সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম জামিন পেয়েছেন। এ খবরে সারা দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের মানুষ, পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষই স্বস্তিবোধ করবেন। ১৭ মে ২০২১ সকালে তিনি তাঁর বাড়ি থেকে বের হয়ে ভ্যাকসিন নেওয়ার পর সচিবালয়ে গিয়েছিলেন পেশাগত কাজে, আজ ২৩ মে তিনি তাঁর ৮ বছরের কন্যা আলভিনাকে কোলে নিতে পারবেন বলে আমরা আশা করছি।
প্রথম আলো সব সময়ই বলে আসছে, আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাস করি, আদালতের সুবিবেচনার ওপরে আমাদের আস্থা আছে। প্রথম আলোর নামে মামলা কম হয়নি, কিন্তু প্রতিবার আদালতের রায়েই প্রথম আলো সুবিচার পেয়েছে। ভবিষ্যতে আদালতের কাছ থেকে সুবিচার, ন্যায়বিচার, প্রতিকার, প্রতিবিধান পাওয়ার ব্যাপারে প্রথম আলোর আস্থা অবিচল ও অটুট আছে।
তবে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা এবং এর আগে-পরে যা কিছু হয়েছে, দেশে-বিদেশে তার প্রতিক্রিয়া হয়েছে মারাত্মক। সচিবালয়ে একজন সাংবাদিককে আটকে রাখা হয়েছে, এই খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে সচিবালয়ে কর্মরত সাংবাদিকেরা ছুটে গেছেন। তাঁরা প্রতিবাদ করেছেন। সাংবাদিক নেতারা তৎপর হয়েছেন। রোজিনা ইসলামকে শাহবাগ থানায় নেওয়া হলে সাংবাদিকেরা থানার সামনে অবস্থান নিয়েছেন। সারা রাত প্রতিবাদ করেছেন, বিক্ষোভ করেছেন।
তাঁরা স্লোগান ধরেছেন—দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে নয়। জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, ডিইউজে, বিএফইউজে, সারা দেশের সাংবাদিকদের সব কটি সংগঠন ও ফোরাম, সব প্রেসক্লাব, সব মানবাধিকার সংগঠন, রাজনৈতিক সংগঠন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ গুরুত্বপূর্ণ সব সাংস্কৃতিক সংগঠন, বহু রাজনৈতিক সংগঠন ও নেতা, পেশাজীবী সংগঠন, শিক্ষক সমিতি, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, টেলিভিশনে কর্মরত সাংবাদিকেরা, অনলাইন মাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকেরা, এডিটরস গিল্ড, নোয়াব, সম্পাদক পরিষদ, প্রতিষ্ঠান হিসেবে সব টেলিভিশন, সংবাদপত্র, নিউজ পোর্টাল, জাতিসংঘ, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার, মানবাধিকার কমিশন, আইনজীবীরা, সাবেক বিচারপতিরা, তথ্য অধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণ নাগরিকেরা—সবার কথা এত স্বল্প পরিসরে বলাও হয়তো গেল না—রোজিনা ইসলামের মুক্তি চেয়েছেন, মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করেছেন, মানববন্ধন করেছেন, অনশন করেছেন, লিখেছেন, বিবৃতি দিয়েছেন, কথা বলেছেন, সভা–সমাবেশ করেছেন, প্রার্থনা করেছেন, সরব হয়েছেন, সক্রিয় হয়েছেন। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সংবিধান সংবাদপত্রের স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা দিয়েছে, সেই অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সাংবাদিকেরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, দেশবাসী একাত্ম হয়েছে।
রোজিনা ইসলামের মুক্তি দাবি করে এবং তাঁর ওপর সংঘটিত অন্যায়ের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছেন যাঁরা, তাঁরা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা ও সাহসের অনন্ত উৎস হয়ে রইলেন। আমরা আশ্বস্ত হলাম, মানুষ মুক্ত সাংবাদিকতার পক্ষে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পক্ষে। সাংবাদিকেরা একা নন, নিঃসঙ্গ নন, সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্য আছে, নিজ পেশার সম্মান রক্ষার বিষয়ে অঙ্গীকার আছে। দেশবাসী ও বিশ্ববিবেক সৎ সাহসী সাংবাদিকতার পক্ষে আছে। কাজেই শুধু প্রথম আলো নয়, শুধু রোজিনা ইসলাম নয়, বাংলাদেশের একটা উপজেলা পর্যায়ের একজন সাংবাদিকও বিপদ হতে পারে জেনেও আত্মসম্মানবোধ নিয়ে পেশাদারি কাজ সততা, নিষ্ঠার সঙ্গে করার সাহস ও প্রেরণা এখন লাভ করতে পারবেন।
রোজিনা ইসলামের জামিন হয়েছে। এ মুহূর্তে আমরা সবাইকে তাই ধন্যবাদ জানাই। অভিনন্দন জানাই। আইনি পথ আরও দীর্ঘ। পেশাগত নিরাপত্তা, সংবিধানপ্রদত্ত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য আরও বহু পথ অতিক্রম করতে হবে, বহু সংগ্রাম করে যেতে হবে, আরও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কাজেই সাংবাদিক ও নাগরিকদের এই ঐক্য ও সংহতি ধরে রাখতে হবে।আদালতে আজ পাবলিক প্রসিকিউটর পাসপোর্ট জমা সাপেক্ষে জামিন দেওয়ার ব্যাপারে অনাপত্তি জানিয়েছেন। এই ব্যাপারটা লক্ষ করার মতো। আমরা মনে করি, এর মাধ্যমে একটা শুভবুদ্ধি ও সদিচ্ছার বার্তা দেওয়া হয়েছে।
আদেশে আদালত বলেছেন, ‘গণমাধ্যম গণতন্ত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ। গণমাধ্যমের কারণেই কিন্তু অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল আচরণ করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সুতরাং কোর্ট এবং গণমাধ্যম কখনোই একটি আরেকটির জন্য বাধা হিসেবে কাজ করে না। কোর্ট সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।’
আদালতের এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ একমত পোষণ করি। আমাদের সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রোজিনা যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন, তার প্রতিকারে ও প্রতিবিধানে আইনগত লড়াইয়ে প্রথম আলো রোজিনার পাশে থাকবে।পাশাপাশি, একজন নাগরিক হিসেবে দাবি করব, রোজিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা নিঃশর্তভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়া হোক। ১৭ মে সচিবালয়ের ভেতরে রোজিনাকে শারীরিক মানসিকভাবে যেভাবে হেনস্তা করা হয়েছে, তার নিরপেক্ষ তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টসহ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্নকারী সব আইন বাতিল করা হোক।
১৭৮৭ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন বলেছিলেন, ‘সরকারবিহীন সংবাদপত্র আর সংবাদপত্রবিহীন সরকারের মধ্যে আমি প্রথমটাকে বেছে নেব।’ প্রশাসনের সঙ্গে সংবাদমাধ্যম মুখোমুখি সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড়াবে, এটা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না। সরকারের উচিত উদ্ভূত অনভিপ্রেত পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে ভূমিকা রাখা। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে অন্যান্য অঙ্গের সম্পর্ককে সহযোগিতামূলক করে তোলা। যাতে সবাই নিজ নিজ কাজে উৎকর্ষ অর্জন করতে পারে, সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা প্রশাসনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি আনতে সাহায্য করে, দুর্নীতি অনিয়ম দূর করতে সাহায্য করে। মানুষের অধিকার, জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত হয়। রাষ্ট্রের মালিক তো জনগণ। জনগণের কল্যাণের জন্যই সর্বপক্ষ কাজ করুক সুন্দর পরিবেশে, এইটাই তো আমরা চাই।
করোনাকালে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, যে দেশে গণতন্ত্র এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না। কথাটা উল্টোভাবেও বলা যায়। গণতন্ত্র এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকলে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে, মহামারির প্রতিক্রিয়া মারাত্মক হতে পারে। কাজেই এখনই স্বচ্ছতা, সুশাসন, সুনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য সুসাংবাদিকতার চর্চা করা সবচেয়ে বেশি দরকার।
আমরা আবারও সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
লেখক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক।