সরকারি সফর হলে স্টারমার কেন সাক্ষাৎ দিলেন না? বিবিসির প্রশ্নে যে উত্তর দিলেন ইউনূস

  • Update Time : ০২:২১:০৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫
  • / 62

যুক্তরাজ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চার দিনের সফরকে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হলেও, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ না হওয়া নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে।

গত ১২ জুন ‘কিং চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণের আগে বিবিসির ‘দ্য ওয়ার্ল্ড টুনাইট’ অনুষ্ঠানে সাংবাদিক রাজিনি বৈদ্যনাথন তাঁর সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন। একইসঙ্গে টিউলিপ সিদ্দিক ইস্যু, যুক্তরাজ্যের উন্নয়ন সহায়তা এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত নিয়েও একাধিক প্রশ্ন রাখেন তিনি।

বিবিসি উপস্থাপক: এই সফরকে ‘সরকারি’ বলা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর (কিয়ার স্টারমার) সঙ্গে কোনো বৈঠক নেই আপনার। মুহাম্মদ ইউনূস বাকিংহাম প্যালেসে যাওয়ার ঠিক আগে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড টুনাইট’-এর রাজিনি বৈদ্যনাথন তার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানতে চান, কেন কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে কোনো বৈঠক হল না?

মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা উনার (কিয়ার স্টারমারের) সঙ্গে দেখা করতে খুবই আগ্রহী ছিলাম। হয়ত তিনি ব্যস্ত ছিলেন বা অন্য কোনো কারণে তা সম্ভব হয়নি। তবে এতে করে আমার জন্য একটা বড় সুযোগও তৈরি হয়েছে। এখন যেহেতু তিনি ব্যস্ত, আমি তাকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমরা একসঙ্গে সময় কাটাতে পারব, যা ঘটছে তা দেখাতে পারব, এবং তিনি পুরো পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারবেন। এটা ইতিহাসের একটি বিশেষ মুহূর্ত, যার মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। একভাবে বললে, আমরা অতীতকে পেছনে ফেলে এক নতুন ভবিষ্যতের সূচনা করছি।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: আপনি বলছেন তিনি ব্যস্ত। কিন্তু আপনি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা, আপনি তার রাজনৈতিক সমমর্যাদার ব্যক্তি। যুক্তরাজ্যে প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি এখানে, যুক্তরাজ্যে আছেন। ব্রিটিশ জীবনে বাংলাদেশি সংস্কৃতি গভীরভাবে মিশে আছে। তাহলে আপনি কতটা হতাশ যে, যুক্তরাজ্যে আপনার কয়েক দিনের সফরে তিনি সময় বের করতে পারলেন না?

মুহাম্মদ ইউনূস: আমি জানি না আমি হতাশ হব, না তিনি। কোনো কারণে একটা সুযোগ হারাল, আমি জানি না। এজন্যই বলেছি, তার বাংলাদেশে আসা উচিত। একটু নির্ভার থাকবেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি উপলব্ধি করবেন, এই মুহূর্তের মর্ম বুঝতে পারবেন।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: কিন্তু বৈঠকের ব্যবস্থা না করার পেছনে কী কারণ দেখিয়েছে ডাউনিং স্ট্রিট?

মুহাম্মদ ইউনূস: আমার জানা মতে, তারা তেমন কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। হয়তো তিনি অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: এবার কিয়ার স্টারমারের এক এমপি, লেবার পার্টির টিউলিপ সিদ্দিককে নিয়ে বলি। তিনি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি। আর বাংলাদেশের এক আদালত তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে জমি নেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। যদিও তিনি তা অস্বীকার করেছেন। তিনি আপনাকে চিঠি লিখেছেন, আমরা সেই চিঠি দেখেছি। তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। আপনি কি তার সঙ্গে দেখা করবেন?

মুহাম্মদ ইউনূস: না, আমি দেখা করব না। কারণ এটা একটি আইনি প্রক্রিয়া। আমি সেই প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে চাই না। প্রক্রিয়াটা যেন চলতে পারে।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: ব্রিটিশ সরকারের ইনডিপেনডেন্ট এথিকস অ্যাডভাইজর টিউলিপ সিদ্দিকের বিষয়ে একটি তদন্ত করেছেন এবং তাকে নির্দোষ ঘোষণা করেছেন। টিউলিপ বলছেন, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। তাহলে কেন এখনও দুদক তার বিরুদ্ধে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে?

