বাধা পেরিয়ে প্রথম বিসিএসেই প্রশাসন ক্যাডারে রাসেল

  • Update Time : ০১:৩১:২৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ মে ২০২২
  • / 964

রাসেল মুন্সী ৪০তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার শৈশব ও বেড়ে ওঠা খুলনার দৌলতপুরেই। তার বাবা আসলাম মুন্সী একটি ফ্যাক্টরির শ্রমিক এবং মা তরুণী বেগম একজন গৃহিণী।

তিনি ২০১১ সালে সরকারি দৌলতপুর মুহসিন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০১৩ খুলনা সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিন বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।

বর্তমানে তিনি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকশন অফিসার (গ্রেড-২) পদে কর্মরত রয়েছে। সম্প্রতি তার বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন বিডি সমাচারকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—

বিডি সমাচার: আপনার শৈশবের কাটানো দিনগুলি কেমন ছিল?

রাসেল মুন্সী: ছোটবেলায় ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার প্রতি অত্যন্ত ঝোঁক ছিলো। সবসময় মনটা খেলার মাঠে যাওয়ার জন্য আনচান করতো। বিশেষ করে টেলিভিশনে সম্প্রচার হওয়া কোনো ক্রিকেট খেলায় মিস করতাম না। শচীন টেন্ডুলকার ছিলো আমার প্রিয় ক্রিকেটার। আমাদের তখন টেলিভিশন ছিলো না, শচীনের খেলা দেখার জন্য ছুটে যেতাম অন্যদের বাড়িতে। আমার মা আমার প্রতি বিরক্ত হয়ে বলতেন,” তুই কি শচীন টেন্ডুলকার হতে পারবি,মেসি হতে পারবি? যদি না হতে পারিস তাহলে মন দিয়ে পড়াশোনা কর।” এভাবে মায়ের কড়া শাসনের মধ্যে থেকেই আজকের অবস্থানে এসেছি। সত্য কথা বলতে আমার মা এখনো আমাকে সেই ছোট্ট বেলার মতোই শাসন করেন। আর আমি আমার মায়ের সকল আদেশ নির্দেশ সর্বোচ্চ মেনে চলার চেষ্টা করি। খুব ছোটবেলায় আমার অধিকাংশ সময় কেটেছে যশোরের বসুন্দিয়ায় আমার মামা বাড়িতে। ঐখানে কিছুদিনের জন্য আমাকে একটা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল। পরবর্তীতে কয়েক মাস পরেই আমি খুলনায় চলে আসি।

বিডি সমাচার: আপনার পড়াশোনায় কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল?

রাসেল মুন্সী: আসলে শৈশব কাল থেকেই অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিয়েই আমাকে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। আর্থিক অসচ্ছলতা ও পারিবারিক নানা সমস্যার কারণেই ছোটবেলায় আমাকে অনেকসময়ই আমার মামা বাড়িতে কাটাতে হয়েছে। অত্যন্ত আর্থিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমার আব্বু আম্মু আমাকে পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং আমি সর্বদা তাদের স্বপ্ন পূরণের পথেই হেঁটেছি। জীবনের চলার পথে
কষ্টের অনেক স্মৃতি রয়েছে। সেই স্মৃতিগুলো থেকে প্রতিনিয়ত শিক্ষা নিয়ে নিজেকে গঠন করার চেষ্টা করেছি।

বিডি সমাচার: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছেন কবে থেকে?

রাসেল মুন্সী: উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর আমি মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমি মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় একটা বড় ধরণের হোঁচট খাই। যা আমাকে অত্যন্ত ব্যথিত করে। তারপর আমি মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাই। তখন থেকেই ধীরে ধীরে জানতে পারি যে বিসিএসের মাধ্যমে জনগণের সর্বোচ্চ সেবা করা সম্ভব এবং বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে এই সুযোগ সবচেয়ে বেশি। তাই তখন থেকেই দেশ ও জাতির সেবায় নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার লক্ষ্যে বিসিএস(প্রশাসন) ক্যাডারে যোগদান করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি।

বিডি সমাচার: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, পাশাপাশি প্রস্তুতি কিভাবে নিয়েছেন?

রাসেল মুন্সী: বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময় থেকেই বিসিএসের জন্য ধীরে ধীরে প্রস্তুতি শুরু করি। পত্রিকা ও ফেসবুকে বিভিন্ন বিসিএস ক্যাডারদের লেখা পড়তাম আর নিজের প্রস্তুতি কৌশল সাজানোর চেষ্টা করতাম। অনার্সের শেষের দিকে এসে ওরাকলে ভর্তি হই এবং বিসিএস সিলেবাস অনুসরণ করে প্রস্তুতি নিতে থাকি। অনার্সের শেষে আমি “চিরন্তন জব এইড” নামে একটি চাকরির কোচিং পরিচালনা করি। এই চাকরির কোচিং-এ পড়ানো আমাকে বিসিএস এর প্রস্তুতি নিতে অনেক বেশি সহায়তা করেছে। ৪০ তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি ও আমার মাস্টার্স ১ম টার্মের পরীক্ষা একইসময়ে পড়ছিল। অনেক চাপের মধ্যেই বিসিএস প্রিলিমিনারিতে অংশগ্রহণ করি এবং আলহামদুলিল্লাহ সফল হই। প্রিলিমিনারি প্রস্তুতির সময় আমি সবসময় চেষ্টা করতাম ট্রেনের লাস্ট বগিটা ধরতে, কারণ প্রিলিমিনারিতে পাশ করতে পারলেই হলো সর্বোচ্চ মার্ক পাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। শেষ সময়ে আমি অনেকগুলো মডেল টেস্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। পরীক্ষা শেষে সবসময় আমার প্রাপ্ত নম্বর আ্যনালাইসিস করে দুর্বলতা খুঁজে বের করে সেখানে পরিমিত সময় দেওয়ার চেষ্টা করতাম। এভাবে পড়াশোনা করেই আলহামদুলিল্লাহ পরপর ৩ টি বিসিএস ৪০,৪১ও ৪৩ এর প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই।

লিখিত পরীক্ষার আগে আমরা প্রায় ৭ মাস সময় পেয়েছিলাম। সিলেবাস অনুসরণ করে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। কিন্তু লিখিত পরীক্ষার বিশাল সিলেবাসের কিছুই যেন শেষ হচ্ছিল না। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির জন্য পত্রিকা থেকে গুরুত্বপূর্ন টপিক নোট করার চেষ্টা করতাম। ইংরেজির জন্য তেমন কিছু পড়া লাগেনি তবে অনুবাদ প্রাকটিস করতাম৷ বিজ্ঞানের বিশাল সিলেবাসের মধ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিজে সাজেশন করে পড়ার চেষ্টা করতাম। বাংলায় ব্যাকরণ ও সাহিত্য অংশ গুরুত্ব দিয়ে পড়েছি। গণিত লিখিত সিলেবাস অনুসরণ করে প্র্যাকটিস করেছি। আর মানসিক দক্ষতার জন্য প্রিলির প্রস্তুতির পরে নতুন করে আর দেখার সুযোগ হয়নি। হঠাৎ মাত্র ২৩ দিন আগে আমাদের লিখিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা হয়। পরীক্ষার সিডিউল ঘোষণার পর থেকে সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু পড়াশোনার চেষ্টা করি।

লিখিত পরীক্ষার পরপরই ভাইভার প্রস্তুতি শুরু করি। নিজ সাবজেক্ট, নিজের জেলা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের সংবিধান, বর্তমান সরকারের কার্যক্রম, পত্রিকায় সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনাবলি গুরুত্ব দিয়ে পড়ার চেষ্টা করতাম। এর পাশাপাশি কয়েকটা মডেল ভাইবায় অংশগ্রহণ করে নিজেকে আরো শাণিত করে তোলার চেষ্টা করেছি।

বিডি সমাচার: বিসিএস যাত্রায় কাদের থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন?

রাসেল মুন্সী: আমার সফলতার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান আমার আম্মুর। আমার মা জীবনভর অনেক সংগ্রাম করে আমাকে আজকের অবস্থানে এনেছেন। আমার আব্বুও আমার সফলতার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা আমার শিক্ষার ভিত্তিটা অনেক মজবুত করে গড়ে তুলতে সহায়তা করেছেন যা আমাকে প্রথম বিসিএসেই প্রশাসন ক্যাডার উপহার দিয়েছে। আমার স্ত্রী সর্বদা আমাকে মানসিক সাপোর্ট দিয়ে নানা সংগ্রামের মধ্যে টিকে থাকতে সহায়তা করেছে। এছাড়াও আমার ছোট বোন, আত্মীয় স্বজন, সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধবী, ছাত্র-ছাত্রী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা সবাই আমার জন্য অনেক বেশি দোয়া করেছে। আমি তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞ।

বিডি সমাচার: নতুনদের বিসিএস প্রিলির প্রস্তুতি নিয়ে আপনার পরামর্শ কি?

রাসেল মুন্সী: বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণের পূর্বে সর্বপ্রথম মন স্থির করতে হবে যে অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে সম্পূর্ণ বিসিএস জার্নিটা উপভোগ করবো। পিএসসি’র সাবেক চেয়ারম্যান ড. সাদিক স্যার বলেছেন, ” বিসিএস মেধাবীদের জন্য নয়, বিসিএস ধৈর্যশীল মেধাবীদের জন্য।” কথাটা আসলেই সত্য। এই চরম সত্য মাথায় রেখেই নতুনদের বিসিএস যাত্রা শুরু করতে হবে। এ যাত্রার শুরুতেই বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার সিলেবাস অনুসরণ করে টপিক ধরে ধরে গুছিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে। এক্ষেত্রে যে টপিক থেকে বেশি মার্ক আসার নিশ্চয়তা রয়েছে সেখানে বেশি সময় দিতে হবে। এভাবে বিগত বিসিএস প্রশ্ন প্যাটার্ণ অ্যানালাইসিস করে প্রস্তুতি কৌশল সাজাতে হবে। প্রতিদিন পড়ার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে এবং নিয়মিত পড়াশোনায় সময় দিতে হবে। অনেকেই আমাদের কাছে প্রশ্ন করে, ” কত ঘন্টা পড়া উচিত?” আসলে নিজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও পরিমিত ঘুমের সময় বাদ দিয়ে বাকি সবসময় পড়াশোনা করা উচিত বলে আমি মনে করি। তাই নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। এভাবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার সাথে সাথে অবশ্যই মহান সৃষ্টিকর্তাকে বেশি বেশি স্মরণ করতে হবে। নিয়মিত নামাজ পড়া ও প্রার্থনা করতে হবে৷ কখনো কখনো মনের আকাশে হতাশার কালো মেঘ জমতে শুরু করবে। কিন্তু হতাশ না হয়ে আমাদের আশায় বুক বাঁধতে হবে। মহাপবিত্র আল কুরআনে বলা হয়েছে, ” কষ্টের পরেই স্বস্তি আছে।”

বিডি সমাচার: বিসিএস লিখিত প্রস্তুতিতে কিভাবে পড়াশোনা করতে হবে?

রাসেল মুন্সী: প্রিলিমিনারি পরীক্ষার পর থেকে লিখিত পরীক্ষার আগে প্রায় ৫/৬ মাস সময় সাধারণত থাকে। বিসিএস লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য এই সময়টা অত্যন্ত স্বল্প। তাই বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার পরদিন থেকেই প্রিলি পরীক্ষা ভালো হলে লিখিত প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করতে হবে। লিখিত পরীক্ষার বিশাল সিলেবাস শেষ করার জন্য একটু কৌশল অবলম্বনের চেষ্টা করতে হবে। বিসিএস লিখিত সিলেবাস থেকে খুঁজে বের করতে হবে কোথায় কোথায় ফুল মার্ক পাওয়া সম্ভব, সেগুলো যত্ন সহাকারে পড়ে ফেলতে হবে। ইংরেজি ও গণিত নিয়মিত প্র্যাকটিস করতে হবে। নিয়মিত পত্রিকা পড়ে সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নোট করতে হবে। ম্যাপ,ডাটা,চার্ট, উক্তির মাধ্যমে খাতার উপস্থাপনা আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে নীল রঙের কালার পেন ব্যবহার করা যাবে। এছাড়া লিখিত পরীক্ষায় ভালো করার জন্য বেশি বেশি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। হাতের লেখার গতি ও টাইম ম্যানেজমেন্ট ভালো না হলে অনেক ভালো প্রস্তুতি নিয়েও সফলতার দেখা মিলবে না। তাই লিখিত পরীক্ষায় টাইম ম্যানেজমেন্ট এর বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।

বিডি সমাচার: বিসিএস ভাইবা প্রস্তুতি কেমন হবে?

রাসেল মুন্সী: ভাইভা পরীক্ষার মাধ্যমে মূলত পরীক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব, উপস্থাপন দক্ষতা, চাপ মোকাবেলার সক্ষমতা, ভাষাগত দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা, আ্যটিচিউড, সাধারণ জ্ঞান, বিশ্লেষণী দক্ষতা প্রভৃতি যাচাই করা হয়। এজন্য নিজ সাবজেক্ট, নিজের জেলা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের সংবিধান, বর্তমান সরকারের কার্যক্রম, পত্রিকায় সাম্প্রতিক দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন ঘটনাবলি গুরুত্ব দিয়ে পড়ার চেষ্টা করতে হবে। এর পাশাপাশি কয়েকটা মডেল ভাইভায় অংশগ্রহণ করে নিজের দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করলে ভাইভা প্রস্তুতি আরো যুতসই হবে ইনশাআল্লাহ।

বিডি সমাচার: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?

রাসেল মুন্সী: ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল মানুষের উপকারে নিজেকে নিয়োজিত করার। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাকে সেই সুযোগটা করে দিয়েছেন। তাই এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে সর্বোচ্চ নিযুক্ত রাখার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

Please Share This Post in Your Social Media


বাধা পেরিয়ে প্রথম বিসিএসেই প্রশাসন ক্যাডারে রাসেল

Update Time : ০১:৩১:২৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ মে ২০২২

রাসেল মুন্সী ৪০তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার শৈশব ও বেড়ে ওঠা খুলনার দৌলতপুরেই। তার বাবা আসলাম মুন্সী একটি ফ্যাক্টরির শ্রমিক এবং মা তরুণী বেগম একজন গৃহিণী।

তিনি ২০১১ সালে সরকারি দৌলতপুর মুহসিন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০১৩ খুলনা সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিন বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।

বর্তমানে তিনি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকশন অফিসার (গ্রেড-২) পদে কর্মরত রয়েছে। সম্প্রতি তার বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন বিডি সমাচারকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—

বিডি সমাচার: আপনার শৈশবের কাটানো দিনগুলি কেমন ছিল?

রাসেল মুন্সী: ছোটবেলায় ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার প্রতি অত্যন্ত ঝোঁক ছিলো। সবসময় মনটা খেলার মাঠে যাওয়ার জন্য আনচান করতো। বিশেষ করে টেলিভিশনে সম্প্রচার হওয়া কোনো ক্রিকেট খেলায় মিস করতাম না। শচীন টেন্ডুলকার ছিলো আমার প্রিয় ক্রিকেটার। আমাদের তখন টেলিভিশন ছিলো না, শচীনের খেলা দেখার জন্য ছুটে যেতাম অন্যদের বাড়িতে। আমার মা আমার প্রতি বিরক্ত হয়ে বলতেন,” তুই কি শচীন টেন্ডুলকার হতে পারবি,মেসি হতে পারবি? যদি না হতে পারিস তাহলে মন দিয়ে পড়াশোনা কর।” এভাবে মায়ের কড়া শাসনের মধ্যে থেকেই আজকের অবস্থানে এসেছি। সত্য কথা বলতে আমার মা এখনো আমাকে সেই ছোট্ট বেলার মতোই শাসন করেন। আর আমি আমার মায়ের সকল আদেশ নির্দেশ সর্বোচ্চ মেনে চলার চেষ্টা করি। খুব ছোটবেলায় আমার অধিকাংশ সময় কেটেছে যশোরের বসুন্দিয়ায় আমার মামা বাড়িতে। ঐখানে কিছুদিনের জন্য আমাকে একটা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল। পরবর্তীতে কয়েক মাস পরেই আমি খুলনায় চলে আসি।

বিডি সমাচার: আপনার পড়াশোনায় কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল?

