বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু নয়, চিকিৎসার নিশ্চয়তা দিন

  • Update Time : ০৩:৩০:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ জুন ২০২০
  • / 172
আরিফ ইশতিয়াক রাহুল:
কয়েক মাস ধরে লক্ষ্য করছি, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসার অভাবে ও হাসপাতালে ভর্তি করাতে না পেরে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। নিঃসন্দেহে এর প্রধান কারণ করোনা পরিস্থিতি; যা শুধু চিকিৎসা খাতেই নয়, বরং বিশ্বের সকল কর্মকাণ্ডেই সৃষ্টি করেছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আমাদের দেশের অতি বাণিজ্যিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ও অধিকাংশ চিকিৎসকদের ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’ নীতির অবলম্বন । যার কারণে এখন মৃত্যুই হয়ে উঠেছে খুব সাধারণ ও নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার, প্রিয় মাতৃভূমি হয়ে উঠছে অচেনা মৃত্যুপুরী।একদিকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু, অপর দিকে করোনা সন্দেহে যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যু সমানুপাতিকভাবে বেড়ে চলেছে উভয় মৃত্যুর হার।
.
বর্তমাম সময়ে একজন অসুস্থ রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে গেলে রোগী কি সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে এসেছে তা জানতে চাওয়ার আগেই তার কাছে চাওয়া হয় করোনা নেগেটিভ থাকার রিপোর্ট। তার করোনার উপসর্গ থাকুক বা না থাকুক; সে হার্টের রোগী হোক, ক্যান্সারের রোগী হোক বা মানসিক রোগীই হোক তার কাছে রিপোর্ট চাওয়া হবেই। এরপর যা হওয়ার তাই হচ্ছে। সবাই তো আর করোনা টেস্ট করে নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে না, সবার সার্মথ্য বা প্রয়োজনও নেই করোনা টেস্ট করানোর, আবার সরকারের কাছে কোটি কোটি লোকের টেস্ট করানোর মতো কিটও নেই। কিন্তু হাসপাতালগুলো এ যুক্তি শুনবে না, তারা দরজা বন্ধ করে ভেতর থেকে করোনার নেগেটিভ রিপোর্ট চাইবে।
.
তৎক্ষণাৎ তাদের রিপোর্ট দেখাতে পারলে তারা কথা বলবে, না পারলে বলবে না। তাতে রোগী বাঁচুক বা মারা যাক তাদের কিছুই যায় আসে না। হাসপাতাল ও ডাক্তাদের বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হয়, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে করোনা ছাড়া আর কোনো রোগ নেই বা কখনও ছিলোও না। অসুস্থ রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়া হয় হাসপাতালের গেট থেকেই। এরপর তারা একইভাবে ঘোরে আরও কিছু হাসপাতালে এবং একই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে একইভাবে হয়রানি হয়। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে রোগী মুমূর্ষু অবস্থায় পৌঁছে যায়। কোথাও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না পেরে অবশেষে স্বজনদের অসুস্থ রোগীকে নিয়ে বাসায় ফিরতে হয়। কেউ বাসায় ফেরার পথেই চলে যায় না ফেরার দেশে, কেউবা বাসায় গিয়ে।
.
এভাবেই সম্প্রতি একের পর এক হাসপাতাল ঘুরে কিডনি জটিলতায় অবশেষে মারা গিয়েছেন অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকার। রাজধানীর ল্যাবএইড, স্কয়ার, ইউনাইটেড, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, রিজেন্ট হাসপাতাল, আনোয়ার খান মডার্ন সহ আরও কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরেও বাবার চিকিৎসা করাতে পারেননি মেয়ে ডা. সুস্মিতা আইচ। এটা তো শুধু একজন গৌতম আইচ সরকারের গল্প ছিলো। এভাবেই গত কয়েকমাসে রেবেকা সুলতানা, সাভারের জসীম উদ্দীন, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জিয়াউদ্দীন হায়দারের মা, চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা সফিউল আলম সগীর, চার বছরের শিশু শাওন, সিলেটের ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন খোকা, সোনারগাঁয়ের মেধাবী ছাত্রী ইসরাত জাহান উষ্ণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমন চাকমা, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি নেতা কামাল উদ্দিন, অন্তঃসত্ত্বা ফাতেমা আক্তার মুক্তা ও প্রবাসী সেকেন্দার হোসেন সহ আরও বহু হতভাগ্য মানুষের মৃত্যুকে বরণ করার করুণ গল্পের জন্ম হয়েছে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিলো না। তারা এমন একটি দেশের নাগরিক ছিলো যেখানে পাঁচটি মৌলিক অধিকারের একটি ছিলো চিকিৎসা। তাদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য এ রাষ্ট্র দায়বদ্ধ থাকলেও দুঃসময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্বয়ং রাষ্ট্রই তা অস্বীকার করেছে, এমনকি তাদের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত হওয়া সরকারি হাসপাতালগুলোও তাদের নূন্যতম চিকিৎসা প্রদান করে নি।
.
