উই আর পলিটিক্যাল ক্রিমিনালস

  • Update Time : ০৭:১৫:২২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর ২০২১
  • / 326

একটি তাৎপর্যপূর্ণ সময় অতিবাহিত করছে বাঙালি জাতি। এ বছর, বাংলাদেশ যখন পদার্পণ করলো স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে, ঠিক তখনই এ দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ, ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পৌঁছে গিয়েছে তার শততম বর্ষে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী তার সাথে যুক্ত করেছে বাড়তি মাত্রা। তবে এই আনন্দের সময়ের চ্যালেঞ্জও কম নয়। করোনা মহামারীতে একদিকে ভেঙ্গে পড়েছে দুর্বল অর্থ ব্যবস্থা, অন্যদিকে ধর্মের নামে দেখা গেছে কতিপয় নরপিশাচের ঘৃণ্য নিষ্ঠুরতা। শতবর্ষের গৌরবকে ম্লান করতে অন্য সকল বছরের চেয়ে অবনতি দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং -এও ৷ করোনার প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে দীর্ঘ প্রায় ১৮ মাস পর আবারও শুরু হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কার্যক্রম। এই দোদুদ্যমানতার অধীর সময়ে বাংলাদেশের ‘সেকেন্ড পার্লামেন্ট’ হিসেবে পরিচিত ডাকসু এবং হল সংসদের নেতৃবৃন্দের চিন্তা-ভাবনাকে জানতে এবং তা জনসাধারণের কাছে তুলে ধরতে বিডি সমাচার আয়োজন করেছে নিয়মিত সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান, –  “কী ভাবছেন তাঁরা ?”

এ পর্বে অতিথি হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হল ছাত্র সংসদের (সাবেক) সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার । সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, মুহাম্মদ ইমাম-উল-জাননাহ 

সাক্ষাৎকরের প্রথম অংশটি প্রকাশিত হলো এবার। শীঘ্রই প্রকাশ করা হবে দ্বিতীয় অংশটিও। বিডি সমাচারের সাথেই থাকুন।

জাননাহ : হাজারো স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসে নবীন শিক্ষার্থীরা। যখন জানতে পারলেন আপনি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, কেমন অনুভূতি হয়েছিল ?

মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : আসলে যে কোনো সফলতাই মানুষকে কিন্তু ভেতর থেকে আন্দোলিত করে। যেহেতু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যে প্রক্রিয়া সে প্রক্রিয়াটি আসলে যুদ্ধের ন্যায়। আমরা যোদ্ধা হিসেবেই আসলে একটা অংশগ্রহণ করেছিলাম। অনেকজনকে পিছনে ফেলে একটি সিট আমরা নিজের করে নিতে পেরেছি, সেটি অবশ্যই অনাবিল আনন্দের ছিল৷ আর আমার বাবা যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন, সেহেতু বাবার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক গল্পই শুনেছি। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার যে প্রবল আকাঙ্ক্ষা এটি আমারও স্বপ্ন, আমার পরিবারের ও স্বপ্ন ছিল৷ যেহেতু দুটি স্বপ্নেরই জয় হয়েছে, সেই হিসেবে বলতে পারেন, যে আনন্দ আমার ভিতরে প্রবাহিত হয়েছিল,সে আনন্দ প্রবাহিত হয়েছিল আমার পরিবারের মধ্যেও। অর্থাৎ এটি একটি সামগ্রিক অর্জন বলতে পারেন,আমার এবং আমার পরিবারের জন্য।

জাননাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কে নিয়ে পূর্ব যে ধারণা আপনার মধ্যে ছিল,যে স্বপ্ন ছিল, যে ধরনের পরিবেশ আশা করেছিলেন, এখানে ভর্তির পরে সেই পূর্ব ধারণার কোনো পরিবর্তন হয়েছিল কী?

মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কে নিয়ে অতীতে কী ধরনের প্রচারণা ছিল, সে বিষয়ে আমিও অনেকের কাছ থেকে শুনেছি। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কে নিয়ে সম্যক যে ধারণা টা আমি আমার বাবার কাছ থেকে পেয়েছি, সে ধারণা টা আসলে অনেকটা প্রচলিত ধারণা আর আমাদের যে জীবন বাস্তবতা- এখন বর্তমান সময়ে তার একটা মিশ্র রূপ। কিন্তু আমি যখন আমার বাবার কাছে গল্প শুনতাম, সেই গল্পে কখনও আমাদের ক্যাম্পাসের সমস্যাগুলো প্রধান হয়ে উঠতো না৷ কিন্তু আজকে যখন আমি আমার পরবর্তী প্রজন্মের সাথে কথা বলতে যাবো- আমার বিশ্ববিদ্যালয় কে নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই, আমার সমস্যাগুলোই প্রধান

আমি বলতে চাচ্ছি, আমার বাবা যখন সত্তরের বা আশির দশকের যে বিশ্ববিদ্যালয় সেটি নিয়ে আমার কাছে গর্ব করতেন,সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সমস্যা বা সংকট ছিল না বিষয়টা কিন্তু সেরকম নয়। তখন রাজনৈতিক সংকট ছিল, তখনও বাজেট সমস্যা ছিল তখনও দ্বন্দ্ব ছিল, কলহ ছিল এবং পরিশেষে নানা রকম অপসংস্কৃতির যে চর্চা-আমরা যেটিকে বলছি, সেটির চর্চাও কিন্তু ছিল। কিন্তু এগুলো কখনও প্রধান হয়ে উঠেনি। কিন্তু আজকে সেই চর্চাই প্রধান হয়ে উঠেছে, যেটি আসলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে গর্ব করে বলার মতো কিছু নয়।

আর দ্বিতীয়ত আমি যেটি বলবো, আমি আমার বাবার কাছে যে গল্প শুনেছি, সে গল্পের মধ্যে অনেক সময়ই প্রধান হয়ে উঠতো তাদের অনেক শিক্ষকের নাম। সেই শিক্ষকেরা ঐতিহাসিকভাবে কোনো কিংবদন্তি তুল্য শিক্ষক না, তাঁরা আসলে সাধারণ শিক্ষকই ছিলেন৷ কিন্তু তারপরেও তাঁরা সারা জাতির জন্য একজন বুদ্ধিজীবী হয়ে উঠতে না পারলেও একজন শিক্ষার্থীর কাছে তাঁরা একজন অনুকরণীয় ব্যাক্তিত্ব হয়তো হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তাঁরা একটি শ্রদ্ধাভাজন পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। তো, আমাদের সমাজে বা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন যে সেরকম কিংবদন্তি শিক্ষক দু’ একজন নেই তা আমি বলব না, আছেন,  কিন্তু যেসব শিক্ষকেরা সাধারণের তালিকায় আছেন, সেসব শিক্ষকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যতটুকু মর্যাদা পেতেন, আজকে, নির্মোহ দৃষ্টিতে যদি আমরা দেখি,- প্রবাহিত না হয়ে, তাহলে আমরা দেখবো যে আজকের এই সাধারণ শিক্ষকদের কে শ্রদ্ধা করার, অনুকরণীয় করার কিছু নেই। এটি হচ্ছে একটি বড় সমস্যা।

অর্থাৎ সাধারণ যারা ছিলেন, যাদের নাম ইতিহাসে লেখা হয় নাই,  যাদের নাম বাংলাদেশের মানুষ জানে নাই, ঐ মানুষটাও তাঁর শিক্ষার্থীর কাছে একজন নায়ক ছিলেন। কিন্তু আজকে যিনি সাধারণ তিনি জাতির কাছে, সমাজের কাছে সাধারণ তো বটেই, তিনি তার শিক্ষার্থীর কাছেও একজন সাধারণ শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তার যে গুরুত্ব সেই গুরুত্বটা শিক্ষার্থীরা এখন আর  অনুভব করে না।

জাননাহ : শিক্ষকদের মূল্যায়নটা যে আগের মতো হচ্ছে না, মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এই যে নিন্মগামিতা, এর পিছনে কী কারণ রয়েছে বলে আপনার মনে হয় ?

মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : এর পেছনে অনেক কারণের কথাই কিন্তু আমাদের শিক্ষকমণ্ডলী বা আমাদের অন্যান্য বুদ্ধিজীবীরা ;- সেই আমলের বুদ্ধিজীবীরা কিন্তু এই আমলের শিক্ষকদের মূল্যায়ন করতে গিয়ে নানান রকম কথাই বলেন। কিন্তু আমি যে কারণটা দেখি, যে, এরকম হওয়ার পেছনের মূল কারণ কী, আমার মনে হয় মূল কারণটা হচ্ছে, তাদের ব্যাক্তিগত জীবনের যে উদ্দেশ্য, সেটি। একজন শিক্ষক চাচ্ছেন না যথার্থ শিক্ষক হতে। তিনি বরং উৎসাহী হয়ে উঠছেন বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে যেতে। অর্থাৎ একজন শিক্ষকের প্রধান উদ্দেশ্য এখন আর একজন ভালো শিক্ষক হয়ে ওঠা নয়, একজন নন্দিত শিক্ষক হয়ে ওঠা নয়৷ কিংবা তার যে প্রধান কাজ -পাঠদান, সেই পাঠদানের ক্ষেত্রেও গুরুত্ব দেওয়া নয়। তিনি সবসময় মনোযোগ দিচ্ছেন, যে কী করে তিনি একটি বিভাগের চেয়ারম্যান হবেন, কী করে তিনি একটি হলের প্রভোস্ট হবেন,কীভাবে একটি হাউজ টিউটর হবেন বা তিনি কীভাবে আরও বড় কোনো প্রশাসনিক পদ গ্রহণ করে মর্যাদা লাভ করবেন। অর্থাৎ তারা তাদের শিক্ষক হিসেবে মর্যাদাটা শিক্ষকতার মধ্যে খুঁজছেন না, প্রশাসনিক পদের মধ্যে খুঁজছেন

আপনি একটি পেশায় থাকেন, আপনি নিজেই যদি নিজের পেশাকে সম্মান না করেন, অন্যের কাছ থেকে আপনি কীভাবে সম্মান আশা করেন ?

