মনির-ইনামুলের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষে আরও সংকটে হেফাজতে ইসলাম
- Update Time : ০৮:০৮:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ মে ২০২১
- / 210
রাজধানীর জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদ্রাসার মুহতারিম ও হেফাজতে ইসলামের সাবেক অর্থ সম্পাদক মনির হোসেন কাসেমীর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ, অর্থলিপসা এবং জুনায়েদ বাবুনগরীর খাদেম ইনামুল হাসান ফারুকীর স্বেচ্ছাচারিতার কারণে গভীর সংকটে হেফাজতে ইসলাম। এই দুই ষড়যন্ত্রকারী দীর্ঘদিন ধরে হেফাজতে ইসলামের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করেছেন। এতে একদিকে তারা যেমন অঢেল অর্থ সম্পত্তির মালিক হয়েছেন, অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামকে ব্যবহার করেছেন নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের ঢাল হিসেবে। তদন্ত সংশ্নিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
মনির হোসেন কাসেমীকে গত শুক্রবার বারিধারা থেকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তার বিরুদ্ধে সহিংসতা ও নাশকতার একাধিক মামলা রয়েছে। নারায়ণগঞ্জে সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনাতেও জড়িত ছিলেন এই হেফাজত নেতা। শনিবার তাকে চারদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। শুক্রবার রাতে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ইনামুল হাসান ফারুকী।
তদন্ত সংশ্নিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মনির হোসেন কাসেমী বারিধারা মাদ্রাসা দখল নিতে ভারপ্রাপ্ত মুহতারিম মাওলানা নাজমুল হাসানকে মাদ্রাসায় না আসার জন্য বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়েছেন। অথচ মাওলানা নাজমুল হাসানকে নুর হোসেন কাসেমী জীবদ্দশায় ভারপ্রাপ্ত মুহতারিম হিসেবে অসিয়ত করে যান। সরকারবিরোধীদের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করার জন্য বারিধারা মাদ্রাসা দখলে নিয়ে ভবিষ্যতে হেফাজতে ইসলাম ও সরকারবিরোধী গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করাই ছিল মনির হোসেন ও তার সহযোগীদের মূল লক্ষ্য।
মনির হোসেন বারিধারা মাদ্রাসার গরিব, অসহায় ছাত্রদের ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্য এবং গুলশান, বনানী, বারিধারার ধনাঢ্য ও দানশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ চাঁদার টাকা সংগ্রহ করেছেন। অথচ এ টাকার সিকিভাগও মাদ্রাসা ছাত্রদের পেছনে ব্যয় করেননি তিনি। চাঁদার টাকায় রাজধানী ঢাকার অভিজাতপাড়ায় গড়ে তুলেছেন আলিসান বাড়ি। ছাত্রদের নামে তোলা চাঁদার টাকায় আয়েশি জীবনযাপন করছেন তিনি। তিনি অতীতেও এ ধরনের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটিয়েছেন। এরমধ্যে গাজীপুরের শ্রীপুর মাদ্রাসায় চাকরিকালীন কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন মনির হোসেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মনিরের এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী এসব তথ্য জানিয়েছেন।
তদন্ত সংশ্নিষ্ট সূত্র আরও জানিয়েছে, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসার পরে তাদের সাহায্যার্থে বিশ্বের বিভিন্ন দাতা সংস্থা অর্থ সাহায্য করে। মনির হোসেন কাসেমী ওই চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে রোহিঙ্গাদের পেছনে ব্যয় না করে নিজে আত্মসাৎ করেছেন।
এছাড়াও হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী বাঙালিসহ বিদেশিদের অনুদানকৃত অর্থও আত্মসাতের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। বারিধারা মাদ্রাসা দখল, মাদ্রাসা ছাত্রদের নামে টাকা আদায়, রোহিঙ্গাদের নামে আসা অর্থ, হেফাজতের নামে আদায়কৃত টাকা-সবকিছুই মনির হোসেন কাসেমী ব্যক্তিগত রাজনৈতিক উচ্চভিলাষ বাস্তবায়নে ব্যয় করে আসছিলেন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার সংসদীয় আসন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের প্রার্থী হিসেবে এ টাকার একটি বড় অংশ খরচ করেছেন।
এদিকে হেফাজতে ইসলামের আমীর জুনায়েদ বাবুনগরীর খাদেম ইনামুল হাসান ফারুকী একচ্ছত্রভাবে হাটহাজারী মাদ্রাসাসহ হেফাজতে ইসলামকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন। ইনামুলের কূটকৌশলের কাছে জিম্মি হেফাজতের আমীর জুনায়েদ বাবুনগরী। বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মসহ রাতারাতি বিশাল বিত্তবৈভবের মালিক বনে গেছেন ইনাম।
