অগ্নিঝরা ১১ মার্চ: মিছিল-সমাবেশে মুখর ছিল ঢাকা

  • Update Time : ১১:১৬:১৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ মার্চ ২০২৩
  • / 135

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চের একাদশতম দিনে মিছিল-সমাবেশে মুখর ছিল ঢাকাসহ সারা দেশ। স্বাধীন বাংলার দাবিতে অবিচল সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ অনুযায়ী সরকারের সঙ্গে সব ধরনের অসহযোগিতা অব্যাহত রাখেন।

মুক্তিকামী মানুষ মানছিল না পাকিস্তানি সামরিক শাসকের নির্দেশ। সাত কোটি বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সবকিছুই চলছিল তার নির্দেশে। বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে শরিক হয়ে এদিন হাইকোর্টের বিচারপতি ও প্রশাসনের সচিবসহ সারা বাংলায় সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরের কর্মচারীরা অফিস বর্জন করেন।

১৯৭১ সালের ১১ মার্চ সচিবালয়, মুখ্য সচিবের বাসভবন, প্রধান বিচারপতির বাসভবনসহ সব সরকারি-আধাসরকারি ভবন ও বাসগৃহের শীর্ষে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়তে থাকে। ন্যাপ (ওয়ালী) পূর্ব বাংলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, পাঞ্জাব আওয়ামী লীগ সভাপতি এম খুরশীদ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মমতাজ দৌলতানার বিশেষ দূত পীর সাইফুদ্দিন ও ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি কে উলফ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ধানমণ্ডির বাসভবনে পৃথক বৈঠকে মিলিত হন।

বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর প্রশাসনিক কাজে যেন বাঙালিরা সহায়তা না করে। ৭ মার্চের ভাষণেও সেটা তিনি বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই কথা পুরোপুরি কার্যকর হয় মাত্র পাঁচদিনের মাথাতেই।

সরকারি ও আধা সরকারি প্রায় সব কার্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়। আদালত থেকে শুরু করে অনেক প্রশাসনিক কর্মকর্তাই স্বাধীনতার ডাককে সমর্থন করে কর্মস্থল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বের হয়ে আসেন। এটি ছিল পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ।

মুক্তিকামী সংগ্রামী জনতা সেনাবাহিনীর রসদ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর স্বাভাবিক সরবরাহের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। সিলেটে রেশন নেয়ার সময় সেনাবাহিনীর একটি কনভয়কে বাধা দেয়া হয়। যশোরেও এ ধরনের ঘটনা ঘটে।

রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ ১১৪নং সামরিক আদেশ জারি করে নির্দেশ দেয় যে, কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারি সম্পতির ক্ষতিসাধন করলে অথবা সশস্ত্রবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ বা সেনাবাহিনীর গতিবিধিতে অন্তরায় সৃষ্টি করলে তাদের কার্যকলাপ আক্রমণাত্মক কাজের শামিল বলে গণ্য হবে, যা সংশ্লিষ্ট সামরিক বিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য।

এদিন টাঙ্গাইলে বিন্দুবাসিনী হাইস্কুল মাঠে এক জনসভায় ন্যাপপ্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেন।

তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান সাত কোটি বাঙালির নেতা। নেতার নির্দেশ পালন করুন। লক্ষ্য অর্জনের জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করুন। এ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনোরকম বিরোধ থাকা উচিত নয়। জনগণ এখন নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে একটি তারবার্তা পাঠান। সেখানে ভুট্টো বলেন, উদ্ভূত সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। আমরা বিরাট সংকটের মুখোমুখি। দেশের ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চিত।

এ ব্যাপারে আমাদের উভয়ের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। ধ্বংস এড়ানোর জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই আমাদের করতে হবে। যে কোনো মূল্যে দেশকে রক্ষা করতে হবেই।

করাচিতে গণঐক্য আন্দোলনের নেতা এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, খুব দ্রুত পটপরিবর্তন হচ্ছে। দেশকে বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে রক্ষা করতে হলে শিগগির ব্যবস্থা নিতে হবে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানই কার্যত এখন ঢাকার সরকার। সেখানে সব সরকারি কর্মচারী ও সচিব তার নির্দেশ পালন করছেন।

ঢাকায় কেবল সামরিক সদর দফতরে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। তিনি আরও বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা ছাড়া না হলে দেশের দু’অংশকে এক রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


