রাবু- নামক কাল্পনিক চরিত্র

  • Update Time : ০৪:৫৬:২৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ জুলাই ২০২০
  • / 332
মেসকাত হোসেন:
আমাদের গতিময় এই জীবন যেন নানারকম কল্পনায় ভরপুর। এসব কল্পনা- জল্পনার হাত ধরেই আমাদের জীবনের ধারাবাহিক কাঠামো গড়ে ওঠে। আর এজন্যই মনুষ্যজাতি সর্বদা কল্পনার কম্পনে ঝাঁকুনি খেতে চায়। তাইতো আমিও এর বিরোধিতা করতে নারাজ।
.
নোবেলজয়ী মহান পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইন যখন, স্বয়ং নিজেই তাঁর  জ্ঞানের চেয়ে কল্পনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন; তখন আমার মত তুচ্ছ স্বঘোষিত লেখকেরই কল্পনা করা ছাড়া আর কি-ই-বা করার আছে। আর   তাই তো আমার মত সকল মনুষ্যই তার নিজস্ব কল্পনার রাজা; আর কল্পনার স্থায়িত্ব যেন তার রাজত্ব ক্ষমতা।
.
‘কল্পনা’ করার রোগটি বড়ই সংক্রামক, যার কোন প্রতিষেধক নেই। যে কেউ সহজেই সংক্রমিত হতে পারে। উচ্চবংশীয় খান, চৌধুরী, চক্রবর্তী হতে শুরু করে পথে পথে ট্যাক্স আদায়কারী ভিক্ষুক  মহাশয়ও এর হাত হতে রক্ষা পাননি। যার ফলে স্বভাবতই, ঐ লেবুতলা মোড়ের শেষ মাথায়, রাসেলের চায়ের দোকানের পাশের গলিতে,  দিন কাটানো লাল জামা পরিহিত ছেলেটিও এই কল্পনার কাহিনীতে ধরা পড়া কই মাছ।
.
বুদ্ধিমান  পাঠক হয়তো ভাবছেন, কৈ মাছ কেন? তার ব্যাখ্যা না হয় এই উদীয়মান স্বঘোষিত লেখকের এই অপক্ক অভিষেক সাহিত্যের শেষেই পাবেন।  দয়া করে একটু ধৈর্য্য ধারণ করুন। আর যদি মনটাকে ফ্রেশ করতে চান তাহলে এক গ্লাস করলার জুস পান করতে পারেন। আহা! করলার জুস! বড়ই সুস্বাদু উপকারী রেসিপি। এক গ্লাস পান করে সাহিত্যে ফেরা যাক। সাহিত্য নং ফেরাং উত্তমঃ।
.
যাহোক, লালজামা পরিহিত সেই ছেলেটিকে লেবুতলা মোড়ে সবাই চেনেন। কিন্তু তার আকিকা ছাড়াই ‘রাবু’- নামটি কেবল তার আপনজন ছাড়া আর কেউই জানেনা। নিজেও যেন তার নামটি ভুলতে বসেছে। আর ভুলবেই না বা কেন? সারাদিন ক্ষুধার্ত পেটে ছুটে বেড়াতে বেড়াতে খাবার ছাড়া আর কিছু কি মাথায় আসে?
.
তবে এর মধ্যেও তার কল্পনার জগতটি বিস্তার পেতে থাকে। রাবু তার কল্পনার জগতে নিজেকে নবাব সিরাজউদ্দৌলার রূপে নিজেকে কল্পনা করে। তবে এই নব্য কল্পিত নবাব সিরাজের রাজত্ব যেন আলাদিনের চেরাগ। যাহা চাই , তাহা পাই। এই অভাবহীন কল্পনাটা স্ব-ঘোষিত এই লেখকের নহে পাঠক  মহাশয়।
.
এটি রাবু  নামক এই নব্য সিরাজের কল্পনা।  কেননা, তার রাজত্ব হলো লেবু তলার মোড় হতে শুরু করে তার  অনির্দিষ্ট ভ্রমণপথ পর্যন্ত বিস্তৃত। আর এই নব্য সিরাজের রাজত্ব রক্ষার জন্য তার সাথে রয়েছে এগলি- ওগলির, নেপোলিয়ান কর্তৃক প্রশিক্ষিত কুকুরবৃন্দ।
.
বলে রাখি, পাঠক মহাশয় যদি একটু দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়েন ;তবে ওই অমৃত রেসিপি ( করলার জুস) আবারও এক গ্লাস পান করে সাহিত্যের ফিরতে পারেন।
.
রাবু যেহেতু নিজেকে নবাব মনে করে সেহেতু তার আহার, বসবাস নিয়ে নিজস্ব কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই । কিন্তু তার শুভাকাঙ্খীরা তাকে নিয়ে খুবই চিন্তা প্রকাশ করত। কিন্তু কাজের কাজটি কেউই করত না। আর এই নব্য নবাব সিরাজউদ্দৌলা সাধারণত কোন দিন নারায়ণ ঠাকুরের মন্দিরে, আবার কোনদিন লেবুতলা জামে মসজিদে আহার করে থাকে। আবার কোন কোন দিন হয়তো বা না খেয়েই কাটাতে হয়। এই নব্য সিরাজের সবকিছু থাকলেও নেই তার পিতা।
.
যখন রাবুর  ৫ বছর পূর্ণ হয় তার পিতা তাকে একটি লাল রঙের জামা উপহার দিয়েছিল।  সেই উপহারটিই ছিল তার বাবার দেয়া শেষ উপহার। এর কিছুদিন পরেই তার বাবার একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। এরপরই তার জীবন যাপনের বর্তমান পরিস্থিতির কিছুটা আবির্ভাব ঘটে। বাবার মৃত্যুর পর রাবু তার মায়ের সাথে কুঁড়েঘরে থাকত।
.
রাবুর যাবতীয় দুঃখের সমাপ্তি ঘটত তার মায়ের উষ্ণ বুকে স্নেহের আদরে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায়।  এভাবে কিছুদিন কাটলেও তার মা একদিন  (সম্ভবত রাবুর পিতৃ শোকে) মারা যায়। রাবুর  যেটা বোঝার ক্ষমতা ছিল না বলেই সে এটাকে গভীর ঘুম মনে করত। রাবুর কল্পনায় তার মা তখন একজন নিষ্ঠুর মা। তা না হলে কোন মা কি  তার সন্তানকে অনাহারে রেখে এমন গভীর ঘুম দিতে পারে? এ তো যেমন তেমন ঘুম না, যেন কুম্ভকর্ণের মত স্বর্গীয়  ঘুম।  যা আর কোনদিনই ভাঙবে না।
.
প্রায় প্রতিদিনই রাবু খাবার  না পেলে মাকে স্মরণ করে; সে কল্পনা করে, হয়তো মা বেঁচে থাকলে পূর্বের ন্যায় লবণ, ভেজাভাত,  পেঁয়াজ ও মরিচ এর মিশ্রণ দিয়ে একটি বিশেষ স্যুপ তৈরি করে দিত। এই বিশেষ স্যুপটি অবশ্য প্রায় প্রতিটি গরিব ঘরের ব্রেকফাস্ট, আবার কারও কারও লাঞ্ছ বটে। যদিও মূর্খ জাতি এটিকে পান্তা বলে থাকে।
.
রাবুর খাবার ঠিকমতো জুটত না। তাই প্রায়ই রাতে তাকে অনাহারে ঘুমাতে হতো।  অনেক সময় অসহ্য ক্ষুধার জ্বালা জেগে উঠলে সে তার সৈনিকের সাথে ডাস্টবিন নামক উন্মুক্ত রেস্টুরেন্টে খেয়ে থাকে যেখানে কোন বিল দিতে হয় না।
.
এই নব্য রাজকুমারের ন্যায় আরো কিছু রাজকুমারের একটি যৌথ অথচ পরাধীন সাম্রাজ্য রয়েছে, যেটিকে শিক্ষিত সমাজ এতিমখানা বলে থাকে। রাবু  সেখানে থাকতে চায় না। কেননা সেখানে রাজত্বের চেয়ে অত্যাচার বেশি। এইতো সেদিনই এক ছেলে  কিছু খাবার চুরি করে খাওয়ার কারণে এতিমখানার ম্যানেজার তাকে লাঠি সহিত এমন স্নেহ করেছে যে, প্রায় এক সপ্তাহ ওই ছেলেটিকে জ্বর ও গায়ের ব্যথা নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনি।
.
অন্যদিকে এলাকার উকিল সাহেবের ছেলে সুমনও একই পরিস্থিতির শিকার হয়।  কিন্তু একটু তফাৎ রয়েছে। সুমন প্রতিদিন ডিম, দুধ, মাছ, মাংস  না খাওয়ার কারণে একই নির্যাতনের শিকার হয়। কি অদ্ভুত ব্যাপার!!  একজন খেতে চাইলে মার খায়, অপরজন না খেতে চাইলে। হিসেবটা খুবই অদ্ভুত। রাবুর কাছে এটি ৮ এর   ঘরের নামতা মুখস্ত করার মতো কঠিন লাগে।  তবে এটি সর্বজনীন আশ্চর্যের বিষয়ও বটে।তবে এর চেয়েও হয়তো আরো আশ্চর্যের বিষয় রয়েছে যার একটি রাবুর জীবনের পরবর্তী অধ্যায় হিসেবে যুক্ত।
.
রাবুর আহার  যেহেতু নিয়মিত জুটত না, সেহেতু তার অনাহারে থাকার ক্ষমতা টা বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে খুব বেশি অসহ্যকর হলে সে এদিক-ওদিক উঁকি দেয় এই আশায়  যে,  যদি কেউ তাকে খাবার দেয়। এমতবস্থায় রাবু   সুমনদের বাড়ির দিকেই বেশি যায় । সুমনও রাবুর ভালো বন্ধু ছিল। সুমনের মা রাবুকে  পুত্রস্নেহ করতেন।  কিন্তু উকিল সাহেব রাবুকে দেখলেই খিটখিট আচরণ করতেন।  তিনি খুব রাগী ও খিটখিটে  স্বভাবের হওয়ার কারণে এলাকার সবাই তাকে খুব ভয় ও ঘৃণা দুটোই করতেন।
.
এইতো সেদিনই নগেন নাপিতের ছেলে বল খেলতে গিয়ে উকিল সাহেবের গাড়িটি নোংরা করে ফেলায় উকিল সাহেবের ছেলেটিকে উত্তম-মধ্যম দেয়। হায় রে! বেচারা ছেলেটি, কয়েক দিন ব্যথায় উঠতে পারেনি।এতে সবাই রাগান্বিত হলেও কেউই তার প্রকাশ্য প্রতিবাদ করতে পারেনি। নগেন নাপিতও তো নয়। অবশ্য নগেনের অনুচ্চারিত অভিশাপ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা।
.
উপরওয়ালা হয়তো নগেন নাপিতের অভিশাপ কবুল করেছিলেন। কেননা উক্ত ঘটনার মাসখানেক পরে সেবার প্রবল বৃষ্টিতে বন্যা হয়। বন্যায় লেবু তলার মোড় সহ আশেপাশের কয়েকটি এলাকার লোকজন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।  তবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন উকিল সাহেব। ওনার বাপ-দাদার  গড়ে যাওয়া বিশাল বাড়িটি ধ্বসে যায়। সাথে বিভিন্ন ধন- সম্পত্তি তলিয়ে  যায়। তবে যেটি আসল ক্ষতি হয়েছিল তা হলো বাড়ি ধ্বসের সময় ওনার পা দুটি ভেঙে যায়।
.
 যাহোক, বন্যাটি বেশিদিন স্থায়ী না হলেও যার যা ক্ষতি হবার ছিল, তাতো হয়েই গিয়েছিল। বন্যা শেষে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতায় সবাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছিল। উকিল সাহেবও নিজেকে বদলে ফেললেন।  এবং সবার সহযোগিতা করার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন।  সবাই হাসিখুশিতে দিন কাটাতে লাগলেন। সবাই বন্যার স্মৃতিচারণের কিছু রসিকতাও  সমাবেশ ও আড্ডায় তুলে ধরতো।  সবাই সবার কথা বলতো।
.
কিন্তু  একজন ছিল, যার কথা হয়তো কারো- ই বা   মনে ছিল না। যাকে হয়তো কেউই স্মরণ রাখে নি, হয়তো আর রাখবেও না। সে বেঁচে আছে কিনা হয়তো কেউই জানবে না। হয়তো আর লাল জামা পরিহিত সেই রাবু নামক সিরাজউদ্দৌলাকে, লেবু তলার মোড়ে আর দেখা যাবে না। হয়তোবা সে রাসেলের চা আর খাবে না। এই কল্পিত নবাবের জীবনের পরাজয় টা হয়তো বন্যার পর কোন একটি রোগে, হয়তো চিকিৎসার অথবা খাদ্যের অভাবে হয়েছিল। হয়তো সাহায্যের জন্য সেই কুঁড়েঘর থেকে কাউকে ডাকার ক্ষমতাও তার ছিল না।
.
পরিশেষে, 
.
বুদ্ধিমান পাঠক মহাশয়ের কাছে, এই কৌতুহলী স্বঘোষিত লেখক এর কিছু প্রশ্ন রয়েছে। সঠিক উত্তর দিতে পাবলে পাবেন করলার জুস। তবে চলুনঃ
.
এই কল্পিত নবাব সিরাজের রাজত্বে না ছিল মীরজাফর, না ছিল  ঘষেটি বেগম এমনকি ইংরেজরাও ছিল না। তাহলে মোহাম্মদী বেগ ছাড়াই কার আদেশে বা কোন অপরাধে রাবু নামক নব্য এই  সিরাজের জীবনের পরাজয় ঘটল?
.
বুদ্ধীমান পাঠক মহাশয় উত্তরে হয়তো বলবেন চিরসত্য সেই কথা যার নাম ” দারিদ্রতা” অথবা  “এতিমতা”।
.
উন্নয়নশীল এই সমাজে এরকম উত্তরটি আজও শুনতে হবে এই ভেবে এই তুচ্ছ স্বঘোষিত   লেখকের মাথাটি আর কাজ করছে না।
.
তাই পাঠক মহাশয়ের নিকট আবেদন, আসুন আমরা একসাথে করলার স্যুপটি পান করি। তাতে —–কিছুটা মাইন্ড ফ্রেশ হতে পারে—-।
.
লেখক: শিক্ষার্থী, প্রথম বর্ষ,অর্থনীতি বিভাগ
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। 
.
Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


রাবু- নামক কাল্পনিক চরিত্র

Update Time : ০৪:৫৬:২৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ জুলাই ২০২০
মেসকাত হোসেন:
আমাদের গতিময় এই জীবন যেন নানারকম কল্পনায় ভরপুর। এসব কল্পনা- জল্পনার হাত ধরেই আমাদের জীবনের ধারাবাহিক কাঠামো গড়ে ওঠে। আর এজন্যই মনুষ্যজাতি সর্বদা কল্পনার কম্পনে ঝাঁকুনি খেতে চায়। তাইতো আমিও এর বিরোধিতা করতে নারাজ।
.
নোবেলজয়ী মহান পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইন যখন, স্বয়ং নিজেই তাঁর  জ্ঞানের চেয়ে কল্পনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন; তখন আমার মত তুচ্ছ স্বঘোষিত লেখকেরই কল্পনা করা ছাড়া আর কি-ই-বা করার আছে। আর   তাই তো আমার মত সকল মনুষ্যই তার নিজস্ব কল্পনার রাজা; আর কল্পনার স্থায়িত্ব যেন তার রাজত্ব ক্ষমতা।
.
‘কল্পনা’ করার রোগটি বড়ই সংক্রামক, যার কোন প্রতিষেধক নেই। যে কেউ সহজেই সংক্রমিত হতে পারে। উচ্চবংশীয় খান, চৌধুরী, চক্রবর্তী হতে শুরু করে পথে পথে ট্যাক্স আদায়কারী ভিক্ষুক  মহাশয়ও এর হাত হতে রক্ষা পাননি। যার ফলে স্বভাবতই, ঐ লেবুতলা মোড়ের শেষ মাথায়, রাসেলের চায়ের দোকানের পাশের গলিতে,  দিন কাটানো লাল জামা পরিহিত ছেলেটিও এই কল্পনার কাহিনীতে ধরা পড়া কই মাছ।
.
বুদ্ধিমান  পাঠক হয়তো ভাবছেন, কৈ মাছ কেন? তার ব্যাখ্যা না হয় এই উদীয়মান স্বঘোষিত লেখকের এই অপক্ক অভিষেক সাহিত্যের শেষেই পাবেন।  দয়া করে একটু ধৈর্য্য ধারণ করুন। আর যদি মনটাকে ফ্রেশ করতে চান তাহলে এক গ্লাস করলার জুস পান করতে পারেন। আহা! করলার জুস! বড়ই সুস্বাদু উপকারী রেসিপি। এক গ্লাস পান করে সাহিত্যে ফেরা যাক। সাহিত্য নং ফেরাং উত্তমঃ।
.
যাহোক, লালজামা পরিহিত সেই ছেলেটিকে লেবুতলা মোড়ে সবাই চেনেন। কিন্তু তার আকিকা ছাড়াই ‘রাবু’- নামটি কেবল তার আপনজন ছাড়া আর কেউই জানেনা। নিজেও যেন তার নামটি ভুলতে বসেছে। আর ভুলবেই না বা কেন? সারাদিন ক্ষুধার্ত পেটে ছুটে বেড়াতে বেড়াতে খাবার ছাড়া আর কিছু কি মাথায় আসে?
.
তবে এর মধ্যেও তার কল্পনার জগতটি বিস্তার পেতে থাকে। রাবু তার কল্পনার জগতে নিজেকে নবাব সিরাজউদ্দৌলার রূপে নিজেকে কল্পনা করে। তবে এই নব্য কল্পিত নবাব সিরাজের রাজত্ব যেন আলাদিনের চেরাগ। যাহা চাই , তাহা পাই। এই অভাবহীন কল্পনাটা স্ব-ঘোষিত এই লেখকের নহে পাঠক  মহাশয়।
.
এটি রাবু  নামক এই নব্য সিরাজের কল্পনা।  কেননা, তার রাজত্ব হলো লেবু তলার মোড় হতে শুরু করে তার  অনির্দিষ্ট ভ্রমণপথ পর্যন্ত বিস্তৃত। আর এই নব্য সিরাজের রাজত্ব রক্ষার জন্য তার সাথে রয়েছে এগলি- ওগলির, নেপোলিয়ান কর্তৃক প্রশিক্ষিত কুকুরবৃন্দ।
.
বলে রাখি, পাঠক মহাশয় যদি একটু দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়েন ;তবে ওই অমৃত রেসিপি ( করলার জুস) আবারও এক গ্লাস পান করে সাহিত্যের ফিরতে পারেন।
.
রাবু যেহেতু নিজেকে নবাব মনে করে সেহেতু তার আহার, বসবাস নিয়ে নিজস্ব কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই । কিন্তু তার শুভাকাঙ্খীরা তাকে নিয়ে খুবই চিন্তা প্রকাশ করত। কিন্তু কাজের কাজটি কেউই করত না। আর এই নব্য নবাব সিরাজউদ্দৌলা সাধারণত কোন দিন নারায়ণ ঠাকুরের মন্দিরে, আবার কোনদিন লেবুতলা জামে মসজিদে আহার করে থাকে। আবার কোন কোন দিন হয়তো বা না খেয়েই কাটাতে হয়। এই নব্য সিরাজের সবকিছু থাকলেও নেই তার পিতা।
.
যখন রাবুর  ৫ বছর পূর্ণ হয় তার পিতা তাকে একটি লাল রঙের জামা উপহার দিয়েছিল।  সেই উপহারটিই ছিল তার বাবার দেয়া শেষ উপহার। এর কিছুদিন পরেই তার বাবার একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। এরপরই তার জীবন যাপনের বর্তমান পরিস্থিতির কিছুটা আবির্ভাব ঘটে। বাবার মৃত্যুর পর রাবু তার মায়ের সাথে কুঁড়েঘরে থাকত।
.
রাবুর যাবতীয় দুঃখের সমাপ্তি ঘটত তার মায়ের উষ্ণ বুকে স্নেহের আদরে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায়।  এভাবে কিছুদিন কাটলেও তার মা একদিন  (সম্ভবত রাবুর পিতৃ শোকে) মারা যায়। রাবুর  যেটা বোঝার ক্ষমতা ছিল না বলেই সে এটাকে গভীর ঘুম মনে করত। রাবুর কল্পনায় তার মা তখন একজন নিষ্ঠুর মা। তা না হলে কোন মা কি  তার সন্তানকে অনাহারে রেখে এমন গভীর ঘুম দিতে পারে? এ তো যেমন তেমন ঘুম না, যেন কুম্ভকর্ণের মত স্বর্গীয়  ঘুম।  যা আর কোনদিনই ভাঙবে না।
.
প্রায় প্রতিদিনই রাবু খাবার  না পেলে মাকে স্মরণ করে; সে কল্পনা করে, হয়তো মা বেঁচে থাকলে পূর্বের ন্যায় লবণ, ভেজাভাত,  পেঁয়াজ ও মরিচ এর মিশ্রণ দিয়ে একটি বিশেষ স্যুপ তৈরি করে দিত। এই বিশেষ স্যুপটি অবশ্য প্রায় প্রতিটি গরিব ঘরের ব্রেকফাস্ট, আবার কারও কারও লাঞ্ছ বটে। যদিও মূর্খ জাতি এটিকে পান্তা বলে থাকে।
.
রাবুর খাবার ঠিকমতো জুটত না। তাই প্রায়ই রাতে তাকে অনাহারে ঘুমাতে হতো।  অনেক সময় অসহ্য ক্ষুধার জ্বালা জেগে উঠলে সে তার সৈনিকের সাথে ডাস্টবিন নামক উন্মুক্ত রেস্টুরেন্টে খেয়ে থাকে যেখানে কোন বিল দিতে হয় না।
.
এই নব্য রাজকুমারের ন্যায় আরো কিছু রাজকুমারের একটি যৌথ অথচ পরাধীন সাম্রাজ্য রয়েছে, যেটিকে শিক্ষিত সমাজ এতিমখানা বলে থাকে। রাবু  সেখানে থাকতে চায় না। কেননা সেখানে রাজত্বের চেয়ে অত্যাচার বেশি। এইতো সেদিনই এক ছেলে  কিছু খাবার চুরি করে খাওয়ার কারণে এতিমখানার ম্যানেজার তাকে লাঠি সহিত এমন স্নেহ করেছে যে, প্রায় এক সপ্তাহ ওই ছেলেটিকে জ্বর ও গায়ের ব্যথা নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনি।
.
অন্যদিকে এলাকার উকিল সাহেবের ছেলে সুমনও একই পরিস্থিতির শিকার হয়।  কিন্তু একটু তফাৎ রয়েছে। সুমন প্রতিদিন ডিম, দুধ, মাছ, মাংস  না খাওয়ার কারণে একই নির্যাতনের শিকার হয়। কি অদ্ভুত ব্যাপার!!  একজন খেতে চাইলে মার খায়, অপরজন না খেতে চাইলে। হিসেবটা খুবই অদ্ভুত। রাবুর কাছে এটি ৮ এর   ঘরের নামতা মুখস্ত করার মতো কঠিন লাগে।  তবে এটি সর্বজনীন আশ্চর্যের বিষয়ও বটে।তবে এর চেয়েও হয়তো আরো আশ্চর্যের বিষয় রয়েছে যার একটি রাবুর জীবনের পরবর্তী অধ্যায় হিসেবে যুক্ত।
.
রাবুর আহার  যেহেতু নিয়মিত জুটত না, সেহেতু তার অনাহারে থাকার ক্ষমতা টা বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে খুব বেশি অসহ্যকর হলে সে এদিক-ওদিক উঁকি দেয় এই আশায়  যে,  যদি কেউ তাকে খাবার দেয়। এমতবস্থায় রাবু   সুমনদের বাড়ির দিকেই বেশি যায় । সুমনও রাবুর ভালো বন্ধু ছিল। সুমনের মা রাবুকে  পুত্রস্নেহ করতেন।  কিন্তু উকিল সাহেব রাবুকে দেখলেই খিটখিট আচরণ করতেন।  তিনি খুব রাগী ও খিটখিটে  স্বভাবের হওয়ার কারণে এলাকার সবাই তাকে খুব ভয় ও ঘৃণা দুটোই করতেন।
.
এইতো সেদিনই নগেন নাপিতের ছেলে বল খেলতে গিয়ে উকিল সাহেবের গাড়িটি নোংরা করে ফেলায় উকিল সাহেবের ছেলেটিকে উত্তম-মধ্যম দেয়। হায় রে! বেচারা ছেলেটি, কয়েক দিন ব্যথায় উঠতে পারেনি।এতে সবাই রাগান্বিত হলেও কেউই তার প্রকাশ্য প্রতিবাদ করতে পারেনি। নগেন নাপিতও তো নয়। অবশ্য নগেনের অনুচ্চারিত অভিশাপ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা।
.
উপরওয়ালা হয়তো নগেন নাপিতের অভিশাপ কবুল করেছিলেন। কেননা উক্ত ঘটনার মাসখানেক পরে সেবার প্রবল বৃষ্টিতে বন্যা হয়। বন্যায় লেবু তলার মোড় সহ আশেপাশের কয়েকটি এলাকার লোকজন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।  তবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন উকিল সাহেব। ওনার বাপ-দাদার  গড়ে যাওয়া বিশাল বাড়িটি ধ্বসে যায়। সাথে বিভিন্ন ধন- সম্পত্তি তলিয়ে  যায়। তবে যেটি আসল ক্ষতি হয়েছিল তা হলো বাড়ি ধ্বসের সময় ওনার পা দুটি ভেঙে যায়।
.
 যাহোক, বন্যাটি বেশিদিন স্থায়ী না হলেও যার যা ক্ষতি হবার ছিল, তাতো হয়েই গিয়েছিল। বন্যা শেষে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতায় সবাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছিল। উকিল সাহেবও নিজেকে বদলে ফেললেন।  এবং সবার সহযোগিতা করার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন।  সবাই হাসিখুশিতে দিন কাটাতে লাগলেন। সবাই বন্যার স্মৃতিচারণের কিছু রসিকতাও  সমাবেশ ও আড্ডায় তুলে ধরতো।  সবাই সবার কথা বলতো।
.
কিন্তু  একজন ছিল, যার কথা হয়তো কারো- ই বা   মনে ছিল না। যাকে হয়তো কেউই স্মরণ রাখে নি, হয়তো আর রাখবেও না। সে বেঁচে আছে কিনা হয়তো কেউই জানবে না। হয়তো আর লাল জামা পরিহিত সেই রাবু নামক সিরাজউদ্দৌলাকে, লেবু তলার মোড়ে আর দেখা যাবে না। হয়তোবা সে রাসেলের চা আর খাবে না। এই কল্পিত নবাবের জীবনের পরাজয় টা হয়তো বন্যার পর কোন একটি রোগে, হয়তো চিকিৎসার অথবা খাদ্যের অভাবে হয়েছিল। হয়তো সাহায্যের জন্য সেই কুঁড়েঘর থেকে কাউকে ডাকার ক্ষমতাও তার ছিল না।
.
পরিশেষে, 
.
বুদ্ধিমান পাঠক মহাশয়ের কাছে, এই কৌতুহলী স্বঘোষিত লেখক এর কিছু প্রশ্ন রয়েছে। সঠিক উত্তর দিতে পাবলে পাবেন করলার জুস। তবে চলুনঃ
.
এই কল্পিত নবাব সিরাজের রাজত্বে না ছিল মীরজাফর, না ছিল  ঘষেটি বেগম এমনকি ইংরেজরাও ছিল না। তাহলে মোহাম্মদী বেগ ছাড়াই কার আদেশে বা কোন অপরাধে রাবু নামক নব্য এই  সিরাজের জীবনের পরাজয় ঘটল?
.
বুদ্ধীমান পাঠক মহাশয় উত্তরে হয়তো বলবেন চিরসত্য সেই কথা যার নাম ” দারিদ্রতা” অথবা  “এতিমতা”।
.
উন্নয়নশীল এই সমাজে এরকম উত্তরটি আজও শুনতে হবে এই ভেবে এই তুচ্ছ স্বঘোষিত   লেখকের মাথাটি আর কাজ করছে না।
.
তাই পাঠক মহাশয়ের নিকট আবেদন, আসুন আমরা একসাথে করলার স্যুপটি পান করি। তাতে —–কিছুটা মাইন্ড ফ্রেশ হতে পারে—-।
.
লেখক: শিক্ষার্থী, প্রথম বর্ষ,অর্থনীতি বিভাগ
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। 
.