সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের মেগা প্রকল্প

  • Update Time : ১১:২৭:২১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ মে ২০২১
  • / 204

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ

ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেখানে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন; মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সেই ভাষণস্থলসহ এ ধরনের সাতটি স্থান সংরক্ষণে ২০০৯ সালে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ওই রায় বাস্তবায়নে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্প’ গ্রহণ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এটি মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। ২৬৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ আগামী ২০২২ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

মন্ত্রণালয় বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শেষ হলে নানা শ্রেণি-পেশার ৫০ হাজার মানুষের পদচারণায় মুখর হবে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। দেশের ৬৪ জেলা থেকে তালিকা করে স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুই হাজার শিক্ষার্থীকে এই উদ্যানে নিয়ে আসা হবে। দেশি-বিদেশি যে কেউ এসে জানবে বঙ্গবন্ধু ও বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা ও বাঙালির বঞ্চনার ইতিহাস। সেভাবেই উদ্যান ঘিরে নানা কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণের প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজে খরচ হয়েছে ২৬২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। ২০১৮ সাল থেকে প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সম্প্রতি উদ্যানের ৫০টি গাছ কাটা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে মন্ত্রণালয়।

এর আগে বিভিন্ন সময়ে গাছ কাটা হলেও এবার ওয়াকওয়ে (রাস্তা) এবং ফুডকিয়স্ক (খাবারের দোকান) নির্মাণের জন্য গাছা কাটার ঘটনায় পরিবেশবাদীসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি সরব হয়েছেন। এ ঘটনায় গাছ কাটা বন্ধে ইতোমধ্যে হাইকোর্টে রিট এবং আদালত অবমাননার আবেদন করেছেন পরিবেশবাদী ছয় সংগঠন ও তিন আইনজীবী।

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বিডিসমাচার কে বলেন, ‘বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনে বিভিন্ন সময়ের আন্দোলন, ঘটনাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইতোমধ্যে শিখা চিরন্তন, স্বাধীনতা স্তম্ভ, ভূগর্ভস্থ স্বাধীনতা জাদুঘর প্রভৃতি নির্মাণ করা হয়েছে। এখন প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণস্থল, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ মঞ্চ, ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণস্থলসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিড়ড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এ জন্য ৫০টি গাছ কাটা হয়েছে। আর্কিটেক্টের নকশা অনুযায়ী তা করা হয়েছে।’

ওয়াকওয়ে এবং রেস্টুরেন্ট তৈরির জন্য গাছ কাটা হচ্ছে- এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ‘শুধু ওয়াকওয়ে নির্মাণের জন্য যদি গাছ কাটা হয়ে থাকে, তা দুঃখজনক। কারও দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বা অসাবধানতার কারণে যদি গাছ কাটা হয়ে থাকে, তা তদন্ত করে দেখা হবে। অবহেলা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রকল্পটি শেষ হওয়ার আগেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন করে এক হাজার গাছ লাগানো হবে।

১৬১০ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ঢাকা নগরী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান গড়ে ওঠে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষীও এই উদ্যান। ব্রিটিশ আমলে এখানে নিয়মিত আয়োজন করা হতো ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা। একে ঘিরে চলত জুয়ার আসরও। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব নাম রেসকোর্স ময়দান। রমনা জিমখানা নামেও ডাকা হতো। স্বাধীনতার পর রেসকোর্স ময়দানের নাম পরিবর্তন করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্থানটির নামকরণ করেন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, বাঙালির জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে। বঙ্গবন্ধু এ উদ্যানে ঘোড়ার দৌড় ও জুয়া বন্ধের পাশাপাশি নিজ হাতে বৃক্ষরোপণ করেন। এর পর থেকে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রজাতির গাছ লাগানোর মধ্য দিয়ে এই উদ্যানকে নানা বৈচিত্র্যে সাজানো হয়েছে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রামের ঘোষণা দিয়েছিলেন। একইভাবে ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই বাঙালিদের কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এই উদ্যান ঘিরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত নানা ঘটনা। এসব কারণেও দেশ-বিদেশে বহুল পরিচিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ১৯৯৯ সালে এখানে নির্মাণ করা হয় ‘শিখা চিরন্তন’। ২০১৮ সালে ৬৮ একরের পুরো উদ্যানকে কেপিআই এলাকা ঘোষণা করেছে সরকার।

চলমান স্বাধীনতা স্তম্ভ প্রকল্পের গুরুত্ব তুলে ধরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, এটি বর্তমান সরকারের মুক্তিযুদ্ধের মেগা প্রকল্প। আমরা আশা করছি, এটি বাস্তবায়িত হলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রতিদিন ৫০ হাজার মানুষ এখানে আসবে। দুই হাজার শিক্ষার্থীকে তালিকা করে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এখানে নিয়ে আসা হবে। তারা জানবে পাকিস্তানি শাসনবিরোধী ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রাম, ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাষণসহ নানা ইতিহাস।

২০০৯ সালের ৮ জুলাই স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত স্থান, বধ্যভূমিসহ সংশ্নিষ্ট ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। রায়ে ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষণ, ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্র্রপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ ও ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দেওয়া ভাষণের স্থান সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদে নির্বাচিত সদস্যদের শপথ নেওয়ার স্থান এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের স্থানও সংরক্ষণের জন্য বলা হয়েছিল।

পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ স্থানের নামকরণ ‘স্বাধীনতা চত্বর বা লিবার্টি স্কয়ার’ করতে বলা হয়। এ ছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থিত অবৈধ সব স্থাপনা অপসারণ করতে বলেন আদালত। এক বা একাধিক কমিটি গঠন করে সরকারকে এই রায় বাস্তবায়নের নির্দেশও দেন আদালত।

রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জন্ম এবং একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর সেই জাতি জন্মের স্বীকৃতি লাভ করেছে। যে স্থানে এই দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, সেই স্থানে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে উপলব্ধি করতে পারে যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এখানে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। যদি কেউ বাঙালি হয়ে থাকে, তাহলে ওই স্থানে দাঁড়িয়ে তার প্রাণ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠবে। এ ছাড়া চোখ বন্ধ করে চিন্তা করবে এখানে জেনারেল এএকে নিয়াজী তার বাহিনীসহ বাঙালি জাতির সম্মুখে আত্মসমর্পণ করেছিল। অথচ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সেসব স্থান এখন অযত্ন-অবহেলায় পড়ে রয়েছে। এরই আলোকে বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম চলছে।

মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, স্বাধীনতা প্রকল্পের দুটি পর্যায়ে ১৯৯৮ সাল থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গ্লাস টাওয়ার, শিখা চিরন্তন, স্বাধীনতা জাদুঘর, ফোয়ারা, জলাধার ও উন্মুক্ত মঞ্চ ইতোমধ্যে তৈরি করা হয়েছে।

এবার প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ে পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য শিশু পার্ক ভেঙে নতুন করে সাজানো হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ স্থান, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ স্থান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ স্থানসহ ১০টি স্থাপনা হচ্ছে।

পাশাপাশি নির্মাণ করা হচ্ছে থিম পার্ক, ৫৭০টি গাড়ি রাখার ভূগর্ভস্থ পার্কিং, লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো, ফোয়ারাসহ অনেক কিছু। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জায়গায় নির্মিত শাহবাগ থানা এবং শিশু পার্কও স্থানান্তরের কার্যক্রম চলছে।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের মেগা প্রকল্প

Update Time : ১১:২৭:২১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ মে ২০২১

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ

ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেখানে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন; মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সেই ভাষণস্থলসহ এ ধরনের সাতটি স্থান সংরক্ষণে ২০০৯ সালে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ওই রায় বাস্তবায়নে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্প’ গ্রহণ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এটি মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। ২৬৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ আগামী ২০২২ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

মন্ত্রণালয় বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শেষ হলে নানা শ্রেণি-পেশার ৫০ হাজার মানুষের পদচারণায় মুখর হবে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। দেশের ৬৪ জেলা থেকে তালিকা করে স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুই হাজার শিক্ষার্থীকে এই উদ্যানে নিয়ে আসা হবে। দেশি-বিদেশি যে কেউ এসে জানবে বঙ্গবন্ধু ও বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা ও বাঙালির বঞ্চনার ইতিহাস। সেভাবেই উদ্যান ঘিরে নানা কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণের প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজে খরচ হয়েছে ২৬২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। ২০১৮ সাল থেকে প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সম্প্রতি উদ্যানের ৫০টি গাছ কাটা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে মন্ত্রণালয়।

এর আগে বিভিন্ন সময়ে গাছ কাটা হলেও এবার ওয়াকওয়ে (রাস্তা) এবং ফুডকিয়স্ক (খাবারের দোকান) নির্মাণের জন্য গাছা কাটার ঘটনায় পরিবেশবাদীসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি সরব হয়েছেন। এ ঘটনায় গাছ কাটা বন্ধে ইতোমধ্যে হাইকোর্টে রিট এবং আদালত অবমাননার আবেদন করেছেন পরিবেশবাদী ছয় সংগঠন ও তিন আইনজীবী।

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বিডিসমাচার কে বলেন, ‘বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনে বিভিন্ন সময়ের আন্দোলন, ঘটনাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইতোমধ্যে শিখা চিরন্তন, স্বাধীনতা স্তম্ভ, ভূগর্ভস্থ স্বাধীনতা জাদুঘর প্রভৃতি নির্মাণ করা হয়েছে। এখন প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণস্থল, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ মঞ্চ, ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণস্থলসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিড়ড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এ জন্য ৫০টি গাছ কাটা হয়েছে। আর্কিটেক্টের নকশা অনুযায়ী তা করা হয়েছে।’

ওয়াকওয়ে এবং রেস্টুরেন্ট তৈরির জন্য গাছ কাটা হচ্ছে- এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ‘শুধু ওয়াকওয়ে নির্মাণের জন্য যদি গাছ কাটা হয়ে থাকে, তা দুঃখজনক। কারও দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বা অসাবধানতার কারণে যদি গাছ কাটা হয়ে থাকে, তা তদন্ত করে দেখা হবে। অবহেলা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রকল্পটি শেষ হওয়ার আগেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন করে এক হাজার গাছ লাগানো হবে।

১৬১০ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ঢাকা নগরী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান গড়ে ওঠে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষীও এই উদ্যান। ব্রিটিশ আমলে এখানে নিয়মিত আয়োজন করা হতো ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা। একে ঘিরে চলত জুয়ার আসরও। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব নাম রেসকোর্স ময়দান। রমনা জিমখানা নামেও ডাকা হতো। স্বাধীনতার পর রেসকোর্স ময়দানের নাম পরিবর্তন করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্থানটির নামকরণ করেন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, বাঙালির জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে। বঙ্গবন্ধু এ উদ্যানে ঘোড়ার দৌড় ও জুয়া বন্ধের পাশাপাশি নিজ হাতে বৃক্ষরোপণ করেন। এর পর থেকে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রজাতির গাছ লাগানোর মধ্য দিয়ে এই উদ্যানকে নানা বৈচিত্র্যে সাজানো হয়েছে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রামের ঘোষণা দিয়েছিলেন। একইভাবে ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই বাঙালিদের কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এই উদ্যান ঘিরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত নানা ঘটনা। এসব কারণেও দেশ-বিদেশে বহুল পরিচিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ১৯৯৯ সালে এখানে নির্মাণ করা হয় ‘শিখা চিরন্তন’। ২০১৮ সালে ৬৮ একরের পুরো উদ্যানকে কেপিআই এলাকা ঘোষণা করেছে সরকার।

চলমান স্বাধীনতা স্তম্ভ প্রকল্পের গুরুত্ব তুলে ধরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, এটি বর্তমান সরকারের মুক্তিযুদ্ধের মেগা প্রকল্প। আমরা আশা করছি, এটি বাস্তবায়িত হলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রতিদিন ৫০ হাজার মানুষ এখানে আসবে। দুই হাজার শিক্ষার্থীকে তালিকা করে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এখানে নিয়ে আসা হবে। তারা জানবে পাকিস্তানি শাসনবিরোধী ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রাম, ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাষণসহ নানা ইতিহাস।

২০০৯ সালের ৮ জুলাই স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত স্থান, বধ্যভূমিসহ সংশ্নিষ্ট ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। রায়ে ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষণ, ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্র্রপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ ও ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দেওয়া ভাষণের স্থান সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদে নির্বাচিত সদস্যদের শপথ নেওয়ার স্থান এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের স্থানও সংরক্ষণের জন্য বলা হয়েছিল।

পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ স্থানের নামকরণ ‘স্বাধীনতা চত্বর বা লিবার্টি স্কয়ার’ করতে বলা হয়। এ ছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থিত অবৈধ সব স্থাপনা অপসারণ করতে বলেন আদালত। এক বা একাধিক কমিটি গঠন করে সরকারকে এই রায় বাস্তবায়নের নির্দেশও দেন আদালত।

রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জন্ম এবং একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর সেই জাতি জন্মের স্বীকৃতি লাভ করেছে। যে স্থানে এই দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, সেই স্থানে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে উপলব্ধি করতে পারে যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এখানে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। যদি কেউ বাঙালি হয়ে থাকে, তাহলে ওই স্থানে দাঁড়িয়ে তার প্রাণ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠবে। এ ছাড়া চোখ বন্ধ করে চিন্তা করবে এখানে জেনারেল এএকে নিয়াজী তার বাহিনীসহ বাঙালি জাতির সম্মুখে আত্মসমর্পণ করেছিল। অথচ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সেসব স্থান এখন অযত্ন-অবহেলায় পড়ে রয়েছে। এরই আলোকে বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম চলছে।

মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, স্বাধীনতা প্রকল্পের দুটি পর্যায়ে ১৯৯৮ সাল থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গ্লাস টাওয়ার, শিখা চিরন্তন, স্বাধীনতা জাদুঘর, ফোয়ারা, জলাধার ও উন্মুক্ত মঞ্চ ইতোমধ্যে তৈরি করা হয়েছে।

এবার প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ে পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য শিশু পার্ক ভেঙে নতুন করে সাজানো হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ স্থান, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ স্থান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ স্থানসহ ১০টি স্থাপনা হচ্ছে।

পাশাপাশি নির্মাণ করা হচ্ছে থিম পার্ক, ৫৭০টি গাড়ি রাখার ভূগর্ভস্থ পার্কিং, লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো, ফোয়ারাসহ অনেক কিছু। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জায়গায় নির্মিত শাহবাগ থানা এবং শিশু পার্কও স্থানান্তরের কার্যক্রম চলছে।