বাসে ডাকাতি: সিসি ক্যামেরার আওতায় আসছে মহাসড়ক

  • Update Time : ০৯:৪৯:৫০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২
  • / 264

*পাঁচ বছরে মহাসড়কে ডাকাতির মামলার আসামিদের নামের তালিকা করেছে হাইওয়ে পুলিশ
*তালিকা ধরে বড় ধরনের পরিকল্পনা
* আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে উদাসীন বাস মালিকরা
*ডাকাতি রোধে বাসে যাত্রীদের ভিডিও করা, সিসি ক্যামেরা স্থাপন এবং ‘প্যানিক বাটন’ লাগানো
*মহাসড়কে যাত্রী ওঠানামার স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা

বাসে ডাকাতিসহ ধর্ষণের ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে হাইওয়ে পুলিশ। সড়ক-মহাসড়কে বাসে রাতের যাত্রা যেন হয়ে উঠছে বিভীষিকাময়। রাত যত গভীর হয়, ভয় আর আতঙ্ক ততই বাড়ে। ক্রমে আরও সক্রিয় হচ্ছে ডাকাতদল। শুধু দামি মালামাল, টাকা, অলংকার ছিনিয়ে নেওয়া নয়, তারা ঘটাচ্ছে নারীর যৌন হয়রানি ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা। অধিকাংশ ঘটনার হোতা যাত্রীবেশে ওঠা ডাকাতদল। মহসড়কে পুলিশের টহল থাকলেও কার্যকারিতা নেই। নিয়ম ভেঙে যত্রতত্র যাত্রী তোলেন বাসের চালক ও সুপারভাইজর। তাদের লোভের বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। দায় আছে বাস মালিকদেরও।

বিভিন্ন সময় ডাকাতি ও নৃশংসতার ঘটনা গণমাধ্যমে প্রচার হলে প্রতিরোধে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেয় পুলিশ সদর দপ্তর। তবে অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয় না। চলতি বছরের শুরুতে মহাসড়কে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা প্রতিরোধে পুলিশের পক্ষ থেকে ১৮ দফা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও বাস্তবায়ন হয়নি বললেই চলে। সম্প্রতি বাসে ডাকাতিসহ ধর্ষণের ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে হাইওয়ে পুলিশ। গত পাঁচ বছরে সারাদেশে মহাসড়কে ডাকাতির তালিকা করেছে তারা। তালিকা হাইওয়ে পুলিশের সদর দপ্তর পর্যালোচনা করছে। এ তালিকা ধরে শিগগির বড় ধরনের অভিযান শুরু করা হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

মহাসড়কে চলাচলকারী বাসগুলোর একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে যাত্রী তুলে আবার নির্দিষ্ট স্থানে নামিয়ে দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু তারা মহাসড়কের যত্রতত্র যাত্রী তোলে বলে অভিযোগ।

বাসচালকদের দাবি, রাতে কিছু লোভী চালক, সুপারভাইজর ও হেলপারের কারণে বাসে ডাকাতি হয়। তারা রাস্তার মাঝ থেকে যাত্রী তোলেন। রাতে ফাঁকা জায়গায় পুলিশের জোরালো টহল না থাকার কারণে সুযোগ নেয় ডাকাতরা।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বাসে যাত্রীদের ভিডিও করা, সিসি ক্যামেরা স্থাপন এবং প্যানিক বাটন লাগানোর মাধ্যমে ডাকাতি রোধ সম্ভব। কিন্তু এসব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে উদাসীন মালিকরা। তারা চালক-সহকারীদের সতর্ক করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। নির্ধারিত স্টপেজের বাইরে যাত্রী না তুলতে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তাদের। নির্ধারিত রুটের বাইরে বাস না চালানোর বিষয়টিও কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে বলা হয়েছে।

সূত্র জানায়, দূরপাল্লার গাড়িতে ডেস্ক ক্যামেরা স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ওই ক্যামেরার মাধ্যমে যাত্রীদের মনিটরিং করা হবে। সেখানে বিশেষ ডিভাইস থাকবে। সংযুক্ত থাকবে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর সঙ্গে। গাড়িটি বিপদে পড়লে ডিভাইসটিতে চাপ দিলেই সংকেত ৯৯৯-এ চলে যাবে। এর মাধ্যমে স্থানীয় থানা বিপদে পড়া গাড়ির বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারবে।

সম্প্রতি সারা দেশের থানা ও ফাঁড়িতে হাইওয়ে পুলিশের সদর দপ্তর থেকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, মহাসড়কে বাস ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনা বেড়েছে। অপরাধীচক্রের সদস্যরা যাত্রীবেশে বাসে উঠে সুযোগ বুঝে ডাকাতি করছে। নারী নির্যাতনের মতো অপরাধেও তারা লিপ্ত। বাস টার্মিনালে যাত্রীদের ছবি ও ভিডিও ধারণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। পাশাপাশি নতুন যাত্রী ওঠানোর সময় ছবি তোলা ও তা সংরক্ষণ করতে বাস মালিক সমিতির সঙ্গে আলোচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব স্থানে যাত্রী ওঠানামার জন্য বাস থামে, সেসব স্থান সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসার জন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। হাইওয়ে এবং জেলা পুলিশের ভ্রাম্যমাণ টহল দল যথাযথ কর্তব্য পালন করছে কি না, তা সংশ্লিষ্ট ইউনিটের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিবিড়ভাবে তদারকি করবেন। দায়িত্ব পালনে ব্যত্যয় হলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে।

গত কয়েক বছরের বাস ডাকাতির ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অধিকাংশ ঘটনায় ডাকাতরা টাঙ্গাইল থেকে উঠেছে বা এই পথকে নিরাপদ ভেবে ডাকাতি করেছে। সবশেষ কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থেকে সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে ছাড়া ঈগল পরিবহনের বাসে টাঙ্গাইলে এসে ডাকাতি ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় হয়।

এর আগে গত ১৬ জুন কুমিল্লার দাউদকান্দিতে কক্সবাজারগামী একটি মাইক্রোবাস ও পিকআপভ্যানে ডাকাতির সময় তিন যাত্রীকে কুপিয়ে আহত করে ডাকাতদল। গত ৩১ মার্চ স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং ভাগ্নিকে নিয়ে ঢাকা থেকে গাড়ি চালিয়ে কক্সবাজার যাওয়ার পথে ওই এলাকায় ডাকাতের কবলে পড়েন গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহবুব আলম। গত ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে কালিয়াকৈর যাওয়ার পথে পাকুল্লা বাজারের কাছাকাছি যাত্রীবেশে ওঠা ডাকাতদল প্রায় তিন ঘণ্টা হাইওয়ে বাস নিয়ে ঘোরাঘুরি করে টাকা ও মালামাল ছিনিয়ে নেয়। বাসের মধ্যে থাকা নারীদের ওপর চলে পাশবিক নির্যাতন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ডাকাতি কমিয়ে আনতে হাইওয়ে পুলিশকে আরও তৎপর হতে হবে। বাড়াতে হবে টহল। অন্যথায় কমবে না। হাইওয়ে পুলিশকে টহল চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি চালক ও মালিককে সচেতন হতে হবে। কেননা ট্রিপপ্রতি চুক্তিতে চালককে টাকা দেওয়ায় মাঝরাতে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো হচ্ছে। এতে ভয়ংকর ঝুঁকিতে পড়ছেন অন্য যাত্রীরা। সুতরাং, চুক্তিভিত্তিক নয়, বেতনভুক্ত চালক ও হেলপারের ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রতিটি গাড়িতে সিসি ক্যামেরা লাগানো গেলে ডাকাতি কমবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সব গাড়িতে সিসি ক্যামেরা লাগানো সম্ভব নয়। কারণ ভাঙা সড়কে ঝাঁকির কারণে ক্যামেরাগুলো বেশিদিন টেকে না। আমার কিছু দামি গাড়িতে এরই মধ্যে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছি। এছাড়া রাতের কোচে একাধিক স্পটে যাত্রীদের ভিডিও করা হচ্ছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সবার আগে উন্নত বিশ্বের আদলে বাসের চালক-শ্রমিকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। এটি করা গেলে অনেকাংশে পরিবহন খাত শৃঙ্খলিত হবে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত অপরাধ কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, বর্তমান সরকারের সময়ে সব গাড়িতে ডিজিটাল নম্বরপ্লেট সাঁটানো আছে। এই ডিজিটাল নম্বরপ্লেটটি দেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য ছিল, গাড়ি ট্র্যাকিং করা এবং যার মূল কাজ ছিল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যার দায়িত্ব ছিল একটি বেসরকারি কোম্পানির।

তিনি বলেন, যানবাহনে ডিজিটাল নম্বরপ্লেট লাগালেও ডিভাইস স্থাপন করেনি তারা। শুধু নম্বরপ্লেট লাগিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের সঙ্গে চুক্তি ছিল এক লাখ গাড়িতে নম্বরপ্লেট লাগিয়ে সড়কে ডিভাইস লাগাবে। কিন্তু ২০ লাখের বেশি গাড়িতে ডিজিটাল নম্বরপ্লেট সাঁটানোর পরেও ডিভাইস স্থাপন করেনি। সরকারের পক্ষ থেকেও সেই কোম্পানিকে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে না। ডিভাইসটি থাকলে যানবাহনের গতিবিধি শনাক্ত করা যাবে, যানবাহন ট্র্যাকিং এমনকি যানবাহনে কতজন যাত্রী আছে তাও মোবাইলে দেখা সম্ভব।

মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরও বলেন, উন্নত বিশ্বের মতো হাইওয়ে পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে সড়কে ডাকাতিসহ অন্যান্য অপরাধ অনেকাংশে কমে যাবে।

হাইওয়ে পুলিশের গাজীপুর রিজিয়নের পুলিশ সুপার মো. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাত্রিকালীন যাত্রীদের মহাসড়কের মূল পাঁচটি টেকনিক্যাল পয়েন্টে ভিডিও করা হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনায় প্রায় সোয়া ২শ ডাকাতের তালিকা করা হয়েছে। এসব ডাকাতদের বিভিন্নভাবে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। আগের তুলনায় জোরদার করা হয়েছে রাত্রীকালীন টহল।

‘দফায় দফায় বাস মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে রাতের কোচে টিকিট ছাড়া যাত্রী তোলা থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না কোনো অবস্থাতেই। নির্জন স্থানে বাস না থামানোর জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে পুলিশের সহয়তার কথাও জানানো হয়েছে। রাতে লোকাল বাস না চালানোর জন্যও পরামর্শ দেওয়া হয়।’

এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন্স) হায়দার আলী খান বলেন, যাত্রী নিরাপত্তার দায়িত্ব বাস মালিক ও শ্রমিকদের। মালিক চাইলে বাসের ভেতরে সিসিটিভি লাগাতে পারেন। কাউন্টার ছাড়া পথে যাত্রী তুললে পুলিশের করার কিছু থাকে না। এজন্য মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নকে বলা হয়েছে আগেই। পথে যাত্রী তুললে কাউন্টারে ভিডিও করেও লাভ নেই। এজন্য সবাইকে সতর্ক হতে হবে। হাইওয়েতে যাত্রী ও পরিবহনের নিরাপত্তায় পুলিশকে সতর্ক থাকতে সব সময় নির্দেশনা দেওয়া থাকে।

Please Share This Post in Your Social Media


বাসে ডাকাতি: সিসি ক্যামেরার আওতায় আসছে মহাসড়ক

Update Time : ০৯:৪৯:৫০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২

*পাঁচ বছরে মহাসড়কে ডাকাতির মামলার আসামিদের নামের তালিকা করেছে হাইওয়ে পুলিশ
*তালিকা ধরে বড় ধরনের পরিকল্পনা
* আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে উদাসীন বাস মালিকরা
*ডাকাতি রোধে বাসে যাত্রীদের ভিডিও করা, সিসি ক্যামেরা স্থাপন এবং ‘প্যানিক বাটন’ লাগানো
*মহাসড়কে যাত্রী ওঠানামার স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা

বাসে ডাকাতিসহ ধর্ষণের ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে হাইওয়ে পুলিশ। সড়ক-মহাসড়কে বাসে রাতের যাত্রা যেন হয়ে উঠছে বিভীষিকাময়। রাত যত গভীর হয়, ভয় আর আতঙ্ক ততই বাড়ে। ক্রমে আরও সক্রিয় হচ্ছে ডাকাতদল। শুধু দামি মালামাল, টাকা, অলংকার ছিনিয়ে নেওয়া নয়, তারা ঘটাচ্ছে নারীর যৌন হয়রানি ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা। অধিকাংশ ঘটনার হোতা যাত্রীবেশে ওঠা ডাকাতদল। মহসড়কে পুলিশের টহল থাকলেও কার্যকারিতা নেই। নিয়ম ভেঙে যত্রতত্র যাত্রী তোলেন বাসের চালক ও সুপারভাইজর। তাদের লোভের বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। দায় আছে বাস মালিকদেরও।

বিভিন্ন সময় ডাকাতি ও নৃশংসতার ঘটনা গণমাধ্যমে প্রচার হলে প্রতিরোধে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেয় পুলিশ সদর দপ্তর। তবে অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয় না। চলতি বছরের শুরুতে মহাসড়কে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা প্রতিরোধে পুলিশের পক্ষ থেকে ১৮ দফা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও বাস্তবায়ন হয়নি বললেই চলে। সম্প্রতি বাসে ডাকাতিসহ ধর্ষণের ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে হাইওয়ে পুলিশ। গত পাঁচ বছরে সারাদেশে মহাসড়কে ডাকাতির তালিকা করেছে তারা। তালিকা হাইওয়ে পুলিশের সদর দপ্তর পর্যালোচনা করছে। এ তালিকা ধরে শিগগির বড় ধরনের অভিযান শুরু করা হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

মহাসড়কে চলাচলকারী বাসগুলোর একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে যাত্রী তুলে আবার নির্দিষ্ট স্থানে নামিয়ে দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু তারা মহাসড়কের যত্রতত্র যাত্রী তোলে বলে অভিযোগ।

বাসচালকদের দাবি, রাতে কিছু লোভী চালক, সুপারভাইজর ও হেলপারের কারণে বাসে ডাকাতি হয়। তারা রাস্তার মাঝ থেকে যাত্রী তোলেন। রাতে ফাঁকা জায়গায় পুলিশের জোরালো টহল না থাকার কারণে সুযোগ নেয় ডাকাতরা।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বাসে যাত্রীদের ভিডিও করা, সিসি ক্যামেরা স্থাপন এবং প্যানিক বাটন লাগানোর মাধ্যমে ডাকাতি রোধ সম্ভব। কিন্তু এসব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে উদাসীন মালিকরা। তারা চালক-সহকারীদের সতর্ক করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। নির্ধারিত স্টপেজের বাইরে যাত্রী না তুলতে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তাদের। নির্ধারিত রুটের বাইরে বাস না চালানোর বিষয়টিও কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে বলা হয়েছে।

সূত্র জানায়, দূরপাল্লার গাড়িতে ডেস্ক ক্যামেরা স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ওই ক্যামেরার মাধ্যমে যাত্রীদের মনিটরিং করা হবে। সেখানে বিশেষ ডিভাইস থাকবে। সংযুক্ত থাকবে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর সঙ্গে। গাড়িটি বিপদে পড়লে ডিভাইসটিতে চাপ দিলেই সংকেত ৯৯৯-এ চলে যাবে। এর মাধ্যমে স্থানীয় থানা বিপদে পড়া গাড়ির বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারবে।

সম্প্রতি সারা দেশের থানা ও ফাঁড়িতে হাইওয়ে পুলিশের সদর দপ্তর থেকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, মহাসড়কে বাস ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনা বেড়েছে। অপরাধীচক্রের সদস্যরা যাত্রীবেশে বাসে উঠে সুযোগ বুঝে ডাকাতি করছে। নারী নির্যাতনের মতো অপরাধেও তারা লিপ্ত। বাস টার্মিনালে যাত্রীদের ছবি ও ভিডিও ধারণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। পাশাপাশি নতুন যাত্রী ওঠানোর সময় ছবি তোলা ও তা সংরক্ষণ করতে বাস মালিক সমিতির সঙ্গে আলোচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব স্থানে যাত্রী ওঠানামার জন্য বাস থামে, সেসব স্থান সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসার জন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। হাইওয়ে এবং জেলা পুলিশের ভ্রাম্যমাণ টহল দল যথাযথ কর্তব্য পালন করছে কি না, তা সংশ্লিষ্ট ইউনিটের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিবিড়ভাবে তদারকি করবেন। দায়িত্ব পালনে ব্যত্যয় হলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে।

গত কয়েক বছরের বাস ডাকাতির ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অধিকাংশ ঘটনায় ডাকাতরা টাঙ্গাইল থেকে উঠেছে বা এই পথকে নিরাপদ ভেবে ডাকাতি করেছে। সবশেষ কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থেকে সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে ছাড়া ঈগল পরিবহনের বাসে টাঙ্গাইলে এসে ডাকাতি ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় হয়।