অগ্নিঝরা ১১ মার্চ: মিছিল-সমাবেশে মুখর ছিল ঢাকা

Update Time : ১১:১৬:১৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ মার্চ ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চের একাদশতম দিনে মিছিল-সমাবেশে মুখর ছিল ঢাকাসহ সারা দেশ। স্বাধীন বাংলার দাবিতে অবিচল সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ অনুযায়ী সরকারের সঙ্গে সব ধরনের অসহযোগিতা অব্যাহত রাখেন।

মুক্তিকামী মানুষ মানছিল না পাকিস্তানি সামরিক শাসকের নির্দেশ। সাত কোটি বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সবকিছুই চলছিল তার নির্দেশে। বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে শরিক হয়ে এদিন হাইকোর্টের বিচারপতি ও প্রশাসনের সচিবসহ সারা বাংলায় সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরের কর্মচারীরা অফিস বর্জন করেন।

১৯৭১ সালের ১১ মার্চ সচিবালয়, মুখ্য সচিবের বাসভবন, প্রধান বিচারপতির বাসভবনসহ সব সরকারি-আধাসরকারি ভবন ও বাসগৃহের শীর্ষে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়তে থাকে। ন্যাপ (ওয়ালী) পূর্ব বাংলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, পাঞ্জাব আওয়ামী লীগ সভাপতি এম খুরশীদ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মমতাজ দৌলতানার বিশেষ দূত পীর সাইফুদ্দিন ও ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি কে উলফ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ধানমণ্ডির বাসভবনে পৃথক বৈঠকে মিলিত হন।

বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর প্রশাসনিক কাজে যেন বাঙালিরা সহায়তা না করে। ৭ মার্চের ভাষণেও সেটা তিনি বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই কথা পুরোপুরি কার্যকর হয় মাত্র পাঁচদিনের মাথাতেই।

সরকারি ও আধা সরকারি প্রায় সব কার্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়। আদালত থেকে শুরু করে অনেক প্রশাসনিক কর্মকর্তাই স্বাধীনতার ডাককে সমর্থন করে কর্মস্থল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বের হয়ে আসেন। এটি ছিল পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ।

মুক্তিকামী সংগ্রামী জনতা সেনাবাহিনীর রসদ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর স্বাভাবিক সরবরাহের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। সিলেটে রেশন নেয়ার সময় সেনাবাহিনীর একটি কনভয়কে বাধা দেয়া হয়। যশোরেও এ ধরনের ঘটনা ঘটে।

রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ ১১৪নং সামরিক আদেশ জারি করে নির্দেশ দেয় যে, কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারি সম্পতির ক্ষতিসাধন করলে অথবা সশস্ত্রবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ বা সেনাবাহিনীর গতিবিধিতে অন্তরায় সৃষ্টি করলে তাদের কার্যকলাপ আক্রমণাত্মক কাজের শামিল বলে গণ্য হবে, যা সংশ্লিষ্ট সামরিক বিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য।

এদিন টাঙ্গাইলে বিন্দুবাসিনী হাইস্কুল মাঠে এক জনসভায় ন্যাপপ্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেন।

তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান সাত কোটি বাঙালির নেতা। নেতার নির্দেশ পালন করুন। লক্ষ্য অর্জনের জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করুন। এ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনোরকম বিরোধ থাকা উচিত নয়। জনগণ এখন নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে একটি তারবার্তা পাঠান। সেখানে ভুট্টো বলেন, উদ্ভূত সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। আমরা বিরাট সংকটের মুখোমুখি। দেশের ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চিত।

এ ব্যাপারে আমাদের উভয়ের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। ধ্বংস এড়ানোর জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই আমাদের করতে হবে। যে কোনো মূল্যে দেশকে রক্ষা করতে হবেই।

করাচিতে গণঐক্য আন্দোলনের নেতা এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, খুব দ্রুত পটপরিবর্তন হচ্ছে। দেশকে বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে রক্ষা করতে হলে শিগগির ব্যবস্থা নিতে হবে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানই কার্যত এখন ঢাকার সরকার। সেখানে সব সরকারি কর্মচারী ও সচিব তার নির্দেশ পালন করছেন।

ঢাকায় কেবল সামরিক সদর দফতরে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। তিনি আরও বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা ছাড়া না হলে দেশের দু’অংশকে এক রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।