“মন খারাপের পোষ্টার”যেনো মন ভালো করার মহৌষধ!
- Update Time : ০৮:৫৬:০৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ মে ২০২১
- / 224
সারওয়ার বাবর চৌধুরী:
কবি, গীতিকার ও অনুসন্ধানী সাংবাদিক মিজান মালিক। তাঁর প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ ‘মন খারাপের পোষ্টার’হাতে পেয়ে পড়ে ফেললাম। কিন্তু মুশকিল হলো, নামটিই আমার মন খারাপ করে দেয় ! চর্তুদিকে মন খারাপের ঘটনা। ডানে মন খারাপ, বামে মন খারাপ ! যেখানে যাই, যার কাছে যাই, মন খারাপ হয় এমন একটা সংবাদ থাকছে। এই যখন অবস্থা, তখন মন ভালো হবে এমন কিছুই তো প্রত্যাশা করতেই পারি। কিন্তু তা না, মন খারাপের পোষ্টার গ্রন্হটি পড়ে আরো মন খারাপে ডুবে যেতে হবে !! এটি পড়ে আরও মন খারাপের রিস্কে যাওয়ার কোন মানেই হয় না ! পাঠক যদি জানতে চান, কবিতাগুলো কেমন হয়েছে? করে বলে দেবো, মজবুত কবিতা।
.
নতুন বইয়ের পাতার গন্ধ, সকালের প্রথম পত্রিকার গন্ধ, কচকচে নতুন টাকার গন্ধ, খটখটে শুকনো মাটির উঠোনে হঠাৎ বৃষ্টিতে মাটির ভেজা গন্ধ- এইসব গন্ধের প্রতি আমার আজন্ম গোপন প্রেম ! যদিও, ফুলের সুবাস, পারফিউম,এসবেও কিন্তু সবাই প্রলুব্ধ হন। কিন্তু সবাইকে যেটি মাতায়, আমাকে সেটি মাতালে তখন তো সেখানে কোন বৈচিত্র থাকে না!
.
বদ অভ্যেস বলা যাক কিংবা নেশা বলা যাক-নতুন বইটির পাতার গন্ধ সত্যিই আমার চিন্তাভাবনা ওলোট পালোট করে দেয় ! মিজান মালিকের বইটি খুলতেই আমায় যেন কেউ ক্লোরোফর্ম স্প্রে করে দেয়। বোধশোধহীন নেশাগ্রস্ত মানুষ হয়ে পড়ি। আমার মনে থাকে না, মন খারাপের পোষ্টার নামের কবিতাগ্রন্থ আমাকে উল্টো ‘মন খারাপের দেশেই’ নিয়ে যেতে পারে ! কোথায়.. চলে যায় আমার সেইসব ভয়, শঙ্কা ! আমি যেন অবুঝ বালিকার মত নিষিদ্ধ প্রেমে জড়িয়ে পড়ার আকর্ষণে ডুবমারি !
.
মন খারাপের পোষ্টার গ্রন্থেই একই নামের একটি কবিতা রয়েছে ! কবি সেখানে বলছেন,”কোলাহল লেগে থাকে প্রিয় এই শহরে /কেউ যেন না হারায় অচিন বহরে…চারিদিকে এমন দৈনদশা চাই না যে আর /চাইনা দেখতে মন খারাপের পোষ্টার / এমন পদ্যে কবি যখন নিজেই মন খারাপের পোষ্টারের বিরুদ্ধে শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে যান, তখন তো আমার আর নিরাশার কিছু থাকে না !
.
কবি এখানে নিজেই আমাদের আশায় বুক বাঁধার সাহস দিচ্ছেন। হ্যাঁ, এটি মানছি, তিনি করোনার মত এক আদৃশ্য শত্রুকে এখানে মূল প্রতিপাদ্য করেছেন ! এই শত্রুর নির্মম আচরণে নিজের মনক্ষুন্নতা, বিষন্নতার কথা জানিয়েছেন । যে কারণে তিনি কাব্যগ্রন্থ’র নামও এমন নেতিবাচকতায় দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, আমাদের তিনি নৈরাশ্যবাদের বাণী বিশ্বাস করাতে চেয়েছেন। কিংবা আমাদের মনোবলহীন করার প্রয়াস চালিয়েছেন ! তাতো নয়। তিনি বরং বিপর্যয়ের হাত থেকেই আমাদের উত্তরণের পথ দেখাতে চেয়েছেন। তার লেখনীর শক্ত শৈলীতে সেটি তিনি চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন।
.
মানব সভ্যতার চিরচেনা রূপকে এই অতিমারি কতটা অচেনা আর বিধ্বস্ত করে দিয়েছে, সেই ভয়াবহতা থেকে তিনি আমাদের শিক্ষা নেবার আবেদনই স্পষ্ট করেছেন। তিনি মানবকুলের কিছু ব্যর্থতা ও অহঙ্কারকেও দায়ি করেছেন করোনার এই করাল গ্রাসের পেছনে। এ কারণে তিনি তার কবিতার বিভিন্ন আঙ্গিকে সবাইকে সতর্ক হওয়ারই আহবান জানিয়েছেন। মহামারিকে মেনে নিতে হবে, মহামারিকে স্বাগত জানাতে হবে-এমন দুর্বলচিত্তকে তিনি মোটেই অনুপ্রাণিত করেননি। বরং কোথায় আমাদের গলদ, কী আমাদের করনীয় সেই বার্তাটি তিনি পরিস্কার করছেন তার বলিষ্ঠ লেখনিতে। তিনি বারংবারই সাহস ও উদ্দীপনার কথা বলতে চেয়েছেন।
করোনার নিকষ অন্ধকারের বিরুদ্ধে তিনি নতুন, সুস্থ, সুন্দর এক পৃথিবীর জয়গান গেয়েছেন। এমন বিচার-বিবেচনায় মন খারাপের পোষ্টার প্রকারন্তরে মন ভালো করার একটি মহৌষধই বটে!
.
কবি এখানে বলছেন, “ভাগ্য ! দুর্ভাগ্য ! নিয়তি এবং আমাদের পরীক্ষা / হারাতে হারাতে ঠিকই একদিন ঘুুরে দাঁড়াব / ঝুলে থাকা বোবা অন্ধকার ক্লান্ত হয়ে ফিরে যাবে পুরনো ঠিকানায় / আত্মসমালোচনার কথা বলতে গিয়ে কবি বলছেন, “দায় আমাদেরই ,আমরা নিজ হাতে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য বিনষ্ট করেছি /…এই কথাগুলো বলার জন্যে কাব্যগ্রন্থে একজন কমন ব্যক্তির পরিচয় সামনে এনেছেন। এটি তাঁর কবিতার নিপূন কারুকাজে। গায়ক নচিকেতা যেমন ‘নীলাঞ্জনাকে’ নিয়ে আসেন, কবি ও লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যেমন ‘বরুনা’ কিংবা ‘নাদের আলীকে’ নিয়ে আসেন ! তেমনি মিজান মালিক এনেছেন ‘আবীর আলীকে ।’ বস্তুত; এমন রূপক চরিত্রের ব্যঞ্জনায় যুগে যুগে সাহিত্যিকরা বাস্তব চরিত্রের গভীর সংকট ও সমঝোতার মূল চিত্রকে তুলে ধরারই প্রয়াস চালান। কাব্যগ্রন্থে বেশ ক’টি কবিতায় আবীর আলীকে এভাবে তুলে ধরেছেন যে, আবীর আলীর কন্ঠে সাধারণ মানুষের বিদগ্ধতার কথা, হাপিত্যেশের কথা বিমূর্ত করেছেন কবি। তবে, সমস্ত কিছু ছাপিয়ে, তিনি মানব জাতির কল্যাণ ও সঠিক ঠিকানাটিই নির্ধারণ করেছেন।
.
তিনি বিভ্রান্তির জায়গায় আধ্যাত্ববাদ, ধর্মীয় অনুরাগ প্রতিষ্ঠারই বাণী শুনিয়েছেন। নিজেদের সৃষ্টিকর্তার প্রতি যথাযথ সঁপে না দেবার ভুল বা অবহেলাকে আমাদের ব্যর্থতা বা করোনার অনিবার্যতার কারণ বলেই ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, এই জগত সংসারের যিনি প্রতিপালক, তার সন্তুষ্টি অর্জনই এই অবেলায় আমাদের বড় বেশি প্রয়োজন। তাঁর অবাধ্য হওয়া, তাঁর সৃষ্টির প্রতি অমানবিক হওয়ার মানেই তাঁর ক্ষোভকে স্বেচ্ছায় নিজেদের দিকে টেনে আনার শামিল। মানব জাতির অনিবার্য সর্বনাশকে আলিঙ্গণ করা।
.
তাই কবি মিজান মালিক বলেন, “পিলারবিহীন আকাশটা যিনি চোখের সামনে তুলে রেখেছেন আমরা সেটিও নিরাপদ রাখতে চাইনি /…এমন অনেক কবিতা তুলে ধরা যায় , যেখানে মিজান মালিক তার সৃজনশীল জ্ঞান, প্রাজ্ঞতা আর মননশীলতার সুঁতোয় গোটা বইটিকে সাজিয়েছেন। তিনি আশা নিরাশার দোলায় পাঠককে বিভ্রান্ত করতে চাননি। বরং এটিকে তিনি বেঁচে থাকার, নতুন করে স্বপ্ন দেখার এবং জ্বরাগ্রস্তহীন নির্মল বাতাসে ভরা নতুন পৃথিবী গড়ার এক অনন্য চুক্তিমালা হিসেবেই গাঁথতে চেয়েছেন। বলাই বাহুল্য, এতে তিনি শতভাগ সার্থক !
.
লেখক: সাংবাদিক, কথা সাহিত্যিক।
Tag :
মিজান মালিক