জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা

  • Update Time : ০২:০২:২০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪
  • / 65

মোঃ মুশফিকুর রহমান (তুহিন):

বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বেশিদিনের নয়। ১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি) যাত্রা শুরু করে। সরকার ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন চালু করলে আইইউবিএটি উক্ত আইনে নিবন্ধিত হয়। অর্থাৎ নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পরে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বয়স ৩৪ বছরের কম। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের যে গৌরবোজ্জ্বল অতীত (ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান), সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা না থাকাটাই স্বাভাবিক, যেহেতু তখন দেশে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো না। নিকট অতীতে ২০১৫ সালে ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সহ বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকলেও ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান সন্দেহাতীতভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

২০২৪ সালে সরকারি চাকরিতে যৌক্তিক কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়ে সেটা পরবর্তীতে স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে রূপ নেয়। আমরা যদি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে নজর দেই, গ্র্যাজুয়েশনের পর হয়তো পরিস্থিতির কারণে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে চিন্তাও করে না যে সে সরকারি চাকরিতে যোগ দিবে। এখানকার বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বিদেশমুখী এবং বেসরকারি চাকরি করতে কিংবা উদ্যোক্তা হতেই বেশি আগ্রহী। যেখানে সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়ার আগ্রহ খুবই কম, সেখানে কোটা সংস্কার আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এভাবে রাস্তায় নামবে, আন্দোলনের অন্যতম মেরুদণ্ড হয়ে আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সেটা সরকারেরও সিলেবাসের বাইরে ছিলো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলো নিঃস্বার্থভাবে দেশের প্রয়োজনে, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ভাই বোনদের প্রতি সহমর্মী হয়ে।

২০১৮ সালে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পর জুলাইয়ের শুরুতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দোলন পুণরায় শুরু হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্ন জায়গায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দেয়, আমি নিজেও ৭ জুলাই শাহবাগে গিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু সংগঠিত হয়ে সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানারে প্রথম ১০ জুলাই শিক্ষার্থীরা রামপুরায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দেয়। যেখানে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, গ্রিন ইউনিভার্সিটি ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা সহ অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে এই আন্দোলন চলতে থাকে। শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যোগ দিয়েছিলো, ৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতন পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে নিয়েছিলো। এই আন্দোলনে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান কম নয়, কাউকে বাদ দিয়ে কেউকে কৃতিত্ব দেয়াটা একদমই সমীচিন হবে না। নিজের জানার সীমাবদ্ধতা থাকায় সবার নাম এই লেখায় উল্লেখ করতে পারছিনা বলে দুঃখ প্রকাশ করছি।

১৫ জুলাই থেকে বড় আকারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে আন্দোলন শুরু হয়। ১৫ জুলাই সকাল ১০ টায় ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ) ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা নতুন বাজারে অবস্থিত আমেরিকান দূতাবাসের সামনের মূল সড়ক অবরোধ করে। পরবর্তীতে তাদের সাথে ইউনিভার্সিটি অফ ইনফরমেশন টেকনোলজি এন্ড সাইন্স (ইউআইটিএস) সহ আশেপাশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালের শিক্ষার্থীরা যোগ দেয়। একই দিনে রামপুরায় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা, যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (এআইইউবি) ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে। ফলে সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এই সড়ক কার্যত অচল হয়ে যায়।১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর আওয়ামীলীগ সরকারের সন্ত্রাসী ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা করে। বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের উপর ন্যাক্কারজনক হামলার ছবি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলস্বরুপ ১৬ জুলাই সারাদেশের শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং সারাদেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে যায়।

