পঁচাত্তরে পা রাখছেন শেখ হাসিনা

  • Update Time : ০১:৪২:২৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২১
  • / 199

জাফর ওয়াজেদ:

আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঁচাত্তরে পা রাখছেন, চুয়াত্তর ছাড়িয়ে। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, শোক-দুঃখ, ব্যথা-বেদনার পাশাপাশি দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ ও ভালোবাসার ভেতর দিয়ে চুয়াত্তর বছর পেরিয়ে তিনি পা রাখলেন পঁচাত্তর বছরে। জন্মেছিলেন এই বাংলায় রাজনৈতিক পরিবারে। পিতার আরাধ্য অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে জাতিকে সমৃদ্ধি ও উন্নতির পথে এগিয়ে নিতে ৪১ বছর ধরে নিরলস তিনি শ্রমে, কর্মে, সৃজনে, উত্তরণে। তিনি, শেখ হাসিনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা পিতা বঙ্গবন্ধুর মতোই ‘জীবন্মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ করে এগিয়ে চলেছেন বিশ্বমানবের মুক্তির সাধনায়। আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার জন্মদিন। জাতি কৃতজ্ঞতাচিত্তে প্রার্থনার দু’হাত তুলে দীর্ঘায়ু কামনা করবে। পঁচাত্তর বছর বয়সেও তিনি থাকুন সক্রিয়, সচল এবং কর্মপ্রাণ। থাকুন জাতির আশা-ভরসার স্থল হিসেবে। জয়তু বিশ্বনেত্রী শেখ হাসিনা।

তৃতীয় দফা রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনায় দক্ষতা-কুশলতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন গোটা জাতিকে। তাই নানা ইস্যুতে জাতিও ঐক্যবদ্ধ তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে। পিতার মতোই গভীর দেশপ্রেম ও দুর্জয় সাহস, প্রজ্ঞা, ধৈর্য এবং সব প্রতিক‚লতার সঙ্গে লড়াই করে এগিয়েছেন ক্রমশ সামনে। লক্ষ্য স্থির তাঁর। বাংলার মানুষের সঙ্গে অধিকার আদায়ের জন্য টানা ৩০ বছর পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘপথ। ব্যক্তিগত লোভ-লালসা নিয়ে নয়, রাজনীতি করেন জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে। দুঃখী মানুষের মুখে তিনিও চান হাসি ফোটাতে এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে।

তিনি, শেখ হাসিনা, যাঁর একচল্লিশ বছরের (সক্রিয়ভাবে) রাজনীতিক জীবনজুড়ে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধময় ঝড়ো হাওয়ার মোকাবিলা, ঘাতকের হত্যা প্রচেষ্টা, চক্রান্ত, নির্যাতন, জেল-জুলুম সয়ে যেতে হয়েছে। পুরো জীবনই তাঁর নিবেদিত বাঙালি ও এই বাংলার মানুষের জন্য। আর এজন্য তাঁকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে বহুবার। পিতা-মাতাসহ পরিবারের সদস্যদের নৃশংস হত্যার পর ঘাতকচক্র তাঁকেও বিনাশে কতশত অপচেষ্টা ও চক্রান্তই না চালিয়ে যাচ্ছে আজও। কিন্তু তিনি রয়েছেন এই বাংলার মানুষের অন্তরজুড়ে। বয়সি মানুষের কাছে তিনি তো আজও ‘শেখের বেটি’।

কত গভীর মমত্ববোধে মানুষ তাঁকে আপ্লুত করে, শুভাশিস জানায়। বাস্তবে তিনি রাজনীতিক থেকে ক্রমান্বয়ে পরিণত হয়েছেন স্টেটসম্যানশিপে। ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’- এর মতোই বিশ্বজুড়ে এই একুশ শতকে বাংলাদেশ পরিচিত হচ্ছে ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’ হিসেবেই। বাঙালির সহস্র বছরের সাধনাকে পাথেয় করে বাঙালি জাতিসত্তার আসন বিশ্বদরবারে উঁচু রাখার সর্বসাধ্য প্রচেষ্টা বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনার। তাই মানবসম্পদকে জনশক্তিতে রূপান্তর ঘটাতে সচেষ্ট তিনি। বাংলার সম্পদকে রক্ষা ও কাজে ব্যবহৃত করে উন্নত দেশ ও জাতিতে উন্নীত করায় শেখ হাসিনা তাঁর স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন দীপ্ত আলোক মশাল হাতে। তাঁর দেশপ্রেম, সাহস, দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার কোনো তুলনা নেই। বাংলায় গণতন্ত্র ও গণ-অধিকার রক্ষার লাগাতার সংগ্রামের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নেত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ। তাঁকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি অচল। এই সত্যটি এদেশের গণতন্ত্রের শত্রুরাও জানে।

আমাদের স্মরণে আসে, প্রায় ৪১ বছর আগের এক ঐতিহাসিক দিন। ১৯৮১ সালের ১৭ মের দৃশ্যপট। দখলদার জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ফিরে এলেন বাংলার ইতিহাসের ট্র্যাজেডি কন্যা শেখ হাসিনা নিজ মাতৃভূমিতে। যেখানে জন্মেছেন তিনি ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার দেড় মাসের মাথায়। আর জন্মেই দেখেছেন ‘ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি’। সেদিন লাখ লাখ মানুষ তাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীকে বরণ করে নিতে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরের সামনে উন্মুখ। পুরো শহর পরিণত জনসমুদ্রে। তিনি এলেন সেই ভূমিতে, যেখানে নির্মম নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। হত্যাকারী ও তাদের বশংবদরা দখলে রেখেছে রাষ্ট্র ও ক্ষমতা।

তিনি ফিরে এলেন দীর্ঘ নির্বাসন শেষে। যেমন এসেছিলেন পিতা। নেতাকর্মী ও জনতার আবেগে সিক্ত হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাংলার মাটিতে নেমে বলেছিলেন স্বজনহারা শেখ হাসিনা, ‘আমার হারাবার আর কিছু নেই। বাবা-মা-ভাই, আত্মীয়স্বজন সবাইকে হারিয়ে আজ আমি নিঃস্ব। আমি আপনাদের কাছে শপথ করছি, আমার দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য জীবনের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করে যাব।’ জানা ছিল তাঁর, এই লড়াইয়ের পথে পথে শ্বাপদসংকুল পথ, পদে পদে বাধাবিপত্তি, নিষেধাজ্ঞা, শাসন-ত্রাসন, জেল-জুলুম শুধু নয়- জীবনও হতে পারে বিপন্ন। তবু এই শপথের আলোয় আলোকিত হয়ে তিনি একচল্লিশ বছর ধরে এসব মোকাবিলা করে, এখনো সক্রিয় মানবমুক্তির লড়াই-সংগ্রামে। মানুষের জন্য, মানবতার জন্য নিরলস প্রয়াস তাঁকে জননেত্রীতে পরিণত করেছে।

ঘাতকের অস্ত্র বহুবার আঘাত হেনেছে, সহকর্মীরা খুন হয়েছেন, মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এসেছেন। কিন্তু দমে যাননি। বরং ‘জীবন মরণ পায়ের চরণ’ করে আরও উদ্দীপনায় মানুষের পাশে থেকে মানুষের উত্থানে এখনো সব তুচ্ছজ্ঞানে এগিয়ে যাচ্ছেন। যেমন এগিয়েছিলেন তাঁর পিতা। গ্রেনেড হামলা চালিয়ে প্রকাশ্য জনসভায় হত্যা করার চেষ্টাও হয়েছে। নির্জন সেলে বন্দি করে মধ্যযুগীয় প্রথায় বিষ খাইয়ে মারার অপচেষ্টাও হয়েছে। দেশ থেকে, রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করার কঠোর কঠিন দমনপীড়ন, নির্যাতনও চলেছে। কিন্তু কিছুই টলাতে পারেনি। নিজের আত্মবিশ্বাস ও বাংলার মানুষের বিশাল সমর্থন নিয়ে অন্ধ প্রকোষ্ঠে থেকেও দৃঢ়তার সঙ্গে সবকিছু মোকাবিলা করেছেন। সাহস তাঁকে দিয়েছে প্রেরণা। জুগিয়েছে অজস্র উদ্দীপনা। নতজানু না হওয়ার মন্ত্র তো তাঁর আজন্ম। আপসহীন দৃঢ়তায় তিনি সব ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেছেন।

দেশের মাটিতে একচল্লিশ বছর আগে ফিরে যে শপথ উচ্চারণ করেছিলেন শোকাতুর কণ্ঠে, সে শপথ থেকে চ্যুত করার সব ষড়যন্ত্র, প্রতিরোধ মোকাবিলা করেছেন। শোককে পরিণত করেছেন শক্তিতে। দৃঢ়তা, একাগ্রতা, সাহস, নিষ্ঠা, মানবতা, নৈতিকতা, দূরদর্শিতাÑসবকিছুকেই তিনি সমন্বিত করেছেন নিজস্ব চেতনায়। আর সেই চেতনার আলোকরশ্মি ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। গৌরবের মশাল বহন করে তিনি এগিয়ে চলেছেন বিশ্বের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে। বিশ্বমানবতাকে তাই বারবার আহ্বান করে আসছেন, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়তে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে চান শান্তি। হিংসা, হানাহানি নয়, সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠুক মানুষের মধ্যে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায় মানবতার মহত্তকে এগিয়ে নিতে। আর এই সবকিছু শেখ হাসিনাকে পরিণত করেছে স্টেটসম্যানশিপে। মৃত্যুভীতি তাঁকে আর তাড়া করে না। বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি, বলা যায়- মরণের পর গত একচল্লিশ বছরে কতবারই ফিরে এসেছেন।

