তাপমাত্রাজনিত জরুরি অবস্থা জারি হতে পারে

  • Update Time : ০১:০১:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৩
  • / 126

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রচণ্ড গরমে পুড়ছে দেশ। চৈত্রের তীব্র তাপপ্রবাহ বৈশাখের শুরুতে এসে অতি তীব্র হয়েছে। ফলে শহর-গ্রাম কোথাও স্বস্তিতে নেই মানুষ। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও নারীদের কষ্ট এ পরিস্থিতিতে চরমে উঠেছে।

রমজানের এই সময়ে রোজাদারদের অবস্থা আরও কষ্টকর। সারা দিন পানি পান না করায় অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

সাধারণের ধারণা, এ বছরের তাপপ্রবাহ মানুষের বেঁচে থাকার সর্বোচ্চ সীমায় রয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যও মিলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের এ ধারণার সঙ্গে। গতকাল শনিবার ঢাকায় গত ৯ বছরের তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙেছে।

২০১৪ সালের এপ্রিলে রাজধানীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর শনিবার তাপমাত্রা ঠেকেছিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা ‘অতি তীব্র’ তাপমাত্রা হিসেবে উল্লেখ করেছেন আবহাওয়াবিদরা।

এ অবস্থায় যেকোনো সময় অতি তীব্র তাপপ্রবাহের সংকট মোকাবিলায় ‘তাপমাত্রাজনিত জরুরি অবস্থা’ জারি করা হতে পারে বলে গতকাল শনিবার জানিয়েছেন পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দীন।

তিনি বলেন, ‘তীব্র গরমে জনজীবনে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। আমরা চিন্তাভাবনা করছি, জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যায় কি না। গত দুদিন শুক্র ও শনিবার অফিস-আদালতে ছুটি ছিল। তাই আগামীকাল ও পরশু (রবি ও সোমবার) দুদিন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হবে। তাপমাত্রা যদি এরপরও বাড়তে থাকে, তবে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গতকাল রাজধানী ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর দেশের সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা ছিল খুলনা বিভাগের চুয়াডাঙ্গায়- সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল শনিবার পর্যন্ত টানা ১৪ দিন চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে।

গতকাল চট্টগ্রাম বিভাগে বান্দরবান জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অফিস জানায়, ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মৃদু, ৩৮-৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রিকে মাঝারি, ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রিকে তীব্র এবং ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রাকে ‘অতি তীব্র’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

আগামী ৭-৮ দিনেও বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই

ঢাকা বিভাগের মধ্যে গতকাল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ফরিদপুর জেলায় ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি। সিলেট বিভাগের শ্রীমঙ্গলে ছিল সর্বোচ্চ ৩৭ দশমিক ৫ ও সর্বনিম্ন ২২ দশমিক ৪ ডিগ্রি। রাজশাহী বিভাগে পাবনার ঈশ্বরদীতে সর্বোচ্চ ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি ও সর্বনিম্ন নওগাঁর বদলগাছীতে ২২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল।

রংপুর বিভাগের সৈয়দপুরে ৩৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বরিশালের খেপুপাড়ায় ৩৮ দশমিক ৯ ডিগ্রি এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল। ‘ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর মিডিয়াম-রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্ট (ইপিএমডব্লিউএফ) আজ থেকে আগামী ১০ দিনের পূর্বাভাস দিতে গিয়ে বলছে, ‘আগামী সাত থেকে আট দিন বাংলাদেশে বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই।’

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘খুলনা বিভাগসহ, ঢাকা, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী পাবনা ও পটুয়াখালীতে টানা তীব্র তাপদাহ ও দেশের অন্যান্য জেলায় মৃদু ও মাঝারি তাপপ্রবাহ বইছে। প্রথমে কয়েকটি জেলায় ‘মৃদু’ তাপপ্রবাহ ছিল। পরে কয়েকটি জেলায় ‘মৃদু’র পাশাপাশি ‘তীব্র’ তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে।

ওড়িশায় বিশেষ গাইডলাইন জারি

এদিকে তীব্র তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় ও নাগরিকদের স্বস্তি দিতে ভারতের ওড়িশা সরকার বিশেষ গাইডলাইন জারি করেছে। স্কুল-কলেজসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি শহর ও নগরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, মার্কেট, বাসস্টপে পর্যাপ্ত নিরাপদ খাবার পানির ব্যবস্থাসহ হাসপাতালগুলোতে হিট স্ট্রোকে আক্রান্তদের জন্য বিশেষ শয্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া ওষুধের দোকানগুলোতে গরমে আক্রান্তদের জন্য স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ মজুদ রাখারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।‍

তাপমাত্রাজনিত জরুরি অবস্থা কেন প্রয়োজন

গত এক সপ্তাহ ধরে তীব্র তাপপ্রবাহের পর অতি তীব্র তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। এ অবস্থায় সরকারকে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দিয়েছেন পরিবেশ ও জলবায়ুবিদ এবং চিকিসৎকরা। কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় তা নিয়ে ভাবছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ও।

‘তাপমাত্রাজনিত জরুরি অবস্থা’ কেন প্রয়োজন তা জানাতে গিয়ে বেসরকারি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আহম্মদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘বছরের পর বছর দূষণ করলে, অপরিকল্পিতভাবে গাছপালা কাটা ও জলাশয় ভরাট অব্যাহত রাখলে তাপমাত্রার এমন বিরূপ আচরণ আগামীতে আরও বাড়বে। তাই এবারের তাপপ্রবাহের সংকট আমলে নিয়ে ভবিষ্যতের উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে। তবে এ মুহূর্তে জনগণকে স্বস্তি দিতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যে কারণে ‘‘তাপমাত্রাজনিত জরুরি অবস্থা’’র ঘোষণা দিতে পারে সরকার। কারণ জরুরি অবস্থা ঘোষণা না করলে সরাসরি সরকারি পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব না। এর ফলে বেসরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসার পথও তৈরি হবে।’

এ পরিস্থিতিতে যা করণীয়

এ প্রসঙ্গে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আহম্মদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘উত্তপ্ত এই আবহাওয়ায় দিনের বেলা রাস্তায় পানি দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ এতে সড়ক ফেটে ক্ষতি হবে। তবে ভোরে সূর্য ওঠার আগে সড়কগুলোয় বেশি করে পানি ছিটালে তাপমাত্রার নেতিবাচক প্রভাব কাটানো সম্ভব।

বিভিন্ন খাতে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ পানির পাশাপাশি স্যালাইনের ব্যবস্থা করতে হবে। যেকোনো পরিস্থিতির জন্য হাসপাতালগুলোতে আলাদা ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। এ ছাড়া দিনের কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনতে হবে। এক্ষেত্রে সকাল ৯টার বদলে ৮টা থেকে অফিস-আদালতের কাজ শুরু হয়ে দুপুর নাগাদ চলতে পারে।’

বায়ুদূষণের কারণেও তাপমাত্রা বেশি অনুভূত হচ্ছে, জানিয়ে ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘ধূলিকণা এবং দূষিত গ্যাসের তাপ শোষণ করার ক্ষমতা থাকায় বর্তমানে অত্যধিক দূষিত ধূলিকণা এবং গ্যাসীয় পদার্থগুলো সূর্যের তাপমাত্রাকে শোষণ করে তাপপ্রবাহ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সসাইড, কার্বন মনোক্সাসাইড, কার্বন ডাইঅক্সসাইডও তাপমাত্রা বাড়িয়ে থাকে। সুতরাং তাপমাত্রার বৃদ্ধি কমাতে বায়ুদূষণও কমানো জরুরি।’

বুয়েটের জলবায়ুবিদ ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘তাপদাহ সহজে যাবে না। এ অবস্থায় মানুষকে রক্ষায় অভিযোজন করতে হবে। এজন্য শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে অস্থায়ী বিশ্রামাগার করা যেতে পারে। যারা বস্তিতে বা রাস্তায় থাকেন, তাদের শহরের কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে অস্থায়ীভাবে রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সাধারণ মানুষকেও সচেতন থাকতে হবে। এ মুহূর্তে অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ থেকেও বিরত থাকতে হবে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘তীব্র গরমে কেউ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন। হিট স্ট্রোক হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ছায়াযুক্ত স্থানে নিতে হবে। নিরাপদ পানি, ডাব বা লেবুর শরবত পান করাতে হবে। এগুলো না পেলে স্যালাইন খাওয়াতে হবে। দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে রোগীকে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘বর্তমানের এই তাপদাহের সরাসরি প্রভাব হচ্ছে বৃদ্ধ লোকদের বেশি হিট স্ট্রোক হতে পারে। অনেকে মারাও যেতে পারেন। হিট স্ট্রোক ঠেকাতে প্রচুর পানি পান করতে হবে। সূর্যের সরাসরি আলো থেকে যতটা সম্ভব ছায়াতে থাকতে হবে। টানা পরিশ্রম না করে বিশ্রাম নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে মুখে, মাথায় পানি ঝাপটা দিতে হবে। শিশুদের ঘরের বাইরে কম বের হওয়া উচিত। রোজাদারদের ইফতারের পর নিয়মিত বিরতিতে পানি পান করতে হবে।’

চুয়াডাঙ্গায় দুর্বিষহ জনজীবন

চুয়াডাঙ্গা প্রতিবেদক জানাচ্ছেন, চুয়াডাঙ্গায় টানা দুই সপ্তাহের তাপপ্রবাহে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। গতকাল শনিবার থেকে শুরু হয়েছে অতি দাবদাহ। গতকাল বেলা ৩টায় এ জেলায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ১৬ শতাংশ। এ অবস্থায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এলাকায় বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে মাইকিং করা হচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ইনচার্জ জামিনুর রহমান বলেন, ‘প্রতিদিনই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় রেকর্ড হচ্ছে। টানা দুই সপ্তাহ জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে। গতকাল শনিবার সকাল ৯টায় ছিল ৩০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দুপুর ১২টায় তাপমাত্রা বেড়ে ৪০ দশমিক ৪ ডিগি হয়। বেলা ৩টায় তা ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে। শুরু হয় অতি দাবদাহ।’

চলমান তাপপ্রবাহে সবচেয়ে কষ্টে পড়েছেন খেটে খাওয়া দিনমজুর, রিকশা-ভ্যান চালক ও কৃষকরা। এদিকে তীব্র খরায় ঝরে যাচ্ছে আম-লিচুর গুটি। বোরো ধান ও সবজিক্ষেতে প্রতিদিন সেচ দিতে হচ্ছে। বাড়তি দামে প্রতিদিন ডিজেল কিনতে গিয়ে কৃষকদের নাভিশ্বাস উঠছে।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


তাপমাত্রাজনিত জরুরি অবস্থা জারি হতে পারে

Update Time : ০১:০১:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রচণ্ড গরমে পুড়ছে দেশ। চৈত্রের তীব্র তাপপ্রবাহ বৈশাখের শুরুতে এসে অতি তীব্র হয়েছে। ফলে শহর-গ্রাম কোথাও স্বস্তিতে নেই মানুষ। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও নারীদের কষ্ট এ পরিস্থিতিতে চরমে উঠেছে।

রমজানের এই সময়ে রোজাদারদের অবস্থা আরও কষ্টকর। সারা দিন পানি পান না করায় অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

সাধারণের ধারণা, এ বছরের তাপপ্রবাহ মানুষের বেঁচে থাকার সর্বোচ্চ সীমায় রয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যও মিলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের এ ধারণার সঙ্গে। গতকাল শনিবার ঢাকায় গত ৯ বছরের তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙেছে।

২০১৪ সালের এপ্রিলে রাজধানীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর শনিবার তাপমাত্রা ঠেকেছিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা ‘অতি তীব্র’ তাপমাত্রা হিসেবে উল্লেখ করেছেন আবহাওয়াবিদরা।

এ অবস্থায় যেকোনো সময় অতি তীব্র তাপপ্রবাহের সংকট মোকাবিলায় ‘তাপমাত্রাজনিত জরুরি অবস্থা’ জারি করা হতে পারে বলে গতকাল শনিবার জানিয়েছেন পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দীন।

তিনি বলেন, ‘তীব্র গরমে জনজীবনে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। আমরা চিন্তাভাবনা করছি, জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যায় কি না। গত দুদিন শুক্র ও শনিবার অফিস-আদালতে ছুটি ছিল। তাই আগামীকাল ও পরশু (রবি ও সোমবার) দুদিন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হবে। তাপমাত্রা যদি এরপরও বাড়তে থাকে, তবে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গতকাল রাজধানী ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর দেশের সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা ছিল খুলনা বিভাগের চুয়াডাঙ্গায়- সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল শনিবার পর্যন্ত টানা ১৪ দিন চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে।

গতকাল চট্টগ্রাম বিভাগে বান্দরবান জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অফিস জানায়, ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মৃদু, ৩৮-৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রিকে মাঝারি, ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রিকে তীব্র এবং ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রাকে ‘অতি তীব্র’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

আগামী ৭-৮ দিনেও বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই

ঢাকা বিভাগের মধ্যে গতকাল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ফরিদপুর জেলায় ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি। সিলেট বিভাগের শ্রীমঙ্গলে ছিল সর্বোচ্চ ৩৭ দশমিক ৫ ও সর্বনিম্ন ২২ দশমিক ৪ ডিগ্রি। রাজশাহী বিভাগে পাবনার ঈশ্বরদীতে সর্বোচ্চ ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি ও সর্বনিম্ন নওগাঁর বদলগাছীতে ২২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল।

রংপুর বিভাগের সৈয়দপুরে ৩৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বরিশালের খেপুপাড়ায় ৩৮ দশমিক ৯ ডিগ্রি এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল। ‘ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর মিডিয়াম-রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্ট (ইপিএমডব্লিউএফ) আজ থেকে আগামী ১০ দিনের পূর্বাভাস দিতে গিয়ে বলছে, ‘আগামী সাত থেকে আট দিন বাংলাদেশে বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই।’

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘খুলনা বিভাগসহ, ঢাকা, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী পাবনা ও পটুয়াখালীতে টানা তীব্র তাপদাহ ও দেশের অন্যান্য জেলায় মৃদু ও মাঝারি তাপপ্রবাহ বইছে। প্রথমে কয়েকটি জেলায় ‘মৃদু’ তাপপ্রবাহ ছিল। পরে কয়েকটি জেলায় ‘মৃদু’র পাশাপাশি ‘তীব্র’ তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে।

ওড়িশায় বিশেষ গাইডলাইন জারি

এদিকে তীব্র তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় ও নাগরিকদের স্বস্তি দিতে ভারতের ওড়িশা সরকার বিশেষ গাইডলাইন জারি করেছে। স্কুল-কলেজসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি শহর ও নগরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, মার্কেট, বাসস্টপে পর্যাপ্ত নিরাপদ খাবার পানির ব্যবস্থাসহ হাসপাতালগুলোতে হিট স্ট্রোকে আক্রান্তদের জন্য বিশেষ শয্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া ওষুধের দোকানগুলোতে গরমে আক্রান্তদের জন্য স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ মজুদ রাখারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।‍

তাপমাত্রাজনিত জরুরি অবস্থা কেন প্রয়োজন

গত এক সপ্তাহ ধরে তীব্র তাপপ্রবাহের পর অতি তীব্র তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। এ অবস্থায় সরকারকে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দিয়েছেন পরিবেশ ও জলবায়ুবিদ এবং চিকিসৎকরা। কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় তা নিয়ে ভাবছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ও।

‘তাপমাত্রাজনিত জরুরি অবস্থা’ কেন প্রয়োজন তা জানাতে গিয়ে বেসরকারি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আহম্মদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘বছরের পর বছর দূষণ করলে, অপরিকল্পিতভাবে গাছপালা কাটা ও জলাশয় ভরাট অব্যাহত রাখলে তাপমাত্রার এমন বিরূপ আচরণ আগামীতে আরও বাড়বে। তাই এবারের তাপপ্রবাহের সংকট আমলে নিয়ে ভবিষ্যতের উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে। তবে এ মুহূর্তে জনগণকে স্বস্তি দিতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যে কারণে ‘‘তাপমাত্রাজনিত জরুরি অবস্থা’’র ঘোষণা দিতে পারে সরকার। কারণ জরুরি অবস্থা ঘোষণা না করলে সরাসরি সরকারি পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব না। এর ফলে বেসরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসার পথও তৈরি হবে।’

এ পরিস্থিতিতে যা করণীয়

এ প্রসঙ্গে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আহম্মদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘উত্তপ্ত এই আবহাওয়ায় দিনের বেলা রাস্তায় পানি দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ এতে সড়ক ফেটে ক্ষতি হবে। তবে ভোরে সূর্য ওঠার আগে সড়কগুলোয় বেশি করে পানি ছিটালে তাপমাত্রার নেতিবাচক প্রভাব কাটানো সম্ভব।

