বাংলার যৌবন শক্তির প্রতীক

  • Update Time : ০১:৫৫:৪১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুন ২০২১
  • / 200

জাফর ওয়াজেদ:

শেখ মুজিব, বাঙালী ও বাংলাদেশ একীভূত নাম। পরষ্পর পরষ্পরের পরিপূরক। পশ্চাদপদ একটি জাতির উত্থানের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এক সাহসী বাঙালী মানবের নাম। যাঁর অঙ্গুলি হেলনে গোটা দেশ পরিচালিত হতো, যাঁর ডাকে সাড়ে সাত কোটি মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্তের বিনিময়ে অনেক দাম দিয়ে এনেছে স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড বাংলাদেশ।

শাসন, শোষণ, নিপীড়ন, নিষ্পেষণে পর্যদুস্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তির মন্ত্র তুলে দিয়েছিলেন। আর এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধা জাতির মুক্তিত্রাতা হতে জাতির পিতা। আজ বাংলাদেশ বলে যে ভূখণ্ডে বসবাস ১৬ কোটি বাঙালীর, সেই ভূখণ্ডটিকে পাকিস্তানীদের হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংগ্রাম, লড়াই এবং যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। বাঙালী অন্তঃপ্রাণ এক মানব ছিলেন তিনি।

ব্রিটিশ ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নিলেও চিন্তা-চেতনায়, পাঠাভ্যাসে ছিলেন প্রাগ্রসর। বাড়িতে আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত পত্রিকা নিয়মিত আসত। তিনি গোগ্রাসে তা পাঠ করতেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত পাঠাভ্যাসে ছিলেন মগ্ন। বাল্যকালে মিশনারী স্কুলে পড়াশোনার কারণে ইংরেজী ভিত গড়ে ওঠে বাংলার পাশাপাশি। উর্দু, হিন্দিও জানা ছিল তাঁর। দীর্ঘদেহী মানবটির রাজনৈতিক জীবনও দীর্ঘ। স্কুলজীবনেই রাজনীতিতে হাতে খড়ি। বাঙালী শীর্ষ নেতাদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ তখনই হয়। আর তা তাঁর জীবনধারাকে বদলে দেয়। নেতৃত্বের শীর্ষদেশে পৌঁছার আগে তিনি ছিলেন সাধারণ স্বেচ্ছাসেবক আর নিরলস কর্মী। আবার তাঁর মতো দীর্ঘদিন কারান্তরালে কাটিয়েছেন এমন নেতা নেই।

যৌবনের একটা সময় তিনি জেল থেকে জেলে কাটিয়েছেন। সত্য-মিথ্যা, নানারকম কত মামলায় যে তাঁকে জড়ানো হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু কোনভাবেই শাসক চক্র তাঁকে কাবু করতে পারেনি। সামরিক জান্তাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নিজস্ব সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল। কখনই তিনি আরাম আয়েশের রাজনীতি করেননি। নির্যাতন ভোগের পথ ধরেই তাঁর জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ। কারান্তরালে তিনি যেমন ভেঙ্গে পড়েননি, তেমনি মচকেও যাননি। পাকিস্তানীরা তাঁর জন্য জেলের পাশে কবরও খুঁড়েছিল। কিন্তু তাতেও তিনি বিচলিত হননি। মৃত্যুভয়কে সারাজীবন তুচ্ছ করেছেন।

শেখ মুজিবের জীবনধারার দিকে তাকালে স্পষ্ট হয় তিনি মূলত বাংলার যৌবন শক্তির প্রতীক। ১৯২০ সালে জন্মের পর অসুখে ভুগলেও মনোবল হারাননি। বাল্যকাল থেকে সাহসী যেমন, তেমনি পরোপকারীও ছিলেন। এই দু’য়ের সমন্বয়ে তিনি হয়ে ওঠেন গণমানুষের একচ্ছত্র নেতা। বুঝতেন তিনি জনগণের ভাষা। তাদের চাওয়া পাওয়া, আশা-আকাক্সক্ষা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে। নিজ জন্মভূমির মানুষকে অর্ধাহারে, অনাহারে দরিদ্র জীবনের ঘানি টেনে কঠিন কষ্টকরভাবে দিনাতিপাত করতে দেখেছেন। মানুষের মুক্তি ও কল্যাণেÑমঙ্গলে তাই জড়িয়ে পড়েন সমাজসেবা থেকে রাজনীতিতে। দীর্ঘকাল ধরে শ্রম আর সংগ্রামের পথে তিনি বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। বাঙালী প্রথমবারের মতো নির্ভর করতে পারা নেতৃত্ব পেয়েছিল।

যে নেতা তাদের প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ। শেখ মুজিব ব্রিটিশদের নিপীড়ন দেখেছেন, দেশভাগের করুণ ঘটনারও প্রত্যক্ষদর্শী, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে পূর্ববঙ্গকে নয়া উপনিবেশ হিসেবে দেখে তিনি সেই যৌবনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালেই আন্দোলন শুরু করেন।

আন্দোলনের চাপে কর্তৃপক্ষ নতি স্বীকার করলেও তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্র আটক রাখে এবং বহিষ্কার করে। কিন্তু তিনি থেমে থাকার জন ছিলেন না। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ১৯৪৮ সালেই তিনি প্রথম গ্রেফতার হন। জান্তা শাসক বুঝতে পেরেছিল তখনই শেখ মুজিব তাদের জন্য বিপজ্জনক। তাই পদে পদে তাঁকে হয়রানি করা, রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা, মিথ্যা মামলা অব্যাহত রাখা ইত্যাদি নানাভাবে নিপীড়ন, নির্যাতন চালিয়েছিল। এ সবকিছু সয়ে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তাঁর দুঃসাহস আর নিজের আদর্শে নিষ্ঠা তাঁকে করে তুলেছিল জনগণের একান্ত আস্থাভাজন। ছাত্র আর তরুণ সমাজের কাছে তিনি হয়ে উঠেন মহানায়ক। তাঁর নামে লাখ লাখ তরুণ জীবন উৎসর্গ করেছে। বাংলার ঘরে ঘরে একটি নামই জ্বল জ্বল করে জ্বলত, প্রতিধ্বনিত হতো, তিনিই শেখ মুজিব। বাঙালীর জীবনে সবচেয়ে বেশী উচ্চারিত রাজনীতিকের ও মানব মুক্তির নায়কের নাম শেখ মুজিব। অসাধারণ সাংগঠনিক শক্তির সঙ্গে সম্মোহনী শক্তি সমন্বিত হওয়ার কারণে বাঙালী মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর নির্দেশ মেনে চলেছে। অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টকে সহ্য করেছে। মা-বোনেরা তাঁর জন্য প্রার্থনা করতেন। আওয়ামী লীগ নামক সংগঠনটিকে তিনি তিলে তিলে গড়েছেন এবং তাঁকে সর্বপ্রধান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে তুলেছিলেন। তিনি নিজেই তাঁর সংগঠনের প্রধান স্থপতি।

মানুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশেছেন। একবার পরিচয় হলে বহু বছর পরও নামঠিকুজিসহ চিনতে পারতেন। অসম্ভব স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন। বাঙালী সম্পর্কে যৌবনকালে তাঁর উপলব্ধি হয়েছিল এমনটাই, “আমাদের বাঙালীর মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো ‘আমরা মুসলমান’, আর একটা হলো, ‘আমরা বাঙালী’।” পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে নাÑ ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে; কিন্তু বাঙালীদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালী জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ার খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)।

শেখ মুজিব যৌবনে এই দেশ, জাতি, কৃষিভূমির অবস্থাটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আর জাতিকে করুণ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে মুক্তির পথে নিয়ে আসার অদম্য আগ্রহ তাঁকে ক্রমান্বয়ে জাতির প্রধান নেতৃত্বের আসনটি দিয়েছে। পরশ্রীকাতর জাতিকে তিনি যুদ্ধজয়ী জাতিকে পরিণত করে রবীন্দ্রনাথের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘কবি গুরু, তোমার বাণী ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী/রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ করনি। দেখে যাও, কবিগুরু, তোমার বাঙালী আজ মানুষ হয়েছে।’ অর্থাৎ একটি স্বাধীন দেশ স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শক্তি ও সাহস পেয়েছে। পরাধীনতার শেকল ভেঙ্গে লাল সূর্যটাকে ছিনিয়ে এনেছে। বাঙালী নামক জাতিটি এবং তার ভাষা, ভঙ্গিমা শেখ মুজিব আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। মানুষের প্রতি ছিল নেতার অগাধ বিশ্বাস। ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’ তিনিও মনে করতেন। কিন্তু বাঙালী যে পরশ্রীকাতরের পাশাপাশি বিশ্বাসঘাতক, তা তিনি জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন। জান্তা শাসকরা হাজারো চেষ্টা করে যার মৃত্যুদ- কার্যকর করার সাহস পায়নি, সেই তিনি সপরিবারে নিহত হলেন নিজ দেশের, নিজভাষী, নিজের বাহিনীর বিপথগামীদের হাতে। আর জাতিকে সেই হত্যার পাপ আজও বহন করতে হয়। তাঁকে হত্যার পর দেশ আবার পাকিস্তানী ধারায় ফিরে যায়। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিরা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

১৯৪১ সালে শেখ মুজিব ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে কলকাতা যান। সেখানে সভা-সমাবেশে যোগ দিতেন। কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা আর ব্যক্তিত্বের সম্মোহনী শক্তি আর সে সঙ্গে তাঁর ত্যাগ আদর্শনিষ্ঠা আর অপরিসীম নির্যাতন ভোগ সব মিলে তাঁকে করে তোলে জনগণের একচ্ছত্র নেতায়। অসাধারণ জনপ্রিয়তা তাঁর সমকালের আর কোন নেতার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সারাদেশে জাদুমন্ত্রের মতো উচ্চারিত হতো তাঁর নাম।

তরুণ শেখ মুজিব তাঁর রাজনীতিক দীক্ষা পেয়েছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে সেই স্কুলজীবন হতে। তারপর ঘনিষ্ঠতা বেড়ে ওঠায় হয়ে ওঠেন একান্তজন। তরুণ বয়সে শেখ মুজিব উপলব্ধি করেছিলেন, ‘আমি অনেকের মধ্যে একটা জিনিস দেখেছি, কোন কাজ করতে গেলে শুধুই চিন্তা করে। চিন্তা করতে করতে সময় পার হয়ে যায়, কাজ আর হয়ে ওঠে না।

অনেক সময় করব কি করব না, এভাবে সময় নষ্ট করে এবং জীবনে কোন কাজই করতে পারে না। আমি চিন্তা-ভাবনা করে যে কাজটা করব ঠিক করি, তা করেই ফেলি। যদি ভুল হয়, সংশোধন করে নেই। কারণ, যারা কাজ করে তাদেরই ভুল হতে পারে। যারা কাজ করে না তাদের ভুলও হয় না।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)শেখ মুজিব তরুণ বয়সেই ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ গঠনে জড়িয়ে পড়েন। মুজিব তরুণ বয়সেই প্রাদেশিক মন্ত্রী পরিষদে মন্ত্রী ছিলেন। তবে সংগঠনে কাজ করার জন্য পদত্যাগও করেছিলেন। শেখ মুজিব ছিলেন বাঙালী মনে অনেক সূর্যের আশা।

শেখ মুজিবের বিশেষ অবদান তিনি বাঙালীকে আত্মসচেতন করে তুলেছেন, বাঙালী জাতিকে দিয়েছেন ভাষা। বাঙালীর অভাব অভিযোগ দাবি-দাওয়া আর আশা-আকাক্সক্ষাকে বাংলার নগরে-বন্দরে, শহরে-গ্রামে, ধনীর প্রাসাদ থেকে গরিবের পর্ণকুঠির পর্যন্ত সর্বত্র পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। তাঁর ‘জয়বাংলা’ স্লোগান বাংলা ও বাঙালীর আত্মসন্ধান আর আত্ম আবিষ্কারেরই যেন এক অমোঘযন্ত্র।

তরুণ শেখ মুজিব ইতিহাসের এক বিশাল অধ্যায় সৃষ্টি করেছেন। তিনি বাঙালীর মনে আর ইতিহাসে অমর হয়ে থাকছেন বাঙালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। আজ আমরা যে নিজেদের বাঙালী বলে পরিচয় দিতে পারছি, তাও শেখ মুজিবেরই অবদান। শেখ মুজিব বাংলাদেশের আত্মশক্তিরই প্রতীক।

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক পিআইবি।

Please Share This Post in Your Social Media


বাংলার যৌবন শক্তির প্রতীক

Update Time : ০১:৫৫:৪১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৩ জুন ২০২১

জাফর ওয়াজেদ:

শেখ মুজিব, বাঙালী ও বাংলাদেশ একীভূত নাম। পরষ্পর পরষ্পরের পরিপূরক। পশ্চাদপদ একটি জাতির উত্থানের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এক সাহসী বাঙালী মানবের নাম। যাঁর অঙ্গুলি হেলনে গোটা দেশ পরিচালিত হতো, যাঁর ডাকে সাড়ে সাত কোটি মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্তের বিনিময়ে অনেক দাম দিয়ে এনেছে স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড বাংলাদেশ।

শাসন, শোষণ, নিপীড়ন, নিষ্পেষণে পর্যদুস্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তির মন্ত্র তুলে দিয়েছিলেন। আর এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধা জাতির মুক্তিত্রাতা হতে জাতির পিতা। আজ বাংলাদেশ বলে যে ভূখণ্ডে বসবাস ১৬ কোটি বাঙালীর, সেই ভূখণ্ডটিকে পাকিস্তানীদের হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংগ্রাম, লড়াই এবং যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। বাঙালী অন্তঃপ্রাণ এক মানব ছিলেন তিনি।

ব্রিটিশ ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নিলেও চিন্তা-চেতনায়, পাঠাভ্যাসে ছিলেন প্রাগ্রসর। বাড়িতে আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত পত্রিকা নিয়মিত আসত। তিনি গোগ্রাসে তা পাঠ করতেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত পাঠাভ্যাসে ছিলেন মগ্ন। বাল্যকালে মিশনারী স্কুলে পড়াশোনার কারণে ইংরেজী ভিত গড়ে ওঠে বাংলার পাশাপাশি। উর্দু, হিন্দিও জানা ছিল তাঁর। দীর্ঘদেহী মানবটির রাজনৈতিক জীবনও দীর্ঘ। স্কুলজীবনেই রাজনীতিতে হাতে খড়ি। বাঙালী শীর্ষ নেতাদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ তখনই হয়। আর তা তাঁর জীবনধারাকে বদলে দেয়। নেতৃত্বের শীর্ষদেশে পৌঁছার আগে তিনি ছিলেন সাধারণ স্বেচ্ছাসেবক আর নিরলস কর্মী। আবার তাঁর মতো দীর্ঘদিন কারান্তরালে কাটিয়েছেন এমন নেতা নেই।

যৌবনের একটা সময় তিনি জেল থেকে জেলে কাটিয়েছেন। সত্য-মিথ্যা, নানারকম কত মামলায় যে তাঁকে জড়ানো হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু কোনভাবেই শাসক চক্র তাঁকে কাবু করতে পারেনি। সামরিক জান্তাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নিজস্ব সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল। কখনই তিনি আরাম আয়েশের রাজনীতি করেননি। নির্যাতন ভোগের পথ ধরেই তাঁর জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ। কারান্তরালে তিনি যেমন ভেঙ্গে পড়েননি, তেমনি মচকেও যাননি। পাকিস্তানীরা তাঁর জন্য জেলের পাশে কবরও খুঁড়েছিল। কিন্তু তাতেও তিনি বিচলিত হননি। মৃত্যুভয়কে সারাজীবন তুচ্ছ করেছেন।

শেখ মুজিবের জীবনধারার দিকে তাকালে স্পষ্ট হয় তিনি মূলত বাংলার যৌবন শক্তির প্রতীক। ১৯২০ সালে জন্মের পর অসুখে ভুগলেও মনোবল হারাননি। বাল্যকাল থেকে সাহসী যেমন, তেমনি পরোপকারীও ছিলেন। এই দু’য়ের সমন্বয়ে তিনি হয়ে ওঠেন গণমানুষের একচ্ছত্র নেতা। বুঝতেন তিনি জনগণের ভাষা। তাদের চাওয়া পাওয়া, আশা-আকাক্সক্ষা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে। নিজ জন্মভূমির মানুষকে অর্ধাহারে, অনাহারে দরিদ্র জীবনের ঘানি টেনে কঠিন কষ্টকরভাবে দিনাতিপাত করতে দেখেছেন। মানুষের মুক্তি ও কল্যাণেÑমঙ্গলে তাই জড়িয়ে পড়েন সমাজসেবা থেকে রাজনীতিতে। দীর্ঘকাল ধরে শ্রম আর সংগ্রামের পথে তিনি বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। বাঙালী প্রথমবারের মতো নির্ভর করতে পারা নেতৃত্ব পেয়েছিল।

যে নেতা তাদের প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ। শেখ মুজিব ব্রিটিশদের নিপীড়ন দেখেছেন, দেশভাগের করুণ ঘটনারও প্রত্যক্ষদর্শী, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে পূর্ববঙ্গকে নয়া উপনিবেশ হিসেবে দেখে তিনি সেই যৌবনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালেই আন্দোলন শুরু করেন।

আন্দোলনের চাপে কর্তৃপক্ষ নতি স্বীকার করলেও তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্র আটক রাখে এবং বহিষ্কার করে। কিন্তু তিনি থেমে থাকার জন ছিলেন না। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ১৯৪৮ সালেই তিনি প্রথম গ্রেফতার হন। জান্তা শাসক বুঝতে পেরেছিল তখনই শেখ মুজিব তাদের জন্য বিপজ্জনক। তাই পদে পদে তাঁকে হয়রানি করা, রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা, মিথ্যা মামলা অব্যাহত রাখা ইত্যাদি নানাভাবে নিপীড়ন, নির্যাতন চালিয়েছিল। এ সবকিছু সয়ে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তাঁর দুঃসাহস আর নিজের আদর্শে নিষ্ঠা তাঁকে করে তুলেছিল জনগণের একান্ত আস্থাভাজন। ছাত্র আর তরুণ সমাজের কাছে তিনি হয়ে উঠেন মহানায়ক। তাঁর নামে লাখ লাখ তরুণ জীবন উৎসর্গ করেছে। বাংলার ঘরে ঘরে একটি নামই জ্বল জ্বল করে জ্বলত, প্রতিধ্বনিত হতো, তিনিই শেখ মুজিব। বাঙালীর জীবনে সবচেয়ে বেশী উচ্চারিত রাজনীতিকের ও মানব মুক্তির নায়কের নাম শেখ মুজিব। অসাধারণ সাংগঠনিক শক্তির সঙ্গে সম্মোহনী শক্তি সমন্বিত হওয়ার কারণে বাঙালী মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর নির্দেশ মেনে চলেছে। অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টকে সহ্য করেছে। মা-বোনেরা তাঁর জন্য প্রার্থনা করতেন। আওয়ামী লীগ নামক সংগঠনটিকে তিনি তিলে তিলে গড়েছেন এবং তাঁকে সর্বপ্রধান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে তুলেছিলেন। তিনি নিজেই তাঁর সংগঠনের প্রধান স্থপতি।

মানুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশেছেন। একবার পরিচয় হলে বহু বছর পরও নামঠিকুজিসহ চিনতে পারতেন। অসম্ভব স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন। বাঙালী সম্পর্কে যৌবনকালে তাঁর উপলব্ধি হয়েছিল এমনটাই, “আমাদের বাঙালীর মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো ‘আমরা মুসলমান’, আর একটা হলো, ‘আমরা বাঙালী’।” পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে নাÑ ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে; কিন্তু বাঙালীদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালী জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ার খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)।

শেখ মুজিব যৌবনে এই দেশ, জাতি, কৃষিভূমির অবস্থাটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আর জাতিকে করুণ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে মুক্তির পথে নিয়ে আসার অদম্য আগ্রহ তাঁকে ক্রমান্বয়ে জাতির প্রধান নেতৃত্বের আসনটি দিয়েছে। পরশ্রীকাতর জাতিকে তিনি যুদ্ধজয়ী জাতিকে পরিণত করে রবীন্দ্রনাথের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘কবি গুরু, তোমার বাণী ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী/রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ করনি। দেখে যাও, কবিগুরু, তোমার বাঙালী আজ মানুষ হয়েছে।’ অর্থাৎ একটি স্বাধীন দেশ স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শক্তি ও সাহস পেয়েছে। পরাধীনতার শেকল ভেঙ্গে লাল সূর্যটাকে ছিনিয়ে এনেছে। বাঙালী নামক জাতিটি এবং তার ভাষা, ভঙ্গিমা শেখ মুজিব আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। মানুষের প্রতি ছিল নেতার অগাধ বিশ্বাস। ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’ তিনিও মনে করতেন। কিন্তু বাঙালী যে পরশ্রীকাতরের পাশাপাশি বিশ্বাসঘাতক, তা তিনি জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন। জান্তা শাসকরা হাজারো চেষ্টা করে যার মৃত্যুদ- কার্যকর করার সাহস পায়নি, সেই তিনি সপরিবারে নিহত হলেন নিজ দেশের, নিজভাষী, নিজের বাহিনীর বিপথগামীদের হাতে। আর জাতিকে সেই হত্যার পাপ আজও বহন করতে হয়। তাঁকে হত্যার পর দেশ আবার পাকিস্তানী ধারায় ফিরে যায়। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিরা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

১৯৪১ সালে শেখ মুজিব ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে কলকাতা যান। সেখানে সভা-সমাবেশে যোগ দিতেন। কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা আর ব্যক্তিত্বের সম্মোহনী শক্তি আর সে সঙ্গে তাঁর ত্যাগ আদর্শনিষ্ঠা আর অপরিসীম নির্যাতন ভোগ সব মিলে তাঁকে করে তোলে জনগণের একচ্ছত্র নেতায়। অসাধারণ জনপ্রিয়তা তাঁর সমকালের আর কোন নেতার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সারাদেশে জাদুমন্ত্রের মতো উচ্চারিত হতো তাঁর নাম।

তরুণ শেখ মুজিব তাঁর রাজনীতিক দীক্ষা পেয়েছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে সেই স্কুলজীবন হতে। তারপর ঘনিষ্ঠতা বেড়ে ওঠায় হয়ে ওঠেন একান্তজন। তরুণ বয়সে শেখ মুজিব উপলব্ধি করেছিলেন, ‘আমি অনেকের মধ্যে একটা জিনিস দেখেছি, কোন কাজ করতে গেলে শুধুই চিন্তা করে। চিন্তা করতে করতে সময় পার হয়ে যায়, কাজ আর হয়ে ওঠে না।

অনেক সময় করব কি করব না, এভাবে সময় নষ্ট করে এবং জীবনে কোন কাজই করতে পারে না। আমি চিন্তা-ভাবনা করে যে কাজটা করব ঠিক করি, তা করেই ফেলি। যদি ভুল হয়, সংশোধন করে নেই। কারণ, যারা কাজ করে তাদেরই ভুল হতে পারে। যারা কাজ করে না তাদের ভুলও হয় না।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)শেখ মুজিব তরুণ বয়সেই ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ গঠনে জড়িয়ে পড়েন। মুজিব তরুণ বয়সেই প্রাদেশিক মন্ত্রী পরিষদে মন্ত্রী ছিলেন। তবে সংগঠনে কাজ করার জন্য পদত্যাগও করেছিলেন। শেখ মুজিব ছিলেন বাঙালী মনে অনেক সূর্যের আশা।

শেখ মুজিবের বিশেষ অবদান তিনি বাঙালীকে আত্মসচেতন করে তুলেছেন, বাঙালী জাতিকে দিয়েছেন ভাষা। বাঙালীর অভাব অভিযোগ দাবি-দাওয়া আর আশা-আকাক্সক্ষাকে বাংলার নগরে-বন্দরে, শহরে-গ্রামে, ধনীর প্রাসাদ থেকে গরিবের পর্ণকুঠির পর্যন্ত সর্বত্র পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। তাঁর ‘জয়বাংলা’ স্লোগান বাংলা ও বাঙালীর আত্মসন্ধান আর আত্ম আবিষ্কারেরই যেন এক অমোঘযন্ত্র।

তরুণ শেখ মুজিব ইতিহাসের এক বিশাল অধ্যায় সৃষ্টি করেছেন। তিনি বাঙালীর মনে আর ইতিহাসে অমর হয়ে থাকছেন বাঙালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। আজ আমরা যে নিজেদের বাঙালী বলে পরিচয় দিতে পারছি, তাও শেখ মুজিবেরই অবদান। শেখ মুজিব বাংলাদেশের আত্মশক্তিরই প্রতীক।

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক পিআইবি।