিনি ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে বাণীগ্রামে উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি অঙ্ক ও সংষ্কৃতিশাস্ত্রে লেটার নিয়ে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর সংস্কৃতশ্রাস্ত্র ও দর্শনের উচ্চতর উপাধিগুলো অর্জন করেন। বংশগত বৃত্তি আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসায় তিনি ব্যুৎপত্তি লাভ করেন এবং এই পেশায় নিয়োজিত থাকেন পিতার সহায়ক হিসাবে। বাড়ীতে ‘আর্য চতুষ্পাঠি’ নামে সংস্কৃত টোল খোলেন।
.
গ্রামের কিশোরদের নিয়ে তিনি ‘ভক্তির ডোর’ ও ‘বৃত্রসংহার’ নামের দুটি নাটকও পরিচালনা করেন। তাঁর একান্ত অভিলাষ ছিল গৃহত্যাগ করে পরিব্রাজক সাধুরূপে নির্জন বনে চলে যাওয়ার। কিন্তু পিতা প্রতাপচন্দ্র তাঁকে সংসারে থাকতে বাধ্য করেন এবং গুরুমহারাজ স্বামী জগদানন্দ তাঁকে নিবৃত্ত করেন। গুরুদেব তাঁর পরিব্রাজনের সঙ্গী করে অদ্বৈতকে নানা তীর্থ পরিত্রমা করান। তিনি তাঁকে বিদ্বৎ সন্ন্যাস প্রদান করেন।
.
“ সন্ন্যাস নেওয়া নহে সন্ন্যাস হওয়া বিদ্বৎ সন্ন্যাস অন্তরে ফলত্যাগে।” গুরুমহারাজ তাঁকে বলেন, ‘সংসার ত্যাগ অপেক্ষাে অভিমান ত্যাগ শ্রেয়। বাণীগ্রামের পূর্বদিকে নিবিড় অরণ্য সমাচ্ছন্ন নাতিউচ্চ শৈলশেণী।সেখানে রয়েছে পরমহংস শিবনারায়ণ গিরির আখেড়া, বিল্বকানন বৈষ্ণব আশ্রম, ছুতরা ফকিরের আখেড়া ‘বানীগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের পাহাড়’ ও পাতামাটিয়ার পাহাড়।
.
জনারণ্য থেকে দূরে এই নির্জন বনভূমি তাঁর সাধনক্ষেত্র। তিনি বাড়ির শ্রীশ্রী রাজরাজেশ্বরী মন্দির অঙ্গনে তারকব্রহ্ম নাম যজ্ঞের প্রবর্তন করেন এবং শারদীয় উৎসবে তন্ত্রধারকের আসনও অলঙ্কৃত করেন। পিতা প্রতাপচন্দ্রের দেহাবসানের পর অনুজ অচ্যুতানন্দের উপর সংসারের সমস্ত দায়িত্ব অর্পণ করে তিনি তীর্থ পর্যটনে নির্গত হন। ইতিপূর্বে গুরুমহারাজ তাঁর নামকরন করেন অদ্বৈতানন্দ। গুরুদেবের সঙ্গে তিনি আসামে দেবী কামখ্যাকে দর্শন করেছেন। হিমালয়ের মহাতীর্থ কেদারনাথ, বদ্রিনাথ, অমরনাথ, হরিদ্বার, হৃষিকেশে ভ্রমণ করেন। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে যান কন্যাকুমারী, রামেশ্বর সেতুবন্ধ, পন্ডিচেরীর শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম, শ্রীক্ষেত্র পুরীধাম, শৃঙ্গেরী মঠ এবং গঙ্গাসাগর সঙ্গমে।
.
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে গয়া, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন, প্রয়াগ, লক্ষ্ণো, অযোধ্যা চিত্রকুটধাম ধাম দর্শন করেন। তীর্থদর্শন শেষে বিদেহী গুরুর নির্দেশে তিনি জঙ্গল কোকদন্ডীর পরিত্যক্ত পাহাড়ি ভূূমিতে ঋষিধাম প্রতিষ্ঠার কাজে মনোনিবেশ করেন। তাঁরই প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে ফলে ফুলে বৃক্ষলতায় সুশোভিত প্রকৃতির নিসর্গে সুরম্যতপোবন। ১৯৫৪ সালে সাধু সন্ত ভক্তজনদের জন্য প্রবর্তন করেন ঋষিকুম্ভ।
.
বাঁশখালীর গুণাগরীস্থ ঋষিধামে প্রতি ৩বছর পরপর এই ঋষিকুম্ভ ও কুম্ভমেলায় দেশ ও বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ তীর্থ করতে এখানে আসে। তিনি শুধু ঋষি নয়, লিখে গেছেন বহু ধর্মীয় গ্রন্থ।তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ‘গীতায় গুরুশীর্ষ’ ‘শ্রীশ্রী দশমহাবিদ্যা’ ‘শালগ্রাম তত্ত্ব’ ‘শিবলিঙ্গ রহস্য’ ‘গীতা মাধুকরী’ ‘ধর্ম প্রবেশিকা’’ ও ‘ উপসনা পদ্ধতি। ১৯৬১ সালের ১৮ মে তারিখে তিনি চট্টগ্রাম শহর নন্দনকাননে অবস্থিত শ্রীশ্রী তুলসীধামের মোহন্তরূপে অভিষিক্ত হন।
.
চট্টগ্রাম সহ সারাদেশে তারঁ লক্ষলক্ষ ভক্ত-শীর্ষ রয়েছে। ১৯৬৬ খিষ্টাব্দের ১৬ এপ্রিল, শনিবার শ্রীশ্রী মদনমোহনজীর সন্ধ্যারতি চলাকালীন সময়ে এই জগদ্বরেণ্য মহাপুরুষ মহাসমাধিতে মগ্ন হন।
Tag :