কায়কোবাদের এমআইটি জয়

  • Update Time : ০৬:১৮:১৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ অক্টোবর ২০২৩
  • / 459

এস এম কায়কোবাদ বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ম্যাসাচুয়েট ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে(এমআইটি) উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। তার জন্ম বন্দরনগরীর চট্টগ্রামে হলেও বেড়ে ওঠা বগুড়ায়। শৈশবে ডাক্তার হবার স্বপ্ন থাকলেও ভর্তি হন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার প্রোগ্রামে। স্নাতক শেষে ব্র্যাকেই চলে ছয় বছরের শিক্ষকতা। এর মাঝেই চলতে থাকে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি ও আবেদন প্রক্রিয়া। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ‘মাস্টার্স অফ সায়েন্স ইন আর্কিচেকচার স্টাডিস্’ প্রোগ্রামে এমআইটি থেকে অফার লেটার পান। তাকে নিয়ে লিখেছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম-

অনুভূতি স্বপ্নের মতো ছিল

বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠান থেকে অফার লেটার পাওয়ায় তার অনুভূতিটা স্বপ্নের মতো ছিল। তার ভাষায় ‘প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না আসলেই মেইলটা সঠিক কিনা। পরে বার বার চেক করে শিউর হই।’ কায়কোবাদ বিশ্বের নামকরা সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন। এরমধ্যে সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ার সুযোগ পান। তবে ভালো অবস্থান, ফুল স্কলারশিপ ও চাকরির অফার পেয়ে এমআরটিকেই বেছে নেন।

এমআইটির জানাশুনা

স্কুলে পড়ার সময় এমআইটি সম্পর্কে খানিকটা জানাশুনা ছিল। তবে এ্যাডমিশনের চিন্তা কখনও মাথায় আনেননি। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি এমআইটিতে করেছিলেন বাড়তি আবেদন। আবেদনের পর এ্যাডমিশন পাওয়া না পাওয়া নিয়ে ছিলনা তেমন আশা। প্রথমে ফোকাসে ছিল ‘ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান’, ‘ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া’র মতো প্রতিষ্ঠানে। এগুলো থেকে স্কলারশিপ পেয়েও গিয়েছেন। ভর্তির প্রস্তুতি নিতে নিতে এমআইটি থেকে অফার লেটার পেয়ে যান। পাশাপাশি ল্যাবে গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করতে পারবেন।

এমআইটির যাত্রা

কায়কোবাদের এমআইটি’র জন্য আলাদা প্রস্তুতি নিতে হয়নি। স্নাতক পর ২০১৭ সালে লেকচারার হিসেবে ব্র্যাকে শিক্ষকতা শুরু করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি শুরু করেন ফিল্ড প্র্যাকটিস। সেই থেকে ‘সহ-স্থাপন’ নামে ফার্মও খুলেন। প্র্যাকটিসের মধ্যে ছিল কিছু বিল্ডিং ও ইন্টেরিয়র প্রজেক্ট। অল্প দিনেই সফলতা আসতে শুরু করে। এ্যাকাডেমিতে শিক্ষকতার পাশাপাশি প্র্যাকটিসও চলে সমান তালে। ফলে ক্লাসে পড়ানোটা সহজ হয়ে যায়। প্রস্তুতিটা ছিল বেসিক থেকেই। ২০১৮ সালে অল্প বয়সেই তিনটি এবং পরে মোট ছয়টি পাবলিকেশন প্রকাশিত হয়। পাশাপাশি ফিল্ডে কাজেের অভিজ্ঞতা ও রিসার্চ পেপারে উন্নতি হয়। পড়াশোনা ও শিক্ষকতা নিয়ে অনেকটা বছর ব্র্যাকেই কাটে। তখন সিদ্ধান্ত নেন, মাস্টার্স পড়বেন বিদেশের মাটিতে। তবে আবেদনের শুরুতেই করোনার ধাক্কা! সবশেষে ২০২২ সালের নভেম্বরে করেন আবেদন। এমআইটি’র রিকোয়ারমেন্ট অনুযায়ী পোর্টফোলিও এবং সেস্টমেন্ট অফ পারপাস(এসওপি) পূরন করেন। তিনি বলেন, ‘এমআইটি’র রিকোয়ারমেন্টে কেন পড়তে চাই, রিসার্চ আইডিয়া ও ভবিষ্যত রিসার্চ নিয়ে বিস্তারিত লিখে জানাতে হয়।’ আবেদন করা সাতটি বিশ্বিবদ্যালয়ে মধ্যে সবশেষে এমআইটি থেকে অফার লেটার পান। ২০২২ সালের নভেম্বরে আবেদন করলেও অফার লেটার হাতে আসে ২০২৩ সালের এপ্রিলে।

পড়াশোনার খরচ জোগাড়

খুবই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠা কায়কোবাদের। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সে ছোট। বাবা ছোট একটা সরকারি চাকরি করতেন। নবম শ্রেণিতে থাকতেই তার বাবা চাকরি থেকে অবসরে যান। শুরু হয় সংসারে টানাপোড়েন। সংসারের হাল ধরতে বাবাকে নিতে হয় নতুন বেসরকারি চাকরি। কায়কোবাদের পড়ার বাড়তি খরচ যোগাতে একটি লোনও নেন। টাকা-পয়সা বা অন্য প্রয়োজনে তাকে কখনও অভাব বুঝতে দেননি। তিনি এসএসসিতে বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে ঢাকার রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে ভর্তি হন। সেখানেও গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে সফলতা পান। এরপর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার চেষ্টা করেননি। তিনি বলেন, ‘জানতে পারি, ব্র্যাকের আর্কিটেকচার প্রোগ্রাম অনেক ভালো। এসএসসি ও এইচএসসিতে ডাবল গোল্ডেন থাকায় ব্র্যাক থেকে ৮০% স্কলারশিপ পেয়ে ভর্তি হই। স্কলারশিপ না পেলে হয়তো ভর্তি হতে পারতাম না। কারন এত খরচ দেওয়া সম্ভব ছিল না। বাবা অনেক কষ্ট করে পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতেন।’

প্রস্তুতিতে ‘সময়ের’ বাধা

পরিবারের আর্থিক সংকটের ফলে দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই শুরু হয় বাইরে ইন্টেরিয়র কাজ । পাশাপাশি চলে নিজের প্রোজেক্টের কাজও। এতে নিজের দক্ষতা বৃদ্ধির সাথে অর্জিত টাকা দিয়ে পরিবারকে সহায়তা শুরু করেন। ব্র্যাক থেকে স্নাতক পরই কাঁধে এসে পড়ে পরিবারের পুরো দায়িত্ব। তখন পরিবার, নিজের প্রোজেক্ট ও শিক্ষকতার পাশাপাশি বিদেশে মাস্টার্সের প্রস্তুতি নিতে বেগ পেতে হয়। এত কিছু করে হাতে সময় পেতেন না। তবে এরমাঝেও সময় বের করে চলে প্রস্তুতি। তখন তার জন্য সময়টা খুব বড় একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

অনুপ্রেরণায় যারা ছিলেন

শুধু এমআইটি নয়, জীবনের প্রতিটা সময়ে অনুপ্রেরণায় ছিল তার বাবা-মা। তাদের সাপোর্টের কারনে আজকের এই পর্যন্ত আসতে পেরেছেন। কায়কোবাদ কোভিডের সময় তার বিভাগের ব্যাচমেট নওশীন অনযুমকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর স্ত্রী দায়িত্ব ভাগাভাগি করতে শুরু করলে তার চাপ অনেকটা কমে যায়। সেসময় পুরো দমে বিদেশের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারেন। তার স্ত্রী তাকে সবসময় সাপোর্ট দিয়েছেন। সেও একই সময়ে মাস্টার্সের জন্য আমেরিকাতে পাড়ি জমিয়েছেন। এ ছাড়া তার শিক্ষক থিসিস সুপারভাইজার মো: হাবিব রেজা নানাভাবে সাপোর্ট করেছেন। তার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারপার্সন ও ডিন জয়নব ফারুকি আলী এবং ফুয়াদ হাসান মল্লিক স্যারও রয়েছেন। পাশাপাশি এমআইটি থেকে গ্র্যাজুয়েট আদনান মোরশেদ স্যারের থেকে অনেক বিষয়ে শিখেন।

‘সহ-স্থাপন’ প্রতিষ্ঠান

সবাই মিলে কাজ করে স্থাপনা তৈরি করা থেকে ‘সহ-স্থাপন’ কথাটি এসেছে। স্থাপত্যবিদরা ফিল্ডে একা কাজ করেন না। সেখানে ক্লায়েন্ট, মিস্ত্রি, কন্ডাকটর, ওয়ার্কার; সবার অংশগ্রহণ থাকে। ‘সহ-স্থাপন’ প্রতিষ্ঠানটি ইন্ডাস্ট্রি থেকে ফোকাস সরিয়ে স্থানীয় ঐতিহ্যগত জিনিস (বাঁশ,কাঠ,মাটি) ব্যবহার করে। যেমন- মাটি দিয়ে দেওয়াল তৈরি এবং বাশ বা কাঠ ব্যবহার করে টেবিল বা আসবাবপত্র বানায়। এতে সময় বাঁচার সাথে অর্থেরও সাশ্রয় হয়। পাশাপাশি গণসচেতনতা থাকে স্থানীয় জিনিসপত্র ব্যবহার করা নিয়ে।

এমআইটিতে যোগ্যতা ও দক্ষতা

এমআইটি আসলে একটা ফুল প্যাকেজের মতো। এমআইটিতে চান্স পেতে কি ধরনের যোগ্যতা বা দক্ষতা প্রয়োজন, তার ধরা বাধা নিয়ম নেই। তিনি বলেন, ‘আবেদনের আগে নিজের পোর্টফোলিও, সিভি এবং পাশাপাশি স্টেটমেন্ট অফ পারপাসে(এসওপি) আবেদনপ্রার্থী উল্লেখ করবেন, এমআইটি আপনাকে স্কলারশিপ ও এডমিশন অফার করবে কেন? এই বিষয়গুলো দক্ষতার সাথে গুছিয়ে লিখতে হবে। এ ছাড়া নিজের পোর্টফোলিও উন্নত করা যেমন- ফিল্ডে কাজ করার অভিজ্ঞতা, ভালো লিখতে পারা, রিসার্চ পেপার ও পাবলিকেশনের মতো বিষয়গুলো ভালো জানতে হবে।’ এমআইটি নিদিষ্ট নিয়ম বেধে অফার করে না। পূর্ণাঙ্গ যোগ্যতা ও দক্ষতা দেখে পড়ার সুযোগ দিয়ে থাকে।

নতুনদের পরামর্শ

এমআইটিতে পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে অবদান রাখা যায়। এক বিভাগ থেকে অন্যান্য বিভাগে ডিগ্রি নেওয়া ও শিক্ষদের সাথে যোগাযোগ রাখাও সম্ভব। সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি ক্লাব। নতুনরা এমআইটিতে আগ্রহের সাথে আবেদন করবে। পাশাপাশি বিশ্বাস রাখতে হবে চান্স পাওয়া সম্ভব। এর আগে গুছিয়ে নিবে সমস্ত কাগজপত্র। ওভারঅল সব ভালো থাকতে হবে। সব কিছু ভালো করতে সময় দেওয়ার পাশাপাশি অধ্যাবসায় চালিয়ে যাবে। শতভাগ চেষ্টা করলে অবশ্যই সফল হবে। এ ছাড়া এমআইটিতে সফল হতে সাহসের সাথে ইচ্ছে থাকাটাও জরুরি।

ভবিষ্যৎতে যা করব

কায়কোবাদ এমআইটি থেকে ফিরে প্রাপ্ত জ্ঞান ব্র্যাকের স্থাপত্যে বিভাগে কাজে লাগাতে চান। সেইসাথে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের মাধ্যমে দেশের শিক্ষার্থীদের এমআইটিতে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। এমআইটিতে বিভিন্ন ধরনের ল্যাব থেকে কোলাবোরেশান করে প্রোজেক্ট তৈরি করা যায়। ‘এমআইটির ল্যাব থেকে ঢাকা শহরকে স্টাডি করে পজিটিভ এবং নেগেটিভ জিনিসগুলো তুলে আনতে পারবো। আমার রিসার্চ ‘আরবান হেরিটেজ’ নিয়ে। ঢাকার পুরান ঐতিহ্যগত বিল্ডিংগুলোকে নতুনভাবে ব্যবহারের প্রক্রিয়া রিসার্চ করে শিখতে পারবো’ যোগ করেন তিনি । এ ছাড়া ট্যালেন্ট থাকা সত্ত্বেও আর্থিক কারনে উঠে আসতে না পারা মানুষদের নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন।

এস এস কায়কোবাদ
শিক্ষার্থী ও গবেষনা সহকারী, মাস্টার্স অফ সায়েন্স ইন আর্কিচেকচার স্টাডিস্, ম্যাসাচুয়েট ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


কায়কোবাদের এমআইটি জয়

Update Time : ০৬:১৮:১৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ অক্টোবর ২০২৩

এস এম কায়কোবাদ বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ম্যাসাচুয়েট ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে(এমআইটি) উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। তার জন্ম বন্দরনগরীর চট্টগ্রামে হলেও বেড়ে ওঠা বগুড়ায়। শৈশবে ডাক্তার হবার স্বপ্ন থাকলেও ভর্তি হন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার প্রোগ্রামে। স্নাতক শেষে ব্র্যাকেই চলে ছয় বছরের শিক্ষকতা। এর মাঝেই চলতে থাকে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি ও আবেদন প্রক্রিয়া। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ‘মাস্টার্স অফ সায়েন্স ইন আর্কিচেকচার স্টাডিস্’ প্রোগ্রামে এমআইটি থেকে অফার লেটার পান। তাকে নিয়ে লিখেছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম-

অনুভূতি স্বপ্নের মতো ছিল

বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠান থেকে অফার লেটার পাওয়ায় তার অনুভূতিটা স্বপ্নের মতো ছিল। তার ভাষায় ‘প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না আসলেই মেইলটা সঠিক কিনা। পরে বার বার চেক করে শিউর হই।’ কায়কোবাদ বিশ্বের নামকরা সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন। এরমধ্যে সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ার সুযোগ পান। তবে ভালো অবস্থান, ফুল স্কলারশিপ ও চাকরির অফার পেয়ে এমআরটিকেই বেছে নেন।

এমআইটির জানাশুনা

স্কুলে পড়ার সময় এমআইটি সম্পর্কে খানিকটা জানাশুনা ছিল। তবে এ্যাডমিশনের চিন্তা কখনও মাথায় আনেননি। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি এমআইটিতে করেছিলেন বাড়তি আবেদন। আবেদনের পর এ্যাডমিশন পাওয়া না পাওয়া নিয়ে ছিলনা তেমন আশা। প্রথমে ফোকাসে ছিল ‘ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান’, ‘ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া’র মতো প্রতিষ্ঠানে। এগুলো থেকে স্কলারশিপ পেয়েও গিয়েছেন। ভর্তির প্রস্তুতি নিতে নিতে এমআইটি থেকে অফার লেটার পেয়ে যান। পাশাপাশি ল্যাবে গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করতে পারবেন।

এমআইটির যাত্রা

কায়কোবাদের এমআইটি’র জন্য আলাদা প্রস্তুতি নিতে হয়নি। স্নাতক পর ২০১৭ সালে লেকচারার হিসেবে ব্র্যাকে শিক্ষকতা শুরু করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি শুরু করেন ফিল্ড প্র্যাকটিস। সেই থেকে ‘সহ-স্থাপন’ নামে ফার্মও খুলেন। প্র্যাকটিসের মধ্যে ছিল কিছু বিল্ডিং ও ইন্টেরিয়র প্রজেক্ট। অল্প দিনেই সফলতা আসতে শুরু করে। এ্যাকাডেমিতে শিক্ষকতার পাশাপাশি প্র্যাকটিসও চলে সমান তালে। ফলে ক্লাসে পড়ানোটা সহজ হয়ে যায়। প্রস্তুতিটা ছিল বেসিক থেকেই। ২০১৮ সালে অল্প বয়সেই তিনটি এবং পরে মোট ছয়টি পাবলিকেশন প্রকাশিত হয়। পাশাপাশি ফিল্ডে কাজেের অভিজ্ঞতা ও রিসার্চ পেপারে উন্নতি হয়। পড়াশোনা ও শিক্ষকতা নিয়ে অনেকটা বছর ব্র্যাকেই কাটে। তখন সিদ্ধান্ত নেন, মাস্টার্স পড়বেন বিদেশের মাটিতে। তবে আবেদনের শুরুতেই করোনার ধাক্কা! সবশেষে ২০২২ সালের নভেম্বরে করেন আবেদন। এমআইটি’র রিকোয়ারমেন্ট অনুযায়ী পোর্টফোলিও এবং সেস্টমেন্ট অফ পারপাস(এসওপি) পূরন করেন। তিনি বলেন, ‘এমআইটি’র রিকোয়ারমেন্টে কেন পড়তে চাই, রিসার্চ আইডিয়া ও ভবিষ্যত রিসার্চ নিয়ে বিস্তারিত লিখে জানাতে হয়।’ আবেদন করা সাতটি বিশ্বিবদ্যালয়ে মধ্যে সবশেষে এমআইটি থেকে অফার লেটার পান। ২০২২ সালের নভেম্বরে আবেদন করলেও অফার লেটার হাতে আসে ২০২৩ সালের এপ্রিলে।

পড়াশোনার খরচ জোগাড়

খুবই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠা কায়কোবাদের। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সে ছোট। বাবা ছোট একটা সরকারি চাকরি করতেন। নবম শ্রেণিতে থাকতেই তার বাবা চাকরি থেকে অবসরে যান। শুরু হয় সংসারে টানাপোড়েন। সংসারের হাল ধরতে বাবাকে নিতে হয় নতুন বেসরকারি চাকরি। কায়কোবাদের পড়ার বাড়তি খরচ যোগাতে একটি লোনও নেন। টাকা-পয়সা বা অন্য প্রয়োজনে তাকে কখনও অভাব বুঝতে দেননি। তিনি এসএসসিতে বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে ঢাকার রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে ভর্তি হন। সেখানেও গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে সফলতা পান। এরপর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার চেষ্টা করেননি। তিনি বলেন, ‘জানতে পারি, ব্র্যাকের আর্কিটেকচার প্রোগ্রাম অনেক ভালো। এসএসসি ও এইচএসসিতে ডাবল গোল্ডেন থাকায় ব্র্যাক থেকে ৮০% স্কলারশিপ পেয়ে ভর্তি হই। স্কলারশিপ না পেলে হয়তো ভর্তি হতে পারতাম না। কারন এত খরচ দেওয়া সম্ভব ছিল না। বাবা অনেক কষ্ট করে পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতেন।’

প্রস্তুতিতে ‘সময়ের’ বাধা

পরিবারের আর্থিক সংকটের ফলে দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই শুরু হয় বাইরে ইন্টেরিয়র কাজ । পাশাপাশি চলে নিজের প্রোজেক্টের কাজও। এতে নিজের দক্ষতা বৃদ্ধির সাথে অর্জিত টাকা দিয়ে পরিবারকে সহায়তা শুরু করেন। ব্র্যাক থেকে স্নাতক পরই কাঁধে এসে পড়ে পরিবারের পুরো দায়িত্ব। তখন পরিবার, নিজের প্রোজেক্ট ও শিক্ষকতার পাশাপাশি বিদেশে মাস্টার্সের প্রস্তুতি নিতে বেগ পেতে হয়। এত কিছু করে হাতে সময় পেতেন না। তবে এরমাঝেও সময় বের করে চলে প্রস্তুতি। তখন তার জন্য সময়টা খুব বড় একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

অনুপ্রেরণায় যারা ছিলেন

শুধু এমআইটি নয়, জীবনের প্রতিটা সময়ে অনুপ্রেরণায় ছিল তার বাবা-মা। তাদের সাপোর্টের কারনে আজকের এই পর্যন্ত আসতে পেরেছেন। কায়কোবাদ কোভিডের সময় তার বিভাগের ব্যাচমেট নওশীন অনযুমকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর স্ত্রী দায়িত্ব ভাগাভাগি করতে শুরু করলে তার চাপ অনেকটা কমে যায়। সেসময় পুরো দমে বিদেশের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারেন। তার স্ত্রী তাকে সবসময় সাপোর্ট দিয়েছেন। সেও একই সময়ে মাস্টার্সের জন্য আমেরিকাতে পাড়ি জমিয়েছেন। এ ছাড়া তার শিক্ষক থিসিস সুপারভাইজার মো: হাবিব রেজা নানাভাবে সাপোর্ট করেছেন। তার ডিপার্টমেন্টের চেয়ারপার্সন ও ডিন জয়নব ফারুকি আলী এবং ফুয়াদ হাসান মল্লিক স্যারও রয়েছেন। পাশাপাশি এমআইটি থেকে গ্র্যাজুয়েট আদনান মোরশেদ স্যারের থেকে অনেক বিষয়ে শিখেন।

‘সহ-স্থাপন’ প্রতিষ্ঠান

সবাই মিলে কাজ করে স্থাপনা তৈরি করা থেকে ‘সহ-স্থাপন’ কথাটি এসেছে। স্থাপত্যবিদরা ফিল্ডে একা কাজ করেন না। সেখানে ক্লায়েন্ট, মিস্ত্রি, কন্ডাকটর, ওয়ার্কার; সবার অংশগ্রহণ থাকে। ‘সহ-স্থাপন’ প্রতিষ্ঠানটি ইন্ডাস্ট্রি থেকে ফোকাস সরিয়ে স্থানীয় ঐতিহ্যগত জিনিস (বাঁশ,কাঠ,মাটি) ব্যবহার করে। যেমন- মাটি দিয়ে দেওয়াল তৈরি এবং বাশ বা কাঠ ব্যবহার করে টেবিল বা আসবাবপত্র বানায়। এতে সময় বাঁচার সাথে অর্থেরও সাশ্রয় হয়। পাশাপাশি গণসচেতনতা থাকে স্থানীয় জিনিসপত্র ব্যবহার করা নিয়ে।

এমআইটিতে যোগ্যতা ও দক্ষতা

এমআইটি আসলে একটা ফুল প্যাকেজের মতো। এমআইটিতে চান্স পেতে কি ধরনের যোগ্যতা বা দক্ষতা প্রয়োজন, তার ধরা বাধা নিয়ম নেই। তিনি বলেন, ‘আবেদনের আগে নিজের পোর্টফোলিও, সিভি এবং পাশাপাশি স্টেটমেন্ট অফ পারপাসে(এসওপি) আবেদনপ্রার্থী উল্লেখ করবেন, এমআইটি আপনাকে স্কলারশিপ ও এডমিশন অফার করবে কেন? এই বিষয়গুলো দক্ষতার সাথে গুছিয়ে লিখতে হবে। এ ছাড়া নিজের পোর্টফোলিও উন্নত করা যেমন- ফিল্ডে কাজ করার অভিজ্ঞতা, ভালো লিখতে পারা, রিসার্চ পেপার ও পাবলিকেশনের মতো বিষয়গুলো ভালো জানতে হবে।’ এমআইটি নিদিষ্ট নিয়ম বেধে অফার করে না। পূর্ণাঙ্গ যোগ্যতা ও দক্ষতা দেখে পড়ার সুযোগ দিয়ে থাকে।

নতুনদের পরামর্শ

এমআইটিতে পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে অবদান রাখা যায়। এক বিভাগ থেকে অন্যান্য বিভাগে ডিগ্রি নেওয়া ও শিক্ষদের সাথে যোগাযোগ রাখাও সম্ভব। সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি ক্লাব। নতুনরা এমআইটিতে আগ্রহের সাথে আবেদন করবে। পাশাপাশি বিশ্বাস রাখতে হবে চান্স পাওয়া সম্ভব। এর আগে গুছিয়ে নিবে সমস্ত কাগজপত্র। ওভারঅল সব ভালো থাকতে হবে। সব কিছু ভালো করতে সময় দেওয়ার পাশাপাশি অধ্যাবসায় চালিয়ে যাবে। শতভাগ চেষ্টা করলে অবশ্যই সফল হবে। এ ছাড়া এমআইটিতে সফল হতে সাহসের সাথে ইচ্ছে থাকাটাও জরুরি।

ভবিষ্যৎতে যা করব

কায়কোবাদ এমআইটি থেকে ফিরে প্রাপ্ত জ্ঞান ব্র্যাকের স্থাপত্যে বিভাগে কাজে লাগাতে চান। সেইসাথে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের মাধ্যমে দেশের শিক্ষার্থীদের এমআইটিতে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। এমআইটিতে বিভিন্ন ধরনের ল্যাব থেকে কোলাবোরেশান করে প্রোজেক্ট তৈরি করা যায়। ‘এমআইটির ল্যাব থেকে ঢাকা শহরকে স্টাডি করে পজিটিভ এবং নেগেটিভ জিনিসগুলো তুলে আনতে পারবো। আমার রিসার্চ ‘আরবান হেরিটেজ’ নিয়ে। ঢাকার পুরান ঐতিহ্যগত বিল্ডিংগুলোকে নতুনভাবে ব্যবহারের প্রক্রিয়া রিসার্চ করে শিখতে পারবো’ যোগ করেন তিনি । এ ছাড়া ট্যালেন্ট থাকা সত্ত্বেও আর্থিক কারনে উঠে আসতে না পারা মানুষদের নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন।

এস এস কায়কোবাদ
শিক্ষার্থী ও গবেষনা সহকারী, মাস্টার্স অফ সায়েন্স ইন আর্কিচেকচার স্টাডিস্, ম্যাসাচুয়েট ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি।