উপজাতি সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম কবে থামবে?

  • Update Time : ০৪:৪৭:২৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩ জুলাই ২০২১
  • / 213

মিনহাজুল ইসলাম :

পার্বত্য চট্টগ্রাম যেন দেশের ভেতর এক ভিন্ন দেশ। বাঙালির এই দেশে বাঙালিরাই যেন সেখানে ভিনদেশি। স্বাধীন দেশের সবুজ পাহাড় প্রায়শ লাল হয়ে ওঠে বাঙালির রক্তে। ধর্ম পরিবর্তনের অপরাধে প্রাণ হারাতে হয় উপজাতিদেরও। বিচার পাওয়া তো দূরে থাক, বিচার চাওয়াও যেন সেখানে অসাধ্য। তাহলে প্রশাসন কি সেখানকার সন্ত্রাসীদের লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ? আরও প্রশ্ন হলো এত ভারী অস্ত্র, উন্নত প্রশিক্ষণ কোথা থেকে পায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা?

সম্প্রতি এসব প্রশ্ন নতুন করে জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে বান্দরবানে ওমর ফারুক ত্রিপুরাকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করার পর। ইসলাম ধর্মগ্রহণ ও প্রচার করার অপরাধে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো ওমর ফারুক ত্রিপুরাকে। এমন ঘটনা কিন্তু নতুন নয়। এই বান্দরবানেই বছর তিনেক আগে স্বপরিবারে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার অপরাধে চাকমা দম্পতিকে হত্যা করা হয় এবং তাদের তিন সন্তানকে ভিটেমাটি ছাড়া করা হয়।

শুধু ধর্মীয় বিষয় নিয়ে হত্যার ঘটনা কিছুটা নতুন হলেও, সেখানকার আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস ও বাঙালি হত্যার বিষয়গুলো অনেক পুরনো। এখানে একটা জিনিস উল্লেখ্য, আমাদের অভিযোগ শুধুমাত্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। সাধারণ উপজাতিদের বিরুদ্ধে নয়। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণে গেলে দেখি অনেক উপজাতি বন্ধুরা খুব অতিথিপরায়ণ আচরণ করে। যা সত্যি আমাদের মুগ্ধ করে। তবে, যেসব সন্ত্রাসী সংগঠন এসব নিরীহ মানুষদের সন্ত্রাসীপনা শেখাচ্ছে, অভিযোগটা কেবল তাদের দিকেই।

পাহাড়ে সন্ত্রাসের নমুনা দেখতে একটু পেছন ফিরে তাকানো যাক। ১৯৭২ সালে পাহাড়িদের অধিকার আদায়ের জন্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। এরপর সশস্ত্র সংগ্রামের উদ্দেশ্যে জেএসএসের সামরিক শাখা শান্তিবাহিনী যাত্রা শুরু করে। তারপর সেখানে সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ বাহিনীর সাথে শুরু হয় সংঘাত। এসময় হত্যা করা অনেক নিরীহ বাঙালিদেরও। এদিকে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে পাহাড়ে ভূমিহীন বাঙালিদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে চার লক্ষ বাঙালিকে পুনর্বাসিত করা হয়। এতে চরমভাবে ক্ষুদ্ধ হয় পাহাড়িরা। ভূমি বিরোধ নিয়ে নব উদ্যোমে শুরু হয় সংঘাত।

দীর্ঘ সংঘাত শেষে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৭ সালের ২ রা ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি। এদিকে জেএসএসের শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করে ১৯৯৮ সালে প্রসীত বিকাশ খীসা, সঞ্চয় চাকমার নেতৃত্বে নতুন উপজাতীয় সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) জন্ম হয়। সংগঠনটি অভিযোগ করে এই চুক্তিতে স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি এবং সেনাপ্রত্যাহার সহ অন্যান্য শর্ত পূরণের সুনির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করা হয়নি। তবুও ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি শান্তিবাহিনীর প্রায় দুই হাজার গেরিলা অস্ত্র সমর্পণ করে। এখানে উল্লেখ্য, অস্ত্র সমর্পণ করলেও সংগঠনটি কখনোই সম্পূর্ণ নিরস্ত্র হয়নি। এদিকে জেএসএসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি এবার শুরু হয় ইউপিডিএফের সন্ত্রাসীপনা। নিজেদের ভেতর অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে শুরু হয় সংঘাত। পাহাড়ি মাটি হয়ে ওঠে রক্তলাল।

তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি নানা যুক্তি দেখি তখন থেকেই চুক্তির বিরোধীতা করে৷ তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসলেও তারা চুক্তিটি বাতিল করেনি; আবার পুরোপুরি বাস্তবায়নের উদ্যোগও নেয়নি। তারপর ২০০৯ সালে পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করে। এতে স্থানীয় বাঙালিরা অসন্তোষ প্রকাশ করে। পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াত জোটও তীব্র বিরোধিতা করে। এখানে কথা হচ্ছে, শান্তিচুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল সরকার সেনা প্রত্যাহার করবে এবং শান্তিবাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র সমর্পণ করে নিরস্ত্র হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। যদিও অস্ত্র সমর্পণ ১৯৯৮ সালে হয়েছিল, তবুও তারা কখনোই পুরোপুরি নিরস্ত্র হয়নি। তারপরও চুক্তি বাস্তবায়নের স্বার্থে ২০০৯ সালে সেনা প্রত্যাহার শুরু হয়। কিন্তু, সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো কি পুরোপুরি নিরস্ত্র হয়েছে? বাস্তবতা হলো উপজাতীয় সশস্ত্র সংগঠনগুলো মোটেও নিরস্ত্র হচ্ছে না। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) সরকার শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করছেনা মর্মে দেশে বিদেশে প্রায়শ সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ করে যাচ্ছেন। অথচ, সন্তু লারমা নিজেই তার বাহিনীকে নিরস্ত্র না করে বিভিন্ন সময়ে একতরফাভাবে সরকারকে দুষেছেন। এদিকে সরকারের তরফ থেকে একটি অভিযোগ জনসংহতি সমিতির কাছে- সরকারের প্রধান শর্ত ছিল শান্তির জন্য অস্ত্র সমর্পণ; এই শর্ত গত ২২ বছরেও তারা সম্পূর্ণরূপে পূরণ করেনি। তা সত্ত্বেও চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের কাজ শেষ হয়েছে। ১৫টি ধারার আংশিক বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ৯টি ধারা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

এদিকে বর্তমানে আর জেএসএসের একতরফা রাজত্বও নেই। ২০০৭ সালে জেএসএস ভেঙে দুইভাগ হয়েছে। একটি অংশ ভেঙে গিয়ে জেএসএস (এমএন লারমা) নামে নতুন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছে। অপরদিকে শান্তিচুক্তির বিরোধিতা থেকে ১৯৯৮ সালে জন্ম নেয়া কট্টর সংগঠন ইউপিডিএফও ২০১৭ সালে বিভক্ত হয়েছে দুইভাগে। এখন এই চারটি আঞ্চলিক সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। তাদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিভিন্ন সময় সংঘাত হচ্ছে। নিহত হচ্ছেন বিভিন্ন পক্ষের সন্ত্রাসীরা। আবার অনেক সময় নিরীহ মানুষদের প্রাণ দিতে হচ্ছে। এভাবেই পাহাড়ে সন্ত্রাস যেন দিনকে দিন চরমে রূপ নিচ্ছে। ১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তির পর থেকে আজ পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ সংঘাতে মারা গেছেন হাজারো পাহাড়ি উপজাতি। আর, বাঙালি হত্যা তো আছেই। ১৯৭৭ সালে সংঘাত শুরুর পর থেকে আজ অবধি হাজার হাজার নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে উপজাতীয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। শান্তিচুক্তির ২২ বছর পেরিয়ে গেলেও শান্তি যেন অধরাই থেকে গেছে সবুজ পাহাড়ে।

এখন প্রশ্ন হলো উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের বলি হয়ে নিজ দেশেই কেন মরবে বাঙালিরা? আর, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই দেশে পছন্দসই ধর্ম গ্রহণের জন্য কেন দিতে হবে প্রাণ? এরকম অসংখ্য প্রশ্ন মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে যুগ যুগ ধরে। সবশেষে বলবো, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হলে আগে অবশ্যই পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো সম্পূর্ণভাবে নিরস্ত্র হয়ে স্বাভাবিক ধারার রাজনীতিতে ফিরে আসতে হবে। আর, সরকারকেও পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুতে আরও সতর্ক হতে হবে এবং যেকোনো উপায়েই হোক সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে নিরস্ত্র করতে হবে। প্রতিটি হত্যাকান্ডের বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিতেও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। নতুবা, সবুজ শ্যামল পাহাড়ে শান্তি অধরাই থেকে যাবে।

লেখক :শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
সদস্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি।

Please Share This Post in Your Social Media


উপজাতি সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম কবে থামবে?

Update Time : ০৪:৪৭:২৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩ জুলাই ২০২১

মিনহাজুল ইসলাম :

পার্বত্য চট্টগ্রাম যেন দেশের ভেতর এক ভিন্ন দেশ। বাঙালির এই দেশে বাঙালিরাই যেন সেখানে ভিনদেশি। স্বাধীন দেশের সবুজ পাহাড় প্রায়শ লাল হয়ে ওঠে বাঙালির রক্তে। ধর্ম পরিবর্তনের অপরাধে প্রাণ হারাতে হয় উপজাতিদেরও। বিচার পাওয়া তো দূরে থাক, বিচার চাওয়াও যেন সেখানে অসাধ্য। তাহলে প্রশাসন কি সেখানকার সন্ত্রাসীদের লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ? আরও প্রশ্ন হলো এত ভারী অস্ত্র, উন্নত প্রশিক্ষণ কোথা থেকে পায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা?

সম্প্রতি এসব প্রশ্ন নতুন করে জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে বান্দরবানে ওমর ফারুক ত্রিপুরাকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করার পর। ইসলাম ধর্মগ্রহণ ও প্রচার করার অপরাধে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো ওমর ফারুক ত্রিপুরাকে। এমন ঘটনা কিন্তু নতুন নয়। এই বান্দরবানেই বছর তিনেক আগে স্বপরিবারে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার অপরাধে চাকমা দম্পতিকে হত্যা করা হয় এবং তাদের তিন সন্তানকে ভিটেমাটি ছাড়া করা হয়।

শুধু ধর্মীয় বিষয় নিয়ে হত্যার ঘটনা কিছুটা নতুন হলেও, সেখানকার আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস ও বাঙালি হত্যার বিষয়গুলো অনেক পুরনো। এখানে একটা জিনিস উল্লেখ্য, আমাদের অভিযোগ শুধুমাত্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। সাধারণ উপজাতিদের বিরুদ্ধে নয়। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণে গেলে দেখি অনেক উপজাতি বন্ধুরা খুব অতিথিপরায়ণ আচরণ করে। যা সত্যি আমাদের মুগ্ধ করে। তবে, যেসব সন্ত্রাসী সংগঠন এসব নিরীহ মানুষদের সন্ত্রাসীপনা শেখাচ্ছে, অভিযোগটা কেবল তাদের দিকেই।

পাহাড়ে সন্ত্রাসের নমুনা দেখতে একটু পেছন ফিরে তাকানো যাক। ১৯৭২ সালে পাহাড়িদের অধিকার আদায়ের জন্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। এরপর সশস্ত্র সংগ্রামের উদ্দেশ্যে জেএসএসের সামরিক শাখা শান্তিবাহিনী যাত্রা শুরু করে। তারপর সেখানে সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ বাহিনীর সাথে শুরু হয় সংঘাত। এসময় হত্যা করা অনেক নিরীহ বাঙালিদেরও। এদিকে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে পাহাড়ে ভূমিহীন বাঙালিদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে চার লক্ষ বাঙালিকে পুনর্বাসিত করা হয়। এতে চরমভাবে ক্ষুদ্ধ হয় পাহাড়িরা। ভূমি বিরোধ নিয়ে নব উদ্যোমে শুরু হয় সংঘাত।

দীর্ঘ সংঘাত শেষে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৭ সালের ২ রা ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি। এদিকে জেএসএসের শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করে ১৯৯৮ সালে প্রসীত বিকাশ খীসা, সঞ্চয় চাকমার নেতৃত্বে নতুন উপজাতীয় সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) জন্ম হয়। সংগঠনটি অভিযোগ করে এই চুক্তিতে স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি এবং সেনাপ্রত্যাহার সহ অন্যান্য শর্ত পূরণের সুনির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করা হয়নি। তবুও ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি শান্তিবাহিনীর প্রায় দুই হাজার গেরিলা অস্ত্র সমর্পণ করে। এখানে উল্লেখ্য, অস্ত্র সমর্পণ করলেও সংগঠনটি কখনোই সম্পূর্ণ নিরস্ত্র হয়নি। এদিকে জেএসএসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি এবার শুরু হয় ইউপিডিএফের সন্ত্রাসীপনা। নিজেদের ভেতর অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে শুরু হয় সংঘাত। পাহাড়ি মাটি হয়ে ওঠে রক্তলাল।

তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি নানা যুক্তি দেখি তখন থেকেই চুক্তির বিরোধীতা করে৷ তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসলেও তারা চুক্তিটি বাতিল করেনি; আবার পুরোপুরি বাস্তবায়নের উদ্যোগও নেয়নি। তারপর ২০০৯ সালে পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করে। এতে স্থানীয় বাঙালিরা অসন্তোষ প্রকাশ করে। পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াত জোটও তীব্র বিরোধিতা করে। এখানে কথা হচ্ছে, শান্তিচুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল সরকার সেনা প্রত্যাহার করবে এবং শান্তিবাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র সমর্পণ করে নিরস্ত্র হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। যদিও অস্ত্র সমর্পণ ১৯৯৮ সালে হয়েছিল, তবুও তারা কখনোই পুরোপুরি নিরস্ত্র হয়নি। তারপরও চুক্তি বাস্তবায়নের স্বার্থে ২০০৯ সালে সেনা প্রত্যাহার শুরু হয়। কিন্তু, সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো কি পুরোপুরি নিরস্ত্র হয়েছে? বাস্তবতা হলো উপজাতীয় সশস্ত্র সংগঠনগুলো মোটেও নিরস্ত্র হচ্ছে না। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) সরকার শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করছেনা মর্মে দেশে বিদেশে প্রায়শ সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ করে যাচ্ছেন। অথচ, সন্তু লারমা নিজেই তার বাহিনীকে নিরস্ত্র না করে বিভিন্ন সময়ে একতরফাভাবে সরকারকে দুষেছেন। এদিকে সরকারের তরফ থেকে একটি অভিযোগ জনসংহতি সমিতির কাছে- সরকারের প্রধান শর্ত ছিল শান্তির জন্য অস্ত্র সমর্পণ; এই শর্ত গত ২২ বছরেও তারা সম্পূর্ণরূপে পূরণ করেনি। তা সত্ত্বেও চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের কাজ শেষ হয়েছে। ১৫টি ধারার আংশিক বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ৯টি ধারা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

এদিকে বর্তমানে আর জেএসএসের একতরফা রাজত্বও নেই। ২০০৭ সালে জেএসএস ভেঙে দুইভাগ হয়েছে। একটি অংশ ভেঙে গিয়ে জেএসএস (এমএন লারমা) নামে নতুন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছে। অপরদিকে শান্তিচুক্তির বিরোধিতা থেকে ১৯৯৮ সালে জন্ম নেয়া কট্টর সংগঠন ইউপিডিএফও ২০১৭ সালে বিভক্ত হয়েছে দুইভাগে। এখন এই চারটি আঞ্চলিক সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। তাদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিভিন্ন সময় সংঘাত হচ্ছে। নিহত হচ্ছেন বিভিন্ন পক্ষের সন্ত্রাসীরা। আবার অনেক সময় নিরীহ মানুষদের প্রাণ দিতে হচ্ছে। এভাবেই পাহাড়ে সন্ত্রাস যেন দিনকে দিন চরমে রূপ নিচ্ছে। ১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তির পর থেকে আজ পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ সংঘাতে মারা গেছেন হাজারো পাহাড়ি উপজাতি। আর, বাঙালি হত্যা তো আছেই। ১৯৭৭ সালে সংঘাত শুরুর পর থেকে আজ অবধি হাজার হাজার নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে উপজাতীয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। শান্তিচুক্তির ২২ বছর পেরিয়ে গেলেও শান্তি যেন অধরাই থেকে গেছে সবুজ পাহাড়ে।

এখন প্রশ্ন হলো উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের বলি হয়ে নিজ দেশেই কেন মরবে বাঙালিরা? আর, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই দেশে পছন্দসই ধর্ম গ্রহণের জন্য কেন দিতে হবে প্রাণ? এরকম অসংখ্য প্রশ্ন মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে যুগ যুগ ধরে। সবশেষে বলবো, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হলে আগে অবশ্যই পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো সম্পূর্ণভাবে নিরস্ত্র হয়ে স্বাভাবিক ধারার রাজনীতিতে ফিরে আসতে হবে। আর, সরকারকেও পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুতে আরও সতর্ক হতে হবে এবং যেকোনো উপায়েই হোক সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে নিরস্ত্র করতে হবে। প্রতিটি হত্যাকান্ডের বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিতেও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। নতুবা, সবুজ শ্যামল পাহাড়ে শান্তি অধরাই থেকে যাবে।

লেখক :শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
সদস্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি।