মানবতাবাদী রাজনীতিক মতিয়র রহমান তালুকদার

  • Update Time : ১২:৩৫:০৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৪ অক্টোবর ২০২১
  • / 269

ড. মুহাম্মদ সামাদ:

দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার একজন দেশপ্রেমিক ও মানবতাবাদী রাজনীতিক ছিলেন। ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় আমাদের শ্রদ্ধেয় মতি ভাইয়ের অভিভাবকত্বে আমার কাজ করার সৌভাগ্য হয়। উপরন্ত তাঁর ও আমার গ্রামের বাড়ি সরিষাবাড়ী হওয়ায় আমি তাঁর পরিবারের সদস্যের মতো হয়ে যাই এবং তাঁর প্রয়াণের পরেও একইভাবে রয়েছি।

তাঁর মহীয়সী স্ত্রী, আমাদের মাতৃতুল্য ভাবী মনোয়ারা বেগম মনু, জ্যেষ্ঠপুত্র অ্যাডভোকেট মাহমুদ হাসান তালুকদার মিন্টু (বর্তমানে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি), আরেক পুত্র ডা. মো. মুরাদ হাসান (বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী) ও একমাত্র কন্যা মমতাজ জাহান দ্বিজু সকলের সঙ্গে আমার, এবং আমার পরিবারের সম্পর্ক অটুট রয়েছে। প্রসঙ্গত অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদারের ছোট ভাইয়ের ছেলে রতন (ডা. জোবাইদুল আলম তালুকদার) এবং তাঁর সর্বকনিষ্ঠ ভাই মোস্তাফিজুর রহমান তালুকদার দিপু (এখন আইনজীবী) তখন জামালপুরের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতো। সেই সময় আমার জন্যে কক্ষ ছেড়ে দিয়ে তারা অন্য ঘরে ঘুমাতো। বিশেষ করে রতনের স্ত্রী-সন্তানসহ আমরা এখনো ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত রয়েছি।

আজ স্নেহ-শ্রদ্ধার সেই সম্পর্কের সুবাদে মতি ভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে কিছু কথা বলতে বা স্মৃতিচারণ করতে আমি ভার্চুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হয়েছি। প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাসভারি মানুষ ছিলেন মতি ভাই। তাঁর বুকভরা স্নেহ ও ভালোবাসা ছিলো। আমরা ছাত্রলীগ করেছি। ১৯৭৫ সালে পরিতোষ দা এবং বজলু ভাই ছিলেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। পরিতোষ দা কোথায় আছেন জানি না। আর বজলু ভাইকে কীভাবে হত্যা করা হলো সেটা আজও রহস্যাবৃত। জামালপুর জেলা ছাত্রলীগের সেই নির্বাহী কমিটিতে আমি সদস্য ছিলাম। তারপরে জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং কিছু সময় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি। আমার এই সব কিছুতেই মতি ভাই ও শহীদ ভাইয়ের (জামালপুর জেলা যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি) অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় দলের কাজে আমি যখনই জামালপুর গিয়েছি তখনই তাঁর বাড়িতে থাকতে ও খেতে হয়েছে। দেখা গেছে যে, তিনি বাড়িতে থাকলে গেট না খুলে আগে তাকিয়ে দেখতেন হাতে ব্যাগ আছে কিনা। হাতে ব্যাগ না থাকলে বলতেন শহীদের বাসায় ব্যাগ রেখে এসেছো না? আমি বলতাম, শহীদ ভাইয়ের বাসায় স্টেশন থেকে সরাসরি গিয়েছিলাম তাই…। মতি ভাই বলতেন, তুমি যাও। আমার বাসায় তুমি ঢুকতে পারবে না। তখন রিকশা ঘুরিয়ে নিয়ে ব্যাগসহ তাঁর বাসায় আসার পর তিনি দরজা খুলেছেন। সব সময় পাশে বসিয়ে খাওয়াতেন। নেতাকর্মীদের প্রতি তাঁর এমন ভালোবাসার কথা, স্নেহ-মমতার কথা আজকের দিনে কল্পনা করাও কঠিন।

এমনও হয়েছে তাঁর বাসায় খেয়ে-দেয়ে অনেক দিন গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে শহীদ ভাইয়ের অনুজ তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি আবুল কাশেম বা সাংগঠনিক সম্পাদক সারোয়ার জাহান বুলুর বাসায় ঘুমিয়েছি। সেই সময়ের জামালপুরের ছাত্রনেতা আবু জাফর শিশা, কমল কান্তি গোপ, হারেস আলী, বাকি বিল্লাহ (বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি), ফারুক চৌধুরী (বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান), জামান, দিদার পাশাসহ অনেকের কথা মনে পড়ে। আজ মতি ভাই নেই; জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকেই নেই। হারিয়ে যাওয়া সেই সব দিনের কথা মনে হলে মন বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। স্মৃতি সততই বেদনাদায়ক!

রাজনীতির পাশাপাশি লেখাপড়া ও ভালো ছাত্রদের প্রতি মতি ভাইয়ের খুব আগ্রহ ছিলো। আমি মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেলে তিনি আমাকে জামালপুরে সংবর্ধনা দিতে চেয়েছিলেন। আমি কিছুদিন সময় চাইলে জিগ্যেস করেছিলেন কতদিন সময় চাও? আমি উত্তর দিয়েছিলাম, বছর বিশেক। তিনি অবাক হয়ে বলেছিলেন বলো কী? বলা বাহুল্য, তাঁর জীবদ্দশায় আমি কিছু পুরস্কার পেলে তিনি পত্রিকায় সেই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের খবর পড়ে আনন্দিত হয়েছিলেন এবং আমার সেই বিশ বছর সময় নেয়ার কথা বহুবার মজা করে বলেছেন। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণের দিন তাঁর কথা আমার খুব মনে হয়েছিলো।

একজন আইনজীবী হিসেবে তাঁর মহত্বের কথা উল্লেখ না-করলেই নয়। তিনি প্রথমে একজন মক্কেলের কথা শুনতেন। কথা শোনার পর মামলায় জেতার সম্ভাবনা না থাকলে বলতেন, ‘গ্রামে গিয়ে পারলে আপোষ রফা করে ফেলেন। উকিল বাইটা খাওয়াইলেও এই মকদ্দমায় আপনি জিততে পারবেন না। বাংলাদেশে এমন কোনো উকিল নাই যিনি আপনাকে এই মামলায় জিতায়।’ তারপর মহুরীকে বলতেন, ‘টাকাটা ফেরৎ দিয়ে দাও।’ একজন আইনজীবী এতো সততার সঙ্গে এভাবে ওকালতি করতে পারেন, মফস্বল শহরে, মহকুমা শহরে, জেলা শহরে এমন মহৎ আইনজীবীর কথা কখনো শুনিনি।

অন্যদিকে সামরিক জান্তা জেনারেল জিয়ার দুঃশাসনকালে বিনা ফি-তে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের নামে দায়ের করা অসংখ্য হয়রানিমূলক মামলা পরিচালনা করেছেন।

তিনি একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিক ছিলেন। মির্জা আজমকে অত্যন্ত কম বয়সে নেতা বানিয়েছেন। তাঁর ভেতরে যে কাজ করার স্পৃহা, শৌর্য-বীর্য ও সাহস ছিলো সেটা মতিয়র রহমান তালুকদার উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। খুব কম বয়সে তাকে জামালপুরের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করেন মতিয়র রহমান তালুকদার। মির্জা আজম এখন জাতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা এবং আমাদের অহংকার।

অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার একজন প্রচারবিমুখ মানুষ ছিলেন। আমরা কখনো তাঁর মুখ থেকে শুনিনি যে, তিনি আশেক মাহমুদ কলেজের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। এটা আমাদের কারো জানা ছিল না। একজন মানুষকে জানতে হলে তার সম্পর্কে তথ্যগুলো জানতে হয়; তিনি কী কী কাজ করেছেন সেগুলো জানতে হয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। একজন আইনজ্ঞ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সীমান্তের ওপারে বিচারিক দায়িত্ব পালন করেছেন। পঁচাত্তরের পরে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করার জন্য তাঁকে কারা নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, আজকের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিকলীগ যারাই থাকুন না কেন, তাঁদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ যাঁরা তাঁরা জানেন যে, নির্দয় সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে, এরশাদের আমলে কীভাবে আমরা রাজনীতি করেছি। কীভাবে ছাত্র সংগঠন করেছি, কীভাবে জীবন নিয়ে রাস্তা-ঘাটে আমাদের লুকিয়ে পড়তে হয়েছে।

আমার মনে আছে, একবার নির্বাচনী জনসভা করতে গিয়ে মুসুদ্ধি হাইস্কুল মাঠে বক্তৃতা করছিলাম। সেখানে জামাত-বিএনপির সশস্ত্র লোকজন আমাদের ঘেরাও দিয়েছিলো। আমরা বক্তৃতা দিয়ে যে যেখানে পেরেছি পালিয়ে গিয়েছিলাম। একজন মেম্বারের নাম আমার মনে আছে। তাঁর নাম ‘কটু মেম্বার’। নিশ্চয়ই তিনি জীবিত নেই। মুসুদ্ধি হাইস্কুলের পাশেই তাঁর বাড়ি ছিলো। তিনি সেই রাতে আমাকে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। রাতে খাইয়েছিলেন। পরের দিন ভোরে আমি জগন্নাথগঞ্জ ঘাট থেকে ট্রেনে করে বাড়ি ফিরে আসি। সেদিন যদি কোনো কারণে ধরা পড়তাম আজ বেঁচে থাকার কোনো কথাই উঠতো না। সুতরাং এই সমস্ত ঘটনার কথা মনে পড়ে। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে মতি ভাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। সমস্ত নির্বাচনী এলাকায় তাঁর সাথে সাথে থেকেছি। কিছু মটর-সাইকেল আর বাই-সাইকেল ছিলো পথ চলার সম্বল। তখনকার দিনে সরিষাবাড়ীর পশ্চিম অঞ্চলে দুর্গম বালুচরে পায়ে হেঁটে হেঁটে, মঞ্চে হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় রাতের জনসভায় বক্তৃতা দিয়েছি। সেই দিনগুলোতে প্রতিমুহূর্তে জীবনের ঝুকি নিয়ে রাজনীতি করার, বক্তৃতা করার, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলন করার প্রধান অনুপ্রেরণা ছিলেন মতিয়র রহমান তালুকদার। এছাড়া রেজাউল করিম হীরা ভাই, শহিদ ভাই এবং সরিষাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রয়াত আব্দুল মালেক সাহেব প্রমুখ সেই সময় আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন, সাহস দিয়েছেন, আমাদের নানাভাবে সহায়তা করেছেন, সেই কথাও আজ আমরা স্মরণ করি।

অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। এই সময়টায় আমি তাঁর সাথে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। তিনি ঢাকায় আসলেই আমাকে খবর দিতেন বা আগেই জানাতেন যে ঢাকায় আসছেন। জহুরুল হক হলে আমাদের রুমে আসতেন। রিক্সায় চড়ে ঢাকা শহরে আমি তাঁর সাথে ঘুরেছি। অনেক নেতার বাসায় গিয়েছি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আস্থাভাজন ছিলেন।

মতি ভাই জেলা আইনজীবী সমিতি জামালপুরের সেখানে তিনি ছয় বার নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন; জাতীয় আইনজীবী সমিতির সহসভাপতি ছিলেন। জামালপুরে একটি আইন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। আইন কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। এগুলো হচ্ছে মানব সমাজের জন্য তাঁর বড় ধরনের কাজ, যা আমাদের জামালপুর অঞ্চলের অনেক মানুষই জানেন না। দরিদ্র মানুষের জন্য তিনি আজীবন কাজ করেছেন। অন্ধকল্যাণ সমিতির তিনি সভাপতি ছিলেন। সারা জামালপুর এলাকায় সাধারণ মানুষের, গরিব-দুঃখী মানুষের মধ্যে ত্রাণ দেয়ার জন্য, খাদ্য সহায়তা দেয়ার জন্য, ওষুধ দেয়ার জন্য তিনি রেড ক্রিসেন্টের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর ডায়াবেটিস ছিলো। আমি অনেক দিন দেখেছি, ভাবী ও আমি বাসায় বসে আছি; তাঁকে রেখে খেতে পারছি না; তিনি এই ডায়াবেটিস নিয়ে দেরি করে আসতেন। দেরি করে এলে ভাবী খুব রাগারাগি করতেন। ভাবীকে এক সঙ্গে খেতে ডাকতেন। ভাবী বলতেন, তুমি যেহেতু দেরি করে এসেছো আমি আজকে তোমার সাথে খাবো না। এই গুলো ছিল তাঁদের দাম্পত্য জীবনের খুনসুটি। মানুষের মঙ্গলের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য, এই নেতা নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে জীবনের ও স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন।

একটা কথা আমি বিশেষভাবে বলবো। আজকে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক কর্মীদের, রাজনৈতিক নেতাদের মর্যাদা যেভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে, সেই তুলনায় মতিয়র রহমান তালুকদার ছিলেন একজন আদর্শ রাজনীতিবিদ। তাঁর যে প্রজ্ঞা, তাঁর যে জ্ঞান, তাঁর যে ব্যক্তিত্ব, তাঁর যে আত্মমর্যাদাবোধ তা আজ আমাদের জন্যে অনুকরণীয়। আজকের যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁদের জন্যে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে: পৃথিবীতে রাজনীতির উপরে কোনো ঘটনা নেই। রাজনীতির উপরে কোনো বিষয় নেই এই মাটির পৃথিবীতে। তাই একজন বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেন, একজন সমাজবিজ্ঞানী সমাজের সমস্যা তুলে ধরেন, একজন অর্থনীতিবিদ উন্নয়নের তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন, মেধাবী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাষ্ট্র পরিচালনার উত্তম পথের সন্ধান দেন এবং একজন ভালো দার্শনিক নীতি-নৈতিকতার কথা তুলে ধরেন। এই আবিষ্কার, উদ্ভবন ও নৈতিকতার দর্শন বাস্তবে রূপদানের দায়িত্ব প্রধানত রাজনীতিকের। এভাবে একটি দেশ কল্যাণরাষ্ট্রে রূপ নেয়; সমৃদ্ধি লাভ করে। আজকের দিনে আমাদের যে অনৈতিক অবস্থান, আমাদের যে লোভ-লালসা, আমাদের যে অন্যায়ভাবে বিত্ত-বৈভব অর্জনের চিন্তাÑ এটা আসলে সেই মতিয়র রহমান তালুকদারের সময়ে যারা রাজনীতি করতেন তাঁদের মধ্যে ছিলো না। তাঁদের রাজনীতি ছিলো মানুষের কল্যাণের জন্য। তাই আমি বলছি যে, জ্ঞান-বিজ্ঞান যা কিছু আবিষ্কার করা হয়েছে তা জনকল্যাণে কাজে লাগানোর বা প্রয়োগ করার সিদ্ধান্তদাতা হলেন রাজনীতিবিদ।

ভারতের এপিজে আব্দুল কালাম ও পাকিস্তানের আব্দুল কাদির পারমাণু বোমা তৈরি করেছেন। সেই বোমা বিস্ফোরণের অথবা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের হাতে। তেমনিভাবে মানুষের কল্যাণে ওষুধ বা আজকে করোনা মহামারীকালে বিজ্ঞানীরা যে কয়েকটি টিকা আবিষ্কার করেছেন সেগুলো ব্যবহার রাজনীতিবিদরাই নিয়ন্ত্রণ করছেন। সুতরাং, সেই রাজনীতিবিদরা যদি শুদ্ধ না হন, তাঁরা যদি চরিত্রবান না হন, তাঁদের যদি নৈতিকতা না থাকে, তাঁরা যদি অর্থ-বিত্তের পেছনে দৌড়াদৌড়ি করেন, তাঁরা যদি চিন্তা না করেন যে, আমার এই জীবন একটাই এবং আমার মৃত্যু আছে। মতিয়র রহমান তালুকদারের মতো এরকম কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি করে যাই, মানুষের জন্য কিছু কাজ করি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন থেকে আমি শুধু একটা উদহারণ দেবো। সেটা হচ্ছে ১৯৪৯ সালে তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সমর্থনে আন্দোলনে যোগ দেন, তখন ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রী বিভিন্ন মেয়াদে বিভিন্ন শাস্তি পেয়েছিলেন, মুচলেকা, জরিমানা, ট্রান্সফার সার্টিফিকেট, সতর্কতা ইত্যাদি। তাঁদের জন্যে সারা দেশে হরতাল হয়েছে; আন্দোলন হয়েছে। এঁদের মধ্যে ২৬ জন মুচলেকা দিয়ে, শর্ত মেনে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন, চাকরি পেয়েছেন, নানা কিছু হয়েছেন। শুধু একজন সেই অন্যায় শাস্তি মেনে নেননি; একজন মাত্র ছাত্র সেই শাস্তি প্রত্যাখ্যান করেছেন। সেই একজন হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই একজন কিন্তু জাতির পিতা হয়েছেন। সেই একজনই কিন্তু এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। সেই বঙ্গবন্ধুর যোগ্য অনুসারী মতিয়র রহমান তালুকদারও রাজনীতিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। ক্ষমতার লোভে, আত্মস্বার্থে কখনো আপস করেননি। জেল-জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন; দেশের দুর্দিনে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আর সেই মহানুভবতার জন্যেই আজ রাজনীতিক মতিয়র রহমান তালুকদারের স্মরণে আমরা ভার্চুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হয়ে তাঁর মহৎ কর্মযজ্ঞ নিয়ে আলোচনা করছি। আমরা যদি এই মহৎ রাজনৈতিক নেতাদের পথ অনুসরণ করে জনগণনন্দিত নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাজনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি তাহলে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হবে। আমি প্রয়াত নেতা অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদারের স্মৃৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

[২০২১ সালের ১৬ই জুলাই অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ নেতা মতিয়র রহমান তালুকদারের স্মরণসভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য]

লেখক: কবি ও শিক্ষাবিদ; প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


মানবতাবাদী রাজনীতিক মতিয়র রহমান তালুকদার

Update Time : ১২:৩৫:০৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৪ অক্টোবর ২০২১

ড. মুহাম্মদ সামাদ:

দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার একজন দেশপ্রেমিক ও মানবতাবাদী রাজনীতিক ছিলেন। ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় আমাদের শ্রদ্ধেয় মতি ভাইয়ের অভিভাবকত্বে আমার কাজ করার সৌভাগ্য হয়। উপরন্ত তাঁর ও আমার গ্রামের বাড়ি সরিষাবাড়ী হওয়ায় আমি তাঁর পরিবারের সদস্যের মতো হয়ে যাই এবং তাঁর প্রয়াণের পরেও একইভাবে রয়েছি।

তাঁর মহীয়সী স্ত্রী, আমাদের মাতৃতুল্য ভাবী মনোয়ারা বেগম মনু, জ্যেষ্ঠপুত্র অ্যাডভোকেট মাহমুদ হাসান তালুকদার মিন্টু (বর্তমানে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি), আরেক পুত্র ডা. মো. মুরাদ হাসান (বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী) ও একমাত্র কন্যা মমতাজ জাহান দ্বিজু সকলের সঙ্গে আমার, এবং আমার পরিবারের সম্পর্ক অটুট রয়েছে। প্রসঙ্গত অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদারের ছোট ভাইয়ের ছেলে রতন (ডা. জোবাইদুল আলম তালুকদার) এবং তাঁর সর্বকনিষ্ঠ ভাই মোস্তাফিজুর রহমান তালুকদার দিপু (এখন আইনজীবী) তখন জামালপুরের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতো। সেই সময় আমার জন্যে কক্ষ ছেড়ে দিয়ে তারা অন্য ঘরে ঘুমাতো। বিশেষ করে রতনের স্ত্রী-সন্তানসহ আমরা এখনো ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত রয়েছি।

আজ স্নেহ-শ্রদ্ধার সেই সম্পর্কের সুবাদে মতি ভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে কিছু কথা বলতে বা স্মৃতিচারণ করতে আমি ভার্চুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হয়েছি। প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাসভারি মানুষ ছিলেন মতি ভাই। তাঁর বুকভরা স্নেহ ও ভালোবাসা ছিলো। আমরা ছাত্রলীগ করেছি। ১৯৭৫ সালে পরিতোষ দা এবং বজলু ভাই ছিলেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। পরিতোষ দা কোথায় আছেন জানি না। আর বজলু ভাইকে কীভাবে হত্যা করা হলো সেটা আজও রহস্যাবৃত। জামালপুর জেলা ছাত্রলীগের সেই নির্বাহী কমিটিতে আমি সদস্য ছিলাম। তারপরে জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং কিছু সময় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি। আমার এই সব কিছুতেই মতি ভাই ও শহীদ ভাইয়ের (জামালপুর জেলা যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি) অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় দলের কাজে আমি যখনই জামালপুর গিয়েছি তখনই তাঁর বাড়িতে থাকতে ও খেতে হয়েছে। দেখা গেছে যে, তিনি বাড়িতে থাকলে গেট না খুলে আগে তাকিয়ে দেখতেন হাতে ব্যাগ আছে কিনা। হাতে ব্যাগ না থাকলে বলতেন শহীদের বাসায় ব্যাগ রেখে এসেছো না? আমি বলতাম, শহীদ ভাইয়ের বাসায় স্টেশন থেকে সরাসরি গিয়েছিলাম তাই…। মতি ভাই বলতেন, তুমি যাও। আমার বাসায় তুমি ঢুকতে পারবে না। তখন রিকশা ঘুরিয়ে নিয়ে ব্যাগসহ তাঁর বাসায় আসার পর তিনি দরজা খুলেছেন। সব সময় পাশে বসিয়ে খাওয়াতেন। নেতাকর্মীদের প্রতি তাঁর এমন ভালোবাসার কথা, স্নেহ-মমতার কথা আজকের দিনে কল্পনা করাও কঠিন।

এমনও হয়েছে তাঁর বাসায় খেয়ে-দেয়ে অনেক দিন গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে শহীদ ভাইয়ের অনুজ তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি আবুল কাশেম বা সাংগঠনিক সম্পাদক সারোয়ার জাহান বুলুর বাসায় ঘুমিয়েছি। সেই সময়ের জামালপুরের ছাত্রনেতা আবু জাফর শিশা, কমল কান্তি গোপ, হারেস আলী, বাকি বিল্লাহ (বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি), ফারুক চৌধুরী (বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান), জামান, দিদার পাশাসহ অনেকের কথা মনে পড়ে। আজ মতি ভাই নেই; জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকেই নেই। হারিয়ে যাওয়া সেই সব দিনের কথা মনে হলে মন বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। স্মৃতি সততই বেদনাদায়ক!

রাজনীতির পাশাপাশি লেখাপড়া ও ভালো ছাত্রদের প্রতি মতি ভাইয়ের খুব আগ্রহ ছিলো। আমি মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেলে তিনি আমাকে জামালপুরে সংবর্ধনা দিতে চেয়েছিলেন। আমি কিছুদিন সময় চাইলে জিগ্যেস করেছিলেন কতদিন সময় চাও? আমি উত্তর দিয়েছিলাম, বছর বিশেক। তিনি অবাক হয়ে বলেছিলেন বলো কী? বলা বাহুল্য, তাঁর জীবদ্দশায় আমি কিছু পুরস্কার পেলে তিনি পত্রিকায় সেই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের খবর পড়ে আনন্দিত হয়েছিলেন এবং আমার সেই বিশ বছর সময় নেয়ার কথা বহুবার মজা করে বলেছেন। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণের দিন তাঁর কথা আমার খুব মনে হয়েছিলো।

একজন আইনজীবী হিসেবে তাঁর মহত্বের কথা উল্লেখ না-করলেই নয়। তিনি প্রথমে একজন মক্কেলের কথা শুনতেন। কথা শোনার পর মামলায় জেতার সম্ভাবনা না থাকলে বলতেন, ‘গ্রামে গিয়ে পারলে আপোষ রফা করে ফেলেন। উকিল বাইটা খাওয়াইলেও এই মকদ্দমায় আপনি জিততে পারবেন না। বাংলাদেশে এমন কোনো উকিল নাই যিনি আপনাকে এই মামলায় জিতায়।’ তারপর মহুরীকে বলতেন, ‘টাকাটা ফেরৎ দিয়ে দাও।’ একজন আইনজীবী এতো সততার সঙ্গে এভাবে ওকালতি করতে পারেন, মফস্বল শহরে, মহকুমা শহরে, জেলা শহরে এমন মহৎ আইনজীবীর কথা কখনো শুনিনি।

অন্যদিকে সামরিক জান্তা জেনারেল জিয়ার দুঃশাসনকালে বিনা ফি-তে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের নামে দায়ের করা অসংখ্য হয়রানিমূলক মামলা পরিচালনা করেছেন।

তিনি একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিক ছিলেন। মির্জা আজমকে অত্যন্ত কম বয়সে নেতা বানিয়েছেন। তাঁর ভেতরে যে কাজ করার স্পৃহা, শৌর্য-বীর্য ও সাহস ছিলো সেটা মতিয়র রহমান তালুকদার উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। খুব কম বয়সে তাকে জামালপুরের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করেন মতিয়র রহমান তালুকদার। মির্জা আজম এখন জাতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা এবং আমাদের অহংকার।

অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার একজন প্রচারবিমুখ মানুষ ছিলেন। আমরা কখনো তাঁর মুখ থেকে শুনিনি যে, তিনি আশেক মাহমুদ কলেজের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। এটা আমাদের কারো জানা ছিল না। একজন মানুষকে জানতে হলে তার সম্পর্কে তথ্যগুলো জানতে হয়; তিনি কী কী কাজ করেছেন সেগুলো জানতে হয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। একজন আইনজ্ঞ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সীমান্তের ওপারে বিচারিক দায়িত্ব পালন করেছেন। পঁচাত্তরের পরে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করার জন্য তাঁকে কারা নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, আজকের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিকলীগ যারাই থাকুন না কেন, তাঁদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ যাঁরা তাঁরা জানেন যে, নির্দয় সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে, এরশাদের আমলে কীভাবে আমরা রাজনীতি করেছি। কীভাবে ছাত্র সংগঠন করেছি, কীভাবে জীবন নিয়ে রাস্তা-ঘাটে আমাদের লুকিয়ে পড়তে হয়েছে।

আমার মনে আছে, একবার নির্বাচনী জনসভা করতে গিয়ে মুসুদ্ধি হাইস্কুল মাঠে বক্তৃতা করছিলাম। সেখানে জামাত-বিএনপির সশস্ত্র লোকজন আমাদের ঘেরাও দিয়েছিলো। আমরা বক্তৃতা দিয়ে যে যেখানে পেরেছি পালিয়ে গিয়েছিলাম। একজন মেম্বারের নাম আমার মনে আছে। তাঁর নাম ‘কটু মেম্বার’। নিশ্চয়ই তিনি জীবিত নেই। মুসুদ্ধি হাইস্কুলের পাশেই তাঁর বাড়ি ছিলো। তিনি সেই রাতে আমাকে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। রাতে খাইয়েছিলেন। পরের দিন ভোরে আমি জগন্নাথগঞ্জ ঘাট থেকে ট্রেনে করে বাড়ি ফিরে আসি। সেদিন যদি কোনো কারণে ধরা পড়তাম আজ বেঁচে থাকার কোনো কথাই উঠতো না। সুতরাং এই সমস্ত ঘটনার কথা মনে পড়ে। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে মতি ভাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। সমস্ত নির্বাচনী এলাকায় তাঁর সাথে সাথে থেকেছি। কিছু মটর-সাইকেল আর বাই-সাইকেল ছিলো পথ চলার সম্বল। তখনকার দিনে সরিষাবাড়ীর পশ্চিম অঞ্চলে দুর্গম বালুচরে পায়ে হেঁটে হেঁটে, মঞ্চে হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় রাতের জনসভায় বক্তৃতা দিয়েছি। সেই দিনগুলোতে প্রতিমুহূর্তে জীবনের ঝুকি নিয়ে রাজনীতি করার, বক্তৃতা করার, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলন করার প্রধান অনুপ্রেরণা ছিলেন মতিয়র রহমান তালুকদার। এছাড়া রেজাউল করিম হীরা ভাই, শহিদ ভাই এবং সরিষাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রয়াত আব্দুল মালেক সাহেব প্রমুখ সেই সময় আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন, সাহস দিয়েছেন, আমাদের নানাভাবে সহায়তা করেছেন, সেই কথাও আজ আমরা স্মরণ করি।

অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। এই সময়টায় আমি তাঁর সাথে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। তিনি ঢাকায় আসলেই আমাকে খবর দিতেন বা আগেই জানাতেন যে ঢাকায় আসছেন। জহুরুল হক হলে আমাদের রুমে আসতেন। রিক্সায় চড়ে ঢাকা শহরে আমি তাঁর সাথে ঘুরেছি। অনেক নেতার বাসায় গিয়েছি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আস্থাভাজন ছিলেন।

মতি ভাই জেলা আইনজীবী সমিতি জামালপুরের সেখানে তিনি ছয় বার নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন; জাতীয় আইনজীবী সমিতির সহসভাপতি ছিলেন। জামালপুরে একটি আইন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। আইন কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। এগুলো হচ্ছে মানব সমাজের জন্য তাঁর বড় ধরনের কাজ, যা আমাদের জামালপুর অঞ্চলের অনেক মানুষই জানেন না। দরিদ্র মানুষের জন্য তিনি আজীবন কাজ করেছেন। অন্ধকল্যাণ সমিতির তিনি সভাপতি ছিলেন। সারা জামালপুর এলাকায় সাধারণ মানুষের, গরিব-দুঃখী মানুষের মধ্যে ত্রাণ দেয়ার জন্য, খাদ্য সহায়তা দেয়ার জন্য, ওষুধ দেয়ার জন্য তিনি রেড ক্রিসেন্টের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর ডায়াবেটিস ছিলো। আমি অনেক দিন দেখেছি, ভাবী ও আমি বাসায় বসে আছি; তাঁকে রেখে খেতে পারছি না; তিনি এই ডায়াবেটিস নিয়ে দেরি করে আসতেন। দেরি করে এলে ভাবী খুব রাগারাগি করতেন। ভাবীকে এক সঙ্গে খেতে ডাকতেন। ভাবী বলতেন, তুমি যেহেতু দেরি করে এসেছো আমি আজকে তোমার সাথে খাবো না। এই গুলো ছিল তাঁদের দাম্পত্য জীবনের খুনসুটি। মানুষের মঙ্গলের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য, এই নেতা নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে জীবনের ও স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন।

একটা কথা আমি বিশেষভাবে বলবো। আজকে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক কর্মীদের, রাজনৈতিক নেতাদের মর্যাদা যেভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে, সেই তুলনায় মতিয়র রহমান তালুকদার ছিলেন একজন আদর্শ রাজনীতিবিদ। তাঁর যে প্রজ্ঞা, তাঁর যে জ্ঞান, তাঁর যে ব্যক্তিত্ব, তাঁর যে আত্মমর্যাদাবোধ তা আজ আমাদের জন্যে অনুকরণীয়। আজকের যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁদের জন্যে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে: পৃথিবীতে রাজনীতির উপরে কোনো ঘটনা নেই। রাজনীতির উপরে কোনো বিষয় নেই এই মাটির পৃথিবীতে। তাই একজন বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেন, একজন সমাজবিজ্ঞানী সমাজের সমস্যা তুলে ধরেন, একজন অর্থনীতিবিদ উন্নয়নের তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন, মেধাবী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাষ্ট্র পরিচালনার উত্তম পথের সন্ধান দেন এবং একজন ভালো দার্শনিক নীতি-নৈতিকতার কথা তুলে ধরেন। এই আবিষ্কার, উদ্ভবন ও নৈতিকতার দর্শন বাস্তবে রূপদানের দায়িত্ব প্রধানত রাজনীতিকের। এভাবে একটি দেশ কল্যাণরাষ্ট্রে রূপ নেয়; সমৃদ্ধি লাভ করে। আজকের দিনে আমাদের যে অনৈতিক অবস্থান, আমাদের যে লোভ-লালসা, আমাদের যে অন্যায়ভাবে বিত্ত-বৈভব অর্জনের চিন্তাÑ এটা আসলে সেই মতিয়র রহমান তালুকদারের সময়ে যারা রাজনীতি করতেন তাঁদের মধ্যে ছিলো না। তাঁদের রাজনীতি ছিলো মানুষের কল্যাণের জন্য। তাই আমি বলছি যে, জ্ঞান-বিজ্ঞান যা কিছু আবিষ্কার করা হয়েছে তা জনকল্যাণে কাজে লাগানোর বা প্রয়োগ করার সিদ্ধান্তদাতা হলেন রাজনীতিবিদ।

ভারতের এপিজে আব্দুল কালাম ও পাকিস্তানের আব্দুল কাদির পারমাণু বোমা তৈরি করেছেন। সেই বোমা বিস্ফোরণের অথবা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের হাতে। তেমনিভাবে মানুষের কল্যাণে ওষুধ বা আজকে করোনা মহামারীকালে বিজ্ঞানীরা যে কয়েকটি টিকা আবিষ্কার করেছেন সেগুলো ব্যবহার রাজনীতিবিদরাই নিয়ন্ত্রণ করছেন। সুতরাং, সেই রাজনীতিবিদরা যদি শুদ্ধ না হন, তাঁরা যদি চরিত্রবান না হন, তাঁদের যদি নৈতিকতা না থাকে, তাঁরা যদি অর্থ-বিত্তের পেছনে দৌড়াদৌড়ি করেন, তাঁরা যদি চিন্তা না করেন যে, আমার এই জীবন একটাই এবং আমার মৃত্যু আছে। মতিয়র রহমান তালুকদারের মতো এরকম কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি করে যাই, মানুষের জন্য কিছু কাজ করি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন থেকে আমি শুধু একটা উদহারণ দেবো। সেটা হচ্ছে ১৯৪৯ সালে তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সমর্থনে আন্দোলনে যোগ দেন, তখন ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রী বিভিন্ন মেয়াদে বিভিন্ন শাস্তি পেয়েছিলেন, মুচলেকা, জরিমানা, ট্রান্সফার সার্টিফিকেট, সতর্কতা ইত্যাদি। তাঁদের জন্যে সারা দেশে হরতাল হয়েছে; আন্দোলন হয়েছে। এঁদের মধ্যে ২৬ জন মুচলেকা দিয়ে, শর্ত মেনে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন, চাকরি পেয়েছেন, নানা কিছু হয়েছেন। শুধু একজন সেই অন্যায় শাস্তি মেনে নেননি; একজন মাত্র ছাত্র সেই শাস্তি প্রত্যাখ্যান করেছেন। সেই একজন হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই একজন কিন্তু জাতির পিতা হয়েছেন। সেই একজনই কিন্তু এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। সেই বঙ্গবন্ধুর যোগ্য অনুসারী মতিয়র রহমান তালুকদারও রাজনীতিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। ক্ষমতার লোভে, আত্মস্বার্থে কখনো আপস করেননি। জেল-জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন; দেশের দুর্দিনে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আর সেই মহানুভবতার জন্যেই আজ রাজনীতিক মতিয়র রহমান তালুকদারের স্মরণে আমরা ভার্চুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হয়ে তাঁর মহৎ কর্মযজ্ঞ নিয়ে আলোচনা করছি। আমরা যদি এই মহৎ রাজনৈতিক নেতাদের পথ অনুসরণ করে জনগণনন্দিত নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাজনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি তাহলে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হবে। আমি প্রয়াত নেতা অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদারের স্মৃৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

[২০২১ সালের ১৬ই জুলাই অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ নেতা মতিয়র রহমান তালুকদারের স্মরণসভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য]

লেখক: কবি ও শিক্ষাবিদ; প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।