সন্ত্রাসী ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের উপরেও হামলা করে। ১৬ জুলাই নতুন বাজার থেকে ইউআইইউ যাওয়ার যে রাস্তা সেখানে প্রতিটি মোড়ে মোড়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সকাল থেকে অবস্থান নেয়। বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে গমনকারী শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ড চেক করে হেনস্তা ও মারধর করে। এমনকি শিক্ষার্থীরা রিকশা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাওয়ার সময় তাদের রিকশা আটকে ব্যাগের ভেতর আইডি কার্ড আছে কি না তা চেক করে, এবং আইডি কার্ড পেলে মারধর করে। একইসময় সন্ত্রাসীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল বাসেও হামলা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে জমায়েত হয়ে মিছিল নিয়ে নতুন বাজারের দিকে যাওয়ার সময় সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের মিছিলে হামলা করে এবং ধাওয়া পালটা ধাওয়া হয়, পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। সেখানে ইউআইইউ এর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরাও ছিলো। শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে গিয়ে নতুন বাজারের রাস্তা অবরোধ করে। পূর্বের দিনের মতোই অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রামপুরা ও যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের রাস্তা দখলে রাখে। সেদিন উত্তরায় নর্দান ইউনিভার্সিটি, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি ও উত্তরা ইউনিভার্সিটি সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে। অর্থাৎ উত্তরা থেকে রামপুরা এই পুরো অঞ্চলটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দখলে ছিলো। পাশাপাশি ধানমন্ডিতে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) সহ রাজধানীর অন্যান্য জায়গায় অন্যসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো।

১৬ জুলাই শিক্ষার্থীদের নতুন বাজারে প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে যাওয়া ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা রাতে সাতারকুলে শিক্ষার্থীদের মেসে হামলা চালায়, দরজা ভেঙে রুমে প্রবেশ করে শিক্ষার্থীদের মারধর করে স্টুডেন্ট আইডি কার্ড জোরপূর্বক নিয়ে যায়।

১৭ জুলাই (১০ মহরম) দেশে আশুরা পালিত হওয়ায় সেদিন কোনো কর্মসূচি ছিলো না। কিন্তু ১৭ জুলাই রাতে পুলিশ, বিজিবি সহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী যৌথ বাহিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একত্রে হামলা চালায়, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে দেয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো খালি করার পর সরকার ভেবেছিলো এই আন্দোলন এখানেই শেষ! কিন্তু পরের দিন ১৮ জুলাই সবাইকে অবাক করে দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় নামে।

১৮ জুলাই আমরা যখন মিছিল নিয়ে নতুন বাজার অভিমুখে যাচ্ছিলাম তখন আমাদের নিকট খবর আসে, রামপুরায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে পুলিশ হামলা করেছে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির পাশে দাড়াতে আমরা এই এলাকার সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের (নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অফ ইনফরমেশন টেকনোলজি এন্ড সাইন্স সহ অন্যান্য) হাজার হাজার শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে রামপুরার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। মধ্যবাড্ডায় পুলিশ মিছিলে গুলিবর্ষণ শুরু করে।

পুলিশ বিনা উস্কানিতে শিক্ষার্থীদের উপর রামপুরা, উত্তরা সহ বিভিন্ন জায়গায় নির্বিচারে গুলি করে। শত শত শিক্ষার্থী আহত হয়, অনেকে নিজের বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দেয়, কিন্তু কেউ পালিয়ে যায় নি, রাস্তা দখলে রেখেছে, বিশাল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। মধ্যবাড্ডায় আমাদের ইউআইইউ এর শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। চোখের সামনে শত শত আহত শিক্ষার্থী, চোখের সামনে ইম্পেরিয়াল কলেজের এক শিক্ষার্থী শহীদ হয় পুলিশের গুলিতে। রামপুরায় পুলিশের গুলি পর্যন্ত শেষ হয়ে যায়, এতো বেশি হিংস্র ও আক্রমণাত্মক ছিলো পুলিশ। গুলি শেষ হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ছাদে আশ্রয় নেয়। যে পুলিশ ১০ মিনিট আগে আমাদের বুকে গুলি করেছে সে পুলিশ গুলি শেষ হওয়ার পর আমাদের প্রতিরোধের মুখে ছাদে উঠে ছাদ থেকে আমাদের নিকট হাত জোর করে ক্ষমা চায়, স্যালুট দেয়। তারপর এয়ারফোর্স ও র‍্যাবের দুইটি হেলিকপ্টারে প্রতিবারে ৫/৬ জন করে অবশেষে পুলিশ ছাদ থেকে পালিয়ে যায়। একইভাবে উত্তরা সহ ঢাকার অনেক জায়গায় ঐদিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তুলে, সাথে যোগ দেয় বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। ফলস্বরূপ ১৮ তারিখেই সরকার ঘোষণা দেয় ওরা কোটা সংস্কারের দাবি মেনে নিয়েছে, আজই বসতে চায় শিক্ষার্থীদের সাথে, যদিও শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখান করে। তারপর সরকার সারাদেশে কারফিউ ঘোষণা করে।

তখন পুলিশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গণগ্রেফতার ও নির্যাতন চালায়। প্রতিটি মহল্লায় মহল্লায় গিয়ে ব্লক রেইড দিয়ে শিক্ষার্থীদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে সবচেয়ে বেশি অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে গুলশান বিভাগের তিনটি থানায়। এই বিভাগে শুধু বাড্ডা থানাতে ১১টি মামলার প্রতিটিতে সর্বনিম্ন ৩ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। গুলশান থানায় ৬টি মামলার প্রতিটিতে সর্বনিম্ন ৪ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৭ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। ভাটারা থানায় ৪টি মামলায় সর্বনিম্ন ৩ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১২ হাজার জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। উল্লেখ্য এই তিনটি থানার আওতায় সবচেয়ে বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় (ইস্ট ওয়েস্ট, ব্রাক, নর্থ সাউথ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল, প্রাইম এশিয়া, ইউনিভার্সিটি অফ ইনফরমেশন টেকনোলজি এন্ড সাইন্স সহ অন্যান্য) অবস্থিত। শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার করে নিয়ে রিমান্ডেও নির্যাতন করা হয়েছে। আমরা গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে থাকতাম, রাত্রে বাসায় থাকতে পারতাম না। বাসায় পুলিশ এসে ঘুরে যেত। একদিন আমি আমার নিজের বাসায় গিয়েছিলাম, আমার নিচ তলায় একজন দর্জি থাকতেন। আমরা বাসায় ঢুকার সাথে সাথে উনি আমাদেরকে বাসার ভেতরে রেখে দরজা বাইরে রেখে তালা দিয়ে দেন, যেন পুলিশ বা কেউ আসলে বুঝতে না পারে এই বাসায় কেউ আছে। সারারাত লাইট বন্ধ করে আমরা তালাবদ্ধ বাসায় ছিলাম, সকালে উনি আবার তালা খুলে দিলে আমরা বের হয়ে যাই বাসা থেকে। এভাবে দিনের পর দিন ফেরারী জীবন কাটাতে হয়েছে, রাস্তায় বের হবার আগে মোবাইলের সব ছবি ভিডিও ডিলেট করে, সোশ্যাল মিডিয়া এপগুলো আনইন্সটল করে বের হতে হতো, কারণ রাস্তায় পুলিশ মোবাইল চেক করতো। প্রতিদিন জুতার নিচে আইডি কার্ড লুকিয়ে বাসা থেকে বের হতাম, এলাকার গলিতে ছাত্রলীগ রাস্তায় পুলিশ চেক করতো, যেন শিক্ষার্থী হওয়াটা ছিলো অপরাধ। যেখানে কর্মসূচি সেখানে গিয়ে জুতার নিচ থেকে আইডি কার্ড বের করে গলায় পড়তাম।

এতো কিছুর পরেও, এতো আহত-নিহত-গ্রেফতার-নির্যাতনের পরেও শিক্ষার্থীরা রাজপথ ছাড়ে নি, দমানো যায় নি। আগে একটা কথা প্রচলিত ছিলো যে, “একটা গুলি করলে এলাকা খালি”। এই বিষয়টি এই আন্দোলনে একদম ভুল প্রমাণিত করেছে ছাত্র জনতা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পুলিশের একজন কর্মতার বলা “গুলি করি। মরে একটা। একটাই যায়, স্যার। বাকিডি যায় না। এটাই স্যার সবচে বড় আতঙ্কের।” ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিলো। অবস্থা এমন ছিলো যে, আমার পাশের ছেলের গুলি লেগেছে কিন্তু আমার লাগে নাই, কারণ আমার ভাগ্য ভালো। এমন অবস্থায়ও আমরা পালিয়ে যাই নি, মাঠ ছাড়ি নি, ফাইট দিয়েছি। যে গুলি খাচ্ছে, আহত হচ্ছে তাকে আরো ২/৩ জনকে দিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়ে, আমরা বাকিরা ঠিকই আমাদের অবস্থানে অটল ছিলাম। আমাদের একজন শহীদ হয়েছে, পতাকায় মোড়ানো তার লাশ আমাদের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার জন্য খারাপ লেগেছে, কিন্তু আমরা ভয় পাই নি, আমরা পিছিয়ে যাই নি, এই অবস্থায় থেকেও আমরা সামনের দিকে এগিয়েছি। আমাদের এই মনোবল, এই হার না মানা মনোভাবের কারণেই আমরা জয়ী হয়েছি। আমরা যারা এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছি, আমরাই হয়তো শুধু বুঝতে পারবো যে তখন আমাদের বুকে কি ঝড় ছিলো। এই দিনগুলো আমরা কখনো ভুলতে পারবো না।

প্রতিদিন সন্ধায় সারাদেশের সমন্বয়কদের মিটিং, তারপর সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মিটিং, তারপর নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের মিটিং, এভাবে আমরা নিজেদের প্রতিদিনের কর্মসূচির আপডেট ও পরবর্তীদিনের কর্মসূচি ঠিক করতাম। ধারাবাহিকভাবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত এই আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, প্রতিদিনের কথা লিখতে গেলে হয়তো একটা বই লেখা হয়ে যাবে।

অবশেষে ৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতন হলো। যে ভাইদের, যে সহযোদ্ধাদের এই স্বৈরাচারের কারণে হারিয়েছি তাঁদের জন্য বুক ভাঙ্গা কান্না এলো। ঘুম, খাওয়াদাওয়া বাদ দিয়ে দিনের পর দিন এক কাপড়ে কাটিয়েছি। এই মুক্তির পর ভালো করে একবেলা খাওয়া, ভালো করে একটা গোসল, ভালো একটা ঘুম এরকম ক্ষুদ্র ইচ্ছেও কারো হতে পারে? আমার হয়েছিলো!

৫ আগস্টেই যে আমরা চূড়ান্ত মুক্তি অর্জন করেছি, সেটি ভাবা ভুল হবে, এটি ছিলো প্রাথমিক অর্জন। ৫ আগস্ট পরবর্তীতে সরকার বিহীন একটা দেশ, বিভিন্ন নৈরাজ্য, সেখানে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রদান থেকে শুরু করে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ট্রাফিকের ভূমিকা, পরবর্তীতে বন্যায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো সহ যে প্রত্যাশায় এই গণ অভ্যুত্থান হয়েছিলো, একটি সোনার বাংলাদেশ গড়ার কাজে অভ্যুত্থানের স্পিরিট বুকে নিয়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র, শঙ্কা মোকাবেলা করে এখন পর্যন্ত আমাদের কাজ করে যেতেই হচ্ছে চূড়ান্ত মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে।

৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করলেও ‘ইতিহাস’ নিজেই যদি মূল্যায়নে বিচারকের ভূমিকায় থাকে তাহলে ইতিহাসের পাতা থেকে শত চেষ্টা করেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান মুছে ফেলা যাবে না।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