আমার বাবার কাছে আম শুনেছি যে তাদের সময়ে যারা বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে,গুরুত্বপূর্ণ পদে আসতেন, তাঁরাও একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আসতেন। তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি ছিল। কিন্তু সেটাকে রাজনীতিই বলা যায়, সেটাকে লেজুড়বৃত্তি বলা যায় না এবং তখন এই প্রভোস্ট হওয়া, এই চেয়ারম্যান হওয়া নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্বটাও ছিল। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে আজকে যে দ্বন্দ্ব হচ্ছে, আমি শুনেছি তখনও এই শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দ্বন্দ্ব বা অন্যান্য সমস্যা যেগুলো আমরা দেখতে পাই,সেগুলো হতো। কিন্তু সেই দ্বন্দ্বের মধ্যেও শিক্ষক হিসেবে পাঠদানে যে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, সেটিতে তাদের কমতি হতো না। অর্থাৎ একজন শিক্ষক তার নিজের রাজনীতি করতে গিয়ে কখনও ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতেন না। একজন শিক্ষকের সাথে তার প্রতিপক্ষের যে দ্বন্দ্ব, সেই দ্বন্দ্বের প্রতিক্রিয়া তার শিক্ষার্থীর উপরে পড়তো না,যেটি এখন ঘোরতরভাবে পড়ছে

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা শুধুমাত্র পাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, আমি মনে করি এটা হওয়া উচিত গুরুমুখী। আপনি যে বিষয়েই পড়েন না কেন, সেই বিষয়ে একজন শিক্ষককে আপনি গুরু মনে করতে পারেন, যার কাছ থেকে আপনি সার্বিকভাবে দীক্ষা গ্রহণ করবেন।  কিন্তু আপনি যদি বিশেষ কারও অনুসারী হন, তাহলে আপনি কীভাবে লাঞ্ছিত হবেন, আপনি দেখেন ;- প্রথমত আপনার অন্যান্য বন্ধুরা বলবে, যে, আমার অমুক বন্ধুটি তো আজকে লেজুড়বৃত্তি করা শুরু করেছে এবং ঐ শিক্ষকের যিনি প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবেন, তিনি দেখবেন, – যদি একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে চলে আসেন, তখন আপনার শিক্ষাজীবন এবং শিক্ষা পরবর্তী সময়ে, অন্যান্য কর্মসংস্থানের বিষয়ে দেখবেন এটি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করবে। এটাকে আমি মনে করি নোংরামি। রাজনীতি তারা করবেন,তারা দ্বন্দ্ব করবেন,এটা নোংরামি না; কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ায় তিনি তারই একজন শিক্ষার্থীকে লাঞ্ছিত করবেন – একটা ভাবে, তখন আমি মনে করি এটা অপরাজনীতি। ভালো শিক্ষক হয়ে ওঠার পথে এটা একটি বড় অন্তরায়।

জাননাহ : অর্থাৎ শিক্ষকদের যে অবমূল্যায়ন টা বর্তমানে হচ্ছে, তার জন্য বহুলাংশে তারা নিজেরাই   দায়ী  ?

মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : আমি মনে করি।

জাননাহ : একজন নবীন শিক্ষার্থী যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তার আবাসস্থল হয় (বিশেষত ছেলেদের ক্ষেত্রে)একটি হলের গণরুম, যেটি তার কাছে একটি দুঃস্বপ্নের মতো দেখা দেয়৷ এস এম হলের পরিস্থিতিটি কী? এখানেও কী নবীন শিক্ষার্থীদের গণরুমে উঠতে হয়?

মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : এস এম হলের কথা যদি আপনি বলেন, তাহলে সেটি আসলে আরও করুণ । নিঃসন্দেহে অত্যন্ত মানবেতর জীবনের কথা উঠে আসবে, গণরুমের কথা আসলে। আর এস এম হলের অবস্থা ছিল আরও খারাপ৷ গণরুমে যেতেই আপনাকে থার্ড ইয়ারে উঠতে হতো। অর্থাৎ তৃতীয় বর্ষে উঠলে আপনি গণরুমে যাবেন। তার পূর্বে দুটি বছর থাকতে হতো বারান্দায়

আপনি একটি ভবনের বারান্দায় বাস করেন,তার মানে আপনি একজন উদ্বাস্তু। উদ্বাস্তু কে?  যার কোনো ঠিকানা নাই। আপনি রাস্তায় থাকলে কিন্তু কোনো ঠিকানা লেখতে পারবেন না৷ আপনি কোনো হলের গণরুমেও যদি থাকেন, সেই রুমের একটা নাম্বার থাকে। আপনি নিজের পরিচয়পত্রে লিখতে পারবেন, বা অন্য কাউকে বলতে পারবেন, আমি অমুক রুমের বাসিন্দা৷ বারান্দায় থাকলে কিন্তু আপনি সেটি লিখতে পারেন না৷ তার মানে আপনি উদ্বাস্তু। দুটি বছর উদ্বাস্তু হিসেবে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়

আমি নিজে ব্যাক্তিগত জীবনের কথা বলি,আমি এখানে প্রায় সোয়া দুই বছর বারান্দায় কাটিয়েছি। সোয়া দুই বছর পরে আমি একটি গণরুমে উঠেছি; যেটি ডাবল রুম,মানে দু’জনের রুম। সেখানে আমাদের আটজনকে রুম দেওয়া হয়েছিল৷ (২০১৭ সালের প্রথম দিকে,মার্চ বা এপ্রিলের সময়) তৃতীয় বর্ষে যখন আমি উঠেছি, তখন আমি একটি গণরুমে উঠি, আমার বন্ধুদের সাথে এবং এই হলের সবচেয়ে খারাপ রুম যে রুম কোনো আলো-বাতাস প্রবেশ করে না। মাত্র একটি জানালা আছে, যেটি খোলা যায় না। তো দুইজন থাকার জন্য যে রুম প্রস্তুত হয়েছে সেখানে আমরা আটজন উঠেছি। পরে একজন এই অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য চলে গিয়েছেন রুম থেকে। তারপর আমরা সাতজন দীর্ঘ সময় সেই রুমে ছিলাম এবং ঐ রুমে থেকে আমি হল ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হয়েছি। ঐ রুমে থেকেই আমি এস এম হল ছাত্র সংসদের জি এস নির্বাচিত হয়েছি এবং ঐ রুমে থেকেই আমি আমার মেয়াদকাল পার করেছি

অর্থাৎ জি এস হিসেবে আমি আমার শিক্ষার্থীদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে, আমাদের বারান্দা প্রথার যে প্রচলনটি আছে, সেই বারান্দা প্রথাকে আমি বিদায় জানাবো এবং মানুষ অঞ্চলপ্রীতি বা দল-মত নির্বিশেষে আমাকে ভোট দিয়েছে৷ আমি ভিন্ন মতাদর্শের লোকের থেকেও ভোট পেয়েছি,এটা আমি অহংকার করেই বলি৷

কিন্তু যেহেতু আমি আমার এই একটি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি, সেজন্য আমি নিজেও যে গণরুমে ছিলাম, আমার মেয়াদকালে সেই গণরুম ছেড়ে যাই নি, গণরুমেই থেকেছি।

জাননাহ : সম্প্রতি এস এম হলের বারান্দায় ফাটল দেখা দেওয়ায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরবর্তী সময়ে প্রথম বর্ষের নবীন শিক্ষার্থীদেরকে এই হল বরাদ্দ দেওয়া বন্ধ থাকবে৷ এই সিদ্ধান্ত কী হলের বারান্দা ব্যবস্থা বা গণরুম ব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন?

মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : এই সিদ্ধান্তটি নেওয়ার জন্য, আমরা, ছাত্র সংসদ যখন ছিল তখনই আবেদন জানিয়েছি, অফিয়াসিয়ালি আবেদন জানিয়েছি৷ তখন অবশ্য ফাটল দেখা দেয় নি, কিন্তু বারান্দায় যেহেতু শিক্ষার্থীরা ছিলেন, তাদের এই মানবেতর জীবনযাপনের কথা উল্লেখ করে আমরা আবেদন করেছিলাম। সেই আবেদনের ভিত্তিতে পরের বছর যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, অর্থাৎ এখন যারা দ্বিতীয় বর্ষে আছেন(২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ), এই শিক্ষার্থীদের এলটমেন্ট অর্ধেক করা হয়,অনেক কমানো হয়। কমানোর পরেও তো সমস্যা পুরোপুরি সমাধান হয় নি৷ তারপরে এখন ফাটল দেখা দিয়েছে এবং আগেরবারের আবেদনের যে ধারাবাহিকতা সেই ধারাবাহিকতাকে বিবেচনায় নিয়ে এই হলে শিক্ষার্থী বরাদ্দ দেওয়া বন্ধ করেছে প্রশাসন৷

কিন্তু আমি মনে করি এই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তই যথেষ্ট নয়৷ এখানে আমরা যারা শিক্ষার্থীরা থাকি, বিশেষকরে এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমরা যারা রাজনীতি করি, আমাদের যে প্রতিশ্রুতি- রাজনীতির প্রতি বলেন বা মানুষের প্রতিই বলেন, সেই প্রতিশ্রুতির জায়গায় যদি আমরা দৃঢ় না হই,তাহলে এখানে শুধু শিক্ষার্থী বরাদ্দ দেওয়া বন্ধ করে, এই বারান্দা ব্যবস্থা বা গণরুম ব্যবস্থা কে বিদায় জানানো সম্ভব না৷

আমাদের এখানে অনেক ব্যাক্তি আছেন, যিনি সাধারণ শিক্ষার্থীর মতো করে থাকেন না, আপনি সেখানে গেলে দেখবেন যে,  তারা যেভাবে থাকেন, ঐভাবে না থেকে একটু কম্প্রোমাইজ করলে ঐখানে আরও দুইজন-তিনজন শিক্ষার্থী থাকতে পারে। এই যে অনুশীলন, এই যে চর্চা, যে, “আমি নেতা মানুষ, আমি এক রুমে একা থাকবো, এ রুম আমার হবে”,এই চর্চা গুলো যদি চলতে থাকে, তাহলে আপনি দেখবেন, বরাদ্দ না দেওয়া হলে শুধু সাধারণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমবে,নেতার সংখ্যা তো কমছে না। আর নেতারা যদি এই ধরনের মানসিকতাকে ধারণ করতেই থাকেন, তাহলে তো নেতাদের সংকুলান হতে হতেই সব রুম শেষ হয়ে যাবে ; আপনি শিক্ষার্থীদের সিট দিতে পারবেন না৷ তো এই সমস্যার যদি দ্রুত সমাধান আমরা চাই,তাহলে আমাদের প্রথমে যেটা করতে হবে,যে, আমাদেরকেও এই প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত কে স্বাগত জানিয়ে বারান্দা প্রথাকে বা গণরুম প্রথাকে বিদায় দেওয়ার যে অঙ্গীকার, সেটি করতে হবে৷

জাননাহ : প্রথম বর্ষে বিভিন্ন হলে থাকা গণরুমের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তাদেরকে গণরুমে থাকার জন্যে হলেও ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের কোনো না কোনো রাজনৈতিক গ্রুপে বাধ্যতামূলকভাবে যোগ দিতে হয়৷ তাদের এ অভিযোগ কতটা সত্য ?

মোঃ জুলিয়াস সিজার তালুকদার : তাদের অভিযোগ শতভাগ সত্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যে রাজনৈতিক চর্চার মধ্যে আছি, আমি নিজেকেও বাদ দিয়ে বলছি না, আমিও সেই চর্চার মধ্যে এসে জয়েন করেছি এবং সেই চর্চাকারীদের মধ্যে হয়তো বা আমার নিজের নামও আপনি যুক্ত করতে পারবেন। কিন্তু আমি মনে করি যেকোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী অধিকারকে কুক্ষিগত করে রাজনৈতিক চর্চা চালানো – এটি একটি রাজনৈতিক অপরাধ৷ ইটস এ পলিটিক্যাল ক্রাইম। সেই হিসেবে আমি এবং আমার অন্যান্য কলিগ যারা আছে ;- উই আর পলিটিক্যাল ক্রিমিনালস

আপনি নেতা হিসেবে অক্ষম হতে পারেন, আপনার নেতৃত্বের যে গুণাবলি সেটি অন্যের থেকে কম থাকতে পারে,কিন্তু সেটি কোনো অপরাধ নয়৷ সেটি আপনার সীমাবদ্ধতা। কিন্তু আপনি চলমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের জন্য আইনগতভাবে বৈধ একটি সুযোগ কে যখন নিজে কুক্ষিগত করে তারপর তাকে আপনি আপনার উদ্দেশ্য কায়েম করার জন্য ব্যবহার করবেন,তখন সেটি অপরাধ। আমি এটাকে রাজনৈতিক অপরাধ মনে করি এবং সেই অপরাধে আমিও কিছুটা অপরাধী। আমি প্রথমে ভিক্টিম হয়েছি, পরে অপরাধী হয়েছি৷ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় সেটির যদি চর্চা হয় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও এর থেকে ভালো চর্চা যে আমরা পাবো না, এটা আমরা না শুধু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়েন না, তারাও মনে করেন৷

জাননাহ : এটি আসলে দীর্ঘদিনের ট্রাডিশনে পরিণত হয়েছে,যেটি থেকে মুক্ত হওয়া আসলেই খুব কঠিন৷ তবে, বিভিন্ন হলের সিনিয়র নেতারা মতামত প্রকাশ করেছেন যে, “এই গণরুম ব্যবস্থার পিছনে আমরা যে বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন কে দায়ী করে থাকি, আসলে তা নয় বরং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই দায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানে কতজন শিক্ষার্থীকে তারা যথাযথ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পড়াতে পারবে, তারপরও তারা অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করাচ্ছে”। গণরুম ব্যবস্থার ব্যাপারে আমরা যদি তাদের সাথে একমত হয়েও যাই, হল গুলোতে যে গেস্টরুম কালচার চালু রয়েছে এর পিছনেও কী তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই দায়ী?

জুলিয়াস সিজার তালুকদার : আমি তো বললাম, যখন একটা হোল সিস্টেমই একটা করাপ্ট সিস্টেম, পুরো ব্যবস্থাই যখন দুর্নীতিগ্রস্থ তখন আসলে বিশেষভাবে একটি দুটি বিষয়কে নিয়ে বলার কিছু নাই। হোল সিস্টেম ইস করাপ্ট। তাহলে প্রশাসনও এই সংকট তৈরি করার জন্য নিজেদের অক্ষমতাকে তুলে ধরেছে – যে আমরা অক্ষম, সেকারণে আমরা সুযোগটা নিতে পেরেছি।

অন্যদিকে গেস্টরুম কালচারের যে কথা আপনি বলছেন, সেই কালচারের কথা যদি আমরা বলি, তাহলে, এই কালচারটিও প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার্থীদের বিকাশে একটি বাধা। আপনি-আমি হয়তো মনে করি যে এখানে শিক্ষার্থীদের বিকাশ হচ্ছে। হ্যাঁ, একটি ব্যাচের সাথে আরবকটি ব্যাচের যে পারস্পরিক যোগাযোগ সেটির মাধ্যমে অবশ্যই শিক্ষার্থীর বিকাশ হয়।  কিন্তু আমরা যেটাকে গেস্টরুম কালচারে পরিণত করেছি সেটার মাধ্যমে ঐ উদ্দেশ্যেটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কারণ আমি আমার সিনিয়রের কাছ থেকে কী ভাষায় কথাগুলো শুনছি, তারা আমার উপরে কী শব্দগুলো প্রয়োগ করছেন এবং কী উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করছেন – আমি তো জানি যে, আগামীকালকে উনার সাথে থাকার জন্য উনি আজকে আমাকে এই কথাগুলো বলছেন। অর্থাৎ আমাকে এখানে একটা প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, যে প্রশিক্ষণের মাধ্য দিয়ে আমি দুইটা জিনিস শিখছি, সেটা হচ্ছে যে – আগামীকাল থেকে আপনার সাথে আমাকে থাকতে হবে আর দুই যদি আমি না থাকি তাহলে আমার দণ্ডটা কী হবে

তো একজন মানুষকে আপনি যদি প্রতিদিন এই প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসেন, তার তো কোনো বিকাশ হবে না। এবং যখন এই কালচারটি ছিল না,তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর আজকে যে আমরা বলছি, আমরা অনেক বিকাশ করছি শিক্ষার্থীদের, আজকের এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যে তফাতটুকু আছে, সেই তফাতটুকু কে মাপলেই আমরা বুঝতে পারবো আসলে এটা কী কোনো কার্যকর পদ্ধতি না কি অকার্যকর পদ্ধতি৷

জাননাহ : তবে আমি আপনাকে যে প্রশ্নটি করেছি আসলে, আমি বলেছি, গণরুম ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার পিছনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কে দায়ী করা হচ্ছে, গেস্টরুম কালচারকে টিকিয়ে রাখার জন্যও কী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়ী ?

জুলিয়াস সিজার তালুকদার : সেটাই বললাম, যেহেতু দি হোল সিস্টেম ইজ করাপ্ট ;যেমন আমি একজন শিক্ষার্থী, আমি যদি কোথাও লাঞ্ছিত হই,ধরে নিন যে,আমি আমার হলে কোনো একজন শিক্ষার্থীর দ্বারা খুবই সামান্য লাঞ্ছিত হলাম, বা সে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে খেতেই বাধ্য করছে,- আপনি তো আমাকে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে খেতেও বাধ্য করতে পারেন না ; অন্যান্য বিষয় তো অনেক দূরেই রাখলাম, তো এরকম যদি কেউ করে সেটা থেকে আমাকে রক্ষা করার দায়িত্ব তো প্রশাসনের। আর প্রশাসন তো এই জায়গাতে ব্যর্থ হয়েছে। তো তাদের ব্যর্থতার ফলাফলই আজকের যত অপসংস্কৃতি আছে সেগুলির জন্য দায়ী।

জাননাহ : অর্থাৎ প্রত্যক্ষভাবে গণরুম ব্যবস্থার জন্য যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়ী, গণরুম ব্যবস্থাই হলো আবার গেস্টরুম কালচারের জন্য দায়ী ?

জুলিয়াস সিজার তালুকদার : হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়ই।

জাননাহ : দীর্ঘ ২৮ বছর পর, ২০১৯ সালের ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছে ডাকসু নির্বাচন। নির্বাচনে আপনি এস এম হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন৷ ডাকসু এবং সকল হল সংসদের নবনির্বাচিত সকল নেতৃবৃন্দকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক গণভবনে বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হয়। কেমন ছিল তখনকার অনুভূতি?

জুলিয়াস সিজার তালুকদার : আমি যদি একজন নির্বাচন নেতা হিসেবে বলি, আমার অনুভূতিটা কেমন ছিল, তাহলে, আমি আসলে ঐ সংবর্ধনায় আশান্বিত হয়েছিলাম ;- যে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সমস্যা-সংকটগুলো আছে সেগুকো নিরসনে অবশ্যই আমরা একটি ভালো ফলাফল আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়ে যেতে পারবো। আর ঐ দলের একজন অনুসারী হিসেবে অর্থাৎ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দলের একজন কর্মী হিসেবে যদি বলেন, এটিকে আমি নিজের জন্য একটি সৌভাগ্য মনে করেছিলাম, যে এত কাছ থেকে তাঁকে আমরা দেখতে পাবো। আমাদের দুটি কথা শোনার, – সরাসরি বা আমাদেরও কিছু কথা বলার হয়তো সুযোগ হবে এবং প্রথমেই যেটা বললাম,  নির্বাচিত নেতা হিসেবে আমরা আমাদের আশাবাদ নিয়ে গিয়েছিলাম,সেক্ষেত্রে আমরা একদম বঞ্চিত হই নি

আমাদের হল সংসদের পক্ষ থেকে, আমাদের ভি পি যিনি আছেন, তাকে বক্তব্য দেওয়ার সু্যোগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি হল ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এস এম হলের আবাসনের যে দুরবস্থা এবং ভবনের যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান সেটি তার বক্তৃতায় তুলে ধরেছিলেন এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের সামনেই তাঁর নোট নিয়েছিলেন এবং নোট নেওয়ার পরে তিনি যখন বক্তৃতা করেছেন তখন তাঁর বক্তৃতায় এই ব্যাপারটিকে তিনি উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে, “এস এম হলের যে সমস্যার কথা আমি শুনলাম, সেটির সমাধানে আমি অবশ্যই মনোযোগ দেব এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নিয়ে পরবর্তী সময়ে যখন কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নেব তখন এস এম হল আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে একটি বিশেষ গুরুত্ব পাবে” এবং সেটির প্রতিক্রিয়ায় আমরা দেখেছি যে, তিনি তাঁর কথা রেখেছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় কে নিয়ে যে মাস্টারপ্লান হয়েছে সেই মাস্টারপ্লানে কিন্তু এস এম অন্তর্ভুক্ত হয়নি শুধুমাত্র তাঁর ইচ্ছায়। এস এম হল একটি হেরিটেজ একই সাথে এটি একটি ছাত্রাবাস। দুটিকেই একসাথে কীভাবে রক্ষা করা যায়, সেটা নিয়ে তিনি বিশেষ মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন বলে আমরা শুনেছি এবং মাস্টারপ্লানের মাধ্যমে অন্যান্য জায়গায় যে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠছে সেখানে শিক্ষার্থীদের সংকুলান হবে এবং আমাদের এখানে যদি এবছর থেকে শিক্ষার্থী বরাদ্দ দেওয়া না হয়, তারপরেও শিক্ষার্থীদের তেমন কোনো সমস্যা হবে না।

জাননাহ : শতবর্ষে পদার্পণ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইতোধ্যেই আপনি অনেক ধরনের সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন এবং অতীতের যে গৌরবজ্জল সময়টি ছিল সেটিকে ছাপিয়ে এখন যে সমস্যাগুলোই প্রধান হিসেবে দেখা যায় সেটিও বলেছেন। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যাটি কী বলে আপনার মনে হয় ?

মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : আমি সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা মনে করি, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ; এই সম্পর্কটি এখন ক্রান্তিতে আছে। একজন শিক্ষকের কাছে একজন শিক্ষার্থী, বর্তমান সময়ে, আচরণগত দিক থেকে যেটি হয়ে গিয়েছে সেটি হলো কাস্টমারের মতো। যে, তিনি একজন মনোপলি বিজনেসম্যানতার কাছে আমি কাস্টমার হিসেবে গিয়েছি, তিনি যে দর নির্ধারণ করবেন,সেই দরেই তার পণ্যটি আমাকে কিনতে হবে, আমি বাধ্য

কিন্তু ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে একটি অমলিন সম্পর্ক হিসেবে আমরা যেভাবে বিবেচনা করি, সেই অমলিন জায়গাতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটি আর নেই৷ এবং যেহেতু নেই, না থাকার কারণে ঐ সম্পর্কের অবনতির বাই-প্রোডাক্ট হচ্ছে আমাদের অনেক সংকট। আমি উদাহরণ হিসেবে যদি আপনাকে বলি, যে, একজন শিক্ষার্থী তার নিজ বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কর্তৃক কেন লাঞ্ছিত হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের যে পদ্ধতি সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটা বিভাগের প্রধান বা চেয়ারম্যান তো একজন শিক্ষক। তিনি নিশ্চয়ই তার শিক্ষার্থীদের প্রতি যথেষ্ট যত্নবান নন। তিনি যত্নবান নন বলেই তার অধীনস্থ একজন কর্মচারী, একজন শিক্ষার্থীর সাথে লাঞ্ছনামূলক আচরণ করার দুঃসাহস পায়।

জাননাহ : একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দল বিকল্প সরকারের ভূমিকা পালন করে। সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের গঠনমূলক সমালোচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে সহায়তা করে। ক্যাম্পাসে আজ ক্ষমতাসীল রাজনৈতিক দলের যে ছাত্র সংগঠন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, তা পূর্ণাঙ্গরূপে ক্রিয়াশীল। কিন্তু নেই তেমন কোনো বিরোধী দলীয় ছাত্র সংগঠনের কর্মসূচি। হলগুলোতে তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই বললেই চলে। সুষ্ঠু ছাত্র রাজনীতির বিকাশের ক্ষেত্রে, বিরোধী দলীয় ছাত্র সংগঠনগুলোর অনুপস্থিতির এই বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

মো:জুলিয়াস সিজার তালুকদার : আপনাকে ধন্যবাদ। এটি আপনি একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করেছেন। আমাদের দেশের যে গণতান্ত্রিক সংকট, শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, দেশের যে একটা পুরো গণতান্ত্রিক সংকট – আমরা যদি এটা নিয়ে গবেষণা করি বা আলোকপাত করি তাহলে সেখানেও আমরা একটি ভালো ধারণা পাবো যে, সংকটের কারণ কী?

আসলে গণতন্ত্র কে চর্চা করার জন্য প্রতিষ্ঠান দরকার। অর্থাৎ গণতন্ত্রের যদি আপনি প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা নিশ্চিত করতে না পারেন,তাহলে গণতন্ত্র কিন্তু তার যে সুন্দর ব্যাপারগুলো আছে,যেটা দিয়ে মানুষের জীবনকে সে সুন্দর করে – তখন সে ব্যর্থ হবে। কারণ, গণতন্ত্র কিন্তু আসলে একটা দর্শন৷ তো দর্শনের যদি আপনি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না দেন,তাহলে সেটি ব্যর্থ হবে

তো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে সেটির পিছনে প্রধান কারণ হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা না থাকা। মানে, আমি বলতে চাই, ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কতটুকু রাজনীতি করবে সেই স্পেসটুকু করে দেওয়ার দায়িত্ব কখনও ছাত্রলীগের নয়৷ আবার ছাত্রলীগ কতটুকু রাজনীতি করবে সেই সুযোগটুকু করে দেওয়ার দায়িত্বও কিন্তু ছাত্রদলের নয়। দল হিসেবে প্রত্যেক দলই চাবে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিরাজমান রাখতে। এটি হচ্ছে প্রত্যেক দলেরই একটি প্রবণতা৷ যেকোনো রাষ্ট্রই কিন্তু চায় বিশ্বব্যাপী তার একটা একচ্ছত্র  আধিপত্য বিস্তার করতে, বিশেষ করে সুপার পাওয়ারগুলো। কিন্তু সেটি হতে পারে না কখনও, একটি দল কখনও মনোপলি করতে পারে না ৷

তাহলে কখন একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে পারে না ?  যখন গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার মধ্যে যদি আমরা নিয়ে আসতে পারি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে, তাহলে, গণতন্ত্রের এই প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা শুরু হলে আমার মনে হয়, সকল বৈধ রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনই সমানভাবে ক্রিয়াশীল হতে পারবে এবং তারা তাদের নেতৃত্বের যোগ্যতা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের অবস্থান তৈরি করতে পারবে

জাননাহ : আপনি বলছেন, গণতান্ত্রিক যে পরিবেশ, সেটি অনুপস্থিত। কিন্তু বিভিন্ন বিরোধী দলীয় যে ছাত্র সংগঠনগুলো রয়েছে তারা বরাবরের মতো দাবি করে আসছে, তারা যে কর্মসূচি পালন করতে পারছে না, তারা যে হলে অবস্থান করতে পারছে না, এর পিছনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন,  ছাত্রলীগই দায়ী। এ ব্যাপারে আপনার কী বক্তব্য?

মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : এটা তো দৃশ্যমান সত্য । সত্য-মিথ্যার প্রশ্নে যদি আমরা আসি তাহলে তাদের অভিযোগটি সত্য। একই সাথে আমরা যদি বলি যে সমাধান কী? সমাধান এটা না যে, ছাত্রলীগ কে দোষারোপ করা। সমাধান হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা শুরু করা। প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির চর্চা শুরু হলে আর এই দোষারোপ করতে হবে না, তারা তাদের জায়গাটি করে নিতে পারবেন

তারা যে অভিযোগটি করছেন, অভিযোগটি আসলে কার কাছে করছেন ? মানে এই অভিযোগ – যদি আপনি ছাত্রলীগ দ্বারা বিতাড়িত হয়ে থাকেন, ছাত্রলীগের কাছে অভিযোগ করতে পারেন না। আবার প্রশাসনের কাছে যদি করেন তাহলে আপনার রাজনীতি টিকিয়ে রাখার দায়িত্বও প্রশাসনের না।

আপনার রাজনৈতিক কৌশল যদি মধুময় হয়,মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, সেটি তো আপনাকে উপস্থাপনের সুযোগ দিতে হবে৷ অন্যদিকে ছাত্রলীগ যদি বেশি শিক্ষার্থীবান্ধব হয়, তাহলে তারা যেটা দাবি করবে সেই দাবিকে প্রমাণ করারও কিন্তু একটা সুযোগ দিতে হবে৷ তো,যখন আপনি তাদেরকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার মধ্যে দাঁড় করাবেন তখন আসলে বোঝা যাবে কে কতটুকু প্রগ্রেস করলো। অর্থাৎ সমস্যার কারণ যেই হোক না কেন, আওয়ামী লীগের আমলে ছাত্রলীগ হোক না কেন,বিএনপির আমলে ছাত্রদল হোক না কেন, এই সমস্যার সমাধান একটা জায়গাতে আছে৷ সেটা শেখ হাসিনার কাছেও না খালেদা জিয়ার কাছেও না৷ সেটা হচ্ছে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে

শীঘ্রই প্রকাশ করা হবে এই সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় অংশ টি। চোখ রাখুন বিডি সমাচারের পাতায়।

Please Share This Post in Your Social Media


উই আর পলিটিক্যাল ক্রিমিনালস

Update Time : ০৭:১৫:২২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর ২০২১

একটি তাৎপর্যপূর্ণ সময় অতিবাহিত করছে বাঙালি জাতি। এ বছর, বাংলাদেশ যখন পদার্পণ করলো স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে, ঠিক তখনই এ দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ, ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পৌঁছে গিয়েছে তার শততম বর্ষে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী তার সাথে যুক্ত করেছে বাড়তি মাত্রা। তবে এই আনন্দের সময়ের চ্যালেঞ্জও কম নয়। করোনা মহামারীতে একদিকে ভেঙ্গে পড়েছে দুর্বল অর্থ ব্যবস্থা, অন্যদিকে ধর্মের নামে দেখা গেছে কতিপয় নরপিশাচের ঘৃণ্য নিষ্ঠুরতা। শতবর্ষের গৌরবকে ম্লান করতে অন্য সকল বছরের চেয়ে অবনতি দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং -এও ৷ করোনার প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে দীর্ঘ প্রায় ১৮ মাস পর আবারও শুরু হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কার্যক্রম। এই দোদুদ্যমানতার অধীর সময়ে বাংলাদেশের ‘সেকেন্ড পার্লামেন্ট’ হিসেবে পরিচিত ডাকসু এবং হল সংসদের নেতৃবৃন্দের চিন্তা-ভাবনাকে জানতে এবং তা জনসাধারণের কাছে তুলে ধরতে বিডি সমাচার আয়োজন করেছে নিয়মিত সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান, –  “কী ভাবছেন তাঁরা ?”

এ পর্বে অতিথি হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হল ছাত্র সংসদের (সাবেক) সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার । সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, মুহাম্মদ ইমাম-উল-জাননাহ 

সাক্ষাৎকরের প্রথম অংশটি প্রকাশিত হলো এবার। শীঘ্রই প্রকাশ করা হবে দ্বিতীয় অংশটিও। বিডি সমাচারের সাথেই থাকুন।

জাননাহ : হাজারো স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসে নবীন শিক্ষার্থীরা। যখন জানতে পারলেন আপনি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, কেমন অনুভূতি হয়েছিল ?

মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : আসলে যে কোনো সফলতাই মানুষকে কিন্তু ভেতর থেকে আন্দোলিত করে। যেহেতু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যে প্রক্রিয়া সে প্রক্রিয়াটি আসলে যুদ্ধের ন্যায়। আমরা যোদ্ধা হিসেবেই আসলে একটা অংশগ্রহণ করেছিলাম। অনেকজনকে পিছনে ফেলে একটি সিট আমরা নিজের করে নিতে পেরেছি, সেটি অবশ্যই অনাবিল আনন্দের ছিল৷ আর আমার বাবা যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন, সেহেতু বাবার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক গল্পই শুনেছি। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার যে প্রবল আকাঙ্ক্ষা এটি আমারও স্বপ্ন, আমার পরিবারের ও স্বপ্ন ছিল৷ যেহেতু দুটি স্বপ্নেরই জয় হয়েছে, সেই হিসেবে বলতে পারেন, যে আনন্দ আমার ভিতরে প্রবাহিত হয়েছিল,সে আনন্দ প্রবাহিত হয়েছিল আমার পরিবারের মধ্যেও। অর্থাৎ এটি একটি সামগ্রিক অর্জন বলতে পারেন,আমার এবং আমার পরিবারের জন্য।

জাননাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কে নিয়ে পূর্ব যে ধারণা আপনার মধ্যে ছিল,যে স্বপ্ন ছিল, যে ধরনের পরিবেশ আশা করেছিলেন, এখানে ভর্তির পরে সেই পূর্ব ধারণার কোনো পরিবর্তন হয়েছিল কী?

মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কে নিয়ে অতীতে কী ধরনের প্রচারণা ছিল, সে বিষয়ে আমিও অনেকের কাছ থেকে শুনেছি। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কে নিয়ে সম্যক যে ধারণা টা আমি আমার বাবার কাছ থেকে পেয়েছি, সে ধারণা টা আসলে অনেকটা প্রচলিত ধারণা আর আমাদের যে জীবন বাস্তবতা- এখন বর্তমান সময়ে তার একটা মিশ্র রূপ। কিন্তু আমি যখন আমার বাবার কাছে গল্প শুনতাম, সেই গল্পে কখনও আমাদের ক্যাম্পাসের সমস্যাগুলো প্রধান হয়ে উঠতো না৷ কিন্তু আজকে যখন আমি আমার পরবর্তী প্রজন্মের সাথে কথা বলতে যাবো- আমার বিশ্ববিদ্যালয় কে নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই, আমার সমস্যাগুলোই প্রধান

আমি বলতে চাচ্ছি, আমার বাবা যখন সত্তরের বা আশির দশকের যে বিশ্ববিদ্যালয় সেটি নিয়ে আমার কাছে গর্ব করতেন,সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সমস্যা বা সংকট ছিল না বিষয়টা কিন্তু সেরকম নয়। তখন রাজনৈতিক সংকট ছিল, তখনও বাজেট সমস্যা ছিল তখনও দ্বন্দ্ব ছিল, কলহ ছিল এবং পরিশেষে নানা রকম অপসংস্কৃতির যে চর্চা-আমরা যেটিকে বলছি, সেটির চর্চাও কিন্তু ছিল। কিন্তু এগুলো কখনও প্রধান হয়ে উঠেনি। কিন্তু আজকে সেই চর্চাই প্রধান হয়ে উঠেছে, যেটি আসলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে গর্ব করে বলার মতো কিছু নয়।

আর দ্বিতীয়ত আমি যেটি বলবো, আমি আমার বাবার কাছে যে গল্প শুনেছি, সে গল্পের মধ্যে অনেক সময়ই প্রধান হয়ে উঠতো তাদের অনেক শিক্ষকের নাম। সেই শিক্ষকেরা ঐতিহাসিকভাবে কোনো কিংবদন্তি তুল্য শিক্ষক না, তাঁরা আসলে সাধারণ শিক্ষকই ছিলেন৷ কিন্তু তারপরেও তাঁরা সারা জাতির জন্য একজন বুদ্ধিজীবী হয়ে উঠতে না পারলেও একজন শিক্ষার্থীর কাছে তাঁরা একজন অনুকরণীয় ব্যাক্তিত্ব হয়তো হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তাঁরা একটি শ্রদ্ধাভাজন পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। তো, আমাদের সমাজে বা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন যে সেরকম কিংবদন্তি শিক্ষক দু’ একজন নেই তা আমি বলব না, আছেন,  কিন্তু যেসব শিক্ষকেরা সাধারণের তালিকায় আছেন, সেসব শিক্ষকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যতটুকু মর্যাদা পেতেন, আজকে, নির্মোহ দৃষ্টিতে যদি আমরা দেখি,- প্রবাহিত না হয়ে, তাহলে আমরা দেখবো যে আজকের এই সাধারণ শিক্ষকদের কে শ্রদ্ধা করার, অনুকরণীয় করার কিছু নেই। এটি হচ্ছে একটি বড় সমস্যা।

অর্থাৎ সাধারণ যারা ছিলেন, যাদের নাম ইতিহাসে লেখা হয় নাই,  যাদের নাম বাংলাদেশের মানুষ জানে নাই, ঐ মানুষটাও তাঁর শিক্ষার্থীর কাছে একজন নায়ক ছিলেন। কিন্তু আজকে যিনি সাধারণ তিনি জাতির কাছে, সমাজের কাছে সাধারণ তো বটেই, তিনি তার শিক্ষার্থীর কাছেও একজন সাধারণ শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তার যে গুরুত্ব সেই গুরুত্বটা শিক্ষার্থীরা এখন আর  অনুভব করে না।

জাননাহ : শিক্ষকদের মূল্যায়নটা যে আগের মতো হচ্ছে না, মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এই যে নিন্মগামিতা, এর পিছনে কী কারণ রয়েছে বলে আপনার মনে হয় ?

মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : এর পেছনে অনেক কারণের কথাই কিন্তু আমাদের শিক্ষকমণ্ডলী বা আমাদের অন্যান্য বুদ্ধিজীবীরা ;- সেই আমলের বুদ্ধিজীবীরা কিন্তু এই আমলের শিক্ষকদের মূল্যায়ন করতে গিয়ে নানান রকম কথাই বলেন। কিন্তু আমি যে কারণটা দেখি, যে, এরকম হওয়ার পেছনের মূল কারণ কী, আমার মনে হয় মূল কারণটা হচ্ছে, তাদের ব্যাক্তিগত জীবনের যে উদ্দেশ্য, সেটি। একজন শিক্ষক চাচ্ছেন না যথার্থ শিক্ষক হতে। তিনি বরং উৎসাহী হয়ে উঠছেন বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে যেতে। অর্থাৎ একজন শিক্ষকের প্রধান উদ্দেশ্য এখন আর একজন ভালো শিক্ষক হয়ে ওঠা নয়, একজন নন্দিত শিক্ষক হয়ে ওঠা নয়৷ কিংবা তার যে প্রধান কাজ -পাঠদান, সেই পাঠদানের ক্ষেত্রেও গুরুত্ব দেওয়া নয়। তিনি সবসময় মনোযোগ দিচ্ছেন, যে কী করে তিনি একটি বিভাগের চেয়ারম্যান হবেন, কী করে তিনি একটি হলের প্রভোস্ট হবেন,কীভাবে একটি হাউজ টিউটর হবেন বা তিনি কীভাবে আরও বড় কোনো প্রশাসনিক পদ গ্রহণ করে মর্যাদা লাভ করবেন। অর্থাৎ তারা তাদের শিক্ষক হিসেবে মর্যাদাটা শিক্ষকতার মধ্যে খুঁজছেন না, প্রশাসনিক পদের মধ্যে খুঁজছেন

আপনি একটি পেশায় থাকেন, আপনি নিজেই যদি নিজের পেশাকে সম্মান না করেন, অন্যের কাছ থেকে আপনি কীভাবে সম্মান আশা করেন ?

আমার বাবার কাছে আম শুনেছি যে তাদের সময়ে যারা বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে,গুরুত্বপূর্ণ পদে আসতেন, তাঁরাও একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আসতেন। তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি ছিল। কিন্তু সেটাকে রাজনীতিই বলা যায়, সেটাকে লেজুড়বৃত্তি বলা যায় না এবং তখন এই প্রভোস্ট হওয়া, এই চেয়ারম্যান হওয়া নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্বটাও ছিল। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে আজকে যে দ্বন্দ্ব হচ্ছে, আমি শুনেছি তখনও এই শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দ্বন্দ্ব বা অন্যান্য সমস্যা যেগুলো আমরা দেখতে পাই,সেগুলো হতো। কিন্তু সেই দ্বন্দ্বের মধ্যেও শিক্ষক হিসেবে পাঠদানে যে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, সেটিতে তাদের কমতি হতো না। অর্থাৎ একজন শিক্ষক তার নিজের রাজনীতি করতে গিয়ে কখনও ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতেন না। একজন শিক্ষকের সাথে তার প্রতিপক্ষের যে দ্বন্দ্ব, সেই দ্বন্দ্বের প্রতিক্রিয়া তার শিক্ষার্থীর উপরে পড়তো না,যেটি এখন ঘোরতরভাবে পড়ছে

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা শুধুমাত্র পাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, আমি মনে করি এটা হওয়া উচিত গুরুমুখী। আপনি যে বিষয়েই পড়েন না কেন, সেই বিষয়ে একজন শিক্ষককে আপনি গুরু মনে করতে পারেন, যার কাছ থেকে আপনি সার্বিকভাবে দীক্ষা গ্রহণ করবেন।  কিন্তু আপনি যদি বিশেষ কারও অনুসারী হন, তাহলে আপনি কীভাবে লাঞ্ছিত হবেন, আপনি দেখেন ;- প্রথমত আপনার অন্যান্য বন্ধুরা বলবে, যে, আমার অমুক বন্ধুটি তো আজকে লেজুড়বৃত্তি করা শুরু করেছে এবং ঐ শিক্ষকের যিনি প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবেন, তিনি দেখবেন, – যদি একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে চলে আসেন, তখন আপনার শিক্ষাজীবন এবং শিক্ষা পরবর্তী সময়ে, অন্যান্য কর্মসংস্থানের বিষয়ে দেখবেন এটি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করবে। এটাকে আমি মনে করি নোংরামি। রাজনীতি তারা করবেন,তারা দ্বন্দ্ব করবেন,এটা নোংরামি না; কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ায় তিনি তারই একজন শিক্ষার্থীকে লাঞ্ছিত করবেন – একটা ভাবে, তখন আমি মনে করি এটা অপরাজনীতি। ভালো শিক্ষক হয়ে ওঠার পথে এটা একটি বড় অন্তরায়।

জাননাহ : অর্থাৎ শিক্ষকদের যে অবমূল্যায়ন টা বর্তমানে হচ্ছে, তার জন্য বহুলাংশে তারা নিজেরাই   দায়ী  ?

মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : আমি মনে করি।

জাননাহ : একজন নবীন শিক্ষার্থী যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তার আবাসস্থল হয় (বিশেষত ছেলেদের ক্ষেত্রে)একটি হলের গণরুম, যেটি তার কাছে একটি দুঃস্বপ্নের মতো দেখা দেয়৷ এস এম হলের পরিস্থিতিটি কী? এখানেও কী নবীন শিক্ষার্থীদের গণরুমে উঠতে হয়?

মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : এস এম হলের কথা যদি আপনি বলেন, তাহলে সেটি আসলে আরও করুণ । নিঃসন্দেহে অত্যন্ত মানবেতর জীবনের কথা উঠে আসবে, গণরুমের কথা আসলে। আর এস এম হলের অবস্থা ছিল আরও খারাপ৷ গণরুমে যেতেই আপনাকে থার্ড ইয়ারে উঠতে হতো। অর্থাৎ তৃতীয় বর্ষে উঠলে আপনি গণরুমে যাবেন। তার পূর্বে দুটি বছর থাকতে হতো বারান্দায়

আপনি একটি ভবনের বারান্দায় বাস করেন,তার মানে আপনি একজন উদ্বাস্তু। উদ্বাস্তু কে?  যার কোনো ঠিকানা নাই। আপনি রাস্তায় থাকলে কিন্তু কোনো ঠিকানা লেখতে পারবেন না৷ আপনি কোনো হলের গণরুমেও যদি থাকেন, সেই রুমের একটা নাম্বার থাকে। আপনি নিজের পরিচয়পত্রে লিখতে পারবেন, বা অন্য কাউকে বলতে পারবেন, আমি অমুক রুমের বাসিন্দা৷ বারান্দায় থাকলে কিন্তু আপনি সেটি লিখতে পারেন না৷ তার মানে আপনি উদ্বাস্তু। দুটি বছর উদ্বাস্তু হিসেবে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়

আমি নিজে ব্যাক্তিগত জীবনের কথা বলি,আমি এখানে প্রায় সোয়া দুই বছর বারান্দায় কাটিয়েছি। সোয়া দুই বছর পরে আমি একটি গণরুমে উঠেছি; যেটি ডাবল রুম,মানে দু’জনের রুম। সেখানে আমাদের আটজনকে রুম দেওয়া হয়েছিল৷ (২০১৭ সালের প্রথম দিকে,মার্চ বা এপ্রিলের সময়) তৃতীয় বর্ষে যখন আমি উঠেছি, তখন আমি একটি গণরুমে উঠি, আমার বন্ধুদের সাথে এবং এই হলের সবচেয়ে খারাপ রুম যে রুম কোনো আলো-বাতাস প্রবেশ করে না। মাত্র একটি জানালা আছে, যেটি খোলা যায় না। তো দুইজন থাকার জন্য যে রুম প্রস্তুত হয়েছে সেখানে আমরা আটজন উঠেছি। পরে একজন এই অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য চলে গিয়েছেন রুম থেকে। তারপর আমরা সাতজন দীর্ঘ সময় সেই রুমে ছিলাম এবং ঐ রুমে থেকে আমি হল ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হয়েছি। ঐ রুমে থেকেই আমি এস এম হল ছাত্র সংসদের জি এস নির্বাচিত হয়েছি এবং ঐ রুমে থেকেই আমি আমার মেয়াদকাল পার করেছি

অর্থাৎ জি এস হিসেবে আমি আমার শিক্ষার্থীদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে, আমাদের বারান্দা প্রথার যে প্রচলনটি আছে, সেই বারান্দা প্রথাকে আমি বিদায় জানাবো এবং মানুষ অঞ্চলপ্রীতি বা দল-মত নির্বিশেষে আমাকে ভোট দিয়েছে৷ আমি ভিন্ন মতাদর্শের লোকের থেকেও ভোট পেয়েছি,এটা আমি অহংকার করেই বলি৷

কিন্তু যেহেতু আমি আমার এই একটি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি, সেজন্য আমি নিজেও যে গণরুমে ছিলাম, আমার মেয়াদকালে সেই গণরুম ছেড়ে যাই নি, গণরুমেই থেকেছি।

জাননাহ : সম্প্রতি এস এম হলের বারান্দায় ফাটল দেখা দেওয়ায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরবর্তী সময়ে প্রথম বর্ষের নবীন শিক্ষার্থীদেরকে এই হল বরাদ্দ দেওয়া বন্ধ থাকবে৷ এই সিদ্ধান্ত কী হলের বারান্দা ব্যবস্থা বা গণরুম ব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন?

মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : এই সিদ্ধান্তটি নেওয়ার জন্য, আমরা, ছাত্র সংসদ যখন ছিল তখনই আবেদন জানিয়েছি, অফিয়াসিয়ালি আবেদন জানিয়েছি৷ তখন অবশ্য ফাটল দেখা দেয় নি, কিন্তু বারান্দায় যেহেতু শিক্ষার্থীরা ছিলেন, তাদের এই মানবেতর জীবনযাপনের কথা উল্লেখ করে আমরা আবেদন করেছিলাম। সেই আবেদনের ভিত্তিতে পরের বছর যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, অর্থাৎ এখন যারা দ্বিতীয় বর্ষে আছেন(২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ), এই শিক্ষার্থীদের এলটমেন্ট অর্ধেক করা হয়,অনেক কমানো হয়। কমানোর পরেও তো সমস্যা পুরোপুরি সমাধান হয় নি৷ তারপরে এখন ফাটল দেখা দিয়েছে এবং আগেরবারের আবেদনের যে ধারাবাহিকতা সেই ধারাবাহিকতাকে বিবেচনায় নিয়ে এই হলে শিক্ষার্থী বরাদ্দ দেওয়া বন্ধ করেছে প্রশাসন৷

কিন্তু আমি মনে করি এই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তই যথেষ্ট নয়৷ এখানে আমরা যারা শিক্ষার্থীরা থাকি, বিশেষকরে এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমরা যারা রাজনীতি করি, আমাদের যে প্রতিশ্রুতি- রাজনীতির প্রতি বলেন বা মানুষের প্রতিই বলেন, সেই প্রতিশ্রুতির জায়গায় যদি আমরা দৃঢ় না হই,তাহলে এখানে শুধু শিক্ষার্থী বরাদ্দ দেওয়া বন্ধ করে, এই বারান্দা ব্যবস্থা বা গণরুম ব্যবস্থা কে বিদায় জানানো সম্ভব না৷

আমাদের এখানে অনেক ব্যাক্তি আছেন, যিনি সাধারণ শিক্ষার্থীর মতো করে থাকেন না, আপনি সেখানে গেলে দেখবেন যে,  তারা যেভাবে থাকেন, ঐভাবে না থেকে একটু কম্প্রোমাইজ করলে ঐখানে আরও দুইজন-তিনজন শিক্ষার্থী থাকতে পারে। এই যে অনুশীলন, এই যে চর্চা, যে, “আমি নেতা মানুষ, আমি এক রুমে একা থাকবো, এ রুম আমার হবে”,এই চর্চা গুলো যদি চলতে থাকে, তাহলে আপনি দেখবেন, বরাদ্দ না দেওয়া হলে শুধু সাধারণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমবে,নেতার সংখ্যা তো কমছে না। আর নেতারা যদি এই ধরনের মানসিকতাকে ধারণ করতেই থাকেন, তাহলে তো নেতাদের সংকুলান হতে হতেই সব রুম শেষ হয়ে যাবে ; আপনি শিক্ষার্থীদের সিট দিতে পারবেন না৷ তো এই সমস্যার যদি দ্রুত সমাধান আমরা চাই,তাহলে আমাদের প্রথমে যেটা করতে হবে,যে, আমাদেরকেও এই প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত কে স্বাগত জানিয়ে বারান্দা প্রথাকে বা গণরুম প্রথাকে বিদায় দেওয়ার যে অঙ্গীকার, সেটি করতে হবে৷

জাননাহ : প্রথম বর্ষে বিভিন্ন হলে থাকা গণরুমের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তাদেরকে গণরুমে থাকার জন্যে হলেও ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের কোনো না কোনো রাজনৈতিক গ্রুপে বাধ্যতামূলকভাবে যোগ দিতে হয়৷ তাদের এ অভিযোগ কতটা সত্য ?