মুহাম্মদ ইউনূস: যেহেতু এটি আদালতের বিষয়, তাই আদালতই সিদ্ধান্ত নেবে যে মামলা চালানোর মতো যথেষ্ট উপকরণ আছে কিনা, কিংবা মামলাটি বাতিল করা উচিত কিনা।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: কিন্তু আপনি তো দুর্নীতি দূর করার অঙ্গীকার নিয়ে এসেছেন। আমি প্রশ্নটা আবার করব—দুদক বলছে, এটি কোনো ভিত্তিহীন তদন্ত নয়। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। কিন্তু টিউলিপ সিদ্দিকের আইনজীবীরা বলছেন, তারা কোনো প্রমাণই দেখেননি। এমনকি দুদক তাদের সঙ্গে যোগাযোগই করেনি।

মুহাম্মদ ইউনূস: আইনি প্রক্রিয়ায় আইনজীবীদের মধ্যে তথ্য বিনিময় হয়…

রাজিনি বৈদ্যনাথন: কিন্তু তিনি তো বলছেন, তেমন কিছু হয়নি।

মুহাম্মদ ইউনূস: সেজন্য সময় তো শেষ হয়ে যায়নি। আইনি প্রক্রিয়াগুলো সময় নেয়। বাংলাদেশ কখনও বলেনি, কোনো তথ্য দেওয়া হবে না।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: কিন্তু ইতোমধ্যে সুনির্দিষ্ট একটি অভিযোগে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়ে গেছে। অন্যদিকে তিনি (টিউলিপ) ও তার আইনজীবীরা স্পষ্ট করেই বলছেন, এটা সম্পূর্ণ অবিচার এবং নিয়মতান্ত্রিকতার পরিপন্থি। তারা বলছেন, কোনো যোগাযোগ করা হয়নি তাদের সঙ্গে।

মুহাম্মদ ইউনূস: এটা আইনজীবী বনাম আইনজীবীর বিষয়। দুদকের আইনজীবীরা নিশ্চয় এ বিষয়ে একটি যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: কিন্তু সহজভাবে বললে, টিউলিপ বলছেন, তার আইনজীবীরা দুদকের কাছ থেকে কোনো বার্তা পাননি। তাই তিনি বলছেন, এটা যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া নয়।

মুহাম্মদ ইউনূস: দুদকের পক্ষ থেকে তাদের আইনজীবী বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে পারবেন, কীভাবে এটি একটি যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: ঠিক আছে। কিন্তু আপনি তো প্রধান উপদেষ্টা। তাহলে আপনি কি এখনদুদককে আরও স্বচ্ছ হতে বলবেন? আপনি কি এখন এটি অন রেকর্ডে বলতে চান যে, তারা যেন দ্রুত প্রমাণ উপস্থাপন করে, যাতে অভিযোগ নিয়ে কোনো সন্দেহ না থাকে? কারণ টিউলিপ সিদ্দিক তো অভিযোগ অস্বীকার করছেন।

মুহাম্মদ ইউনূস: প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আমি আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখি যে, তারা সঠিক কাজটাই করছে।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। যদি তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে কি তাকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হবে?

মুহাম্মদ ইউনূস: এটা আইনি প্রক্রিয়ার বিষয়। এক ধাপের পর আরেক ধাপ আসে।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: কিন্তু দেশে ফেরানোর বিষয়টা কি এই প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারে?

মুহাম্মদ ইউনূস: যদি আইনের আওতায় পড়ে, তাহলে হতে পারে।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: অর্থাৎ যথেষ্ট প্রমাণ থাকলে, দুদক তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানাতে পারে?

মুহাম্মদ ইউনূস: যদি আইন সেটা চায়।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: যুক্তরাজ্যের সাহায্যপ্রাপ্ত শীর্ষ দশ দেশের একটি বাংলাদেশ। সম্প্রতি আমরা শুনেছি, এমনকি গতকালও বাজেট পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, বিদেশি সাহায্যের বাজেটে বড় কাটছাঁট করা হবে। বাংলাদেশিদের ওপর এর কতটা প্রভাব পড়বে?

মুহাম্মদ ইউনূস: এই কঠিন সময়ে যদি কিছু সহায়তা পাওয়া যায়, আমরা কৃতজ্ঞ থাকব। তবে না পেলেও, আমরা নিজেদের প্রচেষ্টায় এগিয়ে যেতে থাকব এবং আয় বৃদ্ধির চেষ্টা করব।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: কিন্তু এটা কত বড় ধাক্কা, অধ্যাপক?

মুহাম্মদ ইউনূস: ব্রিটিশ সাহায্যে কাটছাঁট, এটা একটা বড় ধাক্কা। তবে জীবনে ওঠানামা থাকেই। আজ কমে গেল, কাল বাড়বে—এখানকার পরিস্থিতির ওপরই সব নির্ভর করে। তবে আমাদের সেই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। যেমন হঠাৎ করে ইউএসএইড সব অর্থ একেবারে বন্ধ করে দিল—১০০%। শেষ। বন্ধ। তখন আমরা দেখলাম, কত বড় ঘটনা ঘটল বাংলাদেশে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে—সব তহবিল বন্ধ হয়ে গেল। শূন্য। রোহিঙ্গা সংকট হঠাৎ করেই আমাদের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়াল। বিস্ময়কর এক পরিস্থিতি। কিন্তু আমাদের সেটা মোকাবিলা করতেই হবে। টাকাপয়সা চলে গেছে বলে তো রোহিঙ্গারা হঠাৎ উধাও হয়ে যাবে না।

বিবিসি উপস্থাপক: মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কথা বলছিলেন আমার সহকর্মী রজিনি বৈদ্যনাথন। আমরা টিউলিপ সিদ্দিক এমপির সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলাম অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য। তিনি তাতে রাজি হননি, তবে একটি বিবৃতি পাঠিয়েছেন।

টিউলিপের প্রতিক্রিয়া

বিবিসির ওই অনুষ্ঠানে টিউলিপ সিদ্দিক অংশ না নিলেও, একটি বিবৃতি পাঠান।

সেখানে তিনি লেখেন: “অধ্যাপক ইউনূস আমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি না হয়ে হতাশ করেছেন। তিনি একটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কেন্দ্রে অবস্থান করছেন, যা ভিত্তিহীন ও প্রমাণহীন অভিযোগের ওপর দাঁড়িয়ে—যেগুলো ধারাবাহিকভাবে মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে। আমি আশা করি, তিনি এখন এই অপপ্রচার বন্ধে মনোযোগ দেবেন এবং বিষয়টি আদালতেই নিষ্পত্তি হবে, যেখানে প্রমাণিত হবে যে, এই অভিযোগের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।”

তথ্যসূত্র : বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


সরকারি সফর হলে স্টারমার কেন সাক্ষাৎ দিলেন না? বিবিসির প্রশ্নে যে উত্তর দিলেন ইউনূস

Update Time : ০২:২১:০৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫

যুক্তরাজ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চার দিনের সফরকে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হলেও, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ না হওয়া নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে।

গত ১২ জুন ‘কিং চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণের আগে বিবিসির ‘দ্য ওয়ার্ল্ড টুনাইট’ অনুষ্ঠানে সাংবাদিক রাজিনি বৈদ্যনাথন তাঁর সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন। একইসঙ্গে টিউলিপ সিদ্দিক ইস্যু, যুক্তরাজ্যের উন্নয়ন সহায়তা এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত নিয়েও একাধিক প্রশ্ন রাখেন তিনি।

বিবিসি উপস্থাপক: এই সফরকে ‘সরকারি’ বলা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর (কিয়ার স্টারমার) সঙ্গে কোনো বৈঠক নেই আপনার। মুহাম্মদ ইউনূস বাকিংহাম প্যালেসে যাওয়ার ঠিক আগে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড টুনাইট’-এর রাজিনি বৈদ্যনাথন তার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানতে চান, কেন কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে কোনো বৈঠক হল না?

মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা উনার (কিয়ার স্টারমারের) সঙ্গে দেখা করতে খুবই আগ্রহী ছিলাম। হয়ত তিনি ব্যস্ত ছিলেন বা অন্য কোনো কারণে তা সম্ভব হয়নি। তবে এতে করে আমার জন্য একটা বড় সুযোগও তৈরি হয়েছে। এখন যেহেতু তিনি ব্যস্ত, আমি তাকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমরা একসঙ্গে সময় কাটাতে পারব, যা ঘটছে তা দেখাতে পারব, এবং তিনি পুরো পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারবেন। এটা ইতিহাসের একটি বিশেষ মুহূর্ত, যার মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। একভাবে বললে, আমরা অতীতকে পেছনে ফেলে এক নতুন ভবিষ্যতের সূচনা করছি।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: আপনি বলছেন তিনি ব্যস্ত। কিন্তু আপনি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা, আপনি তার রাজনৈতিক সমমর্যাদার ব্যক্তি। যুক্তরাজ্যে প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি এখানে, যুক্তরাজ্যে আছেন। ব্রিটিশ জীবনে বাংলাদেশি সংস্কৃতি গভীরভাবে মিশে আছে। তাহলে আপনি কতটা হতাশ যে, যুক্তরাজ্যে আপনার কয়েক দিনের সফরে তিনি সময় বের করতে পারলেন না?

