উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়ানোর নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
- Update Time : ০৭:১৩:৪৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ জুলাই ২০২০
- / 150
স্টাফ রিপোর্টার॥
বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়হীনতা দূর করে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়াও উপকূলীয় এলাকায় রাবার ড্যাম নির্মাণে সাবধানতা অবলম্বন করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে তিনি এসব নির্দেশনা দেন।
মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী ও একনেকের চেয়ারপার্সন শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ১ হাজার ১৩৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ৬ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়।
এর মধ্যে সরকার দেবে ১ হাজার ২৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান ১০৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবরা উপস্থিত ছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে একনেক সভায় যুক্ত হন।
সভায় দুটি প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন দিতে গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান একনেক সভা শেষে ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে জানান। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘খুলনা শীপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন’ প্রকল্পের অগ্রগতি কম। এটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ ও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। প্রকল্প বাস্তবায়ন গতি কম হওয়ার কারণ খুঁজে বের করার নির্দেশনা দিয়েছেন। সড়ক ও জনপথ অধিদফতর ও সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী বিষয়গুলো রিভিউ করতে বলেছেন। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, সড়ক প্রশস্তকরণে ১০৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে। সেইসঙ্গে মেয়াদ বেড়েছে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ফলে ৯৮ কোটি টাকা প্রকল্পে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫৯ কোটি ২১ লাখ টাকা। এছাড়া দুই বছরের প্রকল্প বাস্তবায়নে যাচ্ছে সাড়ে ৭ বছর। ‘খুলনা শীপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন’ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বিদ্যমান সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন, রূপসা ব্রিজ এপ্রোচ সড়ক হতে খুলনা শহরে প্রবেশের জন্য স্বল্পতম দূরত্বের সড়ক নির্মাণ, যোগাযোগ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও যানজট হ্রাস পাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাস্তব অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৩০ শতাংশ। অগ্রগতি অনেক কম হলেও পাঁচ কারণে প্রকল্পটি সংশোধন করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এগুলো হলো-ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণ ও ব্যয় বৃদ্ধি, সড়কের ডিজাইন পরিবর্তন,সর্বশেষ রেট সিডিউল অনুযায়ী ব্যয় প্রাক্কলন, অনতুন অঙ্গ অন্তর্ভুক্তি এবং মেয়াদ বৃদ্ধি। এটির সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন দিতে গিয়ে ক্ষোভ ও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। এটি রিভিউ করতে নির্দেশ দিয়েছেন পরিকল্পনা কমিশনকে।
আরেক প্রকল্পের তথ্য তুলে ধরে মন্ত্রী জানান, নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দ থেকে মিনারবাড়ী পর্যন্ত সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পটি ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে দেড় বছর মেয়াদে হাতে নেয়া হয়। প্রায় সাড়ে তিন বছর প্রকল্পের মেয়াদ আরও আড়াই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যয়ও বেড়েছে ১১৪ দশমিক ২০ শতাংশ। এ সময় মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মন্ত্রী বলেন, এই প্রকল্পে একটা সহজ ব্যাপার ছিল সড়কটাকে বড় করার। কারণ হাজার হাজার (হিন্দু ধর্মের) পুণ্যার্থীরা এখানে স্নানে আসেন। তারা যাতে আরামে চলাফেরা করতে পারেন। এ উদ্দেশে সরকার প্রকল্পটি গ্রহণ করে। পুণ্যার্থীরা স্নানের সময় হাজার হাজার লোক নদীতে নামে। এজন্য অনেক বড় ঘাট দরকার হয়। কিন্তু প্রকল্প কর্তৃপক্ষ পর্যটনসহ নানা ধরনের চিন্তা করে ছোট ছোট ঘাট করতে চেয়েছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, প্রকল্পটিতে মূল কাজের বাইরে বাংলো বা টুরিস্টদের জন্য হোটেল নির্মাণের পরিকল্পনা যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মূল কাজটাই করুন। অর্থাৎ রাস্তা প্রশস্ত করুন, ঘাটলা নির্মাণ করুন। চায়ের দোকান বা অন্য দোকান বসানোর প্রয়োজন হলে বেসরকারীভাবে ব্যবসায়ীরাই সেটা করবেন। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, অনেক সময় প্রকল্প চলাকালীন ‘আইডিয়াওয়ালা’রা এসে নতুন নতুন আইডিয়া যোগ করেন প্রকল্পে। এটা আর করা যাবে না। এতে করে প্রকল্পের কাজের গতি কমে যায়।
এম এ মান্নান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য দেরি হচ্ছে, অহেতুক দেরি হচ্ছে। সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করেছেন তিনি। তিনি লক্ষ্য করেছেন যে, একটা কাজ যখন শুরু করি, তখন অন্যান্য আইডিয়া চলে আসে, এটা করেন ওটা করেন। এতে প্রকল্পের ক্ষতি হয়। এই প্রবণতাকে আটকাতে হবে। আমাদের প্রতি নির্দেশনা আছে, আমরা যারা সরকারের কাজ করি, বিশেষ করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, আমরা দেখবো আরও বেশি করে। আইএমইডি (পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ) দেখবে এটা, মাঠে গিয়ে দেখে আসবে।
বাঁধের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, আমরা যখন চর নিয়ে কথা বলছিলাম, বাঁধের বিষয়ে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বললেন, সাবধান। এই চরের মধ্যে উপকূলে আপনারা যে বাঁধ দেন, ক্রস ডেম যে সংযোগ করেন, এটার কিন্তু ভয়ানক প্রভাব আছে। আপনি হয়ত হাতিয়া দ্বীপ বাঁচালেন, ওইদিকে পানি বেড়ে গিয়ে ভোলাকে ভাঙবে। সুতরাং এ নিয়ে সুদূর প্রসারী স্টাডি করা প্রয়োজন আমাদের। এগুলো স্টাডি করে আমাদের সাবধানে হাত দিতে হবে। মন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ঠিক আছেন, আমার মনে হয়। প্রকৃতির সঙ্গে খেলা করার আগে আমাদের খুব সাবধানে খেলতে হবে।
মঙ্গলবার অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ২৩৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘চর ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড সেটেলমেন্ট প্রজেক্ট-ব্রিজিং’ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ প্রকল্প এলাকায় প্রস্তাবিত ভৌত কাজসমূহ টেকসইকরণের লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা উন্নয়ন, উপকূলীয় চর উন্নয়ন বিষয়ক উপাত্ত সংগ্রহ ও উপকূলীয় চর এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিরাপদ বসবাস স্থাপন ও তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নসহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন সাধন করা হবে। প্রকল্পটি নোয়াখালীর সুবর্ণচর, হাতিয়া, কোম্পানীগঞ্জ ও কবিরহাটে বাস্তবায়িত হবে। প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমসমূহ হলো ১৭১ কিলোমিটার খাল পুনর্খনন, বিকল্প বাঁধ নির্মাণ, নদী তীর প্রতিরক্ষা ও ২৯৩ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ। ২৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘খুলনা শীপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন (১ম সংশোধিত) প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বিদ্যমান অপ্রশস্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন, রূপসা ব্রিজ এ্যাপ্রোচ সড়ক থেকে খুলনা শহরে প্রবেশের জন্য স্বল্পতম দূরত্বের সড়ক নির্মাণ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও যানজট হ্রাস করা হবে।
২৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘লাঙ্গলবন্দ-কাইকারটেক-নবীগঞ্জ জেলা মহাসড়কের লাঙ্গলবন্দ হতে মিনারবাড়ী পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় লাঙ্গলবন্দ-কাইকারটেক-নবীগঞ্জ জেলা মহাসড়কের লাঙ্গলবন্দ হতে মিনারবাড়ী পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণের মাধ্যমে নিরাপদ, আরামদায়ক, সময় ও ব্যয় সাশ্রয়ী সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা হবে। ৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কুমিল্লা জেলার তিতাস ও হোমনা উপজেলায় তিতাস নদী (লোয়ার তিতাস) পুনর্খনন’ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ভরাট হয়ে যাওয়া তিতাস নদী পুনর্খননের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নসহ জলাবদ্ধতা দূর করা হবে। এর পাশাপাশি অনাবাদী জমি আবাদযোগ্য করা, নৌ চলাচল সুবিধা সৃষ্টি, মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করে আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করা হবে। ৪০১ কোটি টাকা ব্যয়ে গাইবান্ধা জেলার সদর ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার গোঘাট ও খানাবাড়ীসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা যমুনা নদীর ডান তীরের ভাঙ্গন হতে রক্ষা প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙ্গন থেকে গাইবান্ধা জেলার সদর ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় প্রকল্প এলাকায় অবস্থিত বসতবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, বাজার, ফসলি জমিসহ সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন স্থাপনা রক্ষা হবে।
১২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ’ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের মাধ্যমে স্থায়ী ও মৌসুমি পতিত জমি চাষের আওতায় এনে প্রকল্প এলাকার শস্যের গড় নিবিড়তা ২০৮ শতাংশ থেকে ২১০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হবে। বিদ্যমান শস্য বিন্যাসে বিভিন্ন ফসল আবাদের মাধ্যমে বহুমুখী শস্য আবাদ এলাকা গড়ে তোলা হবে।
একনেক সভায় কৃষিমন্ত্রী মোঃ আব্দুর রাজ্জাক, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম, শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা অংশ নেন।