রাসেল মুন্সী: আসলে শৈশব কাল থেকেই অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিয়েই আমাকে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। আর্থিক অসচ্ছলতা ও পারিবারিক নানা সমস্যার কারণেই ছোটবেলায় আমাকে অনেকসময়ই আমার মামা বাড়িতে কাটাতে হয়েছে। অত্যন্ত আর্থিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমার আব্বু আম্মু আমাকে পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং আমি সর্বদা তাদের স্বপ্ন পূরণের পথেই হেঁটেছি। জীবনের চলার পথে
কষ্টের অনেক স্মৃতি রয়েছে। সেই স্মৃতিগুলো থেকে প্রতিনিয়ত শিক্ষা নিয়ে নিজেকে গঠন করার চেষ্টা করেছি।

বিডি সমাচার: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছেন কবে থেকে?

রাসেল মুন্সী: উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর আমি মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমি মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় একটা বড় ধরণের হোঁচট খাই। যা আমাকে অত্যন্ত ব্যথিত করে। তারপর আমি মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাই। তখন থেকেই ধীরে ধীরে জানতে পারি যে বিসিএসের মাধ্যমে জনগণের সর্বোচ্চ সেবা করা সম্ভব এবং বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে এই সুযোগ সবচেয়ে বেশি। তাই তখন থেকেই দেশ ও জাতির সেবায় নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার লক্ষ্যে বিসিএস(প্রশাসন) ক্যাডারে যোগদান করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি।

বিডি সমাচার: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, পাশাপাশি প্রস্তুতি কিভাবে নিয়েছেন?

রাসেল মুন্সী: বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময় থেকেই বিসিএসের জন্য ধীরে ধীরে প্রস্তুতি শুরু করি। পত্রিকা ও ফেসবুকে বিভিন্ন বিসিএস ক্যাডারদের লেখা পড়তাম আর নিজের প্রস্তুতি কৌশল সাজানোর চেষ্টা করতাম। অনার্সের শেষের দিকে এসে ওরাকলে ভর্তি হই এবং বিসিএস সিলেবাস অনুসরণ করে প্রস্তুতি নিতে থাকি। অনার্সের শেষে আমি “চিরন্তন জব এইড” নামে একটি চাকরির কোচিং পরিচালনা করি। এই চাকরির কোচিং-এ পড়ানো আমাকে বিসিএস এর প্রস্তুতি নিতে অনেক বেশি সহায়তা করেছে। ৪০ তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি ও আমার মাস্টার্স ১ম টার্মের পরীক্ষা একইসময়ে পড়ছিল। অনেক চাপের মধ্যেই বিসিএস প্রিলিমিনারিতে অংশগ্রহণ করি এবং আলহামদুলিল্লাহ সফল হই। প্রিলিমিনারি প্রস্তুতির সময় আমি সবসময় চেষ্টা করতাম ট্রেনের লাস্ট বগিটা ধরতে, কারণ প্রিলিমিনারিতে পাশ করতে পারলেই হলো সর্বোচ্চ মার্ক পাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। শেষ সময়ে আমি অনেকগুলো মডেল টেস্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। পরীক্ষা শেষে সবসময় আমার প্রাপ্ত নম্বর আ্যনালাইসিস করে দুর্বলতা খুঁজে বের করে সেখানে পরিমিত সময় দেওয়ার চেষ্টা করতাম। এভাবে পড়াশোনা করেই আলহামদুলিল্লাহ পরপর ৩ টি বিসিএস ৪০,৪১ও ৪৩ এর প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই।

লিখিত পরীক্ষার আগে আমরা প্রায় ৭ মাস সময় পেয়েছিলাম। সিলেবাস অনুসরণ করে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। কিন্তু লিখিত পরীক্ষার বিশাল সিলেবাসের কিছুই যেন শেষ হচ্ছিল না। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির জন্য পত্রিকা থেকে গুরুত্বপূর্ন টপিক নোট করার চেষ্টা করতাম। ইংরেজির জন্য তেমন কিছু পড়া লাগেনি তবে অনুবাদ প্রাকটিস করতাম৷ বিজ্ঞানের বিশাল সিলেবাসের মধ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিজে সাজেশন করে পড়ার চেষ্টা করতাম। বাংলায় ব্যাকরণ ও সাহিত্য অংশ গুরুত্ব দিয়ে পড়েছি। গণিত লিখিত সিলেবাস অনুসরণ করে প্র্যাকটিস করেছি। আর মানসিক দক্ষতার জন্য প্রিলির প্রস্তুতির পরে নতুন করে আর দেখার সুযোগ হয়নি। হঠাৎ মাত্র ২৩ দিন আগে আমাদের লিখিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা হয়। পরীক্ষার সিডিউল ঘোষণার পর থেকে সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু পড়াশোনার চেষ্টা করি।

লিখিত পরীক্ষার পরপরই ভাইভার প্রস্তুতি শুরু করি। নিজ সাবজেক্ট, নিজের জেলা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের সংবিধান, বর্তমান সরকারের কার্যক্রম, পত্রিকায় সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনাবলি গুরুত্ব দিয়ে পড়ার চেষ্টা করতাম। এর পাশাপাশি কয়েকটা মডেল ভাইবায় অংশগ্রহণ করে নিজেকে আরো শাণিত করে তোলার চেষ্টা করেছি।

বিডি সমাচার: বিসিএস যাত্রায় কাদের থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন?

রাসেল মুন্সী: আমার সফলতার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান আমার আম্মুর। আমার মা জীবনভর অনেক সংগ্রাম করে আমাকে আজকের অবস্থানে এনেছেন। আমার আব্বুও আমার সফলতার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা আমার শিক্ষার ভিত্তিটা অনেক মজবুত করে গড়ে তুলতে সহায়তা করেছেন যা আমাকে প্রথম বিসিএসেই প্রশাসন ক্যাডার উপহার দিয়েছে। আমার স্ত্রী সর্বদা আমাকে মানসিক সাপোর্ট দিয়ে নানা সংগ্রামের মধ্যে টিকে থাকতে সহায়তা করেছে। এছাড়াও আমার ছোট বোন, আত্মীয় স্বজন, সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধবী, ছাত্র-ছাত্রী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা সবাই আমার জন্য অনেক বেশি দোয়া করেছে। আমি তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞ।

বিডি সমাচার: নতুনদের বিসিএস প্রিলির প্রস্তুতি নিয়ে আপনার পরামর্শ কি?

রাসেল মুন্সী: বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণের পূর্বে সর্বপ্রথম মন স্থির করতে হবে যে অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে সম্পূর্ণ বিসিএস জার্নিটা উপভোগ করবো। পিএসসি’র সাবেক চেয়ারম্যান ড. সাদিক স্যার বলেছেন, ” বিসিএস মেধাবীদের জন্য নয়, বিসিএস ধৈর্যশীল মেধাবীদের জন্য।” কথাটা আসলেই সত্য। এই চরম সত্য মাথায় রেখেই নতুনদের বিসিএস যাত্রা শুরু করতে হবে। এ যাত্রার শুরুতেই বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার সিলেবাস অনুসরণ করে টপিক ধরে ধরে গুছিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে। এক্ষেত্রে যে টপিক থেকে বেশি মার্ক আসার নিশ্চয়তা রয়েছে সেখানে বেশি সময় দিতে হবে। এভাবে বিগত বিসিএস প্রশ্ন প্যাটার্ণ অ্যানালাইসিস করে প্রস্তুতি কৌশল সাজাতে হবে। প্রতিদিন পড়ার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে এবং নিয়মিত পড়াশোনায় সময় দিতে হবে। অনেকেই আমাদের কাছে প্রশ্ন করে, ” কত ঘন্টা পড়া উচিত?” আসলে নিজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও পরিমিত ঘুমের সময় বাদ দিয়ে বাকি সবসময় পড়াশোনা করা উচিত বলে আমি মনে করি। তাই নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। এভাবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার সাথে সাথে অবশ্যই মহান সৃষ্টিকর্তাকে বেশি বেশি স্মরণ করতে হবে। নিয়মিত নামাজ পড়া ও প্রার্থনা করতে হবে৷ কখনো কখনো মনের আকাশে হতাশার কালো মেঘ জমতে শুরু করবে। কিন্তু হতাশ না হয়ে আমাদের আশায় বুক বাঁধতে হবে। মহাপবিত্র আল কুরআনে বলা হয়েছে, ” কষ্টের পরেই স্বস্তি আছে।”

বিডি সমাচার: বিসিএস লিখিত প্রস্তুতিতে কিভাবে পড়াশোনা করতে হবে?

রাসেল মুন্সী: প্রিলিমিনারি পরীক্ষার পর থেকে লিখিত পরীক্ষার আগে প্রায় ৫/৬ মাস সময় সাধারণত থাকে। বিসিএস লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য এই সময়টা অত্যন্ত স্বল্প। তাই বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার পরদিন থেকেই প্রিলি পরীক্ষা ভালো হলে লিখিত প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করতে হবে। লিখিত পরীক্ষার বিশাল সিলেবাস শেষ করার জন্য একটু কৌশল অবলম্বনের চেষ্টা করতে হবে। বিসিএস লিখিত সিলেবাস থেকে খুঁজে বের করতে হবে কোথায় কোথায় ফুল মার্ক পাওয়া সম্ভব, সেগুলো যত্ন সহাকারে পড়ে ফেলতে হবে। ইংরেজি ও গণিত নিয়মিত প্র্যাকটিস করতে হবে। নিয়মিত পত্রিকা পড়ে সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নোট করতে হবে। ম্যাপ,ডাটা,চার্ট, উক্তির মাধ্যমে খাতার উপস্থাপনা আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে নীল রঙের কালার পেন ব্যবহার করা যাবে। এছাড়া লিখিত পরীক্ষায় ভালো করার জন্য বেশি বেশি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। হাতের লেখার গতি ও টাইম ম্যানেজমেন্ট ভালো না হলে অনেক ভালো প্রস্তুতি নিয়েও সফলতার দেখা মিলবে না। তাই লিখিত পরীক্ষায় টাইম ম্যানেজমেন্ট এর বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।

বিডি সমাচার: বিসিএস ভাইবা প্রস্তুতি কেমন হবে?

রাসেল মুন্সী: ভাইভা পরীক্ষার মাধ্যমে মূলত পরীক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব, উপস্থাপন দক্ষতা, চাপ মোকাবেলার সক্ষমতা, ভাষাগত দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা, আ্যটিচিউড, সাধারণ জ্ঞান, বিশ্লেষণী দক্ষতা প্রভৃতি যাচাই করা হয়। এজন্য নিজ সাবজেক্ট, নিজের জেলা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের সংবিধান, বর্তমান সরকারের কার্যক্রম, পত্রিকায় সাম্প্রতিক দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন ঘটনাবলি গুরুত্ব দিয়ে পড়ার চেষ্টা করতে হবে। এর পাশাপাশি কয়েকটা মডেল ভাইভায় অংশগ্রহণ করে নিজের দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করলে ভাইভা প্রস্তুতি আরো যুতসই হবে ইনশাআল্লাহ।

বিডি সমাচার: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?

রাসেল মুন্সী: ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল মানুষের উপকারে নিজেকে নিয়োজিত করার। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাকে সেই সুযোগটা করে দিয়েছেন। তাই এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে সর্বোচ্চ নিযুক্ত রাখার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।