মুহাম্মদ ইউনূস: আমি জানি না আমি হতাশ হব, না তিনি। কোনো কারণে একটা সুযোগ হারাল, আমি জানি না। এজন্যই বলেছি, তার বাংলাদেশে আসা উচিত। একটু নির্ভার থাকবেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি উপলব্ধি করবেন, এই মুহূর্তের মর্ম বুঝতে পারবেন।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: কিন্তু বৈঠকের ব্যবস্থা না করার পেছনে কী কারণ দেখিয়েছে ডাউনিং স্ট্রিট?

মুহাম্মদ ইউনূস: আমার জানা মতে, তারা তেমন কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। হয়তো তিনি অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: এবার কিয়ার স্টারমারের এক এমপি, লেবার পার্টির টিউলিপ সিদ্দিককে নিয়ে বলি। তিনি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি। আর বাংলাদেশের এক আদালত তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে জমি নেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। যদিও তিনি তা অস্বীকার করেছেন। তিনি আপনাকে চিঠি লিখেছেন, আমরা সেই চিঠি দেখেছি। তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। আপনি কি তার সঙ্গে দেখা করবেন?

মুহাম্মদ ইউনূস: না, আমি দেখা করব না। কারণ এটা একটি আইনি প্রক্রিয়া। আমি সেই প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে চাই না। প্রক্রিয়াটা যেন চলতে পারে।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: ব্রিটিশ সরকারের ইনডিপেনডেন্ট এথিকস অ্যাডভাইজর টিউলিপ সিদ্দিকের বিষয়ে একটি তদন্ত করেছেন এবং তাকে নির্দোষ ঘোষণা করেছেন। টিউলিপ বলছেন, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। তাহলে কেন এখনও দুদক তার বিরুদ্ধে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে?

মুহাম্মদ ইউনূস: যেহেতু এটি আদালতের বিষয়, তাই আদালতই সিদ্ধান্ত নেবে যে মামলা চালানোর মতো যথেষ্ট উপকরণ আছে কিনা, কিংবা মামলাটি বাতিল করা উচিত কিনা।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: কিন্তু আপনি তো দুর্নীতি দূর করার অঙ্গীকার নিয়ে এসেছেন। আমি প্রশ্নটা আবার করব—দুদক বলছে, এটি কোনো ভিত্তিহীন তদন্ত নয়। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। কিন্তু টিউলিপ সিদ্দিকের আইনজীবীরা বলছেন, তারা কোনো প্রমাণই দেখেননি। এমনকি দুদক তাদের সঙ্গে যোগাযোগই করেনি।

মুহাম্মদ ইউনূস: আইনি প্রক্রিয়ায় আইনজীবীদের মধ্যে তথ্য বিনিময় হয়…

রাজিনি বৈদ্যনাথন: কিন্তু তিনি তো বলছেন, তেমন কিছু হয়নি।

মুহাম্মদ ইউনূস: সেজন্য সময় তো শেষ হয়ে যায়নি। আইনি প্রক্রিয়াগুলো সময় নেয়। বাংলাদেশ কখনও বলেনি, কোনো তথ্য দেওয়া হবে না।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: কিন্তু ইতোমধ্যে সুনির্দিষ্ট একটি অভিযোগে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়ে গেছে। অন্যদিকে তিনি (টিউলিপ) ও তার আইনজীবীরা স্পষ্ট করেই বলছেন, এটা সম্পূর্ণ অবিচার এবং নিয়মতান্ত্রিকতার পরিপন্থি। তারা বলছেন, কোনো যোগাযোগ করা হয়নি তাদের সঙ্গে।

মুহাম্মদ ইউনূস: এটা আইনজীবী বনাম আইনজীবীর বিষয়। দুদকের আইনজীবীরা নিশ্চয় এ বিষয়ে একটি যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: কিন্তু সহজভাবে বললে, টিউলিপ বলছেন, তার আইনজীবীরা দুদকের কাছ থেকে কোনো বার্তা পাননি। তাই তিনি বলছেন, এটা যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া নয়।

মুহাম্মদ ইউনূস: দুদকের পক্ষ থেকে তাদের আইনজীবী বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে পারবেন, কীভাবে এটি একটি যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: ঠিক আছে। কিন্তু আপনি তো প্রধান উপদেষ্টা। তাহলে আপনি কি এখনদুদককে আরও স্বচ্ছ হতে বলবেন? আপনি কি এখন এটি অন রেকর্ডে বলতে চান যে, তারা যেন দ্রুত প্রমাণ উপস্থাপন করে, যাতে অভিযোগ নিয়ে কোনো সন্দেহ না থাকে? কারণ টিউলিপ সিদ্দিক তো অভিযোগ অস্বীকার করছেন।

মুহাম্মদ ইউনূস: প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আমি আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখি যে, তারা সঠিক কাজটাই করছে।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। যদি তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে কি তাকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হবে?

মুহাম্মদ ইউনূস: এটা আইনি প্রক্রিয়ার বিষয়। এক ধাপের পর আরেক ধাপ আসে।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: কিন্তু দেশে ফেরানোর বিষয়টা কি এই প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারে?

মুহাম্মদ ইউনূস: যদি আইনের আওতায় পড়ে, তাহলে হতে পারে।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: অর্থাৎ যথেষ্ট প্রমাণ থাকলে, দুদক তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানাতে পারে?

মুহাম্মদ ইউনূস: যদি আইন সেটা চায়।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: যুক্তরাজ্যের সাহায্যপ্রাপ্ত শীর্ষ দশ দেশের একটি বাংলাদেশ। সম্প্রতি আমরা শুনেছি, এমনকি গতকালও বাজেট পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, বিদেশি সাহায্যের বাজেটে বড় কাটছাঁট করা হবে। বাংলাদেশিদের ওপর এর কতটা প্রভাব পড়বে?

মুহাম্মদ ইউনূস: এই কঠিন সময়ে যদি কিছু সহায়তা পাওয়া যায়, আমরা কৃতজ্ঞ থাকব। তবে না পেলেও, আমরা নিজেদের প্রচেষ্টায় এগিয়ে যেতে থাকব এবং আয় বৃদ্ধির চেষ্টা করব।

রাজিনি বৈদ্যনাথন: কিন্তু এটা কত বড় ধাক্কা, অধ্যাপক?

মুহাম্মদ ইউনূস: ব্রিটিশ সাহায্যে কাটছাঁট, এটা একটা বড় ধাক্কা। তবে জীবনে ওঠানামা থাকেই। আজ কমে গেল, কাল বাড়বে—এখানকার পরিস্থিতির ওপরই সব নির্ভর করে। তবে আমাদের সেই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। যেমন হঠাৎ করে ইউএসএইড সব অর্থ একেবারে বন্ধ করে দিল—১০০%। শেষ। বন্ধ। তখন আমরা দেখলাম, কত বড় ঘটনা ঘটল বাংলাদেশে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে—সব তহবিল বন্ধ হয়ে গেল। শূন্য। রোহিঙ্গা সংকট হঠাৎ করেই আমাদের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়াল। বিস্ময়কর এক পরিস্থিতি। কিন্তু আমাদের সেটা মোকাবিলা করতেই হবে। টাকাপয়সা চলে গেছে বলে তো রোহিঙ্গারা হঠাৎ উধাও হয়ে যাবে না।

বিবিসি উপস্থাপক: মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কথা বলছিলেন আমার সহকর্মী রজিনি বৈদ্যনাথন। আমরা টিউলিপ সিদ্দিক এমপির সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলাম অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য। তিনি তাতে রাজি হননি, তবে একটি বিবৃতি পাঠিয়েছেন।

টিউলিপের প্রতিক্রিয়া

বিবিসির ওই অনুষ্ঠানে টিউলিপ সিদ্দিক অংশ না নিলেও, একটি বিবৃতি পাঠান।

সেখানে তিনি লেখেন: “অধ্যাপক ইউনূস আমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি না হয়ে হতাশ করেছেন। তিনি একটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কেন্দ্রে অবস্থান করছেন, যা ভিত্তিহীন ও প্রমাণহীন অভিযোগের ওপর দাঁড়িয়ে—যেগুলো ধারাবাহিকভাবে মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে। আমি আশা করি, তিনি এখন এই অপপ্রচার বন্ধে মনোযোগ দেবেন এবং বিষয়টি আদালতেই নিষ্পত্তি হবে, যেখানে প্রমাণিত হবে যে, এই অভিযোগের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।”

তথ্যসূত্র : বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম