করোনার পর কেমন হবে দুনিয়াটা

  • Update Time : ০৬:৩১:১২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ জুন ২০২০
  • / 264

জানুয়ারি থেকে শুরু। এক শহর থেকে আরেক শহর। এক দেশ থেকে আরেক দেশ। এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশ। বিশ্বজুড়ে এই কমাসে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছাড়া যেন আর কোনো আলোচনা নেই। কতজন হারালেন প্রিয়জন। কেউ মৃদু, কেউ ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিলেন সংক্রমিত হয়ে। অন্যরা দুশ্চিন্তা, আতঙ্ক নিয়ে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কায় দিন যাপন করছেন। অনেকে হারালেন জীবিকা। অনেকের জীবিকা আজ হুমকির মুখে।

হাঁপ ধরা এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে টিকে থাকতে হবে, তা নিয়ে নতুন পরিকল্পনা সাজানোর দিকে বিশ্বকে ঠেলে দিয়েছে করোনাভাইরাস। ভয়াবহ এই সংকট পাল্টে দিচ্ছে চেনা বিশ্বটাকে। একটি ভাইরাস এসে যেন বিশ্বকে বুঝিয়ে দিল, কোনো দেশই ‘যথার্থ’ নয়।

উন্নয়নশীল ভুবনের বাসিন্দারা উন্নত দেশগুলোর দিকে আফসোসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে যে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন, আর উন্নত দেশগুলোর বাসিন্দারা গর্বিত ভঙ্গিতে তা দেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেন, এর সবই এখন মিলেমিশে একাকার। করোনায় পাল্টে যাওয়া চেহারা নিয়ে খোলনলচে বদলাতে চাইছে বিশ্ব।রূপান্তরের এই সময়ে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান রেস্তোরাঁ, জিম, বার আর পার্ক। বিবিসি ফিউচারে তুলে আনা হয়েছে সেসব বিষয়।

নতুন পরিকল্পনায় সাজাতে হবে নগর

অনেক দেশ এখন লকডাউন শিথিল করেছে। মুক্তির আনন্দ পেয়ে বাসিন্দারা তাঁদের পরিচিত জায়গাগুলোতে ছুটে যাচ্ছেন। তবে সেই চেনা জায়গাই এখন তাঁদের কাছে অচেনা ঠেকছে। জায়গাটি যে পাল্টে গেছে, তা নয়। তবে জায়গাটিতে অবস্থান করার জন্য যা কিছুর মধ্য দিয়ে তাঁদের যেতে হচ্ছে, তার সঙ্গে কয়েক মাস আগেও পরিচিতি ছিলেন না। মাস্ক পরতে হবে। একসঙ্গে প্রবেশ করতে পারবেন অল্পসংখ্যক মানুষ। কারণ, করোনার সংক্রমণ যদি আবার ছড়ায়, তাহলে ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত নতুনভাবে এটা দীর্ঘমেয়াদি রূপে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকবে। এটা হতে পারে নয় মাস থেকে দুই বছরের জন্য।

বিজ্ঞানীরা আরও মনে করেন, ২০২০ সালে করোনাভাইরাস যা করেছে, ভবিষ্যতে নতুন ও একই ধরনের ভয়াবহ রোগ মানবতাকে পঙ্গু করে ফেলতে পারে।
ভবিষ্যৎ নগর গড়ে তোলার পরিকল্পনায় যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের জন্য এই মহামারি একই সঙ্গে দুটো জিনিস শিখিয়ে দিল। এক. তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা। দুই. আমরা কীভাবে জীবান যাপন করব, চলাফেরা করব এবং একসঙ্গে বসবাস করব, তা নিয়ে নতুন করে ভাবনা।

করোনা দেখিয়েছে, মানুষ আইসোলেশনে ভালো থাকতে পারে না। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, কোয়ারেন্টিনে একা থাকতে থাকতে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে তা প্রভাব ফেলে। কখনো তা গুরুতর আকারও ধারণ করে। মানুষের জন্য সামাজিক মেলামেশার জায়গাটি নিরাপদ করে গড়ে তোলা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেয়েও অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

ইউরোপের দেশগুলো যখন প্রথম লকডাউনে প্রবেশ করল, তখন স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, বিষয়টি বুঝতে বিশেষজ্ঞরা ইতালিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ইতালীয় অ্যাসোসিয়েশন অব সিটিজ অ্যান্ড মিউনিসিপলিটিজের একজন নীতিনির্ধারণী বিশেষজ্ঞ সিমোনে দি অ্যান্তোনিও ‘কেফারে’ ওয়েবপোর্টালে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছেন, ‘ইতালির এখন ভয় ও আশঙ্কার সমাজের পরিবর্তে উজ্জীবিত সমাজ পুনরুদ্ধার করা জরুরি।’

বিবিসি ফিউচারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সিমোনে বলেছেন, ‘এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পর নুতন করে সবকিছু শুরু করার এক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের নতুন ঝুঁকি মোকাবিলার পাশাপাশি মানুষের হারানো অনুভূতি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। এর মানে হচ্ছে, জনসাধারণের জন্য তৈরি স্থান, স্থাপনা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। আমাদের সামাজিক আচার-আচরণ পাল্টাতে হবে। তবে সেটাকে সুযোগ হিসেবেও দেখা যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যেসব স্থানকে লোকজন অবহেলা করতেন, সেসব জায়গাতেও যাওয়া শুরু করতে পারেন।’ এ ক্ষেত্রে তিনি মিউনিখের ঐতিহ্যবাহী বিয়ার গার্ডেনের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে খোলা জায়গায় লম্বা টেবিলে লোকজন পানাহার করেন। অন্য শহরগুলোর প্রতিষ্ঠানগুলোও দূরত্ব বজায় রাখতে বসার আদর্শ ব্যবস্থা করতে পারে।

রেস্তোরাঁ-বারে আউটডোরকে গুরুত্ব দিতে হবে
ভেনিসের কাছাকাছি শহর সান দোনা দি পিয়াভের ডেপুটি মেয়র দানিয়েলে তেরজারিওল লকডাউন খুলে দেওয়ার পর বলেন, প্রশাসন চায় জনগণের জন্য উন্মুক্ত স্থানগুলোকে আরও কার্যকর ও সুন্দরভাবে ব্যবহার করতে। দূরত্ব রেখে জনসমাগমের জন্য শহরের কেন্দ্রস্থলের মূল জায়গাগুলোকে পায়ে চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। রেস্তোরাঁ ও বারের মালিকদের জন্য সবচেয়ে ভালো আউটডোর তৈরির জন্য পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, রেস্তোরাঁ ও বারে একসঙ্গে আসা-যাওয়া যেন নিরাপদ রেখে প্রবেশের সামনের জায়গাটির নকশা করা হয়।
ভারতের মতো দেশে গণপরিবহনে দূরত্ব বজায় রাখা কঠিন। ছবি: রয়টার্সভারতে লকডাউন শিথিল করে ধীরে ধীরে দোকানপাট খোলা হচ্ছে, সীমিত আকারে যোগাযোগব্যবস্থা চালু হচ্ছে। গোয়ার রেস্তোরাঁমালিক শেফালী গান্ধীর মতে, এই সময়ে প্রবেশপথের বাইরের অংশটুকু মূল গুরুত্ব পাবে। মুম্বাইয়ের মতো শহরে লোকজন দুই মাস ধরে খুপরি অ্যাপার্টমেন্টে বন্দী হয়ে পড়েছিলেন। লকডাউনের এই স্মৃতি মানুষের মনে দীর্ঘদিন থেকে যাবে। মানুষ খোলা জায়গায় সামাজিক জীবনের আনন্দ খুঁজে বেড়াবে। তাঁর মতে, বাস্তব দিক বিবেচনায় বাইরে বসার স্থান পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বাগান একটি ভালো জায়গা হতে পারে।

তবে আউটডোর হোক বা ইনডোর, ছোট জায়গাগুলোর ক্ষেত্রে যথাযথ দূরত্ব বজায় রাখা কঠিন হবে। সে ক্ষেত্রে অনেকে প্রতিটি টেবিলের জায়গা প্লাস্টিকের পর্দা দিয়ে ঘিরে দূরত্ব বজায় রাখার পরিকল্পনার কথা বলছেন। তবে অনেকে এর বিরোধিতা করছেন। বিরোধীদের মতে, এতে খাবার ভাগাভাগির আনন্দ থেকে মানুষ যেমন বঞ্চিত হবেন, তেমনি এতে এক ধরনের ‘জেলখানা’ ‘জেলখানা’ ভাবও আসবে।

আস্থা অর্জনই হবে মূল নিয়ামক
অনেক গবেষণা বলছে, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে আস্থা অর্জনের বিষয়টি। সেসব গবেষণায় আস্থার বিষয়টিকে চিহ্নিত করা হয়েছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের মেরুদণ্ড হিসেবে। স্বাভাবিক জীবেন ফিরে যেতে যেকোনো স্থানে মানুষের মনে এই বিশ্বাস আনতে হবে যে তিনি সেখানে নিরাপদ এবং অন্যরাও নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করছে।

ভারতের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অদিতি রাঠোর মতে, উন্মুক্ত বা ব্যক্তিগত যেকোনো স্থানে সমাগমের ক্ষেত্রে মানুষের আত্মবিশ্বাস পুনর্গঠনে আস্থাই এখন মূল চাবিকাঠি।

সুস্থ থাকতে জিমে যাওয়া জরুরি নয়

জিমগুলো তাদের সদস্যদের নিরাপত্তার স্বার্থে এই মহামারির শুরুতেই ব্যবস্থা নেয়। জিমগুলোই প্রথম সরকারের দেওয়া বিধিনিষেধের আগেই পরিচ্ছন্নতাসহ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এস্কেপ ফিটনেসের ৮০টিরও বেশি দেশে চেইন জিম রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের হেড অব কনটেন্ট হ্যাকনে-উইলিয়ামসের মতে, এই লকডাউনে মানুষের মধ্যে এই উপলব্ধি এসেছে যে নিজেকে ফিট রাখতে জিমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দেওয়া জরুরি নয়। পার্কে দৌড়ানো বা হালকা রুটিন মেনে চলাই সুস্থ থাকার জন্য যথেষ্ট। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে মানুষ জিমকে অভিজাত স্থান হিসেবে না দেখে সুস্থ থাকার জায়গা হিসেবে দেখবেন বলে তাঁর আশা।

করোনাভাইরাস মহামারি সর্বসাধারণের চলাচলের বা ব্যবহারের জায়গাকে নতুনভাবে বিন্যাস করতে বাধ্য করেছে। লকডাউন মানুষকে ভাবতে সময় দিয়েছে যে আমরা সামাজিক জীবনকেও এই রকম দেখতে চাই। ভিড়-ভাট্টা, লোকে গিজগিজ বার, থিয়েটার ও জিমকে আমাদের বিদায় জানাতে হতে পারে, যেসব ছিল আমাদের পছন্দের বিষয়, অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও। তবে আমাদের সামনে অনন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে নতুন স্থানে একসঙ্গে থাকার মানে আবারও আবিষ্কারের, করোনাভাইরাসের এই দাগ থেকে নতুন কিছু কল্পনার।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


করোনার পর কেমন হবে দুনিয়াটা

Update Time : ০৬:৩১:১২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ জুন ২০২০

জানুয়ারি থেকে শুরু। এক শহর থেকে আরেক শহর। এক দেশ থেকে আরেক দেশ। এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশ। বিশ্বজুড়ে এই কমাসে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছাড়া যেন আর কোনো আলোচনা নেই। কতজন হারালেন প্রিয়জন। কেউ মৃদু, কেউ ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিলেন সংক্রমিত হয়ে। অন্যরা দুশ্চিন্তা, আতঙ্ক নিয়ে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কায় দিন যাপন করছেন। অনেকে হারালেন জীবিকা। অনেকের জীবিকা আজ হুমকির মুখে।

হাঁপ ধরা এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে টিকে থাকতে হবে, তা নিয়ে নতুন পরিকল্পনা সাজানোর দিকে বিশ্বকে ঠেলে দিয়েছে করোনাভাইরাস। ভয়াবহ এই সংকট পাল্টে দিচ্ছে চেনা বিশ্বটাকে। একটি ভাইরাস এসে যেন বিশ্বকে বুঝিয়ে দিল, কোনো দেশই ‘যথার্থ’ নয়।

উন্নয়নশীল ভুবনের বাসিন্দারা উন্নত দেশগুলোর দিকে আফসোসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে যে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন, আর উন্নত দেশগুলোর বাসিন্দারা গর্বিত ভঙ্গিতে তা দেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেন, এর সবই এখন মিলেমিশে একাকার। করোনায় পাল্টে যাওয়া চেহারা নিয়ে খোলনলচে বদলাতে চাইছে বিশ্ব।রূপান্তরের এই সময়ে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান রেস্তোরাঁ, জিম, বার আর পার্ক। বিবিসি ফিউচারে তুলে আনা হয়েছে সেসব বিষয়।

নতুন পরিকল্পনায় সাজাতে হবে নগর

অনেক দেশ এখন লকডাউন শিথিল করেছে। মুক্তির আনন্দ পেয়ে বাসিন্দারা তাঁদের পরিচিত জায়গাগুলোতে ছুটে যাচ্ছেন। তবে সেই চেনা জায়গাই এখন তাঁদের কাছে অচেনা ঠেকছে। জায়গাটি যে পাল্টে গেছে, তা নয়। তবে জায়গাটিতে অবস্থান করার জন্য যা কিছুর মধ্য দিয়ে তাঁদের যেতে হচ্ছে, তার সঙ্গে কয়েক মাস আগেও পরিচিতি ছিলেন না। মাস্ক পরতে হবে। একসঙ্গে প্রবেশ করতে পারবেন অল্পসংখ্যক মানুষ। কারণ, করোনার সংক্রমণ যদি আবার ছড়ায়, তাহলে ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত নতুনভাবে এটা দীর্ঘমেয়াদি রূপে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকবে। এটা হতে পারে নয় মাস থেকে দুই বছরের জন্য।

বিজ্ঞানীরা আরও মনে করেন, ২০২০ সালে করোনাভাইরাস যা করেছে, ভবিষ্যতে নতুন ও একই ধরনের ভয়াবহ রোগ মানবতাকে পঙ্গু করে ফেলতে পারে।
ভবিষ্যৎ নগর গড়ে তোলার পরিকল্পনায় যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের জন্য এই মহামারি একই সঙ্গে দুটো জিনিস শিখিয়ে দিল। এক. তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা। দুই. আমরা কীভাবে জীবান যাপন করব, চলাফেরা করব এবং একসঙ্গে বসবাস করব, তা নিয়ে নতুন করে ভাবনা।

করোনা দেখিয়েছে, মানুষ আইসোলেশনে ভালো থাকতে পারে না। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, কোয়ারেন্টিনে একা থাকতে থাকতে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে তা প্রভাব ফেলে। কখনো তা গুরুতর আকারও ধারণ করে। মানুষের জন্য সামাজিক মেলামেশার জায়গাটি নিরাপদ করে গড়ে তোলা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেয়েও অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

ইউরোপের দেশগুলো যখন প্রথম লকডাউনে প্রবেশ করল, তখন স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, বিষয়টি বুঝতে বিশেষজ্ঞরা ইতালিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ইতালীয় অ্যাসোসিয়েশন অব সিটিজ অ্যান্ড মিউনিসিপলিটিজের একজন নীতিনির্ধারণী বিশেষজ্ঞ সিমোনে দি অ্যান্তোনিও ‘কেফারে’ ওয়েবপোর্টালে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছেন, ‘ইতালির এখন ভয় ও আশঙ্কার সমাজের পরিবর্তে উজ্জীবিত সমাজ পুনরুদ্ধার করা জরুরি।’

বিবিসি ফিউচারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সিমোনে বলেছেন, ‘এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পর নুতন করে সবকিছু শুরু করার এক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের নতুন ঝুঁকি মোকাবিলার পাশাপাশি মানুষের হারানো অনুভূতি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। এর মানে হচ্ছে, জনসাধারণের জন্য তৈরি স্থান, স্থাপনা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। আমাদের সামাজিক আচার-আচরণ পাল্টাতে হবে। তবে সেটাকে সুযোগ হিসেবেও দেখা যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যেসব স্থানকে লোকজন অবহেলা করতেন, সেসব জায়গাতেও যাওয়া শুরু করতে পারেন।’ এ ক্ষেত্রে তিনি মিউনিখের ঐতিহ্যবাহী বিয়ার গার্ডেনের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে খোলা জায়গায় লম্বা টেবিলে লোকজন পানাহার করেন। অন্য শহরগুলোর প্রতিষ্ঠানগুলোও দূরত্ব বজায় রাখতে বসার আদর্শ ব্যবস্থা করতে পারে।