কিন্তু এমন পরিস্থিতি হঠাৎ করে রাতারাতি সৃষ্টি হয় নি। খুব দ্রুত সবকিছু ঘটলেও যথেষ্ট প্রস্তুতির সময়ও আমরা পেয়েছিলাম। আসন্ন ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা অনুমান করতে পেরেছিলেন আমাদের দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ। তারা বার বার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কিন্তু আমাদের মন্ত্রী মহোদয়রা বছরের শুরু থেকেই ( অন্যান্য দেশে যখন করোনা ভয়াবহ আকার ধারণ করে )  নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্যসেবার আশ্বাস দিয়েছেন। করোনা মোকাবিলায় তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন বলে জেনেছি।
.
আইইডিসিআরের পরিচালক ঘোষণা দিয়েছিলেন, তারা বিশেষায়িত হাসপাতাল সনাক্ত করছেন। ঢাকার বাইরেও এ ধরনের হাসপাতাল করা হবে বলে জানিয়েছিলেন। এ ও বলেছিলেন যে, যদি রোগী বৃদ্ধি পায় তাহলে স্কুল, কলেজ বা কমিউনিটি সেন্টারে হাসপাতাল করা হবে। আমরা তখন আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু ২-৩ মাসের মধ্যে আমরা লক্ষ্য করলাম, স্কুল, কলেজ ও কমিউনিটি সেন্টারের মতো অস্থায়ী হাসপাতালে করোনার উন্নত চিকিৎসা তো অনেক দূরের স্বপ্ন, পূর্বের স্বাভাবিক চিকিৎসা পাওয়াই এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে গেছে। এখন এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে করোনা হলে বা উপসর্গ থাকলে যৎসামান্য চিকিৎসা মিললেও অন্য রোগের ক্ষেত্রে বা করোনা শনাক্ত না হলে সেটাও মিলছে না। এর অর্থ এই নয় যে, হাসপাতালগুলো করোনা রোগী দিয়ে ভর্তি, তারা মূলত ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে দেশের এই চরম দুঃসময়ে।
.
শুনেছিলাম, বসুন্ধরা গ্রুপ ও আকিজ গ্রুপ নাকি চীনের হাসপাতালের চেয়েও বড় হাসপাতাল করবে করোনা চিকিৎসার জন্য। দেশে এখন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা লক্ষাধিক, মৃত্যুর সংখ্যাও হাজার ছাড়িয়েছে। বসুন্ধরা গ্রুপ ও আকিজ গ্রুপ কবে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করবে বা আদৌ চিকিৎসা দেবে কি না সে খবর আর পাওয়া যায় না। হাসপাতাল করার ঘোষণা দিয়ে নিজস্ব গণমাধ্যমে মানবিক হেডলাইনের প্রচারই তাদের কর্পোরেট উদ্দেশ্য ছিলো কি না তা জানি না। তবে বসুন্ধরা গ্রুপ ও আকিজ গ্রুপের কর্পোরেট উদ্দেশ্যের মতো কিছু কর্পোরেট হাসপাতাল চিকিৎসা দিচ্ছে বটে, যাকে চিকিৎসা না বলে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতা বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত। সেখানে সময়মতো ডাক্তার আসুক বা না আসুক, রুটিন করে টেস্ট করানো হবেই। এভাবেই চলছে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাত, চিকিৎসা ব্যবস্থা, মৃত্যুর প্রতিযোগিতা ও লাশের মিছিল। যেখানে আমরা একটি উন্নত দেশে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে উৎসবে মেতে ওঠার স্বপ্ন দেখেছিলাম সেখানে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর প্রহর গুনছি।
.
আমি জানি না, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় হঠাৎ করে এমন ভূমিধস ভরাডুবি কেনো নেমে আসলো? তবে তা যে শুধুমাত্র করোনা ভাইরাসের জন্য নয়-এতটুকু নিশ্চিত। করোনায় বিপর্যস্ত বিশ্বের সকল দেশই। কিন্তু তাই বলে করোনায় সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে অনুন্নত আফ্রিকার দেশগুলোতেও স্বাস্থ্যসেবার পরিমাণ রাতারাতি এভাবে হিমাঙ্কের নিচে চলে যায় নি। একেবারেই অজ্ঞাত ও প্রতিষেধকহীন ভাইরাসের চিকিৎসা দেশে দেওয়া হলেও পাশাপাশি এতোদিনের অভিজ্ঞতা সংবলিত অন্য রোগগুলোর চিকিৎসা না দেওয়া ও বিনা চিকিৎসায় প্রতিদিন মানুষের মৃত্যু হওয়া সত্যিই দুঃখজনক।
.
সরকারকে নতুন করে জানানোর কিছু নেই, কারণ যা হচ্ছে সব কিছুর তথ্যই সরকারের কাছে যাচ্ছে এবং সব কিছুর জন্য ভুক্তভোগীর পর সরকারই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই সরকারের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। মনে রাখা উচিত, রোগ মানেই করোনা নয়, রোগী মানেই করোনা পজিটিভ নয়, ডাক্তার মানেই করোনা চিকিৎসক নয় আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মানেও করোনা মন্ত্রণালয় নয়৷ আমাদের চিকিৎসা খাত শুধু করোনার চিকিৎসা নির্ভর করে ফেলা উচিত নয়। কারণ মানুষ যেমন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে তেমনি অন্য রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু কোনো রোগেরই যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছে না।
.
তাই আমি বিনয়ের সাথে সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, আপনারা চিকিৎসা খাতের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনুন; যেখানে আমরা আগের মতো যে কোনো রোগের জন্য চিকিৎসা নিতে পারবো। ঢেলে সাজানোর দরকার নেই, আমাদের আটপৌরে মধ্যবিত্ত ধরণের চিকিৎসা হলেই হবে-তবুও আমাদের চিকিৎসার অধিকারটুকু ফিরিয়ে দেন। প্রতিদিন বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর সংবাদ আমাদের ভারাক্রান্ত করে তোলে। এই অভিশাপ থেকে মুক্তি চাই।
.
লেখকঃ  শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
.
Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু নয়, চিকিৎসার নিশ্চয়তা দিন

Update Time : ০৩:৩০:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ জুন ২০২০
আরিফ ইশতিয়াক রাহুল:
কয়েক মাস ধরে লক্ষ্য করছি, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসার অভাবে ও হাসপাতালে ভর্তি করাতে না পেরে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। নিঃসন্দেহে এর প্রধান কারণ করোনা পরিস্থিতি; যা শুধু চিকিৎসা খাতেই নয়, বরং বিশ্বের সকল কর্মকাণ্ডেই সৃষ্টি করেছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আমাদের দেশের অতি বাণিজ্যিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ও অধিকাংশ চিকিৎসকদের ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’ নীতির অবলম্বন । যার কারণে এখন মৃত্যুই হয়ে উঠেছে খুব সাধারণ ও নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার, প্রিয় মাতৃভূমি হয়ে উঠছে অচেনা মৃত্যুপুরী।একদিকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু, অপর দিকে করোনা সন্দেহে যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যু সমানুপাতিকভাবে বেড়ে চলেছে উভয় মৃত্যুর হার।
.
বর্তমাম সময়ে একজন অসুস্থ রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে গেলে রোগী কি সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে এসেছে তা জানতে চাওয়ার আগেই তার কাছে চাওয়া হয় করোনা নেগেটিভ থাকার রিপোর্ট। তার করোনার উপসর্গ থাকুক বা না থাকুক; সে হার্টের রোগী হোক, ক্যান্সারের রোগী হোক বা মানসিক রোগীই হোক তার কাছে রিপোর্ট চাওয়া হবেই। এরপর যা হওয়ার তাই হচ্ছে। সবাই তো আর করোনা টেস্ট করে নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে না, সবার সার্মথ্য বা প্রয়োজনও নেই করোনা টেস্ট করানোর, আবার সরকারের কাছে কোটি কোটি লোকের টেস্ট করানোর মতো কিটও নেই। কিন্তু হাসপাতালগুলো এ যুক্তি শুনবে না, তারা দরজা বন্ধ করে ভেতর থেকে করোনার নেগেটিভ রিপোর্ট চাইবে।
.
তৎক্ষণাৎ তাদের রিপোর্ট দেখাতে পারলে তারা কথা বলবে, না পারলে বলবে না। তাতে রোগী বাঁচুক বা মারা যাক তাদের কিছুই যায় আসে না। হাসপাতাল ও ডাক্তাদের বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হয়, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে করোনা ছাড়া আর কোনো রোগ নেই বা কখনও ছিলোও না। অসুস্থ রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়া হয় হাসপাতালের গেট থেকেই। এরপর তারা একইভাবে ঘোরে আরও কিছু হাসপাতালে এবং একই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে একইভাবে হয়রানি হয়। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে রোগী মুমূর্ষু অবস্থায় পৌঁছে যায়। কোথাও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না পেরে অবশেষে স্বজনদের অসুস্থ রোগীকে নিয়ে বাসায় ফিরতে হয়। কেউ বাসায় ফেরার পথেই চলে যায় না ফেরার দেশে, কেউবা বাসায় গিয়ে।
.
এভাবেই সম্প্রতি একের পর এক হাসপাতাল ঘুরে কিডনি জটিলতায় অবশেষে মারা গিয়েছেন অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকার। রাজধানীর ল্যাবএইড, স্কয়ার, ইউনাইটেড, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, রিজেন্ট হাসপাতাল, আনোয়ার খান মডার্ন সহ আরও কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরেও বাবার চিকিৎসা করাতে পারেননি মেয়ে ডা. সুস্মিতা আইচ। এটা তো শুধু একজন গৌতম আইচ সরকারের গল্প ছিলো। এভাবেই গত কয়েকমাসে রেবেকা সুলতানা, সাভারের জসীম উদ্দীন, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জিয়াউদ্দীন হায়দারের মা, চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা সফিউল আলম সগীর, চার বছরের শিশু শাওন, সিলেটের ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন খোকা, সোনারগাঁয়ের মেধাবী ছাত্রী ইসরাত জাহান উষ্ণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমন চাকমা, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি নেতা কামাল উদ্দিন, অন্তঃসত্ত্বা ফাতেমা আক্তার মুক্তা ও প্রবাসী সেকেন্দার হোসেন সহ আরও বহু হতভাগ্য মানুষের মৃত্যুকে বরণ করার করুণ গল্পের জন্ম হয়েছে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিলো না। তারা এমন একটি দেশের নাগরিক ছিলো যেখানে পাঁচটি মৌলিক অধিকারের একটি ছিলো চিকিৎসা। তাদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য এ রাষ্ট্র দায়বদ্ধ থাকলেও দুঃসময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্বয়ং রাষ্ট্রই তা অস্বীকার করেছে, এমনকি তাদের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত হওয়া সরকারি হাসপাতালগুলোও তাদের নূন্যতম চিকিৎসা প্রদান করে নি।
.
কিন্তু এমন পরিস্থিতি হঠাৎ করে রাতারাতি সৃষ্টি হয় নি। খুব দ্রুত সবকিছু ঘটলেও যথেষ্ট প্রস্তুতির সময়ও আমরা পেয়েছিলাম। আসন্ন ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা অনুমান করতে পেরেছিলেন আমাদের দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ। তারা বার বার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কিন্তু আমাদের মন্ত্রী মহোদয়রা বছরের শুরু থেকেই ( অন্যান্য দেশে যখন করোনা ভয়াবহ আকার ধারণ করে )  নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্যসেবার আশ্বাস দিয়েছেন। করোনা মোকাবিলায় তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন বলে জেনেছি।
.
আইইডিসিআরের পরিচালক ঘোষণা দিয়েছিলেন, তারা বিশেষায়িত হাসপাতাল সনাক্ত করছেন। ঢাকার বাইরেও এ ধরনের হাসপাতাল করা হবে বলে জানিয়েছিলেন। এ ও বলেছিলেন যে, যদি রোগী বৃদ্ধি পায় তাহলে স্কুল, কলেজ বা কমিউনিটি সেন্টারে হাসপাতাল করা হবে। আমরা তখন আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু ২-৩ মাসের মধ্যে আমরা লক্ষ্য করলাম, স্কুল, কলেজ ও কমিউনিটি সেন্টারের মতো অস্থায়ী হাসপাতালে করোনার উন্নত চিকিৎসা তো অনেক দূরের স্বপ্ন, পূর্বের স্বাভাবিক চিকিৎসা পাওয়াই এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে গেছে। এখন এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে করোনা হলে বা উপসর্গ থাকলে যৎসামান্য চিকিৎসা মিললেও অন্য রোগের ক্ষেত্রে বা করোনা শনাক্ত না হলে সেটাও মিলছে না। এর অর্থ এই নয় যে, হাসপাতালগুলো করোনা রোগী দিয়ে ভর্তি, তারা মূলত ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে দেশের এই চরম দুঃসময়ে।
.
শুনেছিলাম, বসুন্ধরা গ্রুপ ও আকিজ গ্রুপ নাকি চীনের হাসপাতালের চেয়েও বড় হাসপাতাল করবে করোনা চিকিৎসার জন্য। দেশে এখন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা লক্ষাধিক, মৃত্যুর সংখ্যাও হাজার ছাড়িয়েছে। বসুন্ধরা গ্রুপ ও আকিজ গ্রুপ কবে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করবে বা আদৌ চিকিৎসা দেবে কি না সে খবর আর পাওয়া যায় না। হাসপাতাল করার ঘোষণা দিয়ে নিজস্ব গণমাধ্যমে মানবিক হেডলাইনের প্রচারই তাদের কর্পোরেট উদ্দেশ্য ছিলো কি না তা জানি না। তবে বসুন্ধরা গ্রুপ ও আকিজ গ্রুপের কর্পোরেট উদ্দেশ্যের মতো কিছু কর্পোরেট হাসপাতাল চিকিৎসা দিচ্ছে বটে, যাকে চিকিৎসা না বলে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতা বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত। সেখানে সময়মতো ডাক্তার আসুক বা না আসুক, রুটিন করে টেস্ট করানো হবেই। এভাবেই চলছে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাত, চিকিৎসা ব্যবস্থা, মৃত্যুর প্রতিযোগিতা ও লাশের মিছিল। যেখানে আমরা একটি উন্নত দেশে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে উৎসবে মেতে ওঠার স্বপ্ন দেখেছিলাম সেখানে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর প্রহর গুনছি।
.
আমি জানি না, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় হঠাৎ করে এমন ভূমিধস ভরাডুবি কেনো নেমে আসলো? তবে তা যে শুধুমাত্র করোনা ভাইরাসের জন্য নয়-এতটুকু নিশ্চিত। করোনায় বিপর্যস্ত বিশ্বের সকল দেশই। কিন্তু তাই বলে করোনায় সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে অনুন্নত আফ্রিকার দেশগুলোতেও স্বাস্থ্যসেবার পরিমাণ রাতারাতি এভাবে হিমাঙ্কের নিচে চলে যায় নি। একেবারেই অজ্ঞাত ও প্রতিষেধকহীন ভাইরাসের চিকিৎসা দেশে দেওয়া হলেও পাশাপাশি এতোদিনের অভিজ্ঞতা সংবলিত অন্য রোগগুলোর চিকিৎসা না দেওয়া ও বিনা চিকিৎসায় প্রতিদিন মানুষের মৃত্যু হওয়া সত্যিই দুঃখজনক।
.
সরকারকে নতুন করে জানানোর কিছু নেই, কারণ যা হচ্ছে সব কিছুর তথ্যই সরকারের কাছে যাচ্ছে এবং সব কিছুর জন্য ভুক্তভোগীর পর সরকারই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই সরকারের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। মনে রাখা উচিত, রোগ মানেই করোনা নয়, রোগী মানেই করোনা পজিটিভ নয়, ডাক্তার মানেই করোনা চিকিৎসক নয় আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মানেও করোনা মন্ত্রণালয় নয়৷ আমাদের চিকিৎসা খাত শুধু করোনার চিকিৎসা নির্ভর করে ফেলা উচিত নয়। কারণ মানুষ যেমন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে তেমনি অন্য রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু কোনো রোগেরই যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছে না।
.
তাই আমি বিনয়ের সাথে সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, আপনারা চিকিৎসা খাতের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনুন; যেখানে আমরা আগের মতো যে কোনো রোগের জন্য চিকিৎসা নিতে পারবো। ঢেলে সাজানোর দরকার নেই, আমাদের আটপৌরে মধ্যবিত্ত ধরণের চিকিৎসা হলেই হবে-তবুও আমাদের চিকিৎসার অধিকারটুকু ফিরিয়ে দেন। প্রতিদিন বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর সংবাদ আমাদের ভারাক্রান্ত করে তোলে। এই অভিশাপ থেকে মুক্তি চাই।
.
লেখকঃ  শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
.