সেদিন আকাশে মেঘ ছিল
- Update Time : ১১:৫৪:৪৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ জুলাই ২০২০
- / 213
সেদিন আকাশে মেঘ ছিল(পর্ব-০২)
রাজু আহাম্মেদ
২০ মে,সকাল ন’টা।আমি বেলকুনিতে বসে পেপার পড়ছিলাম।হঠাৎ মেইনগেটের ওপাশে কাউকে লক্ষ করলাম।উুঁকি মারতেই ফোনটা বেজে উঠল,বাড়িওয়ালা ফটিক সাহেবের ফোন।
.
-আস্সালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম আস্সালাম।আকাশ,আমি গেটের বাহিরে দরজা খোল।
-একটু দাঁড়ান।আমি আসছি।
গেট খুলে দিলাম।ভদ্রলোক সাথে দু’টা কার্টন নিয়ে এসেছেন।সম্ভবত আম হয়ে থাকবে,কোন অাত্মীয়র জন্য এনেছে নিশ্চয়।সেজন্য কিছু জানতে চাইলাম না।উনি ভিতরে বসে এক কাপ চা খেয়েই আবার ছুটলেন।কি একটা কাজ আছে বাহিরে, কাজ শেষে আবার আসবেন।আর বলে গেলেন,আসাদ নামে একজন আসবেন,উনি আসলে কার্টন দুইটা দিয়ে দিই।উনি চলে গেলেন।গেট লাগিয়ে ঘরের দিকে ফিরতেই দক্ষিণের আমগাছটার দিকে নজর গেল,কালো ছাঁয়ারর মতো কিছু একটা গাছের পিছনে।আমি সেদিকে মন দিলাম না।ছোটখাট বিষয়ে সহজেই ব্যস্ত হতে নেই।ব্যস্ততা বেড়ে যায়।
বেলকুনিতে এসে আবার পেপার পড়তে শুরু করলাম।খানিকবাদেই আশিকের ফোন,কিছু ছোট মাছ পেয়েছি, নিবো?-নে।
-কিন্তু কথা আছে।আমি একা পরিষ্কার করতে পারব না।
-আমিও করব,সমস্যা নেই।আর শোন,গরুর মাংসও নিয়ে আসিস।ফটিক সাহেব এসেছেন,রাতে থাকতে পারেন।ভাবসাবে তাই মনে হলো।
-আচ্ছা।
.
ফটিকসাহেব ফিরলেন বিকেল চার’টা নাগাদ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো।উনি থাকবেন না, বলছিলেন,কিন্তু শেষটায় উনাকে থেকে যেতে হলো।তবে এতে ভালোই হয়েছে।উনাকে এমনিতেও থাকতেই হত এখানে।রাতে খাবারের সময় ফটিক সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,আকাশ।
-জ্বি।
-কিছুদিন আগে ফোন দিয়ে বললে যে,একটু আসতে পারলে ভালো হত।ব্যস্ততা ছিলো,তাই আসা হয় নি।কি ব্যাপার ছিল?
-তেমন কিছু না।খেয়ে নিন।পরে বলছি।
খাবার খেয়ে উনি সিগারেট ধরালেন।সিগারেট টানতে টানতেই জিজ্ঞেস করলেন,কি ব্যাপার বলো।
-আগে বলুন,এ বাড়িটি বিক্রির জন্য কোথাও সাইনবোর্ড লাগিয়েছিলেন?
-হ্যাঁ, লাগানো হয়েছিলো।
-মাসুদ রানা নামে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন।এ বাড়ির ব্যাপারে কথা বলতে,সেজন্যই ফোন দিয়েছিলাম।আপনি ব্যস্ত ছিলেন,তাই সব’টা বলা হয় নি।পরে বলব,এর মধ্যে আপনি তো চলেই এলেন।
-বেশ।উনি কি এর মধ্যে আবার যোগাযোগ করেছিলেন?
-না।তবে কার্ড দিয়ে গেছেন।আপনার আগ্রহ থাকলে যোগাযোগ করতে বলেছেন।
-উনার কি বাড়ি পছন্দ হয়েছে?
-জ্বি।
-তাহলে কালকে আসতে বলো।মাসুদ সাহেবের সাথে আলাপ করেই নাহয় বাসায় ফিরব।
.
মাসুদ সাহেব পরেরদিন বেলা দশ’টার দিকে আসলেন।কথাবার্তা সব পাকাপাকি হলো।সেদিনই উনি সমস্ত লেনদেন,কাগজপত্র ওকে করতে চাইলেন,কিন্তু সমস্যা হলো বাড়িটি ফটিক সাহেবের নামে নেই।উনার বড় ছেলে সিফাতের নামে।শুধুমাত্র উনার সিগনেচারে বাড়ি কেনাটা বোকামি।সেজন্য সবকিছু ঠিকঠাক হলেও শেষটায় কাজটা আর হলো না।ফটিক সাহেব বললেন,আমার ছেলের সিগনেচার পরে করিয়ে দলিলপত্র পাঠিয়ে দিবো।মাসুদ সাহেব বললেন,না।তা হয় না।উনার হাজির থাকতে হবে।পরে আমি এ বাড়ি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে চাই না।
-ঠিক আছে।কিন্তু সেক্ষেত্রে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে।
-কেন?
-সিফাত দেশে নেই,নেপালে আছে।লকডাউন বন্ধ না হলে,ও’তো আসতে পারবে না।
-তাহলে বরং আপনার ছেলে আসার পরেই যোগাযোগ করবেন।
-ঠিক আছে।
.
দুপুরের পরপরই ফটিক সাহেব চলে গেলেন।রাতে দুই বন্ধু ছাদে সিগারেট টানছি।আশিক বলল,মাসুদ সাহেব কবে এসেছিলেন?বাড়ি বিক্রি নিয়ে কথা বলে গেছেন অথচ আমি কিছুই জানি না।
-তুই তখন বাহিরে ছিলিস।
-তুই তো বলিসও নি আমাকে।
-হ্যাঁ বলা হয়নি।
-বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেলে তো ঝামেলায় পড়ে যাব।
-কেন?
-আবার নতুন বাসা খুঁজতে হবে।তাছাড়া এখানে আছি,টাকাও পাচ্ছি।অন্যকোথাও এমন সুবিধা তো পাবো না।
-হুম,সেটা ঠিক।আচ্ছা, আশিক তুই এখনো কি কান্নার শব্দ শুনিস?
-না তো।আর শুনবোই বা কিভাবে?আমি তো পিছনদিকে লাইট জ্বালাতেই যাই না।এমনকি রাতে একা একা ছাদেও কম আসি।
-ভয়ে…?
-ভয়ে না।এমনিতেই।চল নিচে যাই।ভাল লাগছে না।
-তুই যা।আমি একটু পরে যাচ্ছি।
-ঠিক আছে।
আশিক চলে যাবার খানিকবাদেই আজ হঠাৎ কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম।সে শব্দ ক্রমশ জোরালো হতে শুরু করল।যেন কাউকে আহ্বান করছে।ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নিচে গেলাম না।এ কান্না থামাবার কোন উপায় নেই আমার কাছে।
.
২৭ মে হঠাৎ ফটিক সাহেব ফোন দিলেন,বললেন,আকাশ।লকডাউন অফ হবে।ফ্লাইট চলা শুরু করবে ১তারিখ থেকে।
-জ্বি।
-আমি সিফাতের সাথে কথা বলেছি।ও ৩ তারিখে দেশে ফিরবে।তুমি মাসুদ সাহেবের সাথে কথা বলো।৪ তারিখে ডেট ফিক্সড করো।বাড়ির ঝামেলাটা তাড়াতাড়ি চুকিয়ে গেলেই ভালো।
-ঠিক আছে,বলবো।
.
আমি মাসুদ সাহেবকে ফোনে ৪ তারিখে সকালবেলা আসতে বললাম।বাড়িটা বিক্রি হয়ে যাবে।আমাদের নতুন বাসা খুঁজতে হবে আবার।তবে মাসুদ সাহেবের সাথে কথা বলে দেখা যেতে পারে, শুনেছি এ বাড়িতে “এম আর” ব্যাংকের শাখা চালু করবেন।চিলিকোঠার ঘরটা আমাদের দিলেও চলবে।
.
ফটিক সাহেব,সিফাত দুজনেই এসেছেন।মাসুদ সাহেব তখনো আসেন নাই।ফটিক সাহেব ফোন দিতে বললেন,আমি ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,কোথায় আছেন?
মাসুদ সাহেব বললেন,এই চলে এসেছি।
উনারা সোফাতে বসে গল্পগুজব করছেন।আমি ঘরে ফিরে এসে বসলাম।হঠাৎ মাথা কেমনজানি ঝিমঝিম করে উঠল।আজ সকাল থেকে বৃষ্টি।আবহাওয়া এমনিতেই ঠান্ডা,তারপরেও শরীর খুব বাজে ভাবে ঘেমে যেতে শুরু করল।ফ্যান ছেড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম যেন দু’চোখে এসে ভর করল।চোখের পাতা যেন টেনে টেনেও তুলতে পারছি না।খোলা জানালা দিয়ে যেন একরাশ কালো ধোঁয়া এসে পুরো ঘরটাকে অন্ধকার বানিয়ে দিলো।কেউ এসে আমার পাশে বসল।চেনা মুখ,যাকে আমি কথা দিয়েছিলাম।এ শরীর দেবার।সেই বিভৎস চেহারার মানুষটি ক্রমশ আমার শরীরটাকে তার নিজের দখলে নিয়ে নিলো।সব ধীরে ধীরে অবচেতন, অচেনা হতে শুরু করল।
যখন জ্ঞান ফিরে এলো তখন নিজেকে অাবিষ্কার করলাম সেই মাকড়সা জালে ঘেরা গোয়ালঘরে।বাহিরে তখন প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে।জানালার কপাট ধড়াস ধড়াস করে ধাক্কা লাগছে।খোলা দরজায় ঘরে অবিচল হাওয়া বইছে।অদূরেই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আশিক চুপচাপ বসে আছে।
পুবের কোণায় নজরে পড়ল নিথর দেহ।একটি নয়,দুই দুটি শরীর।তার পাশেই বিচ্ছিন্ন দুটি মাথা।সিফাত আর ফটিক সাহেব।
.
মাথাতুলে বসতেই আশিক এসে আমাকে ধরে বলল,কিরে?তুই ঠিক আছিস?
-হ্যাঁ।আমি ঠিক আছি।
-সব শেষ দোস্ত।হঠাৎ করে কি হলো তোর?কেন করলি এসব?
-আমি কিছুই করিনি। সব ও’করেছে।
-ও’কে…?
-ও….।
-হ্যাঁ,সেটা কে?
-রোজ রাতে যে কান্না করে,সেই ও।
-কেন….?কি জন্য এমনটা করল?
-সব বলবো।তার আগে এই দুটা ডেডবডি এখানেই কবর দিতে হবে।জানাজানি করলে আমরাই বিপদে পড়বো।
.
রাত দশ’টা।আকাশ কিছুটা পরিষ্কার হওয়াতে ছাদে গেলাম।মোবাইলে গান ছেড়ে চুপচাপ হাঁটাহাঁটি করছি।খানিকবাদেই আশিক এলো,সাথে চা নিয়ে এসেছে।চা’য়ের কাপে চুমুকের ফাঁকে দুই বন্ধু গল্পগুজব করছি।আশিক সকালের ঘটনার কথা জিজ্ঞেস করল,কিরে তখন তো কিছু বললি না।এসেই ঘুমিয়ে পড়লি।এত কিছুর পরেও তোর চোখে ঘুম আসে কি করে?
-ঘুম আসে না।কিন্তু কিছু বিষয়কে ভুলে যেতে জোর করে ঘুমাতে হয়।
-ঘুমালে মানুষ অতীত কষ্ট ভুলে যায়?
-ঠিক ভুলে যায় না।কিন্তু তৎক্ষণাৎ কষ্ট থেকে দূরে সরে থাকা যায়।
-সেটা সত্যি বটে।এখন সবকিছু পরিষ্কার করে বল।
-হুম।রোজ রাতে যে কান্নার শব্দ শুনিস, সেটা একটা মেয়ে ছিল,নিপা।ওর একটা ছোট মেয়েও ছিলো।নিপা এ বাড়িতেই কাজ করত প্রায় বছর দু’য়েক ধরে।আর সিফাত ফটিক সাহেবের বড় ছেলে।
-তারপর…?
.
-একদিন এরকম বর্ষার সময় নিপা ছাদে এসেছিলো।রাতের বৃষ্টিতে মন উজাড় করে ভিজছিল মেয়েটা।আর তখনি সিফাত ছাদে আসে।নিপাকে দেখে সিফাতের মনের কোণে লালসা উুঁকি মারে।সেই লালসার শেষ পরিণতি হিসেবে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিলো নিপার কোমল শরীর।সিফাত অবশ্যি,নিপাকে বলেছিলো আগামীতে বিয়ে করবে।সে আশায় নিপা বেঁচে ছিলো।কিন্তু শেষটায় নিতুর জন্ম হলে,সিফাত আর মেনে নেয় না নিপাকে।সবাইকে বলে দিবে এমনটা নিপা বললে,সিফাত হিংস্র হয়ে ওঠে।শেষ করে ফেলে তাজা দুটি প্রাণ।
-আমি ভাবতে পারছি না।আচ্ছা, ফটিক সাহেবকে কেন মারা হলো?সব জেনে শুনেও কি ছেলেকে একাজে সাহায্য করেছিলো?
.
-না।ফটিক সাহেব এর কিছুই জানেন না।যে ফটিক তোর সামনে মারা গেছে,সে মূলত ফটিক সাহেব না।উনি কাদের হোসেন।এ বাড়ির কাজের লোক,সিফাতের খুব কাছের।ফটিক সাহেবকে সিফাত এটাসেটা বুঝিয়ে আগেই নেপালে পাঠিয়ে দিয়েছিলো।
-আর বলিস না।শুনতে ইচ্ছে করছে না।মানুষ কিভাবে পারে এসব করতে?
-পারে।মানুষ অনেক কিছু করতে পারে।যত্ন নিয়ে চারা গাছে ফুল ফুটাতে পারে,আবার নিমিষেই ফুল ছিঁড়েও ফেলতে পারে।
-ঠিক বলেছিস।
.
আশিকের চোখ জলে ভিজে উঠেছে।আমি বললাম,পাগল ছেলে।কান্না করছিস?যা হবার,তা হয়েছে।আমি সিগারেট ধরালাম,আশিকও ধরাল।বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ রইলাম।
আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে।যেকোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে।আজ বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ইচ্ছে করছে।অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামুক তবে।বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাক সমস্ত বিষণ্ণতা।নতুন করে জন্ম হোক আমাদের।নতুন করে জন্ম হোক এ বিষাক্ত শহরের।
.
লেখক:শিক্ষার্থী,উচ্চমাধ্যমিক ২য় বর্ষ
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
Tag :