বিভিন্ন খাতে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ পানির পাশাপাশি স্যালাইনের ব্যবস্থা করতে হবে। যেকোনো পরিস্থিতির জন্য হাসপাতালগুলোতে আলাদা ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। এ ছাড়া দিনের কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনতে হবে। এক্ষেত্রে সকাল ৯টার বদলে ৮টা থেকে অফিস-আদালতের কাজ শুরু হয়ে দুপুর নাগাদ চলতে পারে।’

বায়ুদূষণের কারণেও তাপমাত্রা বেশি অনুভূত হচ্ছে, জানিয়ে ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘ধূলিকণা এবং দূষিত গ্যাসের তাপ শোষণ করার ক্ষমতা থাকায় বর্তমানে অত্যধিক দূষিত ধূলিকণা এবং গ্যাসীয় পদার্থগুলো সূর্যের তাপমাত্রাকে শোষণ করে তাপপ্রবাহ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সসাইড, কার্বন মনোক্সাসাইড, কার্বন ডাইঅক্সসাইডও তাপমাত্রা বাড়িয়ে থাকে। সুতরাং তাপমাত্রার বৃদ্ধি কমাতে বায়ুদূষণও কমানো জরুরি।’

বুয়েটের জলবায়ুবিদ ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘তাপদাহ সহজে যাবে না। এ অবস্থায় মানুষকে রক্ষায় অভিযোজন করতে হবে। এজন্য শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে অস্থায়ী বিশ্রামাগার করা যেতে পারে। যারা বস্তিতে বা রাস্তায় থাকেন, তাদের শহরের কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে অস্থায়ীভাবে রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সাধারণ মানুষকেও সচেতন থাকতে হবে। এ মুহূর্তে অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ থেকেও বিরত থাকতে হবে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘তীব্র গরমে কেউ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন। হিট স্ট্রোক হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ছায়াযুক্ত স্থানে নিতে হবে। নিরাপদ পানি, ডাব বা লেবুর শরবত পান করাতে হবে। এগুলো না পেলে স্যালাইন খাওয়াতে হবে। দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে রোগীকে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘বর্তমানের এই তাপদাহের সরাসরি প্রভাব হচ্ছে বৃদ্ধ লোকদের বেশি হিট স্ট্রোক হতে পারে। অনেকে মারাও যেতে পারেন। হিট স্ট্রোক ঠেকাতে প্রচুর পানি পান করতে হবে। সূর্যের সরাসরি আলো থেকে যতটা সম্ভব ছায়াতে থাকতে হবে। টানা পরিশ্রম না করে বিশ্রাম নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে মুখে, মাথায় পানি ঝাপটা দিতে হবে। শিশুদের ঘরের বাইরে কম বের হওয়া উচিত। রোজাদারদের ইফতারের পর নিয়মিত বিরতিতে পানি পান করতে হবে।’

চুয়াডাঙ্গায় দুর্বিষহ জনজীবন

চুয়াডাঙ্গা প্রতিবেদক জানাচ্ছেন, চুয়াডাঙ্গায় টানা দুই সপ্তাহের তাপপ্রবাহে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। গতকাল শনিবার থেকে শুরু হয়েছে অতি দাবদাহ। গতকাল বেলা ৩টায় এ জেলায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ১৬ শতাংশ। এ অবস্থায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এলাকায় বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে মাইকিং করা হচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ইনচার্জ জামিনুর রহমান বলেন, ‘প্রতিদিনই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় রেকর্ড হচ্ছে। টানা দুই সপ্তাহ জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে। গতকাল শনিবার সকাল ৯টায় ছিল ৩০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দুপুর ১২টায় তাপমাত্রা বেড়ে ৪০ দশমিক ৪ ডিগি হয়। বেলা ৩টায় তা ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে। শুরু হয় অতি দাবদাহ।’

চলমান তাপপ্রবাহে সবচেয়ে কষ্টে পড়েছেন খেটে খাওয়া দিনমজুর, রিকশা-ভ্যান চালক ও কৃষকরা। এদিকে তীব্র খরায় ঝরে যাচ্ছে আম-লিচুর গুটি। বোরো ধান ও সবজিক্ষেতে প্রতিদিন সেচ দিতে হচ্ছে। বাড়তি দামে প্রতিদিন ডিজেল কিনতে গিয়ে কৃষকদের নাভিশ্বাস উঠছে।