কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর ছাত্রজীবন

  • Update Time : ১০:২৪:৪৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ এপ্রিল ২০২২
  • / 259

আশিকুর রহমান অমি:

বিবিসি বাংলা কলকাতার সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট অমিতাভ ভট্টশালী ৭৬ বছর পূর্বের স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নীহার রঞ্জন চক্রবর্তীর একটি সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন।সে সাক্ষাতকারে নীহার রঞ্জন চক্রবর্তী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন-

‘দিনটি ছিল রশিদ আলি দিবস। ক্যাপ্টেন রশিদ ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্য। তার গ্রেপ্তারি আর কারাদন্ডের আদেশের বিরুদ্ধে ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যাপক গণ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি উল্লেখ করে বলেন, রশিদ আলি দিবসে মুজিবকে দেখেছি খুবই প্রমিনেন্ট রোল প্লে করতে। আমি নিজেও একদিন লালবাজারে কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভে লাঠির বাড়ি খেলাম। হঠাৎ দেখি, মুজিব। এসে বলল, কারফিউ দিয়েছে। এবার চলে যান, ব্যাটারা গুলি করতে পারে। সে অন্য কোথাও চলে গেল, আর আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনে আইন কলেজে চলে গেলাম।’

সে যাত্রায় তরুণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দূরদর্শিতায় বিস্মিত হয়েছিলেন নীহার রঞ্জন চক্রবর্তী। তিনি আরও বলেন, ‘মুজিব যে বছর ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক, আমিও সে বছরই স্কটিশ চার্চ কলেজের সেক্রেটারি হতে কিছুটা বাধ্য হই দাদাদের কথায়। ওদের কলেজে আমার বন্ধুবান্ধবের কাছে শুনতাম খুব শক্তিশালী সংগঠক ছিল মুজিব।কলেজ ইউনিয়নটা নাকি সে খুব ভালো চালাতো।’

নীহার রঞ্জন চক্রবর্তীর এই সরল স্বীকারোক্তির মাঝেই আমরা দেখতে পাই, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের ন্যায়ের সংগ্রামে, সত্য-সুন্দরের হিস্যা আদায়ে কতটা তেজস্বী নেতৃত্ব ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা ইসলামিয়া কলেজেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পড়তে এসেছিলেন। তারপরে ১৯৪৭ সালে দ্বিতীয়বার নাম পাল্টিয়ে হয় সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজ।১৯৬০ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত অপরিবর্তিতভাবে মৌলানা আজাদ কলেজ হিসেবেই প্রতিষ্ঠানটি পরিচিত।কলেজের দোতলায় দুটো বোর্ড আছে ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদকদের নাম লেখা। ‘বার্মা টিক’ কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো বোর্ডে রয়েছে সেই প্রথম বছর থেকে কারা ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদক ছিলেন।১৯৪৫-৪৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র সংসদের নামফলকের পাশে লেখা রয়েছে ‘এম রহমান’। ঐ বছরের সম্পাদকের পুরো নামটা যদি লেখা থাকতো তাহলে সেটা হতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে নিজেই হাস্যরসাত্মকভাবে তাঁর কলকাতায় ছাত্র জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেন, ‘ইলিয়ট হোস্টেল আর বেকার হোস্টেল পাশাপাশি, আমরা ঠাট্টা করে বলতাম ইডিয়ট হোস্টেল।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর এই স্মৃতিচারণের মাধ্যমেই আমরা দেখতে পাই, তিনি তাঁর ছাত্র রাজনীতির স্বর্ণাক্ষরে বেকার হোস্টেল, কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ও পশ্চিম বাংলায় তার যাপিত জীবনের ছাত্র রাজনীতির দিনক্ষণকে গভীরভাবে অনুভব করতেন। বেকার হোস্টেলের বঙ্গবন্ধুর কক্ষটিকে এখন জাদুঘর করা হয়েছে। জাতীয়তাবাদের শেকড় গেড়ে মুক্তির সীমান্ত ঘিরে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে অন্যায়ের বাঁধ নির্মাণ করে কোটি কোটি মুজিবের জন্ম দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু তাঁর কলকাতায় যাপিত ছাত্র রাজনীতির চিত্রপট নিয়ে অনেক স্মৃতিকথাই লিখেছেন। তিনি একাংশে লিখেছেন, “কলেজে যখন ক্লাস করতে যেতাম প্রফেসর সাহেবরা জানতেন, আর দু’একজন বলতেনও, ‘কি সময় পেয়েছো কলেজে আসতে?’ আমি কোনো উত্তর না দিয়ে নিজেই হাসতাম, সহপাঠীরাও হাসতো। পড়তে চাইলেই কি আর লেখাপড়া করা যায়! ক্যাবিনেট মিশন তখন ভারতবর্ষে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ তাদের দাবি নিয়ে আলোচনা করছে ক্যাবিনেট মিশনের সাথে। আমরাও পাকিস্তান না মানলে, কোনোকিছু মানব না। মুসলিম লীগ ও মিল্লাত অফিসে রোজ চায়ের কাপে ঝড় উঠত।”

স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনার প্রত্যয়দীপ্ত অগ্নিগর্ভ বারুদ ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।যিনি সেই কৈশোর থেকেই নিপীড়িত মানবের মুক্তির দূত হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন এবং যৌবন পেরিয়ে বাংলার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের ফিনিক্স পাখি হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

আজ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশেও তাঁর নিজের বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও চায়ের কাপে ঝড় ওঠে, গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্রের দ্বান্দ্বিক বিতর্কের পাঠশালা মঞ্চস্থ হয়। ডায়েরির পাতা থেকে বঙ্গবন্ধুর কলকাতায় যাপিত ছাত্রজীবনের কিয়দাংশ উপস্থাপন করলাম কেননা গতকাল দিল্লীর জওহারলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সভাপতি ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। তারা দুজনই বাঙালি এবং পশ্চিম বাংলার কলকাতার নাগরিক।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর ছাত্রজীবন

Update Time : ১০:২৪:৪৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ এপ্রিল ২০২২

আশিকুর রহমান অমি:

বিবিসি বাংলা কলকাতার সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট অমিতাভ ভট্টশালী ৭৬ বছর পূর্বের স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নীহার রঞ্জন চক্রবর্তীর একটি সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন।সে সাক্ষাতকারে নীহার রঞ্জন চক্রবর্তী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন-

‘দিনটি ছিল রশিদ আলি দিবস। ক্যাপ্টেন রশিদ ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্য। তার গ্রেপ্তারি আর কারাদন্ডের আদেশের বিরুদ্ধে ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যাপক গণ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি উল্লেখ করে বলেন, রশিদ আলি দিবসে মুজিবকে দেখেছি খুবই প্রমিনেন্ট রোল প্লে করতে। আমি নিজেও একদিন লালবাজারে কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভে লাঠির বাড়ি খেলাম। হঠাৎ দেখি, মুজিব। এসে বলল, কারফিউ দিয়েছে। এবার চলে যান, ব্যাটারা গুলি করতে পারে। সে অন্য কোথাও চলে গেল, আর আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনে আইন কলেজে চলে গেলাম।’

সে যাত্রায় তরুণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দূরদর্শিতায় বিস্মিত হয়েছিলেন নীহার রঞ্জন চক্রবর্তী। তিনি আরও বলেন, ‘মুজিব যে বছর ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক, আমিও সে বছরই স্কটিশ চার্চ কলেজের সেক্রেটারি হতে কিছুটা বাধ্য হই দাদাদের কথায়। ওদের কলেজে আমার বন্ধুবান্ধবের কাছে শুনতাম খুব শক্তিশালী সংগঠক ছিল মুজিব।কলেজ ইউনিয়নটা নাকি সে খুব ভালো চালাতো।’

নীহার রঞ্জন চক্রবর্তীর এই সরল স্বীকারোক্তির মাঝেই আমরা দেখতে পাই, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের ন্যায়ের সংগ্রামে, সত্য-সুন্দরের হিস্যা আদায়ে কতটা তেজস্বী নেতৃত্ব ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা ইসলামিয়া কলেজেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পড়তে এসেছিলেন। তারপরে ১৯৪৭ সালে দ্বিতীয়বার নাম পাল্টিয়ে হয় সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজ।১৯৬০ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত অপরিবর্তিতভাবে মৌলানা আজাদ কলেজ হিসেবেই প্রতিষ্ঠানটি পরিচিত।কলেজের দোতলায় দুটো বোর্ড আছে ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদকদের নাম লেখা। ‘বার্মা টিক’ কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো বোর্ডে রয়েছে সেই প্রথম বছর থেকে কারা ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদক ছিলেন।১৯৪৫-৪৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র সংসদের নামফলকের পাশে লেখা রয়েছে ‘এম রহমান’। ঐ বছরের সম্পাদকের পুরো নামটা যদি লেখা থাকতো তাহলে সেটা হতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে নিজেই হাস্যরসাত্মকভাবে তাঁর কলকাতায় ছাত্র জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেন, ‘ইলিয়ট হোস্টেল আর বেকার হোস্টেল পাশাপাশি, আমরা ঠাট্টা করে বলতাম ইডিয়ট হোস্টেল।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর এই স্মৃতিচারণের মাধ্যমেই আমরা দেখতে পাই, তিনি তাঁর ছাত্র রাজনীতির স্বর্ণাক্ষরে বেকার হোস্টেল, কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ও পশ্চিম বাংলায় তার যাপিত জীবনের ছাত্র রাজনীতির দিনক্ষণকে গভীরভাবে অনুভব করতেন। বেকার হোস্টেলের বঙ্গবন্ধুর কক্ষটিকে এখন জাদুঘর করা হয়েছে। জাতীয়তাবাদের শেকড় গেড়ে মুক্তির সীমান্ত ঘিরে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে অন্যায়ের বাঁধ নির্মাণ করে কোটি কোটি মুজিবের জন্ম দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু তাঁর কলকাতায় যাপিত ছাত্র রাজনীতির চিত্রপট নিয়ে অনেক স্মৃতিকথাই লিখেছেন। তিনি একাংশে লিখেছেন, “কলেজে যখন ক্লাস করতে যেতাম প্রফেসর সাহেবরা জানতেন, আর দু’একজন বলতেনও, ‘কি সময় পেয়েছো কলেজে আসতে?’ আমি কোনো উত্তর না দিয়ে নিজেই হাসতাম, সহপাঠীরাও হাসতো। পড়তে চাইলেই কি আর লেখাপড়া করা যায়! ক্যাবিনেট মিশন তখন ভারতবর্ষে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ তাদের দাবি নিয়ে আলোচনা করছে ক্যাবিনেট মিশনের সাথে। আমরাও পাকিস্তান না মানলে, কোনোকিছু মানব না। মুসলিম লীগ ও মিল্লাত অফিসে রোজ চায়ের কাপে ঝড় উঠত।”

স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনার প্রত্যয়দীপ্ত অগ্নিগর্ভ বারুদ ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।যিনি সেই কৈশোর থেকেই নিপীড়িত মানবের মুক্তির দূত হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন এবং যৌবন পেরিয়ে বাংলার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের ফিনিক্স পাখি হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

আজ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশেও তাঁর নিজের বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও চায়ের কাপে ঝড় ওঠে, গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্রের দ্বান্দ্বিক বিতর্কের পাঠশালা মঞ্চস্থ হয়। ডায়েরির পাতা থেকে বঙ্গবন্ধুর কলকাতায় যাপিত ছাত্রজীবনের কিয়দাংশ উপস্থাপন করলাম কেননা গতকাল দিল্লীর জওহারলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সভাপতি ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। তারা দুজনই বাঙালি এবং পশ্চিম বাংলার কলকাতার নাগরিক।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।