সেই ১৯৮১ সালে পিতার প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনকারী দল আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর শেখ হাসিনা ‘নিউজ উইক’ পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সরকারের শক্তিকে পরোয়া করি না, মৃত্যুকেও না। জীবন তো একটাই, একজীবনেই ঝুঁকি নিতে হবে। মৃত্যুকে ভয় করলে জীবনের কোনো মর্যাদা থাকে না। সমগ্র জাতির পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারই হবে আমার অন্যতম অগ্রাধিকার। আমার বাবার প্রতি দেশের জনগণের প্রচণ্ড ভালোবাসা ও মমতা রয়েছে। জাতির জন্য তাঁর যে স্বপ্ন, তা আমি পূরণ করব।’ চলেছেনও তিনি সেই পথেই। যে পথে আছে বাঙালির মুক্তি মানবতাবোধ, দেশপ্রেম ও সাহসী নেতৃত্বের জন্য বাংলার দুঃখী মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।

মৃত্যুশোক জননেত্রীর জন্য শুধু অশ্রুর মালাখানি, সংখ্যাহীন গৃহীর ঘরে প্রতিদিন যেমন সে গাঁথে। মৃত্যু তাঁকে উত্তীর্ণ করে দিয়েছে চেতনার এক স্তরে। দুঃসাধ্য চেষ্টার ভেতর দিয়েই তিনি অন্ধকার থেকে আলোকে উত্তীর্ণ হন। মৃত্যুর দুয়ার দিয়ে তিনি যেন নবজন্মে প্রবেশ করেছেন। পৃথিবীকে যখন প্রথমবার আলোর মতো লাভ করে মানবশিশু। সেটা শিশুর আলোকপ্রাপ্তির মতো। তাতে কোনো কঠিন সাধনার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মৃত্যুশোক অতিক্রম করে বিশ্ব যদি আবারও ব্যক্তির দৃষ্টিতে ‘আলোয় আলোকময়’ হয়, তবে সেটা সাধনালব্ধ ধন। মৃত্যু অন্য এক শিক্ষা দেয়। শেখ হাসিনা সেই আলোকময় বিশ্বের জন্য নিরলস প্রয়াসে ব্যাপ্ত। দেশের মানুষের প্রতি অসীম ভালোবাসার গভীরতায় সর্বস্বত্ব ত্যাগ করে দিয়েছেন। জীবনকে উৎসর্গ করেছেন দেশ মাটি ও মানুষের জন্য। অথচ তাঁরই দেশপ্রেম নিয়ে কটাক্ষ করা হয়। করে যারা, তাদের অতীত তো কলুষময়। তাই এসব কলুষতা কখনো স্পর্শ করে না।

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি জনগণকে ভালোবাসি। জনগণ আমাকে ভালোবাসে। আর কি কখনো আমাকে অনিষ্ট করতে পারবে?’- না, জনগণ তা করেনি। বাংলার মানুষ একাত্তর সালের নয় মাস পাকিস্তানি কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রার্থনা করেছে। স্বাধীন বাংলায় বেঁচে থাকা জাতির পিতার দুই কন্যার জন্য বাংলার মানুষ এখনো দুহাত তুলে প্রার্থনা করে তাঁদের মঙ্গল, কল্যাণ ও দীর্ঘায়ুর জন্য। ষাটতম জন্মদিন শেখ হাসিনাকে পালন করতে হয়েছে কারান্তরালে। পিতার মতোই জেল-জুলুম মেনে নিয়েছেন। বুদ্ধিবৃত্তিজীবীরাও বলেন, ‘পিতার আরাধ্য কাজ শেষ করার দায় তো ইতিহাস তাঁর কাঁধেই চাপিয়েছে। একবার বঙ্গবন্ধুর জাদুকরী নেতৃত্বে বাঙালি তার অভ্যাসের গণ্ডি ভেঙে জাতি হিসেবে বড়ো হয়ে উঠেছিল এবং সেই জোরে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল।

এবার অচলায়তন ভেঙে সামনে এগোতে হলে, সম্মান নিয়ে বাঁচতে হলে আবারও বাঙালিকে সব ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা ও স্বার্থের গণ্ডি ভেঙে বড়ো হয়ে উঠতে হবে। সেই কাজে কে আর নেতৃত্ব দেবে? বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ছাড়া?’ বাঙালি জাতির দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে নতুন যুগের নতুন রাজনীতির মন্ত্রে নতুন প্রজন্মের বাঙালিকে জাগিয়ে আবারও ঐক্য, ত্যাগ ও কর্মের বাতাবরণ তৈরি করে বাঙালিকে বড়ো করে তোলার যে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, তা বাস্তবায়নে বাংলার মানুষই সমর্থন জোগাবে। বলেছেনও শেখ হাসিনা, বক্তিগত লোভ-লালসার রাজনীতি তিনি করেন না।

চার দশকের ইতিহাস তো এই সত্যতা প্রমাণ করে দেশ ও জাতির উন্নতি ও অগ্রগতি ছাড়া আর কোনো কিছুতেই মোহ নেই। তাই দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে দেশকে অভিশাপমুক্ত করেছেন তিনি। বাঙালি জনগোষ্ঠীর মনোজগতে শেখ হাসিনা এক নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটিয়েছেন। একুশ শতকের বাংলা গড়তে চান তিনি। এই বাংলা গড়ার মাধ্যমেই তিনি জবাব দেবেন বঙ্গবন্ধু হত্যার। জানেন তিনি, এই কাজে পদে পদে পেরুতে হবে বাধাবিপত্তি। তিনি যে তাতে সফল হবেন, তাঁর কর্মকাণ্ড সেই জানান দেয়। জনগণের ভালোবাসা এবং সমর্থন নিয়ে গণতান্ত্রিক সমৃদ্ধ দেশ গড়ার কাজে নিজেকে ব্রত করেছেন।

বিশ্বনেত্রী শেখ হাসিনা ইতিহাসকন্যা। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা অধ্যায় দেখেছেন। অনেক অত্যাচার-নির্যাতন সয়েছেন সপরিবারে। সেই ইতিহাস এক রাজনৈতিক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ইতিহাস। তাঁর বাল্যকাল ও তারুণ্য কেটেছে সামরিক শাসনে। বাঙালিরা স্বভাবজাত সামরিকতন্ত্রের বিরোধী। ১৯৫৮ সাল থেকে সামরিক শাসন, রাজনৈতিক নেতাদের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন যেমন দেখেছেন, তেমনই স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক জান্তার একই আচরণ দেখেছেন। এমনকি দুর্বিষহ নিপীড়নও ভোগ করেছেন। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলের দীর্ঘ সামরিক শাসন থেকে দেশকে গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য যে নিরলস সাধনা, সেখানে কোনো আপস নেই। নির্বাচনকে তিনি আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবেও একসময় বেছে নিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক পরিবারে জন্ম বলে ধর্ম কখনো বাধা হয়ে থাকেনি সব মানুষের সঙ্গে মেশার ক্ষেত্রে।

তিনি, মহীয়সী শেখ হাসিনা, যাঁকে গত একচল্লিশ বছরে প্রায় প্রতিদিনই মুখোমুখি হতে হয়েছে পিতৃ-মাতৃ-ভ্রাতৃ স্বজনহারা শোকাতুর মানুষের। নিজের শোককে শক্তিতে পরিণত করে শোকাতুর মানুষকে বুকে জড়িয়ে যে সান্ত্বনা তিনি মেলেছেন, স্পন্দিত হয় তাদেরও বক্ষে শক্তিমত্তা। আর সেই শক্তিতে বলীয়ান হয়ে জাগরুক হয়ে উঠুক মানুষ আবার। যেমন তিনি দাঁড়িয়েছেন নিজের পুরো জীবনকে মানুষের জন্য উৎসর্গ করে, মানুষেরই পাশে।

‘স্মৃতি বড়ো মধুর, স্মৃতি বড়ো বেদনার’- বলেছেন শেখ হাসিনা এক স্মৃতিচারণে। দুঃখ-সুখে গড়া জীবনে বেড়ে ওঠা তাঁর। উপলব্ধি করেন, বাঙালি জাতির জাগতিক উত্থান ও বিকাশের প্রয়োজন। বিস্মৃতি স্পর্শ করে না বলে সবকিছু গোছানো। ভাষণে-বক্তৃতায় ধারাবাহিকতায় তুলে আনেন সত্য ইতিহাসের সোনালি-রুপালি এবং ট্র্যাজিক ইতিহাস। এটা তো সত্য, ট্র্যাজেডির জীবন তাঁর। আমাদের সমকালে, তিনিই একমাত্র রাজনৈতিক, যাঁকে হারাতে হয়েছে সব। আর তাঁর এই হারানো আসলে পুরো জাতির জন্যই হারানো। বাঙালির জীবনে একমাত্র ট্র্যাজেডি পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের নৃশংসতা। ট্র্যাজেডির কন্যা তিনি। পিতৃহন্তারকরা চেয়েছে তাঁর বিনাশ। প্রাণনাশের কতশত আয়োজন হয়েছে। স্বয়ং রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকেও তাঁর প্রাণ হরণের চেষ্টা চলেছে। হত্যার অপচেষ্টা চলে আসছে সেই ’৮১ সাল থেকে দেশে ফেরার পর থেকে।

শেখ হাসিনা পিতা বঙ্গবন্ধুর মতোই ‘জীবন্মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ করে এগিয়ে চলেছেন বিশ্বমানবের মুক্তির সাধনায়। আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার জন্মদিন। জাতি কৃতজ্ঞতাচিত্তে প্রার্থনার দু’হাত তুলে দীর্ঘায়ু কামনা করবে। পঁচাত্তর বছর বয়সেও তিনি থাকুন সক্রিয়, সচল এবং কর্মপ্রাণ। থাকুন জাতির আশা-ভরসার স্থল হিসেবে। জয়তু বিশ্বনেত্রী শেখ হাসিনা।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।

Please Share This Post in Your Social Media


পঁচাত্তরে পা রাখছেন শেখ হাসিনা

Update Time : ০১:৪২:২৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২১

জাফর ওয়াজেদ:

আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঁচাত্তরে পা রাখছেন, চুয়াত্তর ছাড়িয়ে। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, শোক-দুঃখ, ব্যথা-বেদনার পাশাপাশি দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ ও ভালোবাসার ভেতর দিয়ে চুয়াত্তর বছর পেরিয়ে তিনি পা রাখলেন পঁচাত্তর বছরে। জন্মেছিলেন এই বাংলায় রাজনৈতিক পরিবারে। পিতার আরাধ্য অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে জাতিকে সমৃদ্ধি ও উন্নতির পথে এগিয়ে নিতে ৪১ বছর ধরে নিরলস তিনি শ্রমে, কর্মে, সৃজনে, উত্তরণে। তিনি, শেখ হাসিনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা পিতা বঙ্গবন্ধুর মতোই ‘জীবন্মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ করে এগিয়ে চলেছেন বিশ্বমানবের মুক্তির সাধনায়। আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার জন্মদিন। জাতি কৃতজ্ঞতাচিত্তে প্রার্থনার দু’হাত তুলে দীর্ঘায়ু কামনা করবে। পঁচাত্তর বছর বয়সেও তিনি থাকুন সক্রিয়, সচল এবং কর্মপ্রাণ। থাকুন জাতির আশা-ভরসার স্থল হিসেবে। জয়তু বিশ্বনেত্রী শেখ হাসিনা।

তৃতীয় দফা রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনায় দক্ষতা-কুশলতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন গোটা জাতিকে। তাই নানা ইস্যুতে জাতিও ঐক্যবদ্ধ তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে। পিতার মতোই গভীর দেশপ্রেম ও দুর্জয় সাহস, প্রজ্ঞা, ধৈর্য এবং সব প্রতিক‚লতার সঙ্গে লড়াই করে এগিয়েছেন ক্রমশ সামনে। লক্ষ্য স্থির তাঁর। বাংলার মানুষের সঙ্গে অধিকার আদায়ের জন্য টানা ৩০ বছর পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘপথ। ব্যক্তিগত লোভ-লালসা নিয়ে নয়, রাজনীতি করেন জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে। দুঃখী মানুষের মুখে তিনিও চান হাসি ফোটাতে এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে।

তিনি, শেখ হাসিনা, যাঁর একচল্লিশ বছরের (সক্রিয়ভাবে) রাজনীতিক জীবনজুড়ে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধময় ঝড়ো হাওয়ার মোকাবিলা, ঘাতকের হত্যা প্রচেষ্টা, চক্রান্ত, নির্যাতন, জেল-জুলুম সয়ে যেতে হয়েছে। পুরো জীবনই তাঁর নিবেদিত বাঙালি ও এই বাংলার মানুষের জন্য। আর এজন্য তাঁকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে বহুবার। পিতা-মাতাসহ পরিবারের সদস্যদের নৃশংস হত্যার পর ঘাতকচক্র তাঁকেও বিনাশে কতশত অপচেষ্টা ও চক্রান্তই না চালিয়ে যাচ্ছে আজও। কিন্তু তিনি রয়েছেন এই বাংলার মানুষের অন্তরজুড়ে। বয়সি মানুষের কাছে তিনি তো আজও ‘শেখের বেটি’।

কত গভীর মমত্ববোধে মানুষ তাঁকে আপ্লুত করে, শুভাশিস জানায়। বাস্তবে তিনি রাজনীতিক থেকে ক্রমান্বয়ে পরিণত হয়েছেন স্টেটসম্যানশিপে। ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’- এর মতোই বিশ্বজুড়ে এই একুশ শতকে বাংলাদেশ পরিচিত হচ্ছে ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’ হিসেবেই। বাঙালির সহস্র বছরের সাধনাকে পাথেয় করে বাঙালি জাতিসত্তার আসন বিশ্বদরবারে উঁচু রাখার সর্বসাধ্য প্রচেষ্টা বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনার। তাই মানবসম্পদকে জনশক্তিতে রূপান্তর ঘটাতে সচেষ্ট তিনি। বাংলার সম্পদকে রক্ষা ও কাজে ব্যবহৃত করে উন্নত দেশ ও জাতিতে উন্নীত করায় শেখ হাসিনা তাঁর স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন দীপ্ত আলোক মশাল হাতে। তাঁর দেশপ্রেম, সাহস, দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার কোনো তুলনা নেই। বাংলায় গণতন্ত্র ও গণ-অধিকার রক্ষার লাগাতার সংগ্রামের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নেত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ। তাঁকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি অচল। এই সত্যটি এদেশের গণতন্ত্রের শত্রুরাও জানে।

আমাদের স্মরণে আসে, প্রায় ৪১ বছর আগের এক ঐতিহাসিক দিন। ১৯৮১ সালের ১৭ মের দৃশ্যপট। দখলদার জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ফিরে এলেন বাংলার ইতিহাসের ট্র্যাজেডি কন্যা শেখ হাসিনা নিজ মাতৃভূমিতে। যেখানে জন্মেছেন তিনি ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার দেড় মাসের মাথায়। আর জন্মেই দেখেছেন ‘ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি’। সেদিন লাখ লাখ মানুষ তাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীকে বরণ করে নিতে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরের সামনে উন্মুখ। পুরো শহর পরিণত জনসমুদ্রে। তিনি এলেন সেই ভূমিতে, যেখানে নির্মম নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। হত্যাকারী ও তাদের বশংবদরা দখলে রেখেছে রাষ্ট্র ও ক্ষমতা।

তিনি ফিরে এলেন দীর্ঘ নির্বাসন শেষে। যেমন এসেছিলেন পিতা। নেতাকর্মী ও জনতার আবেগে সিক্ত হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাংলার মাটিতে নেমে বলেছিলেন স্বজনহারা শেখ হাসিনা, ‘আমার হারাবার আর কিছু নেই। বাবা-মা-ভাই, আত্মীয়স্বজন সবাইকে হারিয়ে আজ আমি নিঃস্ব। আমি আপনাদের কাছে শপথ করছি, আমার দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য জীবনের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করে যাব।’ জানা ছিল তাঁর, এই লড়াইয়ের পথে পথে শ্বাপদসংকুল পথ, পদে পদে বাধাবিপত্তি, নিষেধাজ্ঞা, শাসন-ত্রাসন, জেল-জুলুম শুধু নয়- জীবনও হতে পারে বিপন্ন। তবু এই শপথের আলোয় আলোকিত হয়ে তিনি একচল্লিশ বছর ধরে এসব মোকাবিলা করে, এখনো সক্রিয় মানবমুক্তির লড়াই-সংগ্রামে। মানুষের জন্য, মানবতার জন্য নিরলস প্রয়াস তাঁকে জননেত্রীতে পরিণত করেছে।

ঘাতকের অস্ত্র বহুবার আঘাত হেনেছে, সহকর্মীরা খুন হয়েছেন, মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এসেছেন। কিন্তু দমে যাননি। বরং ‘জীবন মরণ পায়ের চরণ’ করে আরও উদ্দীপনায় মানুষের পাশে থেকে মানুষের উত্থানে এখনো সব তুচ্ছজ্ঞানে এগিয়ে যাচ্ছেন। যেমন এগিয়েছিলেন তাঁর পিতা। গ্রেনেড হামলা চালিয়ে প্রকাশ্য জনসভায় হত্যা করার চেষ্টাও হয়েছে। নির্জন সেলে বন্দি করে মধ্যযুগীয় প্রথায় বিষ খাইয়ে মারার অপচেষ্টাও হয়েছে। দেশ থেকে, রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করার কঠোর কঠিন দমনপীড়ন, নির্যাতনও চলেছে। কিন্তু কিছুই টলাতে পারেনি। নিজের আত্মবিশ্বাস ও বাংলার মানুষের বিশাল সমর্থন নিয়ে অন্ধ প্রকোষ্ঠে থেকেও দৃঢ়তার সঙ্গে সবকিছু মোকাবিলা করেছেন। সাহস তাঁকে দিয়েছে প্রেরণা। জুগিয়েছে অজস্র উদ্দীপনা। নতজানু না হওয়ার মন্ত্র তো তাঁর আজন্ম। আপসহীন দৃঢ়তায় তিনি সব ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেছেন।

দেশের মাটিতে একচল্লিশ বছর আগে ফিরে যে শপথ উচ্চারণ করেছিলেন শোকাতুর কণ্ঠে, সে শপথ থেকে চ্যুত করার সব ষড়যন্ত্র, প্রতিরোধ মোকাবিলা করেছেন। শোককে পরিণত করেছেন শক্তিতে। দৃঢ়তা, একাগ্রতা, সাহস, নিষ্ঠা, মানবতা, নৈতিকতা, দূরদর্শিতাÑসবকিছুকেই তিনি সমন্বিত করেছেন নিজস্ব চেতনায়। আর সেই চেতনার আলোকরশ্মি ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। গৌরবের মশাল বহন করে তিনি এগিয়ে চলেছেন বিশ্বের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে। বিশ্বমানবতাকে তাই বারবার আহ্বান করে আসছেন, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়তে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে চান শান্তি। হিংসা, হানাহানি নয়, সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠুক মানুষের মধ্যে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায় মানবতার মহত্তকে এগিয়ে নিতে। আর এই সবকিছু শেখ হাসিনাকে পরিণত করেছে স্টেটসম্যানশিপে। মৃত্যুভীতি তাঁকে আর তাড়া করে না। বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি, বলা যায়- মরণের পর গত একচল্লিশ বছরে কতবারই ফিরে এসেছেন।

সেই ১৯৮১ সালে পিতার প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনকারী দল আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর শেখ হাসিনা ‘নিউজ উইক’ পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সরকারের শক্তিকে পরোয়া করি না, মৃত্যুকেও না। জীবন তো একটাই, একজীবনেই ঝুঁকি নিতে হবে। মৃত্যুকে ভয় করলে জীবনের কোনো মর্যাদা থাকে না। সমগ্র জাতির পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারই হবে আমার অন্যতম অগ্রাধিকার। আমার বাবার প্রতি দেশের জনগণের প্রচণ্ড ভালোবাসা ও মমতা রয়েছে। জাতির জন্য তাঁর যে স্বপ্ন, তা আমি পূরণ করব।’ চলেছেনও তিনি সেই পথেই। যে পথে আছে বাঙালির মুক্তি মানবতাবোধ, দেশপ্রেম ও সাহসী নেতৃত্বের জন্য বাংলার দুঃখী মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।

মৃত্যুশোক জননেত্রীর জন্য শুধু অশ্রুর মালাখানি, সংখ্যাহীন গৃহীর ঘরে প্রতিদিন যেমন সে গাঁথে। মৃত্যু তাঁকে উত্তীর্ণ করে দিয়েছে চেতনার এক স্তরে। দুঃসাধ্য চেষ্টার ভেতর দিয়েই তিনি অন্ধকার থেকে আলোকে উত্তীর্ণ হন। মৃত্যুর দুয়ার দিয়ে তিনি যেন নবজন্মে প্রবেশ করেছেন। পৃথিবীকে যখন প্রথমবার আলোর মতো লাভ করে মানবশিশু। সেটা শিশুর আলোকপ্রাপ্তির মতো। তাতে কোনো কঠিন সাধনার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মৃত্যুশোক অতিক্রম করে বিশ্ব যদি আবারও ব্যক্তির দৃষ্টিতে ‘আলোয় আলোকময়’ হয়, তবে সেটা সাধনালব্ধ ধন। মৃত্যু অন্য এক শিক্ষা দেয়। শেখ হাসিনা সেই আলোকময় বিশ্বের জন্য নিরলস প্রয়াসে ব্যাপ্ত। দেশের মানুষের প্রতি অসীম ভালোবাসার গভীরতায় সর্বস্বত্ব ত্যাগ করে দিয়েছেন। জীবনকে উৎসর্গ করেছেন দেশ মাটি ও মানুষের জন্য। অথচ তাঁরই দেশপ্রেম নিয়ে কটাক্ষ করা হয়। করে যারা, তাদের অতীত তো কলুষময়। তাই এসব কলুষতা কখনো স্পর্শ করে না।

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি জনগণকে ভালোবাসি। জনগণ আমাকে ভালোবাসে। আর কি কখনো আমাকে অনিষ্ট করতে পারবে?’- না, জনগণ তা করেনি। বাংলার মানুষ একাত্তর সালের নয় মাস পাকিস্তানি কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রার্থনা করেছে। স্বাধীন বাংলায় বেঁচে থাকা জাতির পিতার দুই কন্যার জন্য বাংলার মানুষ এখনো দুহাত তুলে প্রার্থনা করে তাঁদের মঙ্গল, কল্যাণ ও দীর্ঘায়ুর জন্য। ষাটতম জন্মদিন শেখ হাসিনাকে পালন করতে হয়েছে কারান্তরালে। পিতার মতোই জেল-জুলুম মেনে নিয়েছেন। বুদ্ধিবৃত্তিজীবীরাও বলেন, ‘পিতার আরাধ্য কাজ শেষ করার দায় তো ইতিহাস তাঁর কাঁধেই চাপিয়েছে। একবার বঙ্গবন্ধুর জাদুকরী নেতৃত্বে বাঙালি তার অভ্যাসের গণ্ডি ভেঙে জাতি হিসেবে বড়ো হয়ে উঠেছিল এবং সেই জোরে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল।

এবার অচলায়তন ভেঙে সামনে এগোতে হলে, সম্মান নিয়ে বাঁচতে হলে আবারও বাঙালিকে সব ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা ও স্বার্থের গণ্ডি ভেঙে বড়ো হয়ে উঠতে হবে। সেই কাজে কে আর নেতৃত্ব দেবে? বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ছাড়া?’ বাঙালি জাতির দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে নতুন যুগের নতুন রাজনীতির মন্ত্রে নতুন প্রজন্মের বাঙালিকে জাগিয়ে আবারও ঐক্য, ত্যাগ ও কর্মের বাতাবরণ তৈরি করে বাঙালিকে বড়ো করে তোলার যে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, তা বাস্তবায়নে বাংলার মানুষই সমর্থন জোগাবে। বলেছেনও শেখ হাসিনা, বক্তিগত লোভ-লালসার রাজনীতি তিনি করেন না।

চার দশকের ইতিহাস তো এই সত্যতা প্রমাণ করে দেশ ও জাতির উন্নতি ও অগ্রগতি ছাড়া আর কোনো কিছুতেই মোহ নেই। তাই দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে দেশকে অভিশাপমুক্ত করেছেন তিনি। বাঙালি জনগোষ্ঠীর মনোজগতে শেখ হাসিনা এক নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটিয়েছেন। একুশ শতকের বাংলা গড়তে চান তিনি। এই বাংলা গড়ার মাধ্যমেই তিনি জবাব দেবেন বঙ্গবন্ধু হত্যার। জানেন তিনি, এই কাজে পদে পদে পেরুতে হবে বাধাবিপত্তি। তিনি যে তাতে সফল হবেন, তাঁর কর্মকাণ্ড সেই জানান দেয়। জনগণের ভালোবাসা এবং সমর্থন নিয়ে গণতান্ত্রিক সমৃদ্ধ দেশ গড়ার কাজে নিজেকে ব্রত করেছেন।

বিশ্বনেত্রী শেখ হাসিনা ইতিহাসকন্যা। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা অধ্যায় দেখেছেন। অনেক অত্যাচার-নির্যাতন সয়েছেন সপরিবারে। সেই ইতিহাস এক রাজনৈতিক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ইতিহাস। তাঁর বাল্যকাল ও তারুণ্য কেটেছে সামরিক শাসনে। বাঙালিরা স্বভাবজাত সামরিকতন্ত্রের বিরোধী। ১৯৫৮ সাল থেকে সামরিক শাসন, রাজনৈতিক নেতাদের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন যেমন দেখেছেন, তেমনই স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক জান্তার একই আচরণ দেখেছেন। এমনকি দুর্বিষহ নিপীড়নও ভোগ করেছেন। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলের দীর্ঘ সামরিক শাসন থেকে দেশকে গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য যে নিরলস সাধনা, সেখানে কোনো আপস নেই। নির্বাচনকে তিনি আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবেও একসময় বেছে নিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক পরিবারে জন্ম বলে ধর্ম কখনো বাধা হয়ে থাকেনি সব মানুষের সঙ্গে মেশার ক্ষেত্রে।

তিনি, মহীয়সী শেখ হাসিনা, যাঁকে গত একচল্লিশ বছরে প্রায় প্রতিদিনই মুখোমুখি হতে হয়েছে পিতৃ-মাতৃ-ভ্রাতৃ স্বজনহারা শোকাতুর মানুষের। নিজের শোককে শক্তিতে পরিণত করে শোকাতুর মানুষকে বুকে জড়িয়ে যে সান্ত্বনা তিনি মেলেছেন, স্পন্দিত হয় তাদেরও বক্ষে শক্তিমত্তা। আর সেই শক্তিতে বলীয়ান হয়ে জাগরুক হয়ে উঠুক মানুষ আবার। যেমন তিনি দাঁড়িয়েছেন নিজের পুরো জীবনকে মানুষের জন্য উৎসর্গ করে, মানুষেরই পাশে।

‘স্মৃতি বড়ো মধুর, স্মৃতি বড়ো বেদনার’- বলেছেন শেখ হাসিনা এক স্মৃতিচারণে। দুঃখ-সুখে গড়া জীবনে বেড়ে ওঠা তাঁর। উপলব্ধি করেন, বাঙালি জাতির জাগতিক উত্থান ও বিকাশের প্রয়োজন। বিস্মৃতি স্পর্শ করে না বলে সবকিছু গোছানো। ভাষণে-বক্তৃতায় ধারাবাহিকতায় তুলে আনেন সত্য ইতিহাসের সোনালি-রুপালি এবং ট্র্যাজিক ইতিহাস। এটা তো সত্য, ট্র্যাজেডির জীবন তাঁর। আমাদের সমকালে, তিনিই একমাত্র রাজনৈতিক, যাঁকে হারাতে হয়েছে সব। আর তাঁর এই হারানো আসলে পুরো জাতির জন্যই হারানো। বাঙালির জীবনে একমাত্র ট্র্যাজেডি পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের নৃশংসতা। ট্র্যাজেডির কন্যা তিনি। পিতৃহন্তারকরা চেয়েছে তাঁর বিনাশ। প্রাণনাশের কতশত আয়োজন হয়েছে। স্বয়ং রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকেও তাঁর প্রাণ হরণের চেষ্টা চলেছে। হত্যার অপচেষ্টা চলে আসছে সেই ’৮১ সাল থেকে দেশে ফেরার পর থেকে।

শেখ হাসিনা পিতা বঙ্গবন্ধুর মতোই ‘জীবন্মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ করে এগিয়ে চলেছেন বিশ্বমানবের মুক্তির সাধনায়। আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার জন্মদিন। জাতি কৃতজ্ঞতাচিত্তে প্রার্থনার দু’হাত তুলে দীর্ঘায়ু কামনা করবে। পঁচাত্তর বছর বয়সেও তিনি থাকুন সক্রিয়, সচল এবং কর্মপ্রাণ। থাকুন জাতির আশা-ভরসার স্থল হিসেবে। জয়তু বিশ্বনেত্রী শেখ হাসিনা।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।