সেদিন আকাশে মেঘ ছিল

  • Update Time : ০৫:৪৮:৪৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ জুলাই ২০২০
  • / 182
পর্ব-০১
কলমে-রাজু আহাম্মেদ:
২ সপ্তাহ ধরে কাজের বুয়া আসে না।রান্না,ঘরের ছোটখাট কাজ নিজেদেরই করতে হয়।তবে মানুষ আমরা মাত্র দুজন,আশিক আর আমি।সেজন্য খুব একটা কষ্ট হয় না বললেই চলে।তাছাড়া আশিক বেশ ভালো রান্নাও করতে পারে।ওর হাতের মুরগির মাংসের তরকারী খেয়ে যেকেউ ভক্তবনে চলে যাবেন।যাক সেকথা, ঠিকমত বাজার করা হচ্ছে না,সেজন্য আলুভর্তা আর ডিমভাজিটাই বেশি খেতে হচ্ছে আজকাল।এ পরিস্থিতিতে শহর ছেড়ে গ্রামে যেতে পারলেই বেশি ভালো হত।আশিকের মা, ফোন দিয়ে বলেছিলো অবশ্য,কিন্তু গ্রামে যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি।
.
২০ এর্পিল,ঘড়িতে তখন রাত এগারটার কিছু বেশি।অনলাইনে পত্রিকা পড়ছিলাম।করোনার ভয়াবহতা দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে।আজ আক্রান্তের সংখ্যা ৭৪০ অন্যদিকে মৃত্যু ১৭।প্রতিদিনই গাণিতিকহারে এসংখ্যা বেড়ে চলেছে।এরপরেও রাস্তাঘাটে মানুষের হাঁটাচলার কমতি নেই।
আশিক হেসে বলল,আমরা বাঙালি এমনি।মৃত্যু মাথার উপর ছাঁয়া হয়ে ঘুরলেও,সেই ছাঁয়াকেই আমরা ছুঁতে যাই,স্বাগত জানাই।
.
যাক, মোবাইল রেখে মশারি টানিয়ে নিলাম।আজকাল মশার উৎপাত খুব বেড়ে গেছে।ঘরে নামমাত্র কয়েল নেই।লাইট অফ করতে যাব তখনি কলিংবেল বেজে উঠল।এত রাতে কে?নিশ্চয় বাড়িওয়ালা চাচা,সিগারেট নিতে এসেছে।চাচীর ভয়ে কাছে সিগারেট রাখেন না আবার কিনেও খান না।আশিক যেন উনার কাছে সিগারেটের গুপ্তবাক্স।দেখা হওয়া মানেই…
.
-আস্সালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম আসস্সালাম।কি খবর তোমাদের?ঘর অন্ধকার কেন?
-ঘুমাব ভাবছিলাম।সেজন্য আর কি।
-এত সকাল সকাল?
-সকাল আর কই বার’টা বাজে।
-যুবকদের কাছে বার’টা কোন রাত নাকি।আমি তো এই বয়সে বাহিরেই থাকতাম বেশি।বিয়ের পরে অভ্যেসটা গেছে।
-বেশ ভালো।
-আচ্ছা,আশিক বাবাজী কি ঘুমিয়েছে?
-হ্যাঁ। ওর শরীর একটু খারাপ।সেজন্য আগেই ঘুমিয়েছে।
-কিছু কি প্রয়োজন ছিল ওর কাছে?
-না।তেমন কিছু না।
-বুঝতে পেরেছি।আপনি বসুন।আমি আনছি।
-আরে না।আনতে হবে না,আকাশ।
আমি সিগারেট এনে উনাকে দিলাম।উনি না নেওয়ার ভান করে সিগারেট নিলেন।
-দেখো তে ছেলের কান্ড!আর খাব না ভেবেছিলাম।আচ্ছা, এনেছ যখন দাও।
উনি আমার সামনেই সিগারেট ধরালেন।সোফাতে বসে পায়ের উপরে পা উঠিয়ে নিশ্চিন্তে টানতে শুরু করলেন।
.
আমি কথা বাড়ালাম না।গল্প শুরু করলে,রাত কোন দিক দিয়ে যে শেষ হয়ে যাবে টেরই পাব না।আমি চুপচাপ বসে রইলাম।খানিকবাদেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনি বললেন,আকাশ,আমি কেন এসেছি জানো?
-জানি।
-জানো না।আমি আজ সিগারেটের জন্য আসিনি।এসেছি অন্য একটা কারণে।
-সেটা কি?
-আসলে বলতে খুব খারাপ লাগছে,তবু বলতে হচ্ছে।তোমরা প্রায় সাত মাস ধরে এখানে আছো।বেশ মায়া কাজ করে তোমাদের উপর।কিন্তু বিপদ দরজায় কড়া নাড়লে,করার কিছু থাকে না।
-কি রকম বিপদ?
-বলছি,তোমরা যুবক ছেলে।নানান কাজে বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাহিরে যাওয়া আসা করো।
-হ্যাঁ, সেটা করতেই হয়।উপায় নেই।
.
মিজান সাহেব খানিক চুপ থেকে বললেন,তোমাদের আসলে বাসাটা ছাড়তে হবে।এবং সেটা আগামী দু-তিন দিনের মধ্যেই।
-কিন্তু..!
-কিন্তু বলো না।আমার কিছু করার নেই।
ব্যাপারটা বুঝলাম,সেজন্য আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।উনারা ভয় পাচ্ছেন,আমাদের কারণে উনাদের কারো যদি করোনা হয়,সেই ভয়।
.
বিকেল চার’টা। টিভিতে ভুতুড়ে সিরিয়াল দেখছিলাম,জঙ্গলবাড়িয়া রহস্য,রাজু সাহেবের লেখা।
গাঁ ছমছমে ব্যাপার খুব একটা না থাকলেও মোটামুটি ভুতুড়ে বলা চলে।যাক ভালই লাগছিলো।উনার সাথে একবার দেখা করতে পারলে বেশ হতো।আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা শেয়ার করা যেত,উনি গল্প শুনেই হয়তো কাঁপতেন।আবার নাও কাঁপতে পারেন।লেখক মানুষদের আবার তেমন ভয়ডর থাকে না।ভয় থাকলে লেখালেখিতে আগানো যায় না।
.
-আকাশ।একটা ভালো খবর আছে।
-কি খবর?
-বাসার ব্যবস্থা হয়েছে।
-আলহামদুলিল্লাহ।কোথায়?এসময় কে বাসা দিতে রাজি হলেন?
-শুধু বাসাই দিবেন,এমন না।মাসগেলে মোটা অঙ্কের বেতনও।
-কি বলিস?বিশ্বাস হচ্ছে না।
-ব্যাপারটা একটু অদ্ভূত হলেও সত্যি।বাড়িওয়ালা সপরিবারে গ্রামে যাবেন।করোনার জন্য আর কি!বাসার দেখাশুনা করতে হবে,এই।
-বেশ ভালো তবে।
.
সন্ধ্যার দিকেই আমরা সেখানে গেলাম।বাড়িওয়ালা রাজিও হলেন।হয়তো হতেন না সহজে,কিন্তু মিজান সাহেবের রেফারেন্সে বাসাটা পাওয়া সহজ হলো।মাসগেলে তের হাজার টাকাও পাওয়া যাবে।সবমিলিয়ে ব্যাপারটা আমাদের জন্য বেশ ভালোই।এই মহামারীর সময় ঘরে বসে বসে তের হাজার টাকা ইনকাম কম কিছু না।পরেনদিনেই মালপত্র নিয়ে উঠে পড়লাম নতুন বাসায়।
.
০৫ মে,সন্ধ্যা সাত’টার কিছু বেশি।রান্নাঘরে চা বানাচ্ছিলাম,হঠাৎ আশিক এসে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,দোস্ত।এ বাড়িতে নিশ্চয় কোন ঝামেলা আছে।
-কি রকম?
-পিছন দিকটাতে যে ক’দিন লাইট জ্বালাতে গিয়েছি,বাজে কিছু না কিছু কানে এসেছেই।আজকেও…
-বাজে বলতে আসলে কি রকম বাজে?
-পিছনে যে গোয়ালঘরটা আছে না?সেখান থেকে প্রায়ই কান্নার শব্দ শুনি।ভিতরে গেলে কিচ্ছু নেই।তাছাড়া রাতে ছাদে গেলেও কান্নার শব্দ শোনা যায়।
-কবে থেকে এরকম হচ্ছে তোর সাথে?
-গত সপ্তাহ থেকে।বলবো বলবো করে বলা হয়নি।
আমি মুচকি হেসে বললাম,পাগল।সেরকম ভয়ের কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না।তুই মিছেমিছি ভয় পাচ্ছিস।কিছু থাকলে আমি অবশ্যই টের্ পেতাম।
-সেটা সত্যি।কিন্তু তারপরেও ব্যাপারটা কেমন গাঁ ছমছমে।ধর,রাতে ছাদে সিগারেট টানছি।হঠাৎ কেউ পিছন থেকে ঘাড়ে হাত দিলো,পিছন ফিরে দেখব,বিভৎস চেহারা।চোখ নেই কিংবা চোখের কোটর থেকে রক্ত পড়ছে, তখন…?
-ধ্যুর পাগল।এরকম কিছু হবে না।নিশ্চিন্তে থাক।
.
ব্যাপারটা আসলে সত্যি।আমিও বেশ কয়েকবার টের পেয়েছি।কিন্তু এড়িয়ে গেলাম আশিক যাতে ভয়েভয়ে না থাকে।ভয় মানুষকে দূর্বল বানিয়ে দেয়।এই ধরুন,আপনার সাধারণ জ্বর হলো।কিন্তু আপনি যদি উপসর্গগুলোকে করোনার সাথে মিলানো শুরু করেন,তবে আরো দ্রুত অসুস্থ হয়ে যাবেন।খুব বাজে ভাবে অসুস্থ হয়ে যাবেন।
.
১০মে,রাত তিনটে নাগাদ মোবাইলে টুং করে শব্দ হলো।হাতে নিয়ে দেখলাম আশিকের ম্যাসেজ,জলদি, ছাদে আয়।
এই মাঝরাতে ছেলেটা একা একা ছাদে গেছে।নিশ্চয় অস্বাভাবিক কিছু দেখেছে।আমি দ্রুত ছাদে গেলাম।আশিক বলল,দোস্ত দেখ গোয়ালঘর থেকে গোঙ্গানির শব্দ ভেসে আসছে।আমি কানখাড়া করে শোনার চেষ্ঠা করলাম।সত্যিই গোঙ্গানির শব্দ ভেসে আসছে।লাইট হাতে নিয়ে দুজনে নিচে গেলাম।গোয়ালঘরের দেয়ালে কান লাগিয়ে ভিতরের অবস্থা বোঝার চেষ্ঠা করলাম।বেশ পরিষ্কার শব্দ।দরজা খুলে ধীরপায়ে দুজনে ভিতরে ঢুকলাম।ভিতরে যেতেই কান্নার আওয়াজ কিছুটা কমে গেল।ঘুটঘুটে অন্ধকার চারিপাশ, পুবের কোণায় চেয়ারে কিছু একটা আছে।আমি আশিকের দিকে তাকালাম।উৎসুক চাহনি নিয়ে ও-চারিদিকে দেখছে।সম্ভবত পুবের কোণার দিকে খেয়ালই করে নি।তাছাড়া ওর দেখার কথাও না।গোয়ালঘরটা বেশ বড়।বাড়িওয়ালা হয়তো একসময় গরুর ফার্ম বানিয়েছিলেন।এখন ষ্টোর রুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
.
আমি সেদিকেই এগোলাম।চেয়ারে বসা মানুষটি,মহিলা।বাচ্চা’কে দুধ খাওয়াচ্ছেন আর কাঁদছেন।খুব কাছে যেতেই মহিলাটি আমার দিকে তাকালেন।রক্তাক্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।চোখের ভাষা বেশ পরিষ্কার।আমি যে তাকে দেখতে পাচ্ছি,এটা তিনি বুঝতে পারছেন।জোরে জোরে শ্বাস ফেলছেন।যেখানে আমার ভয় পাবার কথা,সেখানে তিনিই ভয় পাচ্ছেন।আমি বললাম,কে আপনি?
কোন জবাব আসার আগেই রক্তমাখা শরীরটা হারিয়ে গেল।আশপাশ ভালো ভাবে দেখে চলে এলাম।আশিককে বললাম,চল যাওয়া যাক।তেমন কিছু না।
-তেমন কিছু না বললেই হলো?শুধুমাত্র আমার মনের ভুল হলে আজকে তুই আওয়াজটা শুনতিস না।
-চল্।যাই।
-বল না,ব্যাপারটা আসলে কি?
-পরে এ ব্যাপারে কথা হবে।চল যাই।
.
মে মাসের ১৩ তারিখ।ছাদে বসে দুই বন্ধু সিগারেট টানছি।হঠাৎ বাড়িওয়ালার ফোন।
-আস্সালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম।কি খবর,আকাশবাবু?
-আলহামদুলিল্লাহ।আপনি কেমন আছেন?
-আলহামদুলিল্লাহ।তা কোন ঝামেলা টামেলা হয়নি তো?
-না।কিছু কি হতে পারে?
-না।তবে বাড়িওয়ালা নেই।টোকাই পোলাপান যদি জ্বালায়,এই আর কি।
-সেরকম সমস্যা করেনি কেউ।
-সমস্যা করলে বলবেন।আমার ছোট শালা উত্তরা থানার ওসি।
-জ্বি,বলবো।
-টাকা পাঠিয়েছি,গিয়েছে?
-হ্যাঁ।
-সাবধানে থাকবেন।খেয়াল রাখবেন বাসাটার।আর কোন সমস্যা হলে বলবেন।
-জ্বি।
.
মে মাসের ১৫ তারিখ,সেদিন বুধবার।রাত এক’টা নাগাদে ছাদে গেলাম।আশিককে বলে আসা হয় নি।সিগারেট টানছিলাম আর অপেক্ষা করছিলাম কান্নার শব্দের জন্য।যখন দু’টা বাজে,তখন ধীরে ধীরে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম।আওয়াজ জোরালো হলে, নিচে গেলাম।দরজা খুললাম খুবই সতর্কতার সাথে।আজকেও ঠিক পুবের কোণাতেই দেখলাম উনাকে।কাছাকাছি যেতেই উনি দেখে ফেললেন আমাকে।চেয়ার ছুঁড়ে মেরে আঘাত করার চেষ্ঠা করলেন।কিন্তু ব্যর্থ হলেন।হিংস্র চাহনিতে আবার আঘাত করার চেষ্ঠা করে,আবার বিফলে গেলেন।দূরে সরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসাসসূচক চোখে চেয়ে রইলেন।রাজ্যের হাজারও প্রশ্ন যেন তার চোখে।আমি ধীরে ধীরে তার নিকটে গেলাম।কাছে যেতেই উনি বলবেন,প্লিজ আমাদের আর মারবেন না।আমি নিতুকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাব।
.
আমি বললাম,ভয়ের কিছু নেই।আমি কাউকে মারতে আসিনি।কে আপনি?আর আপনার,আপনার কোলের শিশুর এই অবস্থা কেন?কিভাবে হয়েছে?
-আপনি কে?আর আমাদের সাথে কথা বলছেন কি করে?দেখছেনই বা কি করে?
-সেটা একটা রহস্য।সব’টা বলুন।আমি আপনার সাহায্যেও আসতে পারি।
-কি রকম, সাহায্য?আমি যা করতে বলবো,করতে পারবেন?
-সেজন্য সব’টা শুনতে হবে আমাকে।
-তবে শুনোন।
Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


সেদিন আকাশে মেঘ ছিল

Update Time : ০৫:৪৮:৪৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ জুলাই ২০২০
পর্ব-০১
কলমে-রাজু আহাম্মেদ:
২ সপ্তাহ ধরে কাজের বুয়া আসে না।রান্না,ঘরের ছোটখাট কাজ নিজেদেরই করতে হয়।তবে মানুষ আমরা মাত্র দুজন,আশিক আর আমি।সেজন্য খুব একটা কষ্ট হয় না বললেই চলে।তাছাড়া আশিক বেশ ভালো রান্নাও করতে পারে।ওর হাতের মুরগির মাংসের তরকারী খেয়ে যেকেউ ভক্তবনে চলে যাবেন।যাক সেকথা, ঠিকমত বাজার করা হচ্ছে না,সেজন্য আলুভর্তা আর ডিমভাজিটাই বেশি খেতে হচ্ছে আজকাল।এ পরিস্থিতিতে শহর ছেড়ে গ্রামে যেতে পারলেই বেশি ভালো হত।আশিকের মা, ফোন দিয়ে বলেছিলো অবশ্য,কিন্তু গ্রামে যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি।
.
২০ এর্পিল,ঘড়িতে তখন রাত এগারটার কিছু বেশি।অনলাইনে পত্রিকা পড়ছিলাম।করোনার ভয়াবহতা দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে।আজ আক্রান্তের সংখ্যা ৭৪০ অন্যদিকে মৃত্যু ১৭।প্রতিদিনই গাণিতিকহারে এসংখ্যা বেড়ে চলেছে।এরপরেও রাস্তাঘাটে মানুষের হাঁটাচলার কমতি নেই।
আশিক হেসে বলল,আমরা বাঙালি এমনি।মৃত্যু মাথার উপর ছাঁয়া হয়ে ঘুরলেও,সেই ছাঁয়াকেই আমরা ছুঁতে যাই,স্বাগত জানাই।
.
যাক, মোবাইল রেখে মশারি টানিয়ে নিলাম।আজকাল মশার উৎপাত খুব বেড়ে গেছে।ঘরে নামমাত্র কয়েল নেই।লাইট অফ করতে যাব তখনি কলিংবেল বেজে উঠল।এত রাতে কে?নিশ্চয় বাড়িওয়ালা চাচা,সিগারেট নিতে এসেছে।চাচীর ভয়ে কাছে সিগারেট রাখেন না আবার কিনেও খান না।আশিক যেন উনার কাছে সিগারেটের গুপ্তবাক্স।দেখা হওয়া মানেই…
.
-আস্সালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম আসস্সালাম।কি খবর তোমাদের?ঘর অন্ধকার কেন?
-ঘুমাব ভাবছিলাম।সেজন্য আর কি।
-এত সকাল সকাল?
-সকাল আর কই বার’টা বাজে।
-যুবকদের কাছে বার’টা কোন রাত নাকি।আমি তো এই বয়সে বাহিরেই থাকতাম বেশি।বিয়ের পরে অভ্যেসটা গেছে।
-বেশ ভালো।
-আচ্ছা,আশিক বাবাজী কি ঘুমিয়েছে?
-হ্যাঁ। ওর শরীর একটু খারাপ।সেজন্য আগেই ঘুমিয়েছে।
-কিছু কি প্রয়োজন ছিল ওর কাছে?
-না।তেমন কিছু না।
-বুঝতে পেরেছি।আপনি বসুন।আমি আনছি।
-আরে না।আনতে হবে না,আকাশ।
আমি সিগারেট এনে উনাকে দিলাম।উনি না নেওয়ার ভান করে সিগারেট নিলেন।
-দেখো তে ছেলের কান্ড!আর খাব না ভেবেছিলাম।আচ্ছা, এনেছ যখন দাও।
উনি আমার সামনেই সিগারেট ধরালেন।সোফাতে বসে পায়ের উপরে পা উঠিয়ে নিশ্চিন্তে টানতে শুরু করলেন।
.
আমি কথা বাড়ালাম না।গল্প শুরু করলে,রাত কোন দিক দিয়ে যে শেষ হয়ে যাবে টেরই পাব না।আমি চুপচাপ বসে রইলাম।খানিকবাদেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনি বললেন,আকাশ,আমি কেন এসেছি জানো?
-জানি।
-জানো না।আমি আজ সিগারেটের জন্য আসিনি।এসেছি অন্য একটা কারণে।
-সেটা কি?
-আসলে বলতে খুব খারাপ লাগছে,তবু বলতে হচ্ছে।তোমরা প্রায় সাত মাস ধরে এখানে আছো।বেশ মায়া কাজ করে তোমাদের উপর।কিন্তু বিপদ দরজায় কড়া নাড়লে,করার কিছু থাকে না।
-কি রকম বিপদ?
-বলছি,তোমরা যুবক ছেলে।নানান কাজে বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাহিরে যাওয়া আসা করো।
-হ্যাঁ, সেটা করতেই হয়।উপায় নেই।
.
মিজান সাহেব খানিক চুপ থেকে বললেন,তোমাদের আসলে বাসাটা ছাড়তে হবে।এবং সেটা আগামী দু-তিন দিনের মধ্যেই।
-কিন্তু..!
-কিন্তু বলো না।আমার কিছু করার নেই।
ব্যাপারটা বুঝলাম,সেজন্য আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।উনারা ভয় পাচ্ছেন,আমাদের কারণে উনাদের কারো যদি করোনা হয়,সেই ভয়।
.
বিকেল চার’টা। টিভিতে ভুতুড়ে সিরিয়াল দেখছিলাম,জঙ্গলবাড়িয়া রহস্য,রাজু সাহেবের লেখা।
গাঁ ছমছমে ব্যাপার খুব একটা না থাকলেও মোটামুটি ভুতুড়ে বলা চলে।যাক ভালই লাগছিলো।উনার সাথে একবার দেখা করতে পারলে বেশ হতো।আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা শেয়ার করা যেত,উনি গল্প শুনেই হয়তো কাঁপতেন।আবার নাও কাঁপতে পারেন।লেখক মানুষদের আবার তেমন ভয়ডর থাকে না।ভয় থাকলে লেখালেখিতে আগানো যায় না।
.
-আকাশ।একটা ভালো খবর আছে।
-কি খবর?
-বাসার ব্যবস্থা হয়েছে।
-আলহামদুলিল্লাহ।কোথায়?এসময় কে বাসা দিতে রাজি হলেন?
-শুধু বাসাই দিবেন,এমন না।মাসগেলে মোটা অঙ্কের বেতনও।
-কি বলিস?বিশ্বাস হচ্ছে না।
-ব্যাপারটা একটু অদ্ভূত হলেও সত্যি।বাড়িওয়ালা সপরিবারে গ্রামে যাবেন।করোনার জন্য আর কি!বাসার দেখাশুনা করতে হবে,এই।
-বেশ ভালো তবে।
.
সন্ধ্যার দিকেই আমরা সেখানে গেলাম।বাড়িওয়ালা রাজিও হলেন।হয়তো হতেন না সহজে,কিন্তু মিজান সাহেবের রেফারেন্সে বাসাটা পাওয়া সহজ হলো।মাসগেলে তের হাজার টাকাও পাওয়া যাবে।সবমিলিয়ে ব্যাপারটা আমাদের জন্য বেশ ভালোই।এই মহামারীর সময় ঘরে বসে বসে তের হাজার টাকা ইনকাম কম কিছু না।পরেনদিনেই মালপত্র নিয়ে উঠে পড়লাম নতুন বাসায়।
.
০৫ মে,সন্ধ্যা সাত’টার কিছু বেশি।রান্নাঘরে চা বানাচ্ছিলাম,হঠাৎ আশিক এসে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,দোস্ত।এ বাড়িতে নিশ্চয় কোন ঝামেলা আছে।
-কি রকম?
-পিছন দিকটাতে যে ক’দিন লাইট জ্বালাতে গিয়েছি,বাজে কিছু না কিছু কানে এসেছেই।আজকেও…
-বাজে বলতে আসলে কি রকম বাজে?
-পিছনে যে গোয়ালঘরটা আছে না?সেখান থেকে প্রায়ই কান্নার শব্দ শুনি।ভিতরে গেলে কিচ্ছু নেই।তাছাড়া রাতে ছাদে গেলেও কান্নার শব্দ শোনা যায়।
-কবে থেকে এরকম হচ্ছে তোর সাথে?
-গত সপ্তাহ থেকে।বলবো বলবো করে বলা হয়নি।
আমি মুচকি হেসে বললাম,পাগল।সেরকম ভয়ের কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না।তুই মিছেমিছি ভয় পাচ্ছিস।কিছু থাকলে আমি অবশ্যই টের্ পেতাম।
-সেটা সত্যি।কিন্তু তারপরেও ব্যাপারটা কেমন গাঁ ছমছমে।ধর,রাতে ছাদে সিগারেট টানছি।হঠাৎ কেউ পিছন থেকে ঘাড়ে হাত দিলো,পিছন ফিরে দেখব,বিভৎস চেহারা।চোখ নেই কিংবা চোখের কোটর থেকে রক্ত পড়ছে, তখন…?
-ধ্যুর পাগল।এরকম কিছু হবে না।নিশ্চিন্তে থাক।
.
ব্যাপারটা আসলে সত্যি।আমিও বেশ কয়েকবার টের পেয়েছি।কিন্তু এড়িয়ে গেলাম আশিক যাতে ভয়েভয়ে না থাকে।ভয় মানুষকে দূর্বল বানিয়ে দেয়।এই ধরুন,আপনার সাধারণ জ্বর হলো।কিন্তু আপনি যদি উপসর্গগুলোকে করোনার সাথে মিলানো শুরু করেন,তবে আরো দ্রুত অসুস্থ হয়ে যাবেন।খুব বাজে ভাবে অসুস্থ হয়ে যাবেন।
.
১০মে,রাত তিনটে নাগাদ মোবাইলে টুং করে শব্দ হলো।হাতে নিয়ে দেখলাম আশিকের ম্যাসেজ,জলদি, ছাদে আয়।
এই মাঝরাতে ছেলেটা একা একা ছাদে গেছে।নিশ্চয় অস্বাভাবিক কিছু দেখেছে।আমি দ্রুত ছাদে গেলাম।আশিক বলল,দোস্ত দেখ গোয়ালঘর থেকে গোঙ্গানির শব্দ ভেসে আসছে।আমি কানখাড়া করে শোনার চেষ্ঠা করলাম।সত্যিই গোঙ্গানির শব্দ ভেসে আসছে।লাইট হাতে নিয়ে দুজনে নিচে গেলাম।গোয়ালঘরের দেয়ালে কান লাগিয়ে ভিতরের অবস্থা বোঝার চেষ্ঠা করলাম।বেশ পরিষ্কার শব্দ।দরজা খুলে ধীরপায়ে দুজনে ভিতরে ঢুকলাম।ভিতরে যেতেই কান্নার আওয়াজ কিছুটা কমে গেল।ঘুটঘুটে অন্ধকার চারিপাশ, পুবের কোণায় চেয়ারে কিছু একটা আছে।আমি আশিকের দিকে তাকালাম।উৎসুক চাহনি নিয়ে ও-চারিদিকে দেখছে।সম্ভবত পুবের কোণার দিকে খেয়ালই করে নি।তাছাড়া ওর দেখার কথাও না।গোয়ালঘরটা বেশ বড়।বাড়িওয়ালা হয়তো একসময় গরুর ফার্ম বানিয়েছিলেন।এখন ষ্টোর রুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
.
আমি সেদিকেই এগোলাম।চেয়ারে বসা মানুষটি,মহিলা।বাচ্চা’কে দুধ খাওয়াচ্ছেন আর কাঁদছেন।খুব কাছে যেতেই মহিলাটি আমার দিকে তাকালেন।রক্তাক্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।চোখের ভাষা বেশ পরিষ্কার।আমি যে তাকে দেখতে পাচ্ছি,এটা তিনি বুঝতে পারছেন।জোরে জোরে শ্বাস ফেলছেন।যেখানে আমার ভয় পাবার কথা,সেখানে তিনিই ভয় পাচ্ছেন।আমি বললাম,কে আপনি?
কোন জবাব আসার আগেই রক্তমাখা শরীরটা হারিয়ে গেল।আশপাশ ভালো ভাবে দেখে চলে এলাম।আশিককে বললাম,চল যাওয়া যাক।তেমন কিছু না।
-তেমন কিছু না বললেই হলো?শুধুমাত্র আমার মনের ভুল হলে আজকে তুই আওয়াজটা শুনতিস না।
-চল্।যাই।
-বল না,ব্যাপারটা আসলে কি?
-পরে এ ব্যাপারে কথা হবে।চল যাই।
.
মে মাসের ১৩ তারিখ।ছাদে বসে দুই বন্ধু সিগারেট টানছি।হঠাৎ বাড়িওয়ালার ফোন।
-আস্সালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম।কি খবর,আকাশবাবু?
-আলহামদুলিল্লাহ।আপনি কেমন আছেন?
-আলহামদুলিল্লাহ।তা কোন ঝামেলা টামেলা হয়নি তো?
-না।কিছু কি হতে পারে?
-না।তবে বাড়িওয়ালা নেই।টোকাই পোলাপান যদি জ্বালায়,এই আর কি।
-সেরকম সমস্যা করেনি কেউ।
-সমস্যা করলে বলবেন।আমার ছোট শালা উত্তরা থানার ওসি।
-জ্বি,বলবো।
-টাকা পাঠিয়েছি,গিয়েছে?
-হ্যাঁ।
-সাবধানে থাকবেন।খেয়াল রাখবেন বাসাটার।আর কোন সমস্যা হলে বলবেন।
-জ্বি।
.
মে মাসের ১৫ তারিখ,সেদিন বুধবার।রাত এক’টা নাগাদে ছাদে গেলাম।আশিককে বলে আসা হয় নি।সিগারেট টানছিলাম আর অপেক্ষা করছিলাম কান্নার শব্দের জন্য।যখন দু’টা বাজে,তখন ধীরে ধীরে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম।আওয়াজ জোরালো হলে, নিচে গেলাম।দরজা খুললাম খুবই সতর্কতার সাথে।আজকেও ঠিক পুবের কোণাতেই দেখলাম উনাকে।কাছাকাছি যেতেই উনি দেখে ফেললেন আমাকে।চেয়ার ছুঁড়ে মেরে আঘাত করার চেষ্ঠা করলেন।কিন্তু ব্যর্থ হলেন।হিংস্র চাহনিতে আবার আঘাত করার চেষ্ঠা করে,আবার বিফলে গেলেন।দূরে সরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসাসসূচক চোখে চেয়ে রইলেন।রাজ্যের হাজারও প্রশ্ন যেন তার চোখে।আমি ধীরে ধীরে তার নিকটে গেলাম।কাছে যেতেই উনি বলবেন,প্লিজ আমাদের আর মারবেন না।আমি নিতুকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাব।
.
আমি বললাম,ভয়ের কিছু নেই।আমি কাউকে মারতে আসিনি।কে আপনি?আর আপনার,আপনার কোলের শিশুর এই অবস্থা কেন?কিভাবে হয়েছে?
-আপনি কে?আর আমাদের সাথে কথা বলছেন কি করে?দেখছেনই বা কি করে?
-সেটা একটা রহস্য।সব’টা বলুন।আমি আপনার সাহায্যেও আসতে পারি।
-কি রকম, সাহায্য?আমি যা করতে বলবো,করতে পারবেন?
-সেজন্য সব’টা শুনতে হবে আমাকে।
-তবে শুনোন।