রেস্তোরাঁ-বারে আউটডোরকে গুরুত্ব দিতে হবে
ভেনিসের কাছাকাছি শহর সান দোনা দি পিয়াভের ডেপুটি মেয়র দানিয়েলে তেরজারিওল লকডাউন খুলে দেওয়ার পর বলেন, প্রশাসন চায় জনগণের জন্য উন্মুক্ত স্থানগুলোকে আরও কার্যকর ও সুন্দরভাবে ব্যবহার করতে। দূরত্ব রেখে জনসমাগমের জন্য শহরের কেন্দ্রস্থলের মূল জায়গাগুলোকে পায়ে চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। রেস্তোরাঁ ও বারের মালিকদের জন্য সবচেয়ে ভালো আউটডোর তৈরির জন্য পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, রেস্তোরাঁ ও বারে একসঙ্গে আসা-যাওয়া যেন নিরাপদ রেখে প্রবেশের সামনের জায়গাটির নকশা করা হয়।
ভারতের মতো দেশে গণপরিবহনে দূরত্ব বজায় রাখা কঠিন। ছবি: রয়টার্সভারতে লকডাউন শিথিল করে ধীরে ধীরে দোকানপাট খোলা হচ্ছে, সীমিত আকারে যোগাযোগব্যবস্থা চালু হচ্ছে। গোয়ার রেস্তোরাঁমালিক শেফালী গান্ধীর মতে, এই সময়ে প্রবেশপথের বাইরের অংশটুকু মূল গুরুত্ব পাবে। মুম্বাইয়ের মতো শহরে লোকজন দুই মাস ধরে খুপরি অ্যাপার্টমেন্টে বন্দী হয়ে পড়েছিলেন। লকডাউনের এই স্মৃতি মানুষের মনে দীর্ঘদিন থেকে যাবে। মানুষ খোলা জায়গায় সামাজিক জীবনের আনন্দ খুঁজে বেড়াবে। তাঁর মতে, বাস্তব দিক বিবেচনায় বাইরে বসার স্থান পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বাগান একটি ভালো জায়গা হতে পারে।

তবে আউটডোর হোক বা ইনডোর, ছোট জায়গাগুলোর ক্ষেত্রে যথাযথ দূরত্ব বজায় রাখা কঠিন হবে। সে ক্ষেত্রে অনেকে প্রতিটি টেবিলের জায়গা প্লাস্টিকের পর্দা দিয়ে ঘিরে দূরত্ব বজায় রাখার পরিকল্পনার কথা বলছেন। তবে অনেকে এর বিরোধিতা করছেন। বিরোধীদের মতে, এতে খাবার ভাগাভাগির আনন্দ থেকে মানুষ যেমন বঞ্চিত হবেন, তেমনি এতে এক ধরনের ‘জেলখানা’ ‘জেলখানা’ ভাবও আসবে।

আস্থা অর্জনই হবে মূল নিয়ামক
অনেক গবেষণা বলছে, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে আস্থা অর্জনের বিষয়টি। সেসব গবেষণায় আস্থার বিষয়টিকে চিহ্নিত করা হয়েছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের মেরুদণ্ড হিসেবে। স্বাভাবিক জীবেন ফিরে যেতে যেকোনো স্থানে মানুষের মনে এই বিশ্বাস আনতে হবে যে তিনি সেখানে নিরাপদ এবং অন্যরাও নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করছে।

ভারতের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অদিতি রাঠোর মতে, উন্মুক্ত বা ব্যক্তিগত যেকোনো স্থানে সমাগমের ক্ষেত্রে মানুষের আত্মবিশ্বাস পুনর্গঠনে আস্থাই এখন মূল চাবিকাঠি।

সুস্থ থাকতে জিমে যাওয়া জরুরি নয়

জিমগুলো তাদের সদস্যদের নিরাপত্তার স্বার্থে এই মহামারির শুরুতেই ব্যবস্থা নেয়। জিমগুলোই প্রথম সরকারের দেওয়া বিধিনিষেধের আগেই পরিচ্ছন্নতাসহ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এস্কেপ ফিটনেসের ৮০টিরও বেশি দেশে চেইন জিম রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের হেড অব কনটেন্ট হ্যাকনে-উইলিয়ামসের মতে, এই লকডাউনে মানুষের মধ্যে এই উপলব্ধি এসেছে যে নিজেকে ফিট রাখতে জিমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দেওয়া জরুরি নয়। পার্কে দৌড়ানো বা হালকা রুটিন মেনে চলাই সুস্থ থাকার জন্য যথেষ্ট। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে মানুষ জিমকে অভিজাত স্থান হিসেবে না দেখে সুস্থ থাকার জায়গা হিসেবে দেখবেন বলে তাঁর আশা।

করোনাভাইরাস মহামারি সর্বসাধারণের চলাচলের বা ব্যবহারের জায়গাকে নতুনভাবে বিন্যাস করতে বাধ্য করেছে। লকডাউন মানুষকে ভাবতে সময় দিয়েছে যে আমরা সামাজিক জীবনকেও এই রকম দেখতে চাই। ভিড়-ভাট্টা, লোকে গিজগিজ বার, থিয়েটার ও জিমকে আমাদের বিদায় জানাতে হতে পারে, যেসব ছিল আমাদের পছন্দের বিষয়, অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও। তবে আমাদের সামনে অনন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে নতুন স্থানে একসঙ্গে থাকার মানে আবারও আবিষ্কারের, করোনাভাইরাসের এই দাগ থেকে নতুন কিছু কল্পনার।