মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালসহ সাত দফা দাবিতে শাহবাগে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের মানববন্ধন
- Update Time : ০৯:৫৫:২৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ জুলাই ২০২৪
- / 65
মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কটূক্তিকারীদেরকে দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ ৭ দফা দাবিতে আজ ১৩ জুলাই শনিবার বিকাল ৪টায় শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচী পালন করেছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন এর সঞ্চালনায় উক্ত মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল। আরোও বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আকম জামাল উদ্দিন, শহীদদের সন্তান প্রজন্ম ৭১ এর সভাপতি আজিজুর রহমান, ঢাবি শাখা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি সনেট মাহমুদ, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কানিজ ফাতেমা, ঢাবি শাখা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সাধারণ সম্পাদক রাশিদ শাহরিয়ার উদয়, বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের সভাপতি মিজানুর রহমান, আমরা মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের মুখপাত্র সালমান মাহমুদ, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার শিক্ষক সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিমু মাইন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সমন্বয়ক শাহীন সিকদার, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের সভাপতি আঃ রশীদ মণ্ডল রানা, ঢাকা জেলা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি মুরাদ হোসেন, ঢাকা কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক আল ইমামসহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচীর বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অপশক্তি শিবির-ছাত্রদল পরিকল্পিত ভাবে সাধারণ মানুষের মাঝে গুজব ছড়িয়ে কোটা ব্যবস্থাকে বৈষম্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। সত্যিকার অর্থে কোটা ব্যবস্থা কখনো বৈষম্য তৈরী করে না বরং বৈষম্য দূর করে সকলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করে। ১০ শতাংশ জেলা ও ১০ শতাংশ নারী কোটার সুবিধা এদেশের জনগণেই পেয়ে থাকেন। সাধারণ প্রার্থীরাই এসব কোটা সুবিধার আওতাভুক্ত। নারী ও জেলা কোটার কারণে রাষ্ট্রের অধিকাংশ নাগরিক কোটা সুবিধার আওতায় পড়েন। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রে কোটা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। জেলা কোটার কারণে পিছিয়ে পড়া জেলার ছেলেমেয়েরা বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরিতে প্রত্যাশিত ক্যাডারে চাকরি পেয়েছেন। নারী কোটার কারণে নারীরা বিসিএসে প্রত্যাশিত ক্যাডারে চাকরি পেয়েছেন। আজকে নারীরা সচিব পর্যন্ত হতে পেরেছেন। বিগত কয়েকটি বিসিএসের পরিসংখ্যান দেখলে বুঝা যায় নারী কোটা ও জেলা কোটা প্রয়োজনীয়তা এখনো রয়েছে। নারী কোটা বিহীন বিসিএসে খুব কম সংখ্যক নারী ক্যাডার হতে পেরেছেন। পিছিয়ে পড়া জেলাগুলো থেকে কেউ কাঙ্ক্ষিত ক্যাডার পাননি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতি আহবান শিবির-ছাত্রদলের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করবেন না। কারণ আপনারা অধিকাংশ সবাই বিভিন্ন কোটা সুবিধার আওতায় পড়েন। কোটা ব্যবস্থা না থাকলে কিছু উন্নত জেলার পরীক্ষার্থী বারবার সকল পদ নিয়ে যাবে। পিছিয়ে পড়া জেলার পরীক্ষার্থীরা বারবার জেলা কোটার সংরক্ষিত পদগুলো হারাবেন। মেধা কোটার নাম পরিবর্তন করে সাধারণ কোটা নামে সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন। কারণ কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তরা কখনোই অমেধাবী নয়। তারাও মেধাবী। তাদেরকেও প্রিলি, লিখিত ও ভাইভায় পাশ করার পর কোটা সুবিধা পেতে হয়। বৈষম্যমূলক মেধা শব্দ পরিবর্তন করে সাধারণ শব্দ সংযোজন করে সকল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে। মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের ২০১৮ সালের অবৈধ পরিপত্র বাতিলের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তকে এদেশের তরুণ সমাজ স্বাগত জানিয়েছে। উচ্চ আদালতের প্রতি আমাদের পূর্ণাঙ্গ আস্থা রয়েছে। আমাদের বিশ্বাস করি, বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবাররা সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে ন্যায়বিচার পাবেন। ইতিমধ্যে আপীল বিভাগে চার সপ্তাহের স্টে অর্ডার দেয়া হয়েছে। আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে চূড়ান্ত শুনানির জন্য অপেক্ষা করছি। আদালতে আইনী লড়াই চালানোর পাশাপাশি ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালসহ সাত দফা দাবিতে রাজপথে নিয়মিত কর্মসূচী পালন করবে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। খুব শীঘ্রই সমগ্র দেশে সাত দফা দাবি আদায়ে নতুন কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে। কোটা বাতিল আন্দোলনের নামে যারা সুপ্রিম কোর্টের গেটে যেয়ে হাইকোর্টকে ভুয়া ভুয়া বলে শ্লোগান দিয়ে আদালত অবমাননা করেছে তাদেরকে দ্রুত গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তি দেয়ার দাবি জানাচ্ছি। আন্দোলনের নামে যারা সুপরিকল্পিত ভাবে স্বাধীন বিচার বিভাগকে অবমাননা করে তারা কখনোই বাংলাদেশকে ধারণ করে না। এরা স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি জামাত-শিবিরের দোসর। সম্প্রতি কোটা বিরোধী আন্দোলনের নামে রাস্তায় নারীদেরকে হেনস্তা, জনভোগান্তি সৃষ্টি, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল, বারডেম হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালের জরুরী বিভাগের গেইট আটকে দিয়ে চিকিৎসা নিতে বাধা সৃষ্টি, বিভিন্ন মহাসড়কে এ্যাম্বুলেন্স আটকে দিয়ে অনেক রোগীকে হত্যাসহ শাহবাগে জাতির বিবেক সাংবাদিকদের ওপর ন্যাক্কারজনক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। কারণ যারা গণমাধ্যম বয়কট করে এবং সাংবাদিকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালায় তারা দেশ ও জাতির শত্রু। সাংবাদিক সমাজের উচিত সন্ত্রাসীদেরকে বয়কট করে সমুচিত জবাব দেয়া। লন্ডন থেকে তারেক জিয়ার অর্থায়ন ও নির্দেশে আন্দোলনের নামে সুপ্রিম কোর্টকে বারবার অবমাননা করার মাধ্যমে দেশের বিচার বিভাগকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিএনপি-জামাতের শীর্ষ নেতারা অফিসিয়াল বিবৃতি দিয়ে ছাত্রদল-শিবিরের নেতৃত্বে কোটা বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করছেন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট আহবান, অবিলম্বে কোটা বিরোধী আন্দোলনের নামে জামাত-বিএনপির সন্ত্রাসী কার্যকলাপ কঠোর ভাবে দমন করে জনজীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। জনগণের ভোগান্তি দূর করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিশ্চিত করুন। কারণ এসব কখনোই আন্দোলন নয়। বিএনপি-জামাতের রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্র। এদেরকে যেকোনো মূল্যে রুখে দিতে হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে জঘন্য ভাষায় কটূক্তি ও গালিগালাজ করে যাচ্ছে যা আইনের দৃষ্টিতে সুস্পষ্ট অপরাধ। অবিলম্বে এদেরকে চিহ্নিত করে ছাত্রত্ব বাতিলসহ আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। যারা বঙ্গবন্ধু, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করে তারা কখনোই এদেশের স্বাধীনতার আদর্শে বিশ্বাস করে না। এরা স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারদের বংশধর। এদের অবমাননা ও কটূক্তি স্থায়ী ভাবে বন্ধ করার জন্য হলোকাস্ট ডিনায়াল এ্যাক্টের ন্যায় নতুন আইন প্রণয়নের পাশাপাশি বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবার সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।”
ঢাবি শাখা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কানিজ ফাতেমা বলেন, “বৈষম্য দূর করার জন্য নারী কোটার অবশ্যই প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু মেয়ে না বুঝে নারী কোটার বিরোধিতা করে নিজেদের সুযোগ হারাচ্ছেন। বিগত বিসিএসে নারী কোটা না থাকার কারণে ছেলেরা সব ভালো ক্যাডার নিয়ে গেছেন। কিছু নারী শিক্ষা বা অন্য ক্যাডার হতে পারলেও সেটার সংখ্যা পূর্বের তুলনায় সামান্য। নারী কোটা না থাকার কারণে ঢাবির বাহিরের বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীরা আরো বঞ্চিত হচ্ছেন। বিগত বিসিএসে তাদের সংখ্যা নেই বললেই চলে। ১০ শতাংশ নারী কোটা থাকা অবস্থায় বিসিএসে প্রতিটি ক্যাডারে শতকরা ১০ জন করে নারী নিশ্চিত তাদের কাঙ্ক্ষিত ক্যাডার পেয়ে যেতেন। নারী উচ্চ শিক্ষা ও অগ্রগতি বিরোধী মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী জামাত-শিবিরের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনবেন না। কারণ জামাত-শিবিরের পরিকল্পনা হচ্ছে নারীদেরকে চাকরি থেকে বঞ্চিত করে গৃহদাসী করে রেখে বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেয়া। এজন্যই জামাত-বিএনপি রাজনৈতিক মাঠে ব্যর্থ হয়ে এখন কোটা ব্যবস্থা সম্পর্কে অপপ্রচার ও গুজব ছড়িয়ে শিক্ষার্থীদের আবেগকে ব্যবহার করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চালাচ্ছে। নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কোটা পুনর্বহালের কোন বিকল্প নেই।”
মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলেন, “আমাদের পূর্বসূরীরা বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে দেশমাতৃকার জন্য নিজের জীবন ও যৌবন উৎসর্গ করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার দৃঢ প্রত্যয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ও সংবিধান প্রাপ্তির আশায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন। আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ চিন্তা ও লক্ষ্যের উত্তরসূরী বিধায় বাংলাদেশের ভবিষ্যতেরও উত্তরসূরী। আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে টিকিয়ে রাখতে, বাংলাদেশের আইন ও সমাজ ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে এবং সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও উত্তরসূরীদের বাংলাদেশের সরকারি চাকুরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ কোটা সংরক্ষণ ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা আবশ্যক। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সংবিধানের ২৯ (৩) ক অনুচ্ছেদেও বিশেষ কোটা সুবিধা প্রবর্তনের কথা বলা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংরক্ষণের বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনাও রয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও উত্তরসূরীদেরকে দেশের সকল সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের সব পর্যায়ের চাকুরির নিয়োগে ৩০% কোটার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও সংরক্ষণ না করলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র কখনোই বন্ধ করা যাবে না। কারণ সরকারের সকল বিভাগের বিভিন্ন পদে এখনো যুদ্ধাপরাধী, দেশবিরোধী, পাকিস্তানপন্থী ও রবীন্দ্রবিরোধী মৌলবাদী জঙ্গি তৎপরতার সাথে জড়িত নানা কায়েমী স্বার্থবাদী শ্রেণী অবস্থান করছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর অবৈধ সামরিক শাসক জেনারেল খুনী জিয়া ও জেনারেল এরশাদের সময় থেকে এরা বিভিন্ন উপায়ে চাকরিতে প্রবেশ শুরু করেছিল বলেই আজও বাংলাদেশে দুর্নীতি, লুটপাটতন্ত্র, মৌলবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত অপশক্তির বিস্তার এতো বেশী। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে রক্ষা করতে ও একাত্তরের পরাজিত অপশক্তি পাকিস্তানের দোসরদের অপতৎপরতা ঠেকাতে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদেরকে কোটা সুবিধার মাধ্যমে চাকরিতে নিয়োগের ব্যবস্থা করা জরুরী প্রয়োজন। আমরা আশা করি উচ্চ আদালতের আপীল বিভাগে ন্যায় বিচার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে আমাদের সাংবিধানিক অধিকার ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল হবে। ১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধা পরিবার স্বপ্ন দেখলো ভালো ভাবে বেঁচে থাকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের কল্যাণে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে তিনি যখন ক্ষমতায় আসলেন ততদিনে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরিতে প্রবেশের বয়স শেষ হয়ে যায়। স্বাধীনতা বিরোধীরা ক্ষমতায় থাকার কারণে দীর্ঘ ২১ বছর এই কোটা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোন কাজে আসেনি। যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা দেখলেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স শেষ তখন তিনি ১৯৯৭ সালের ১৭ মার্চ মুক্তিযোদ্ধা কোটা তাঁদের সন্তান পর্যন্ত বর্ধিত করেছিলেন। কিন্তু তিনি বার বার লক্ষ্য করছিলেন স্বাধীনতা বিরোধী আমলাদের ষড়যন্ত্রের কারণে সুকৌশলে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরিতে নেওয়া হচ্ছে না। কারণ ১৯৭৫-৯৬ সালের মাঝে নিয়োগকৃত মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী আমলারা ব্যাপক শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। স্বাধীনতা বিরোধী পরিবারের বংশধর আমলারা সুকৌশলে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পাওয়া যাচ্ছে না বলে পদগুলো শূন্য দেখানো শুরু করেছিল। এরপর বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে ৫ বছর চাকুরী প্রত্যাশী বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা নিয়োগ বঞ্চিত হয়েছিলেন। ২০০৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকা অবস্থায় আবার দুই বছর নিয়োগ বঞ্চিত হয়েছিল। দীর্ঘ সময় বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদেরকে কোটা সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখার কারণে সন্তানদেরও চাকরির বয়স শেষ পর্যায়ে যাওয়ার কারণে নাতি-নাতনী পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। প্রশাসনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখার জন্য বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের ন্যায় প্রজন্ম পর্যন্ত কোটা সুবিধা বর্ধিত করা হয়েছে যা অত্যন্ত যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য।”
সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন,
“২০১৮ সালে স্বাধীন বিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্রের কারণে ১ম ও ২য় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কোটা ব্যবস্থা বাতিল হয়। যার ফলে বিগত ৫ বছরে দেশের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা নিয়োগসহ বহু নিয়োগে কোটা ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়নি বিধায় বর্তমানে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী কোটা পুনর্বহালের পাশাপাশি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য একটি বিশেষ বিসিএস পরীক্ষার আয়োজনের প্রয়োজন যাতে করে বিগত ৫ বছরে যারা কোটা ব্যবস্থার সুবিধা না থাকায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন থেকে বঞ্চিত হয়েছে তারা যথাযথ সুযোগ প্রাপ্ত হয়। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রশাসন পরিচালনার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর আশেপাশে থাকা কতিপয় স্বাধীনতা বিরোধী আমলাদের গভীর ষড়যন্ত্রের কারণে ২০১৮ সালে সরকার মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও প্রজন্ম হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের স্বাধীন বিচার বিভাগ আমাদের সাংবিধানিক অধিকার ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপহার মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখবেন এবং ন্যায় বিচারের প্রাপ্তির সুযোগ থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদেরকে বঞ্চিত করবে না। কারণ চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা কখনোই বৈষম্য তৈরী করে না বরং কোটা ব্যবস্থা সবসময় বৈষম্য দূর করে সকলের জন্য সমতা নিশ্চিত করে। রাষ্ট্রে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের সমান সুযোগ সৃষ্টি করে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাজার হাজার সন্তানরা এখনো বেকার জীবন যাপন করছেন। অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধারা এখনো অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। দেশ স্বাধীনের পর অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা বাড়িতে ফিরে দেখেছেন তাঁদের বাড়িঘর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সম্মান দেয়ার পাশাপাশি ক্ষতি কাটিয়ে উঠার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭২ সালে ৫ সেপ্টেম্বর এক আদেশের মাধ্যমে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১০% ক্ষতিগ্রস্থ নারী কোটা ও ৪০% জেলা কোটা রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নেমে আসে কালো অন্ধকার। ১৯৭৫-৯৬ সাল দীর্ঘ একুশ (২১) বছর মুক্তিযোদ্ধা কোটার কোন বাস্তবায়ন হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সাথে সাথেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উপর নেমে আসে দুর্বিষহ অত্যাচার। স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্রের কারণে এসময় বীর মুক্তিযোদ্ধারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাঁদের সন্তানদেরকে তাঁরা তেমন পড়াশোনা করাতে পারেননি। অর্থনৈতিক দৈন্যদশা, যুদ্ধ ক্ষতিগ্রস্থ দেশ, পালিয়ে বেড়ানো সব মিলিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ২১ বছর কোনো সুবিধা পাননি। এমনকি তারা স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার পর্যন্ত হারিয়েছিলেন। ৯ মাস যুদ্ধের ক্ষতি এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ২১ বছরে বীর মুক্তিযোদ্ধারা যে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল তা আজো কাটিয়ে উঠতে পারেননি।”
ঢাবির অধ্যাপক ড. আকম জামাল উদ্দিন বলেন, “২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গুজব সৃষ্টিকারী ও ঢাবির ভিসির বাসায় হামলাকারীদেরকে চিহ্নিত করে আজও পর্যন্ত বিচার করা হয়নি। তদন্ত রিপোর্ট এখনো প্রকাশ হয়নি। অবিলম্বে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে ভিসির বাসায় হামলাকারী ও উস্কানিদাতাদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। কোটা কখনো বৈষম্য তৈরী করে না বরং কোটা ব্যবস্থা রাষ্ট্রে বৈষম্য দূর করে সমতা নিশ্চিত করে। অনেককে ভুল বুঝিয়ে রাস্তায় নামিয়ে সেদিন নুরু গংরা নিজেদের ফায়দা হাসিল করেছিল যা ইতিমধ্যে দেশপ্রেমিক ছাত্রসমাজের নিকট প্রমাণিত হয়েছে। দেশপ্রেমিক সাধারণ শিক্ষার্থীরা ইতিমধ্যে নুরু গংদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছে। এই বিজয় মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির বিজয়। প্রশাসনে জামাত-শিবিরের প্রবেশ বন্ধ করে প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কারণ স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি জামাত-শিবিরের ক্যাডাররা লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে ঢাবির ভিসির বাসভবনে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, পুলিশের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে কোটা বাতিলের অবৈধ পরিপত্র জারি করিয়েছিল। স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির অবৈধ ও অযৌক্তিক দাবির কারণে সরকার ১ম ও ২য় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সংবিধান পরিপন্থী একটি পরিপত্র জারি করেছিল। ২০১৮ সালে জারি করা সংবিধান পরিপন্থী সেই পরিপত্রকে অবশেষে অবৈধ বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছে হাইকোর্ট। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সংবিধান অনুযায়ী সকল শ্রেণির মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।সংবিধান অনুযায়ী বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল করার যৌক্তিক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। সামাজিক সমতা নিশ্চিত করার জন্য সাংবিধানিক অধিকার কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের সিদ্ধান্তকে এদেশের শিক্ষার্থী সমাজ ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কারণ চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা কখনোই বৈষম্য তৈরী করে না। কোটা ব্যবস্থা সবসময় বৈষম্য দূর করে চাকরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিত করে। রাষ্ট্রে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের সমান সুযোগ সৃষ্টি করে। আমাদের দাবি, অবিলম্বে নতুন পরিপত্র জারিসহ সাত দফা দাবি বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যথায় দেশব্যাপী কঠোর কর্মসূচী ঘোষণা করবে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ।”
মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশের ৭ দফা দাবিসমূহ:
১। ২০১৮ সালের অসাংবিধানিক ও অবৈধ পরিপত্র বাতিল করে নতুন পরিপত্র জার করে বঙ্গবন্ধুর উপহার ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল, সংরক্ষণ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।
২। সাম্প্রতিক সময়ে কোটা বাতিল আন্দোলনের নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিয়ে কটূক্তিকারীদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে ছাত্রত্ব বাতিলসহ বিশেষ ট্রাইবুনালে দ্রুত বিচারের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি নিশ্চিতের পাশাপাশি হলোকাস্ট ডিনায়াল এ্যাক্টের ন্যায় নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে।
৩। রাজাকারদের নামের তালিকা প্রকাশ করে দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের নোটিশ বোর্ডে তালিকা প্রদর্শনপূর্বক নাগরিকত্ব বাতিলসহ এদের বংশধরদের চিহ্নিত করে চাকুরীচ্যুত করার পাশাপাশি সকল সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
৪। কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত প্রার্থীরা সকলেই মেধাবী, কেউ অমেধাবী নয়। সাধারণ প্রার্থীদের সাথে একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রিলি, লিখিত ও ভাইভায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর কোটা প্রয়োগ হওয়ার কারণে বৈষম্যমূলক মেধা শব্দ পরিবর্তন করে সাধারণ শব্দ সংযোজনপূর্বক সাধারণ প্রার্থী নামকরণ করে সকল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে।
৫। সমগ্র দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারদের ওপর হামলা, মামলা, হত্যা, নির্যাতন ও কটূক্তি স্থায়ীভাবে প্রতিরোধ করার জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবার সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে।
৬। ২০১৮ সালে কোটা বাতিল আন্দোলনের নামে পুলিশের ওপর নগ্ন সন্ত্রাসী হামলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও হামলায় জড়িত সন্ত্রাসীদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
৭। বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারদের অধিকার আদায়ের প্লাটফর্ম বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করতে হবে।