Please Share This Post in Your Social Media


জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা

Update Time : ০২:০২:২০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪

মোঃ মুশফিকুর রহমান (তুহিন):

বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বেশিদিনের নয়। ১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি) যাত্রা শুরু করে। সরকার ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন চালু করলে আইইউবিএটি উক্ত আইনে নিবন্ধিত হয়। অর্থাৎ নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পরে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বয়স ৩৪ বছরের কম। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের যে গৌরবোজ্জ্বল অতীত (ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান), সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা না থাকাটাই স্বাভাবিক, যেহেতু তখন দেশে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো না। নিকট অতীতে ২০১৫ সালে ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সহ বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকলেও ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান সন্দেহাতীতভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

২০২৪ সালে সরকারি চাকরিতে যৌক্তিক কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়ে সেটা পরবর্তীতে স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে রূপ নেয়। আমরা যদি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে নজর দেই, গ্র্যাজুয়েশনের পর হয়তো পরিস্থিতির কারণে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে চিন্তাও করে না যে সে সরকারি চাকরিতে যোগ দিবে। এখানকার বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বিদেশমুখী এবং বেসরকারি চাকরি করতে কিংবা উদ্যোক্তা হতেই বেশি আগ্রহী। যেখানে সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়ার আগ্রহ খুবই কম, সেখানে কোটা সংস্কার আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এভাবে রাস্তায় নামবে, আন্দোলনের অন্যতম মেরুদণ্ড হয়ে আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সেটা সরকারেরও সিলেবাসের বাইরে ছিলো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলো নিঃস্বার্থভাবে দেশের প্রয়োজনে, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ভাই বোনদের প্রতি সহমর্মী হয়ে।

২০১৮ সালে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পর জুলাইয়ের শুরুতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দোলন পুণরায় শুরু হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্ন জায়গায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দেয়, আমি নিজেও ৭ জুলাই শাহবাগে গিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু সংগঠিত হয়ে সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানারে প্রথম ১০ জুলাই শিক্ষার্থীরা রামপুরায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দেয়। যেখানে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, গ্রিন ইউনিভার্সিটি ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা সহ অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে এই আন্দোলন চলতে থাকে। শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যোগ দিয়েছিলো, ৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতন পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে নিয়েছিলো। এই আন্দোলনে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান কম নয়, কাউকে বাদ দিয়ে কেউকে কৃতিত্ব দেয়াটা একদমই সমীচিন হবে না। নিজের জানার সীমাবদ্ধতা থাকায় সবার নাম এই লেখায় উল্লেখ করতে পারছিনা বলে দুঃখ প্রকাশ করছি।

১৫ জুলাই থেকে বড় আকারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে আন্দোলন শুরু হয়। ১৫ জুলাই সকাল ১০ টায় ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ) ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা নতুন বাজারে অবস্থিত আমেরিকান দূতাবাসের সামনের মূল সড়ক অবরোধ করে। পরবর্তীতে তাদের সাথে ইউনিভার্সিটি অফ ইনফরমেশন টেকনোলজি এন্ড সাইন্স (ইউআইটিএস) সহ আশেপাশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালের শিক্ষার্থীরা যোগ দেয়। একই দিনে রামপুরায় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা, যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (এআইইউবি) ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে। ফলে সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এই সড়ক কার্যত অচল হয়ে যায়।১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর আওয়ামীলীগ সরকারের সন্ত্রাসী ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা করে। বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের উপর ন্যাক্কারজনক হামলার ছবি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলস্বরুপ ১৬ জুলাই সারাদেশের শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং সারাদেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে যায়।

সন্ত্রাসী ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের উপরেও হামলা করে। ১৬ জুলাই নতুন বাজার থেকে ইউআইইউ যাওয়ার যে রাস্তা সেখানে প্রতিটি মোড়ে মোড়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সকাল থেকে অবস্থান নেয়। বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে গমনকারী শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ড চেক করে হেনস্তা ও মারধর করে। এমনকি শিক্ষার্থীরা রিকশা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাওয়ার সময় তাদের রিকশা আটকে ব্যাগের ভেতর আইডি কার্ড আছে কি না তা চেক করে, এবং আইডি কার্ড পেলে মারধর করে। একইসময় সন্ত্রাসীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল বাসেও হামলা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে জমায়েত হয়ে মিছিল নিয়ে নতুন বাজারের দিকে যাওয়ার সময় সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের মিছিলে হামলা করে এবং ধাওয়া পালটা ধাওয়া হয়, পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। সেখানে ইউআইইউ এর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরাও ছিলো। শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে গিয়ে নতুন বাজারের রাস্তা অবরোধ করে। পূর্বের দিনের মতোই অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রামপুরা ও যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের রাস্তা দখলে রাখে। সেদিন উত্তরায় নর্দান ইউনিভার্সিটি, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি ও উত্তরা ইউনিভার্সিটি সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে। অর্থাৎ উত্তরা থেকে রামপুরা এই পুরো অঞ্চলটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দখলে ছিলো। পাশাপাশি ধানমন্ডিতে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) সহ রাজধানীর অন্যান্য জায়গায় অন্যসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো।

১৬ জুলাই শিক্ষার্থীদের নতুন বাজারে প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে যাওয়া ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা রাতে সাতারকুলে শিক্ষার্থীদের মেসে হামলা চালায়, দরজা ভেঙে রুমে প্রবেশ করে শিক্ষার্থীদের মারধর করে স্টুডেন্ট আইডি কার্ড জোরপূর্বক নিয়ে যায়।

১৭ জুলাই (১০ মহরম) দেশে আশুরা পালিত হওয়ায় সেদিন কোনো কর্মসূচি ছিলো না। কিন্তু ১৭ জুলাই রাতে পুলিশ, বিজিবি সহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী যৌথ বাহিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একত্রে হামলা চালায়, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে দেয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো খালি করার পর সরকার ভেবেছিলো এই আন্দোলন এখানেই শেষ! কিন্তু পরের দিন ১৮ জুলাই সবাইকে অবাক করে দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় নামে।

১৮ জুলাই আমরা যখন মিছিল নিয়ে নতুন বাজার অভিমুখে যাচ্ছিলাম তখন আমাদের নিকট খবর আসে, রামপুরায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে পুলিশ হামলা করেছে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির পাশে দাড়াতে আমরা এই এলাকার সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের (নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অফ ইনফরমেশন টেকনোলজি এন্ড সাইন্স সহ অন্যান্য) হাজার হাজার শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে রামপুরার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। মধ্যবাড্ডায় পুলিশ মিছিলে গুলিবর্ষণ শুরু করে।

পুলিশ বিনা উস্কানিতে শিক্ষার্থীদের উপর রামপুরা, উত্তরা সহ বিভিন্ন জায়গায় নির্বিচারে গুলি করে। শত শত শিক্ষার্থী আহত হয়, অনেকে নিজের বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দেয়, কিন্তু কেউ পালিয়ে যায় নি, রাস্তা দখলে রেখেছে, বিশাল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। মধ্যবাড্ডায় আমাদের ইউআইইউ এর শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। চোখের সামনে শত শত আহত শিক্ষার্থী, চোখের সামনে ইম্পেরিয়াল কলেজের এক শিক্ষার্থী শহীদ হয় পুলিশের গুলিতে। রামপুরায় পুলিশের গুলি পর্যন্ত শেষ হয়ে যায়, এতো বেশি হিংস্র ও আক্রমণাত্মক ছিলো পুলিশ। গুলি শেষ হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ছাদে আশ্রয় নেয়। যে পুলিশ ১০ মিনিট আগে আমাদের বুকে গুলি করেছে সে পুলিশ গুলি শেষ হওয়ার পর আমাদের প্রতিরোধের মুখে ছাদে উঠে ছাদ থেকে আমাদের নিকট হাত জোর করে ক্ষমা চায়, স্যালুট দেয়। তারপর এয়ারফোর্স ও র‍্যাবের দুইটি হেলিকপ্টারে প্রতিবারে ৫/৬ জন করে অবশেষে পুলিশ ছাদ থেকে পালিয়ে যায়। একইভাবে উত্তরা সহ ঢাকার অনেক জায়গায় ঐদিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তুলে, সাথে যোগ দেয় বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। ফলস্বরূপ ১৮ তারিখেই সরকার ঘোষণা দেয় ওরা কোটা সংস্কারের দাবি মেনে নিয়েছে, আজই বসতে চায় শিক্ষার্থীদের সাথে, যদিও শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখান করে। তারপর সরকার সারাদেশে কারফিউ ঘোষণা করে।

তখন পুলিশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গণগ্রেফতার ও নির্যাতন চালায়। প্রতিটি মহল্লায় মহল্লায় গিয়ে ব্লক রেইড দিয়ে শিক্ষার্থীদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে সবচেয়ে বেশি অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে গুলশান বিভাগের তিনটি থানায়। এই বিভাগে শুধু বাড্ডা থানাতে ১১টি মামলার প্রতিটিতে সর্বনিম্ন ৩ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। গুলশান থানায় ৬টি মামলার প্রতিটিতে সর্বনিম্ন ৪ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৭ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। ভাটারা থানায় ৪টি মামলায় সর্বনিম্ন ৩ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১২ হাজার জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। উল্লেখ্য এই তিনটি থানার আওতায় সবচেয়ে বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় (ইস্ট ওয়েস্ট, ব্রাক, নর্থ সাউথ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল, প্রাইম এশিয়া, ইউনিভার্সিটি অফ ইনফরমেশন টেকনোলজি এন্ড সাইন্স সহ অন্যান্য) অবস্থিত। শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার করে নিয়ে রিমান্ডেও নির্যাতন করা হয়েছে। আমরা গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে থাকতাম, রাত্রে বাসায় থাকতে পারতাম না। বাসায় পুলিশ এসে ঘুরে যেত। একদিন আমি আমার নিজের বাসায় গিয়েছিলাম, আমার নিচ তলায় একজন দর্জি থাকতেন। আমরা বাসায় ঢুকার সাথে সাথে উনি আমাদেরকে বাসার ভেতরে রেখে দরজা বাইরে রেখে তালা দিয়ে দেন, যেন পুলিশ বা কেউ আসলে বুঝতে না পারে এই বাসায় কেউ আছে। সারারাত লাইট বন্ধ করে আমরা তালাবদ্ধ বাসায় ছিলাম, সকালে উনি আবার তালা খুলে দিলে আমরা বের হয়ে যাই বাসা থেকে। এভাবে দিনের পর দিন ফেরারী জীবন কাটাতে হয়েছে, রাস্তায় বের হবার আগে মোবাইলের সব ছবি ভিডিও ডিলেট করে, সোশ্যাল মিডিয়া এপগুলো আনইন্সটল করে বের হতে হতো, কারণ রাস্তায় পুলিশ মোবাইল চেক করতো। প্রতিদিন জুতার নিচে আইডি কার্ড লুকিয়ে বাসা থেকে বের হতাম, এলাকার গলিতে ছাত্রলীগ রাস্তায় পুলিশ চেক করতো, যেন শিক্ষার্থী হওয়াটা ছিলো অপরাধ। যেখানে কর্মসূচি সেখানে গিয়ে জুতার নিচ থেকে আইডি কার্ড বের করে গলায় পড়তাম।

এতো কিছুর পরেও, এতো আহত-নিহত-গ্রেফতার-নির্যাতনের পরেও শিক্ষার্থীরা রাজপথ ছাড়ে নি, দমানো যায় নি। আগে একটা কথা প্রচলিত ছিলো যে, “একটা গুলি করলে এলাকা খালি”। এই বিষয়টি এই আন্দোলনে একদম ভুল প্রমাণিত করেছে ছাত্র জনতা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পুলিশের একজন কর্মতার বলা “গুলি করি। মরে একটা। একটাই যায়, স্যার। বাকিডি যায় না। এটাই স্যার সবচে বড় আতঙ্কের।” ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিলো। অবস্থা এমন ছিলো যে, আমার পাশের ছেলের গুলি লেগেছে কিন্তু আমার লাগে নাই, কারণ আমার ভাগ্য ভালো। এমন অবস্থায়ও আমরা পালিয়ে যাই নি, মাঠ ছাড়ি নি, ফাইট দিয়েছি। যে গুলি খাচ্ছে, আহত হচ্ছে তাকে আরো ২/৩ জনকে দিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়ে, আমরা বাকিরা ঠিকই আমাদের অবস্থানে অটল ছিলাম। আমাদের একজন শহীদ হয়েছে, পতাকায় মোড়ানো তার লাশ আমাদের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার জন্য খারাপ লেগেছে, কিন্তু আমরা ভয় পাই নি, আমরা পিছিয়ে যাই নি, এই অবস্থায় থেকেও আমরা সামনের দিকে এগিয়েছি। আমাদের এই মনোবল, এই হার না মানা মনোভাবের কারণেই আমরা জয়ী হয়েছি। আমরা যারা এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছি, আমরাই হয়তো শুধু বুঝতে পারবো যে তখন আমাদের বুকে কি ঝড় ছিলো। এই দিনগুলো আমরা কখনো ভুলতে পারবো না।

প্রতিদিন সন্ধায় সারাদেশের সমন্বয়কদের মিটিং, তারপর সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মিটিং, তারপর নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের মিটিং, এভাবে আমরা নিজেদের প্রতিদিনের কর্মসূচির আপডেট ও পরবর্তীদিনের কর্মসূচি ঠিক করতাম। ধারাবাহিকভাবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত এই আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, প্রতিদিনের কথা লিখতে গেলে হয়তো একটা বই লেখা হয়ে যাবে।

অবশেষে ৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতন হলো। যে ভাইদের, যে সহযোদ্ধাদের এই স্বৈরাচারের কারণে হারিয়েছি তাঁদের জন্য বুক ভাঙ্গা কান্না এলো। ঘুম, খাওয়াদাওয়া বাদ দিয়ে দিনের পর দিন এক কাপড়ে কাটিয়েছি। এই মুক্তির পর ভালো করে একবেলা খাওয়া, ভালো করে একটা গোসল, ভালো একটা ঘুম এরকম ক্ষুদ্র ইচ্ছেও কারো হতে পারে? আমার হয়েছিলো!

৫ আগস্টেই যে আমরা চূড়ান্ত মুক্তি অর্জন করেছি, সেটি ভাবা ভুল হবে, এটি ছিলো প্রাথমিক অর্জন। ৫ আগস্ট পরবর্তীতে সরকার বিহীন একটা দেশ, বিভিন্ন নৈরাজ্য, সেখানে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রদান থেকে শুরু করে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ট্রাফিকের ভূমিকা, পরবর্তীতে বন্যায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো সহ যে প্রত্যাশায় এই গণ অভ্যুত্থান হয়েছিলো, একটি সোনার বাংলাদেশ গড়ার কাজে অভ্যুত্থানের স্পিরিট বুকে নিয়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র, শঙ্কা মোকাবেলা করে এখন পর্যন্ত আমাদের কাজ করে যেতেই হচ্ছে চূড়ান্ত মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে।

৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করলেও ‘ইতিহাস’ নিজেই যদি মূল্যায়নে বিচারকের ভূমিকায় থাকে তাহলে ইতিহাসের পাতা থেকে শত চেষ্টা করেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান মুছে ফেলা যাবে না।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।