তদন্ত সংশ্নিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, হাটহাজারী মাদ্রাসায় ছাত্র বিক্ষোভের নেতৃত্বে ছিলেন মুলত ইনামুল হাসান ফারুকী। বিভিন্ন উপায়ে ছাত্রদের উত্তেজিত করে বিক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালেন তিনি। মাদ্রাসার ছাত্রদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার, দলাদলি ইত্যাদি কারণে ছাত্ররা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। হাটহাজারী মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা যেন তার নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। এ কাজে তিনি কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছেন বাবুনগরীকে কব্জা করে। বাবুনগরীর চারপাশে এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে নিজেই সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন তিনি। যার কারণে অন্য কোনো খাদেম কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী বাবুনগরীর ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেন না। ইনামুল হাসানের কর্মকাণ্ডে হাটহাজারী মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষকসহ ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।
জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতের আমীর হলেও ইনামুল তাকে কৌশলে হেফাজতের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবিত করেছেন। অনেক ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ নিয়ে হেফাজতের পদ পাইয়ে দেন। এছাড়া নিজে হাটহাজারীর বাসিন্দা না হয়েও হাটহাজারী পৌরসভা হেফাজতে ইসলামের সহকারী প্রচার সম্পাদক পদটি বাগিয়ে নেন তিনি। খাদেম ইনামুল হাসানের কর্মকাণ্ডে হেফাজতে ইসলামের গ্রেফতার করা নেতৃবৃন্দসহ ইসলামী অঙ্গনে ক্ষোভ রয়েছে। হেফাজতের বিস্তৃতি দেশব্যাপী হলেও এর নেতৃবৃন্দ কেউ সরাসরি বাবুনগরীর সঙ্গে কথা বলতে পারে না, যা নিয়ে হেফাজতের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বিরক্ত ও বাবুনগরীকে দোষারোপ করেন। এতে বাবুনগরীর ইমেজ দিন দিন চরম সংকটের মধ্যে পতিত হচ্ছে।
নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান ইনামুল হাসান ফারুকী। তার বাবার বিরুদ্ধে রয়েছে চেক জালিয়াতির অভিযোগ। অথচ বাবুনগরী হাটহাজারী মাদ্রাসার সর্বেসর্বা হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে তার নিজ বাড়িতে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। বিভিন্ন উৎস থেকে একাধিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য বাবুনগরীর নাম ভাঙিয়ে তিনি নগদ অর্থ, তার বাবা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নামে বিকাশ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করেন। তিনি ব্যক্তিগত ও আত্মীয়-স্বজনদের নানা সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিতে বাবুনগরীকে দিয়ে বিভিন্ন মহলে তদবির করান। সম্প্রতি ইনামুল ঘটা করে তার বিয়ের উৎসব করেন। বিয়েতে দুটি হেলিকপ্টার ভাড়া করেন তিনি। হেলিকপ্টারে অতিথি আনা-নেওয়া করা হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানে খরচ করেছেন লাখ লাখ টাকা। বিয়ে করেছেন কুয়েতপ্রবাসী কনেকে। এর উদ্দেশ্য যেমন কনের বাবার অর্থ সম্পদ করায়ত্ব করা, অন্যদিকে বাংলাদেশি টাকা কুয়েতে পাচার করা।
তদন্ত সংশ্নিষ্টরা জানান, জুনায়েদ বাবুনগরী কোথায় কোন মাহফিলে অতিথি হয়ে যাবেন তা নির্ভর করে খাদেম ইনামুলের ওপর। অনেক ক্ষেত্রে বাবুনগরীর শরীর খারাপ থাকলেও প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাড়ি কিংবা হেলিকপ্টার যোগে বাবুনগরীকে নিয়ে গিয়ে বিতর্কিত করছেন এবং শারীরিকভাবেও তাকে অসুস্থ করে তুলছেন। আমন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে বাবুনগরীর অনুষ্ঠান নির্ধারণ করেন অথচ বাবুনগরী নিজেই জানেন না তিনি কখন কোন অনুষ্ঠানে যাবেন। হাটহাজারী মাদ্রাসায় বাবুনগরীর অনুরক্ত ব্যক্তিরা তার জন্য উপহার ও হাদিয়া নিয়ে এলে এর বড় একটা অংশ চলে যায় ইনামুলের পকেটে। তার অর্থ লোভ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, কোনো বাছ বিচার ছাড়াই সরকার বিরোধী লোকদের কাছেও তিনি হরহামেশা টাকা নিচ্ছেন।
বারিধারা মাদ্রাসা দখলকারী মনির হোসেন কাসেমী বিভিন্ন উৎস থেকে টাকা নিয়ে ইনামুলের সঙ্গে ভাগাভাগিও করছেন। ইনামুলের বিয়েতেও মোটা দাগে অর্থ খরচ করেছেন তিনি। মনিরের ইনামুলকে হাত করার মূল লক্ষ্য হচ্ছে হেফাজতে ইসলামে নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা এবং নিজ স্বার্থে হেফাজতকে ব্যবহার করা। ঐতিহাসিকভাবে খাদেমদের নিয়ে কওমি অঙ্গনে নানা ধরনের বিশ্বাসঘাতকতার গল্প প্রচলিত রয়েছে। এছাড়া মনিরের মত রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী লোকেরা হেফাজতের আজকের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী। সংশ্নিষ্টরা অনেকেই মনে করছেন, জুনায়েদ বাবুনগরী নীরব থাকলে হেফাজতে ইসলাম ও হাটহাজারী মাদ্রাসাসহ সমস্ত কওমি অঙ্গন আবারও গভীর সংকটে পরতে পারে।