এর আগে গত ১৬ জুন কুমিল্লার দাউদকান্দিতে কক্সবাজারগামী একটি মাইক্রোবাস ও পিকআপভ্যানে ডাকাতির সময় তিন যাত্রীকে কুপিয়ে আহত করে ডাকাতদল। গত ৩১ মার্চ স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং ভাগ্নিকে নিয়ে ঢাকা থেকে গাড়ি চালিয়ে কক্সবাজার যাওয়ার পথে ওই এলাকায় ডাকাতের কবলে পড়েন গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহবুব আলম। গত ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে কালিয়াকৈর যাওয়ার পথে পাকুল্লা বাজারের কাছাকাছি যাত্রীবেশে ওঠা ডাকাতদল প্রায় তিন ঘণ্টা হাইওয়ে বাস নিয়ে ঘোরাঘুরি করে টাকা ও মালামাল ছিনিয়ে নেয়। বাসের মধ্যে থাকা নারীদের ওপর চলে পাশবিক নির্যাতন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ডাকাতি কমিয়ে আনতে হাইওয়ে পুলিশকে আরও তৎপর হতে হবে। বাড়াতে হবে টহল। অন্যথায় কমবে না। হাইওয়ে পুলিশকে টহল চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি চালক ও মালিককে সচেতন হতে হবে। কেননা ট্রিপপ্রতি চুক্তিতে চালককে টাকা দেওয়ায় মাঝরাতে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো হচ্ছে। এতে ভয়ংকর ঝুঁকিতে পড়ছেন অন্য যাত্রীরা। সুতরাং, চুক্তিভিত্তিক নয়, বেতনভুক্ত চালক ও হেলপারের ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রতিটি গাড়িতে সিসি ক্যামেরা লাগানো গেলে ডাকাতি কমবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সব গাড়িতে সিসি ক্যামেরা লাগানো সম্ভব নয়। কারণ ভাঙা সড়কে ঝাঁকির কারণে ক্যামেরাগুলো বেশিদিন টেকে না। আমার কিছু দামি গাড়িতে এরই মধ্যে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছি। এছাড়া রাতের কোচে একাধিক স্পটে যাত্রীদের ভিডিও করা হচ্ছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সবার আগে উন্নত বিশ্বের আদলে বাসের চালক-শ্রমিকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। এটি করা গেলে অনেকাংশে পরিবহন খাত শৃঙ্খলিত হবে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত অপরাধ কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, বর্তমান সরকারের সময়ে সব গাড়িতে ডিজিটাল নম্বরপ্লেট সাঁটানো আছে। এই ডিজিটাল নম্বরপ্লেটটি দেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য ছিল, গাড়ি ট্র্যাকিং করা এবং যার মূল কাজ ছিল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যার দায়িত্ব ছিল একটি বেসরকারি কোম্পানির।

তিনি বলেন, যানবাহনে ডিজিটাল নম্বরপ্লেট লাগালেও ডিভাইস স্থাপন করেনি তারা। শুধু নম্বরপ্লেট লাগিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের সঙ্গে চুক্তি ছিল এক লাখ গাড়িতে নম্বরপ্লেট লাগিয়ে সড়কে ডিভাইস লাগাবে। কিন্তু ২০ লাখের বেশি গাড়িতে ডিজিটাল নম্বরপ্লেট সাঁটানোর পরেও ডিভাইস স্থাপন করেনি। সরকারের পক্ষ থেকেও সেই কোম্পানিকে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে না। ডিভাইসটি থাকলে যানবাহনের গতিবিধি শনাক্ত করা যাবে, যানবাহন ট্র্যাকিং এমনকি যানবাহনে কতজন যাত্রী আছে তাও মোবাইলে দেখা সম্ভব।

মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরও বলেন, উন্নত বিশ্বের মতো হাইওয়ে পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে সড়কে ডাকাতিসহ অন্যান্য অপরাধ অনেকাংশে কমে যাবে।

হাইওয়ে পুলিশের গাজীপুর রিজিয়নের পুলিশ সুপার মো. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাত্রিকালীন যাত্রীদের মহাসড়কের মূল পাঁচটি টেকনিক্যাল পয়েন্টে ভিডিও করা হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনায় প্রায় সোয়া ২শ ডাকাতের তালিকা করা হয়েছে। এসব ডাকাতদের বিভিন্নভাবে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। আগের তুলনায় জোরদার করা হয়েছে রাত্রীকালীন টহল।

‘দফায় দফায় বাস মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে রাতের কোচে টিকিট ছাড়া যাত্রী তোলা থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না কোনো অবস্থাতেই। নির্জন স্থানে বাস না থামানোর জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে পুলিশের সহয়তার কথাও জানানো হয়েছে। রাতে লোকাল বাস না চালানোর জন্যও পরামর্শ দেওয়া হয়।’

এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন্স) হায়দার আলী খান বলেন, যাত্রী নিরাপত্তার দায়িত্ব বাস মালিক ও শ্রমিকদের। মালিক চাইলে বাসের ভেতরে সিসিটিভি লাগাতে পারেন। কাউন্টার ছাড়া পথে যাত্রী তুললে পুলিশের করার কিছু থাকে না। এজন্য মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নকে বলা হয়েছে আগেই। পথে যাত্রী তুললে কাউন্টারে ভিডিও করেও লাভ নেই। এজন্য সবাইকে সতর্ক হতে হবে। হাইওয়েতে যাত্রী ও পরিবহনের নিরাপত্তায় পুলিশকে সতর্ক থাকতে সব সময় নির্দেশনা দেওয়া থাকে।