মোঃ জুলিয়াস সিজার তালুকদার : তাদের অভিযোগ শতভাগ সত্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যে রাজনৈতিক চর্চার মধ্যে আছি, আমি নিজেকেও বাদ দিয়ে বলছি না, আমিও সেই চর্চার মধ্যে এসে জয়েন করেছি এবং সেই চর্চাকারীদের মধ্যে হয়তো বা আমার নিজের নামও আপনি যুক্ত করতে পারবেন। কিন্তু আমি মনে করি যেকোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী অধিকারকে কুক্ষিগত করে রাজনৈতিক চর্চা চালানো – এটি একটি রাজনৈতিক অপরাধ৷ ইটস এ পলিটিক্যাল ক্রাইম। সেই হিসেবে আমি এবং আমার অন্যান্য কলিগ যারা আছে ;- উই আর পলিটিক্যাল ক্রিমিনালস

আপনি নেতা হিসেবে অক্ষম হতে পারেন, আপনার নেতৃত্বের যে গুণাবলি সেটি অন্যের থেকে কম থাকতে পারে,কিন্তু সেটি কোনো অপরাধ নয়৷ সেটি আপনার সীমাবদ্ধতা। কিন্তু আপনি চলমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের জন্য আইনগতভাবে বৈধ একটি সুযোগ কে যখন নিজে কুক্ষিগত করে তারপর তাকে আপনি আপনার উদ্দেশ্য কায়েম করার জন্য ব্যবহার করবেন,তখন সেটি অপরাধ। আমি এটাকে রাজনৈতিক অপরাধ মনে করি এবং সেই অপরাধে আমিও কিছুটা অপরাধী। আমি প্রথমে ভিক্টিম হয়েছি, পরে অপরাধী হয়েছি৷ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় সেটির যদি চর্চা হয় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও এর থেকে ভালো চর্চা যে আমরা পাবো না, এটা আমরা না শুধু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়েন না, তারাও মনে করেন৷

জাননাহ : এটি আসলে দীর্ঘদিনের ট্রাডিশনে পরিণত হয়েছে,যেটি থেকে মুক্ত হওয়া আসলেই খুব কঠিন৷ তবে, বিভিন্ন হলের সিনিয়র নেতারা মতামত প্রকাশ করেছেন যে, “এই গণরুম ব্যবস্থার পিছনে আমরা যে বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন কে দায়ী করে থাকি, আসলে তা নয় বরং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই দায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানে কতজন শিক্ষার্থীকে তারা যথাযথ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পড়াতে পারবে, তারপরও তারা অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করাচ্ছে”। গণরুম ব্যবস্থার ব্যাপারে আমরা যদি তাদের সাথে একমত হয়েও যাই, হল গুলোতে যে গেস্টরুম কালচার চালু রয়েছে এর পিছনেও কী তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই দায়ী?

জুলিয়াস সিজার তালুকদার : আমি তো বললাম, যখন একটা হোল সিস্টেমই একটা করাপ্ট সিস্টেম, পুরো ব্যবস্থাই যখন দুর্নীতিগ্রস্থ তখন আসলে বিশেষভাবে একটি দুটি বিষয়কে নিয়ে বলার কিছু নাই। হোল সিস্টেম ইস করাপ্ট। তাহলে প্রশাসনও এই সংকট তৈরি করার জন্য নিজেদের অক্ষমতাকে তুলে ধরেছে – যে আমরা অক্ষম, সেকারণে আমরা সুযোগটা নিতে পেরেছি।

অন্যদিকে গেস্টরুম কালচারের যে কথা আপনি বলছেন, সেই কালচারের কথা যদি আমরা বলি, তাহলে, এই কালচারটিও প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার্থীদের বিকাশে একটি বাধা। আপনি-আমি হয়তো মনে করি যে এখানে শিক্ষার্থীদের বিকাশ হচ্ছে। হ্যাঁ, একটি ব্যাচের সাথে আরবকটি ব্যাচের যে পারস্পরিক যোগাযোগ সেটির মাধ্যমে অবশ্যই শিক্ষার্থীর বিকাশ হয়।  কিন্তু আমরা যেটাকে গেস্টরুম কালচারে পরিণত করেছি সেটার মাধ্যমে ঐ উদ্দেশ্যেটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কারণ আমি আমার সিনিয়রের কাছ থেকে কী ভাষায় কথাগুলো শুনছি, তারা আমার উপরে কী শব্দগুলো প্রয়োগ করছেন এবং কী উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করছেন – আমি তো জানি যে, আগামীকালকে উনার সাথে থাকার জন্য উনি আজকে আমাকে এই কথাগুলো বলছেন। অর্থাৎ আমাকে এখানে একটা প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, যে প্রশিক্ষণের মাধ্য দিয়ে আমি দুইটা জিনিস শিখছি, সেটা হচ্ছে যে – আগামীকাল থেকে আপনার সাথে আমাকে থাকতে হবে আর দুই যদি আমি না থাকি তাহলে আমার দণ্ডটা কী হবে

তো একজন মানুষকে আপনি যদি প্রতিদিন এই প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসেন, তার তো কোনো বিকাশ হবে না। এবং যখন এই কালচারটি ছিল না,তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর আজকে যে আমরা বলছি, আমরা অনেক বিকাশ করছি শিক্ষার্থীদের, আজকের এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যে তফাতটুকু আছে, সেই তফাতটুকু কে মাপলেই আমরা বুঝতে পারবো আসলে এটা কী কোনো কার্যকর পদ্ধতি না কি অকার্যকর পদ্ধতি৷

জাননাহ : তবে আমি আপনাকে যে প্রশ্নটি করেছি আসলে, আমি বলেছি, গণরুম ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার পিছনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কে দায়ী করা হচ্ছে, গেস্টরুম কালচারকে টিকিয়ে রাখার জন্যও কী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়ী ?

জুলিয়াস সিজার তালুকদার : সেটাই বললাম, যেহেতু দি হোল সিস্টেম ইজ করাপ্ট ;যেমন আমি একজন শিক্ষার্থী, আমি যদি কোথাও লাঞ্ছিত হই,ধরে নিন যে,আমি আমার হলে কোনো একজন শিক্ষার্থীর দ্বারা খুবই সামান্য লাঞ্ছিত হলাম, বা সে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে খেতেই বাধ্য করছে,- আপনি তো আমাকে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে খেতেও বাধ্য করতে পারেন না ; অন্যান্য বিষয় তো অনেক দূরেই রাখলাম, তো এরকম যদি কেউ করে সেটা থেকে আমাকে রক্ষা করার দায়িত্ব তো প্রশাসনের। আর প্রশাসন তো এই জায়গাতে ব্যর্থ হয়েছে। তো তাদের ব্যর্থতার ফলাফলই আজকের যত অপসংস্কৃতি আছে সেগুলির জন্য দায়ী।

জাননাহ : অর্থাৎ প্রত্যক্ষভাবে গণরুম ব্যবস্থার জন্য যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়ী, গণরুম ব্যবস্থাই হলো আবার গেস্টরুম কালচারের জন্য দায়ী ?

জুলিয়াস সিজার তালুকদার : হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়ই।

জাননাহ : দীর্ঘ ২৮ বছর পর, ২০১৯ সালের ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছে ডাকসু নির্বাচন। নির্বাচনে আপনি এস এম হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন৷ ডাকসু এবং সকল হল সংসদের নবনির্বাচিত সকল নেতৃবৃন্দকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক গণভবনে বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হয়। কেমন ছিল তখনকার অনুভূতি?

জুলিয়াস সিজার তালুকদার : আমি যদি একজন নির্বাচন নেতা হিসেবে বলি, আমার অনুভূতিটা কেমন ছিল, তাহলে, আমি আসলে ঐ সংবর্ধনায় আশান্বিত হয়েছিলাম ;- যে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সমস্যা-সংকটগুলো আছে সেগুকো নিরসনে অবশ্যই আমরা একটি ভালো ফলাফল আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়ে যেতে পারবো। আর ঐ দলের একজন অনুসারী হিসেবে অর্থাৎ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দলের একজন কর্মী হিসেবে যদি বলেন, এটিকে আমি নিজের জন্য একটি সৌভাগ্য মনে করেছিলাম, যে এত কাছ থেকে তাঁকে আমরা দেখতে পাবো। আমাদের দুটি কথা শোনার, – সরাসরি বা আমাদেরও কিছু কথা বলার হয়তো সুযোগ হবে এবং প্রথমেই যেটা বললাম,  নির্বাচিত নেতা হিসেবে আমরা আমাদের আশাবাদ নিয়ে গিয়েছিলাম,সেক্ষেত্রে আমরা একদম বঞ্চিত হই নি

আমাদের হল সংসদের পক্ষ থেকে, আমাদের ভি পি যিনি আছেন, তাকে বক্তব্য দেওয়ার সু্যোগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি হল ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এস এম হলের আবাসনের যে দুরবস্থা এবং ভবনের যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান সেটি তার বক্তৃতায় তুলে ধরেছিলেন এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের সামনেই তাঁর নোট নিয়েছিলেন এবং নোট নেওয়ার পরে তিনি যখন বক্তৃতা করেছেন তখন তাঁর বক্তৃতায় এই ব্যাপারটিকে তিনি উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে, “এস এম হলের যে সমস্যার কথা আমি শুনলাম, সেটির সমাধানে আমি অবশ্যই মনোযোগ দেব এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নিয়ে পরবর্তী সময়ে যখন কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নেব তখন এস এম হল আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে একটি বিশেষ গুরুত্ব পাবে” এবং সেটির প্রতিক্রিয়ায় আমরা দেখেছি যে, তিনি তাঁর কথা রেখেছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় কে নিয়ে যে মাস্টারপ্লান হয়েছে সেই মাস্টারপ্লানে কিন্তু এস এম অন্তর্ভুক্ত হয়নি শুধুমাত্র তাঁর ইচ্ছায়। এস এম হল একটি হেরিটেজ একই সাথে এটি একটি ছাত্রাবাস। দুটিকেই একসাথে কীভাবে রক্ষা করা যায়, সেটা নিয়ে তিনি বিশেষ মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন বলে আমরা শুনেছি এবং মাস্টারপ্লানের মাধ্যমে অন্যান্য জায়গায় যে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠছে সেখানে শিক্ষার্থীদের সংকুলান হবে এবং আমাদের এখানে যদি এবছর থেকে শিক্ষার্থী বরাদ্দ দেওয়া না হয়, তারপরেও শিক্ষার্থীদের তেমন কোনো সমস্যা হবে না।

জাননাহ : শতবর্ষে পদার্পণ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইতোধ্যেই আপনি অনেক ধরনের সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন এবং অতীতের যে গৌরবজ্জল সময়টি ছিল সেটিকে ছাপিয়ে এখন যে সমস্যাগুলোই প্রধান হিসেবে দেখা যায় সেটিও বলেছেন। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যাটি কী বলে আপনার মনে হয় ?

মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : আমি সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা মনে করি, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ; এই সম্পর্কটি এখন ক্রান্তিতে আছে। একজন শিক্ষকের কাছে একজন শিক্ষার্থী, বর্তমান সময়ে, আচরণগত দিক থেকে যেটি হয়ে গিয়েছে সেটি হলো কাস্টমারের মতো। যে, তিনি একজন মনোপলি বিজনেসম্যানতার কাছে আমি কাস্টমার হিসেবে গিয়েছি, তিনি যে দর নির্ধারণ করবেন,সেই দরেই তার পণ্যটি আমাকে কিনতে হবে, আমি বাধ্য

কিন্তু ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে একটি অমলিন সম্পর্ক হিসেবে আমরা যেভাবে বিবেচনা করি, সেই অমলিন জায়গাতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটি আর নেই৷ এবং যেহেতু নেই, না থাকার কারণে ঐ সম্পর্কের অবনতির বাই-প্রোডাক্ট হচ্ছে আমাদের অনেক সংকট। আমি উদাহরণ হিসেবে যদি আপনাকে বলি, যে, একজন শিক্ষার্থী তার নিজ বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কর্তৃক কেন লাঞ্ছিত হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের যে পদ্ধতি সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটা বিভাগের প্রধান বা চেয়ারম্যান তো একজন শিক্ষক। তিনি নিশ্চয়ই তার শিক্ষার্থীদের প্রতি যথেষ্ট যত্নবান নন। তিনি যত্নবান নন বলেই তার অধীনস্থ একজন কর্মচারী, একজন শিক্ষার্থীর সাথে লাঞ্ছনামূলক আচরণ করার দুঃসাহস পায়।

জাননাহ : একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দল বিকল্প সরকারের ভূমিকা পালন করে। সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের গঠনমূলক সমালোচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে সহায়তা করে। ক্যাম্পাসে আজ ক্ষমতাসীল রাজনৈতিক দলের যে ছাত্র সংগঠন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, তা পূর্ণাঙ্গরূপে ক্রিয়াশীল। কিন্তু নেই তেমন কোনো বিরোধী দলীয় ছাত্র সংগঠনের কর্মসূচি। হলগুলোতে তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই বললেই চলে। সুষ্ঠু ছাত্র রাজনীতির বিকাশের ক্ষেত্রে, বিরোধী দলীয় ছাত্র সংগঠনগুলোর অনুপস্থিতির এই বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

মো:জুলিয়াস সিজার তালুকদার : আপনাকে ধন্যবাদ। এটি আপনি একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করেছেন। আমাদের দেশের যে গণতান্ত্রিক সংকট, শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, দেশের যে একটা পুরো গণতান্ত্রিক সংকট – আমরা যদি এটা নিয়ে গবেষণা করি বা আলোকপাত করি তাহলে সেখানেও আমরা একটি ভালো ধারণা পাবো যে, সংকটের কারণ কী?

আসলে গণতন্ত্র কে চর্চা করার জন্য প্রতিষ্ঠান দরকার। অর্থাৎ গণতন্ত্রের যদি আপনি প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা নিশ্চিত করতে না পারেন,তাহলে গণতন্ত্র কিন্তু তার যে সুন্দর ব্যাপারগুলো আছে,যেটা দিয়ে মানুষের জীবনকে সে সুন্দর করে – তখন সে ব্যর্থ হবে। কারণ, গণতন্ত্র কিন্তু আসলে একটা দর্শন৷ তো দর্শনের যদি আপনি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না দেন,তাহলে সেটি ব্যর্থ হবে

তো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে সেটির পিছনে প্রধান কারণ হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা না থাকা। মানে, আমি বলতে চাই, ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কতটুকু রাজনীতি করবে সেই স্পেসটুকু করে দেওয়ার দায়িত্ব কখনও ছাত্রলীগের নয়৷ আবার ছাত্রলীগ কতটুকু রাজনীতি করবে সেই সুযোগটুকু করে দেওয়ার দায়িত্বও কিন্তু ছাত্রদলের নয়। দল হিসেবে প্রত্যেক দলই চাবে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিরাজমান রাখতে। এটি হচ্ছে প্রত্যেক দলেরই একটি প্রবণতা৷ যেকোনো রাষ্ট্রই কিন্তু চায় বিশ্বব্যাপী তার একটা একচ্ছত্র  আধিপত্য বিস্তার করতে, বিশেষ করে সুপার পাওয়ারগুলো। কিন্তু সেটি হতে পারে না কখনও, একটি দল কখনও মনোপলি করতে পারে না ৷

তাহলে কখন একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে পারে না ?  যখন গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার মধ্যে যদি আমরা নিয়ে আসতে পারি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে, তাহলে, গণতন্ত্রের এই প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা শুরু হলে আমার মনে হয়, সকল বৈধ রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনই সমানভাবে ক্রিয়াশীল হতে পারবে এবং তারা তাদের নেতৃত্বের যোগ্যতা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের অবস্থান তৈরি করতে পারবে

জাননাহ : আপনি বলছেন, গণতান্ত্রিক যে পরিবেশ, সেটি অনুপস্থিত। কিন্তু বিভিন্ন বিরোধী দলীয় যে ছাত্র সংগঠনগুলো রয়েছে তারা বরাবরের মতো দাবি করে আসছে, তারা যে কর্মসূচি পালন করতে পারছে না, তারা যে হলে অবস্থান করতে পারছে না, এর পিছনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন,  ছাত্রলীগই দায়ী। এ ব্যাপারে আপনার কী বক্তব্য?

মো: জুলিয়াস সিজার তালুকদার : এটা তো দৃশ্যমান সত্য । সত্য-মিথ্যার প্রশ্নে যদি আমরা আসি তাহলে তাদের অভিযোগটি সত্য। একই সাথে আমরা যদি বলি যে সমাধান কী? সমাধান এটা না যে, ছাত্রলীগ কে দোষারোপ করা। সমাধান হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা শুরু করা। প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির চর্চা শুরু হলে আর এই দোষারোপ করতে হবে না, তারা তাদের জায়গাটি করে নিতে পারবেন

তারা যে অভিযোগটি করছেন, অভিযোগটি আসলে কার কাছে করছেন ? মানে এই অভিযোগ – যদি আপনি ছাত্রলীগ দ্বারা বিতাড়িত হয়ে থাকেন, ছাত্রলীগের কাছে অভিযোগ করতে পারেন না। আবার প্রশাসনের কাছে যদি করেন তাহলে আপনার রাজনীতি টিকিয়ে রাখার দায়িত্বও প্রশাসনের না।

আপনার রাজনৈতিক কৌশল যদি মধুময় হয়,মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, সেটি তো আপনাকে উপস্থাপনের সুযোগ দিতে হবে৷ অন্যদিকে ছাত্রলীগ যদি বেশি শিক্ষার্থীবান্ধব হয়, তাহলে তারা যেটা দাবি করবে সেই দাবিকে প্রমাণ করারও কিন্তু একটা সুযোগ দিতে হবে৷ তো,যখন আপনি তাদেরকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার মধ্যে দাঁড় করাবেন তখন আসলে বোঝা যাবে কে কতটুকু প্রগ্রেস করলো। অর্থাৎ সমস্যার কারণ যেই হোক না কেন, আওয়ামী লীগের আমলে ছাত্রলীগ হোক না কেন,বিএনপির আমলে ছাত্রদল হোক না কেন, এই সমস্যার সমাধান একটা জায়গাতে আছে৷ সেটা শেখ হাসিনার কাছেও না খালেদা জিয়ার কাছেও না৷ সেটা হচ্ছে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে

শীঘ্রই প্রকাশ করা হবে এই সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় অংশ টি। চোখ রাখুন বিডি সমাচারের পাতায়।