ঈদে বড়লোকের আনন্দ উল্লাসের জলসা অন্যদিকে গরীবের অশ্রুসিক্ত নয়ন

  • Update Time : ০৯:৫৮:৩০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ জুলাই ২০২২
  • / 430

মো: এনামুল হক:

আর মাত্র দুদিন বাদেই ঈদুল আযহা। সমাজের অনেকেই যখন ঈদের কেনাকাটা আর কোরবানির পশু কেনায় ব্যস্ত ঠিক তখনি সমাজের অসহায় দরিদ্র পরিবার গুলোতে ঈদ নিয়ে নেই কোন আয়োজন নেই কোন কেনাকাটা। সমাজের দরিদ্ররা বেশির ভাগই ঈদের দিনটি কাটান কাজ করে বাড়তি রোজগারের আশায়। আবার কিছুসংখ্যক মানুষ বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করেন মাংস সংগ্রহ করার জন্য।

সমাজের অতি দরিদ্র পরিবার গুলোর ঈদ কেমন কাটবে ঈদে তাদের প্রস্তুতি কি?

দুর্গম চরাঞ্চলের সাজু মিয়া ভাঙ্গাচোরা ঘরে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন।তিনি পেশায় একজন দিনমজুর। সারাদিন কাজ করে তার পারিশ্রমিক নিয়ে কখন স্ত্রী-সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিবেন তাই নিয়ে ব্যস্ত তিনি।ঈদের দিনে কি করবেন এমন কথা শুনে সাজু মিয়া বলেন, আমি দিনমজুর মানুষ প্রতিদিন যা রোজগার করি তা দিয়ে ডাল ভাতও জোটাবার পারিনা আর ঈদ দিয়ে কি করি।ঈদের দিনে মাংস,ছেলে মেয়ের জন্য নতুম জামা কিনমু কিভাবে তা আল্লাহ ভালো জানেন।স্ত্রী-সন্তানদের মুখে ডাল ভাত দিতে পারবো কিনা তারও নিশ্চয়তা নাই।

কথা হয় আরেক দিনমজুর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সর্বানন্দের উজ্জল মিয়ার সাথে কেমন কাটবে তার ঈদের দিন? ঈদের কথা শুনতেই উজ্জল মিয়া অশ্রুসিক্ত নয়নে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,হামার মতো গরীবের কিসের ঈদ হামার কোন ঈদ নাই হামরা পোরা কপালি মানুষ।হামার মতো গরীব মানুষের দুইবেলা খাওয়া জোটেনা ঠিকমতো আর ঈদ আসলেই কি না আসলেই কি হামার তাতে যায় আসেনা।ঈদ হামার জন্য না বড়লোকের জন্য।ঈদ আসলে হামরা নতুন কাপড়চোপড়,মাছ মাংস কিনবের পাইনা হামার ঈদের আনন্দ হয়না। বাচ্চাকাচ্চা কে দুবেলা দুমুঠো ডাল ভাত মুখে তুলে দিতে পারিনা আর কাপড়চোপড় কিনমু কেমনে।ঈদ আইসে হামার মত গরীব মানুষের দূঃখ কষ্ট বাড়ানোর জন্য। তিনি আরো বলেন,দিন মজুরের কাজ করে ঈদ উপলক্ষে বাচ্চাকাচ্চার নতুন কাপড়চোপড় কেনা মাংস কেনা দুঃসপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।এই ঈদে নতুন কাপড়চোপড় কেনা হচ্ছেনা বলে পুরানো কাপড় গুলো ধুয়ে দিবেন।সেই কাপড়গুলো ঈদের দিন পরতে দিবেন ছেলে-মেয়েদের এবং মাছ,মাংস কিংবা কোন ধরনের খাবারও কেনা হয়নি তার তবে সেমাই কিনবেন বলে ভেবে রেখেছেন।

অন্যদিকে বড়লোকের ঈদ মানে রঙে-ঢঙে হাজার হাজার টাকা অপচয়। তাদের ঈদ মানেই বিলাসবহুল গাড়ীতে চড়ে নামীদামী মার্কেটে নানারকম কেনাকাটা করা।ফিরনি, পোলাও,কাচ্চি সহ বিভিন্ন আইটেমের খাবার খাওয়া,সপরিবার, বন্ধুবান্ধব সহ নানান জায়গায় ঘুরতে যাওয়া।ঈদের আনন্দে ফটকা,আতসবাজি, ফানুস উড়ানো সহ কত আনন্দ উল্লাসের জলসা।অথচ গরীবের কান্নাকাটিতে গলেনা কারো মন।গরীবের আশা থাকলেও স্ত্রী-সন্তানদের পাতে এক টুকরো মাংস দিতে পারেনা।ঈদের দিনে পুরানো কাপড় পরে ঈদগাহ মাঠে যায় নামাজ আদায় করতে।এমনকি ঈদের নামাজ শেষে সন্তানদের হাতে দশটি টাকাও তুলে দিতে পারেন না পুরানো পাঞ্জাবি পড়া বাবাটি।

আমাদের সকলেরই জানা আছে ঈদুল-ফিতর আর ঈদুল-আযহা হচ্ছে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের সব চাইতে বড় ধর্মীয় উৎসব। আর আমরা এটাও জানি যে,ইসলাম সব সময়ই কল্যাণের ধর্ম, কল্যাণ চায় ব্যক্তির সাথে সমষ্টিরও। কল্যাণ চায় সমাজের ধনী-দরিদ্র সর্বশ্রেণীর মানুষের। তাই উৎসবের মাঝেও সে কল্যাণ-চেতনা থেকে বিচ্যুতির অবকাশ নেই।

ঈদের দিনে সমাজের সচ্ছল মানুষেরা আনন্দ করবে আর হত দরিদ্র মানুষেরা সেই আনন্দ নীরবে দেখবে সে কথা ইসলামে বলা নাই। ঈদের আনন্দ এখানে সার্বজনীন। খুশির এই দিনটিতে কল্যাণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সমাজের অভাবগ্রস্থ দুঃখী মানুষের জন্য। এতিম, অসহায়- হত দরিদ্র মানুষেরাও যাতে ঈদের খুশিতে সামিল হতে পারে সে জন্য ঈদের জামায়াতে শামিল হওয়ার পূর্বে তাদের হাতে যাকাত-ফিতরার টাকা পৌঁছে দিতে হয় প্রতিটি সচ্ছল মুসলমানকে।এটি গরিবের হক, ধনীর দান বা কৃপা নয়। সমাজের অভাবগ্রস্থদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব এখানে প্রতিটি সচ্ছল ব্যক্তির। সম্পদ লাভের সাথে সাথে মু’মিনের ঘাড়ে এ এক বাড়তি দায়িত্ব। গরিবেরা এসে তার দরজায় ধরনা দেবে এবং ফিতরা ভিক্ষা করবে- সেটি ইসলামের বিধান নয়। এমন বিধানে গরিবের প্রচণ্ড অসম্মান হয়। এভাবে গরিবের অসম্মান বাড়িয়ে কি ঈদের খুশি হয়? নির্মিত হয় কি সামাজিক সংহতি? প্রতিষ্ঠা পায় কি শান্তি?ইসলাম কি সেটাই বলেছে কোথাও?

ইসলাম সমর্থন করে দানের সংস্কৃতি, ভিক্ষাবৃত্তির সংস্কৃতি কে সমর্থন করে না। ইসলাম তাই ধনীদের কে বরং গরিবের দরজায় ছুটতে বলছে। খলিফা হযরত উমর (রা.) আটার বস্তা নিজের কাঁধে চাপিয়ে ক্ষুদার্ত মানুষের ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। সম্পদ-লাভ এভাবেই মু’মিনের জীবনে অহংকার না বাড়িয়ে দায়িত্ববোধ বাড়ায়। অর্থ এভাবেই তাঁকে পরীক্ষার মুখে ফেলে দেন। ধনীরা গবিরের হক নিয়ে তাদের দরজায় পৌঁছালে ধনীর মর্যাদা কমে না বরং বাড়ে।

যেহেতু দুদিন বাদেই ঈদুল আযহা তাই কুরবানীর গোশত সম্পর্কেও বলতে হচ্ছে যে, তা গরীব ও অভাবগ্রস্তের বাড়িতে পৌঁছিয়ে দেওয়া চাই, যে কুরবানী করাই হয় ত্যাগের মানসিকতায় এবং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও ছাওয়াব লাভের আশায়। অথচ আমাদের ঐতিহ্য ছিল কতই না উচ্চমার্গীয়। একদা আমরা এই মুসলিম উম্মাহ্ সাধারণ দান-অনুদান ও সাহায্য-সহযোগিতাও মানুষের দ্বারে-দ্বারে পৌঁছে দিতাম। এ ঐতিহ্যের উদ্বোধন হয়েছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাতে এবং তাও তাঁর নবুওয়াতপ্রাপ্তির আগেই। নবুওয়াতের গুরুভারে তিনি যখন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত, তখন আম্মাজান খাদীজা রা. তো সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁকে সান্তনা যুগিয়েছিলেন।

বলেছিলেন, আল্লাহ তাআলা কিছুতেই আপনাকে নিঃসঙ্গ ছেড়ে দিতে পারেন না, কিছুতেই তিনি আপনাকে লাঞ্ছিত করতে পারেন না। কারণ আপনি আত্মীয়তা রক্ষা করেন, আয়-রোজগারে যারা অক্ষম তাদের ভার বহন করেন, নিঃস্ব ও অভাবগ্রস্তদের রোজগার করে দেন, অতিথির সেবা করেন এবং বিপন্ন মানুষের সাহায্য করেন।

নবুওয়াতপ্রাপ্তির পরও তাঁর এ কল্যাণধারা অব্যাহত থেকেছে; বরং তা প্রবাহিত হয়েছে আরও প্রবল বেগে। তাঁর পর তাঁর খলীফাগণও সেবার প্রেরণায় মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রা. ও হযরত উমর ফারূক রা.-এর এ জাতীয় ঘটনাবলী জগৎজোড়া মশহুর। তাঁরা খুঁজে বেড়াতেন কোথায় কার কী সমস্যা, কার কী প্রয়োজন। যার প্রয়োজন এবং যার অভাব, সে কখন তাঁর দুয়ারে এসে হাত পাতবে সে অপেক্ষা তাঁরা করতেন না। এভাবেই চলেছে যুগ যুগ। তাঁদের উত্তরসূরীগণ এ আদর্শের চর্চায় কখনও কসুর করেননি। এমনকি এই অধঃপতন ও অবক্ষয়ের যুগেও অনেকে আছেন, যারা বিপন্ন মানুষের কাছে ছুটে যান এবং সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে অভাবগ্রস্তের বাড়িতে পৌঁছে যান। আজও এরকম লোকের সন্ধান মেলে, যারা কুরবানীর গোশত নিয়ে নিজ বাড়িতে বসে থাকে না; বরং যারা কুরবানী দিতে পারে না, গভীর মমতার সাথে তাদের জীর্ণ কুটিরে তা পৌঁছে দেয়। আমরা তাদের থেকে শিক্ষা নিতে পারি।

এতটুকু কষ্ট আমরা আনন্দের সঙ্গেই করতে পারি যে, আপন এলাকায় কারা কারা কুরবানী দেয় না বা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না তার খোঁজ নেব এবং আগে থেকেই তাদের একটা তালিকা তৈরি করে রাখব। তারপর কুরবানীর দিন সে তালিকা অনুযায়ী কুরবানীর গোশত তাদের বাড়ি পৌঁছে দেব।

দরকার এ ব্যাপারে গণসচেতনতা তৈরির। প্রত্যেক মহল্লার কুরবানীদাতাদের চিন্তা-চেতনায় প্রচলিত পদ্ধতিতে গোশত বিতরণের কী ক্ষতি এবং বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বিতরণের কী ফায়দা তা যদি সঞ্চার করে দেওয়া যায়, তবে আমরা সহজেই আমাদের হারানো ঐতিহ্যে ফিরে যেতে পারি। প্রত্যেক মহল্লার কুরবানীদাতাগণ যদি আগে থেকেই তালিকা তৈরি করে ফেলে এবং সে অনুযায়ী কুরবানীর গোশত মানুষের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেয়, তবে কুরবানীর দিন আঁকা হয়ে যেতে পারে সামাজিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির এক নয়নাভিরাম দৃশ্য, যেখানে থাকবে না কুরবানীদাতার বাড়ির দরজায় ফকীর-মিসকীন ও গরীব-দুঃখীর ভিড়; বরং কুরবানীদাতা বা তার লোকজনকেই দেখা যাবে গরীব-মিসকীনদের বাড়িতে বাড়িতে ছোটাছুটি করছে। সেখানে গোশত বিতরণে ভিক্ষাদানের দৃশ্য পরিলক্ষিত হচ্ছে না; বরং তাতে ইবাদতের মহিমা ভাস্বর হয়ে আছে এবং কুরবানীদাতা অনুভব করছে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অভাবগ্রস্ত ভাইদের যিয়াফত করতে পারার অমলিন আনন্দ।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


ঈদে বড়লোকের আনন্দ উল্লাসের জলসা অন্যদিকে গরীবের অশ্রুসিক্ত নয়ন

Update Time : ০৯:৫৮:৩০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ জুলাই ২০২২

মো: এনামুল হক:

আর মাত্র দুদিন বাদেই ঈদুল আযহা। সমাজের অনেকেই যখন ঈদের কেনাকাটা আর কোরবানির পশু কেনায় ব্যস্ত ঠিক তখনি সমাজের অসহায় দরিদ্র পরিবার গুলোতে ঈদ নিয়ে নেই কোন আয়োজন নেই কোন কেনাকাটা। সমাজের দরিদ্ররা বেশির ভাগই ঈদের দিনটি কাটান কাজ করে বাড়তি রোজগারের আশায়। আবার কিছুসংখ্যক মানুষ বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করেন মাংস সংগ্রহ করার জন্য।

সমাজের অতি দরিদ্র পরিবার গুলোর ঈদ কেমন কাটবে ঈদে তাদের প্রস্তুতি কি?

দুর্গম চরাঞ্চলের সাজু মিয়া ভাঙ্গাচোরা ঘরে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন।তিনি পেশায় একজন দিনমজুর। সারাদিন কাজ করে তার পারিশ্রমিক নিয়ে কখন স্ত্রী-সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিবেন তাই নিয়ে ব্যস্ত তিনি।ঈদের দিনে কি করবেন এমন কথা শুনে সাজু মিয়া বলেন, আমি দিনমজুর মানুষ প্রতিদিন যা রোজগার করি তা দিয়ে ডাল ভাতও জোটাবার পারিনা আর ঈদ দিয়ে কি করি।ঈদের দিনে মাংস,ছেলে মেয়ের জন্য নতুম জামা কিনমু কিভাবে তা আল্লাহ ভালো জানেন।স্ত্রী-সন্তানদের মুখে ডাল ভাত দিতে পারবো কিনা তারও নিশ্চয়তা নাই।

কথা হয় আরেক দিনমজুর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সর্বানন্দের উজ্জল মিয়ার সাথে কেমন কাটবে তার ঈদের দিন? ঈদের কথা শুনতেই উজ্জল মিয়া অশ্রুসিক্ত নয়নে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,হামার মতো গরীবের কিসের ঈদ হামার কোন ঈদ নাই হামরা পোরা কপালি মানুষ।হামার মতো গরীব মানুষের দুইবেলা খাওয়া জোটেনা ঠিকমতো আর ঈদ আসলেই কি না আসলেই কি হামার তাতে যায় আসেনা।ঈদ হামার জন্য না বড়লোকের জন্য।ঈদ আসলে হামরা নতুন কাপড়চোপড়,মাছ মাংস কিনবের পাইনা হামার ঈদের আনন্দ হয়না। বাচ্চাকাচ্চা কে দুবেলা দুমুঠো ডাল ভাত মুখে তুলে দিতে পারিনা আর কাপড়চোপড় কিনমু কেমনে।ঈদ আইসে হামার মত গরীব মানুষের দূঃখ কষ্ট বাড়ানোর জন্য। তিনি আরো বলেন,দিন মজুরের কাজ করে ঈদ উপলক্ষে বাচ্চাকাচ্চার নতুন কাপড়চোপড় কেনা মাংস কেনা দুঃসপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।এই ঈদে নতুন কাপড়চোপড় কেনা হচ্ছেনা বলে পুরানো কাপড় গুলো ধুয়ে দিবেন।সেই কাপড়গুলো ঈদের দিন পরতে দিবেন ছেলে-মেয়েদের এবং মাছ,মাংস কিংবা কোন ধরনের খাবারও কেনা হয়নি তার তবে সেমাই কিনবেন বলে ভেবে রেখেছেন।

অন্যদিকে বড়লোকের ঈদ মানে রঙে-ঢঙে হাজার হাজার টাকা অপচয়। তাদের ঈদ মানেই বিলাসবহুল গাড়ীতে চড়ে নামীদামী মার্কেটে নানারকম কেনাকাটা করা।ফিরনি, পোলাও,কাচ্চি সহ বিভিন্ন আইটেমের খাবার খাওয়া,সপরিবার, বন্ধুবান্ধব সহ নানান জায়গায় ঘুরতে যাওয়া।ঈদের আনন্দে ফটকা,আতসবাজি, ফানুস উড়ানো সহ কত আনন্দ উল্লাসের জলসা।অথচ গরীবের কান্নাকাটিতে গলেনা কারো মন।গরীবের আশা থাকলেও স্ত্রী-সন্তানদের পাতে এক টুকরো মাংস দিতে পারেনা।ঈদের দিনে পুরানো কাপড় পরে ঈদগাহ মাঠে যায় নামাজ আদায় করতে।এমনকি ঈদের নামাজ শেষে সন্তানদের হাতে দশটি টাকাও তুলে দিতে পারেন না পুরানো পাঞ্জাবি পড়া বাবাটি।

আমাদের সকলেরই জানা আছে ঈদুল-ফিতর আর ঈদুল-আযহা হচ্ছে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের সব চাইতে বড় ধর্মীয় উৎসব। আর আমরা এটাও জানি যে,ইসলাম সব সময়ই কল্যাণের ধর্ম, কল্যাণ চায় ব্যক্তির সাথে সমষ্টিরও। কল্যাণ চায় সমাজের ধনী-দরিদ্র সর্বশ্রেণীর মানুষের। তাই উৎসবের মাঝেও সে কল্যাণ-চেতনা থেকে বিচ্যুতির অবকাশ নেই।

ঈদের দিনে সমাজের সচ্ছল মানুষেরা আনন্দ করবে আর হত দরিদ্র মানুষেরা সেই আনন্দ নীরবে দেখবে সে কথা ইসলামে বলা নাই। ঈদের আনন্দ এখানে সার্বজনীন। খুশির এই দিনটিতে কল্যাণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সমাজের অভাবগ্রস্থ দুঃখী মানুষের জন্য। এতিম, অসহায়- হত দরিদ্র মানুষেরাও যাতে ঈদের খুশিতে সামিল হতে পারে সে জন্য ঈদের জামায়াতে শামিল হওয়ার পূর্বে তাদের হাতে যাকাত-ফিতরার টাকা পৌঁছে দিতে হয় প্রতিটি সচ্ছল মুসলমানকে।এটি গরিবের হক, ধনীর দান বা কৃপা নয়। সমাজের অভাবগ্রস্থদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব এখানে প্রতিটি সচ্ছল ব্যক্তির। সম্পদ লাভের সাথে সাথে মু’মিনের ঘাড়ে এ এক বাড়তি দায়িত্ব। গরিবেরা এসে তার দরজায় ধরনা দেবে এবং ফিতরা ভিক্ষা করবে- সেটি ইসলামের বিধান নয়। এমন বিধানে গরিবের প্রচণ্ড অসম্মান হয়। এভাবে গরিবের অসম্মান বাড়িয়ে কি ঈদের খুশি হয়? নির্মিত হয় কি সামাজিক সংহতি? প্রতিষ্ঠা পায় কি শান্তি?ইসলাম কি সেটাই বলেছে কোথাও?

ইসলাম সমর্থন করে দানের সংস্কৃতি, ভিক্ষাবৃত্তির সংস্কৃতি কে সমর্থন করে না। ইসলাম তাই ধনীদের কে বরং গরিবের দরজায় ছুটতে বলছে। খলিফা হযরত উমর (রা.) আটার বস্তা নিজের কাঁধে চাপিয়ে ক্ষুদার্ত মানুষের ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। সম্পদ-লাভ এভাবেই মু’মিনের জীবনে অহংকার না বাড়িয়ে দায়িত্ববোধ বাড়ায়। অর্থ এভাবেই তাঁকে পরীক্ষার মুখে ফেলে দেন। ধনীরা গবিরের হক নিয়ে তাদের দরজায় পৌঁছালে ধনীর মর্যাদা কমে না বরং বাড়ে।

যেহেতু দুদিন বাদেই ঈদুল আযহা তাই কুরবানীর গোশত সম্পর্কেও বলতে হচ্ছে যে, তা গরীব ও অভাবগ্রস্তের বাড়িতে পৌঁছিয়ে দেওয়া চাই, যে কুরবানী করাই হয় ত্যাগের মানসিকতায় এবং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও ছাওয়াব লাভের আশায়। অথচ আমাদের ঐতিহ্য ছিল কতই না উচ্চমার্গীয়। একদা আমরা এই মুসলিম উম্মাহ্ সাধারণ দান-অনুদান ও সাহায্য-সহযোগিতাও মানুষের দ্বারে-দ্বারে পৌঁছে দিতাম। এ ঐতিহ্যের উদ্বোধন হয়েছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাতে এবং তাও তাঁর নবুওয়াতপ্রাপ্তির আগেই। নবুওয়াতের গুরুভারে তিনি যখন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত, তখন আম্মাজান খাদীজা রা. তো সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁকে সান্তনা যুগিয়েছিলেন।

বলেছিলেন, আল্লাহ তাআলা কিছুতেই আপনাকে নিঃসঙ্গ ছেড়ে দিতে পারেন না, কিছুতেই তিনি আপনাকে লাঞ্ছিত করতে পারেন না। কারণ আপনি আত্মীয়তা রক্ষা করেন, আয়-রোজগারে যারা অক্ষম তাদের ভার বহন করেন, নিঃস্ব ও অভাবগ্রস্তদের রোজগার করে দেন, অতিথির সেবা করেন এবং বিপন্ন মানুষের সাহায্য করেন।

নবুওয়াতপ্রাপ্তির পরও তাঁর এ কল্যাণধারা অব্যাহত থেকেছে; বরং তা প্রবাহিত হয়েছে আরও প্রবল বেগে। তাঁর পর তাঁর খলীফাগণও সেবার প্রেরণায় মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রা. ও হযরত উমর ফারূক রা.-এর এ জাতীয় ঘটনাবলী জগৎজোড়া মশহুর। তাঁরা খুঁজে বেড়াতেন কোথায় কার কী সমস্যা, কার কী প্রয়োজন। যার প্রয়োজন এবং যার অভাব, সে কখন তাঁর দুয়ারে এসে হাত পাতবে সে অপেক্ষা তাঁরা করতেন না। এভাবেই চলেছে যুগ যুগ। তাঁদের উত্তরসূরীগণ এ আদর্শের চর্চায় কখনও কসুর করেননি। এমনকি এই অধঃপতন ও অবক্ষয়ের যুগেও অনেকে আছেন, যারা বিপন্ন মানুষের কাছে ছুটে যান এবং সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে অভাবগ্রস্তের বাড়িতে পৌঁছে যান। আজও এরকম লোকের সন্ধান মেলে, যারা কুরবানীর গোশত নিয়ে নিজ বাড়িতে বসে থাকে না; বরং যারা কুরবানী দিতে পারে না, গভীর মমতার সাথে তাদের জীর্ণ কুটিরে তা পৌঁছে দেয়। আমরা তাদের থেকে শিক্ষা নিতে পারি।

এতটুকু কষ্ট আমরা আনন্দের সঙ্গেই করতে পারি যে, আপন এলাকায় কারা কারা কুরবানী দেয় না বা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না তার খোঁজ নেব এবং আগে থেকেই তাদের একটা তালিকা তৈরি করে রাখব। তারপর কুরবানীর দিন সে তালিকা অনুযায়ী কুরবানীর গোশত তাদের বাড়ি পৌঁছে দেব।

দরকার এ ব্যাপারে গণসচেতনতা তৈরির। প্রত্যেক মহল্লার কুরবানীদাতাদের চিন্তা-চেতনায় প্রচলিত পদ্ধতিতে গোশত বিতরণের কী ক্ষতি এবং বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বিতরণের কী ফায়দা তা যদি সঞ্চার করে দেওয়া যায়, তবে আমরা সহজেই আমাদের হারানো ঐতিহ্যে ফিরে যেতে পারি। প্রত্যেক মহল্লার কুরবানীদাতাগণ যদি আগে থেকেই তালিকা তৈরি করে ফেলে এবং সে অনুযায়ী কুরবানীর গোশত মানুষের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেয়, তবে কুরবানীর দিন আঁকা হয়ে যেতে পারে সামাজিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির এক নয়নাভিরাম দৃশ্য, যেখানে থাকবে না কুরবানীদাতার বাড়ির দরজায় ফকীর-মিসকীন ও গরীব-দুঃখীর ভিড়; বরং কুরবানীদাতা বা তার লোকজনকেই দেখা যাবে গরীব-মিসকীনদের বাড়িতে বাড়িতে ছোটাছুটি করছে। সেখানে গোশত বিতরণে ভিক্ষাদানের দৃশ্য পরিলক্ষিত হচ্ছে না; বরং তাতে ইবাদতের মহিমা ভাস্বর হয়ে আছে এবং কুরবানীদাতা অনুভব করছে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অভাবগ্রস্ত ভাইদের যিয়াফত করতে পারার অমলিন আনন্দ।