হাজী মুহাম্মদ মহসীন: ক্ষণজন্মা এক ত্যাগী পুরুষ
- Update Time : ০১:১১:৪৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৪ জানুয়ারী ২০২২
- / 198
রাহাত হুসাইন:
হাজী মুহাম্মদ মহসীন, দানে আর গুণে ভারতী উপমহাদেশে যার সুখ্যাতি রয়েছে। অঢেল সম্পদ তিনি মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে দিয়েছেন। সেই ক্ষণজন্মা মহান পুরুষের জন্মদিন আজ। ১৭৩২ সালের ৩ জানুয়ারি দানবীর হাজী মুহাম্মদ মহসীন ভারতের পশ্চিম বঙ্গের হুগলি জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।
দানশীলতার জন্য হাজী মুহাম্মাদ মহসীন প্রবাদপুরুষে পরিণত হয়েছেন। আরবের বিখ্যাত দাতা হাতিম তায়ির সঙ্গে হাজী মুহাম্মদ মহসীনের নাম জুড়ে দেয়া হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, বাংলার দাতা হাতিম তায়ি হাজী মুহাম্মদ মহসীন। সকল ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষের কল্যাণে তার অর্থ-সম্পত্তি বিলিয়ে দিয়েছেন। দানের ক্ষেত্রে তিনি কখন শ্রেণিবিন্যাস করতেন না। বাঙালি সমাজ হাজী মুহাম্মদ মহসীনের দানে সামগ্রিকভাবে ঋদ্ধ হয়েছে।
পিতা-মাতার আর বোনের সম্পত্তির উত্তরাধিকার হন হাজী মুহাম্মদ মহসীন। তার পিতা হাজী ফয়জুল্লাহ ছিলেন অত্যন্ত ধনী ও জমিদার, মা জয়নব খানমও ছিলেন জমিদার বংশের মেয়ে। বোন মন্নুজানের মৃত্যুর পর তার সম্পত্তিরও উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন হাজী মুহাম্মদ মহসীন।
অঢেল সম্পত্তির অধিকারী হয়েও তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, ধার্মিক এবং অহংকারশূন্য একজন মানুষ। খুব সহজ-সরল জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। এত ধন-সম্পদ উত্তরাধিকার হয়েও বিয়ে করেননি তিনি। চিরকুমার ছিলেন এই মহান দানবীর। বিলাসিতার লেশমাত্র ছিলও না তার জীবনে। থাকতেন ছোট্ট এক কুটিরে। পবিত্র কোরান শরিফ হাতে লিখে, সেগুলো বিক্রি করে যা পেতেন তাই দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। নিজের রান্না নিজে করতেন এবং অধীনস্থ সকলকে নিয়ে একসঙ্গে বসে সকাল, দুপুর ও রাতে খাওয়া-দাওয়া করতেন। উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব এই ভেদাভেদ করতেন না।
জ্ঞান অর্জনের জন্য দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। পবিত্র মক্কা-মদিনাসহ আরব, অনারব দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি জ্ঞানের সন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। দীর্ঘ ২৭ বছর দুনিয়ায় বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণের পর তিনি নিজ দেশে ফেরেন। দেশে ফিরে, নিজের ধনসম্পত্তি দিয়ে তিনি শুরু করেন সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড।
১৭৬৯-৭০ সালে গোটা ভারতব্যাপী যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, সেই দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষদের সাহায্যার্থে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অকাতরে হাজী মুহাম্মদ মহসীন অর্থ ব্যয় করে লঙ্গরখানা খুলেছিলেন। দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষদের সাহায্যার্থে একটা ব্যাপক অর্থ তিনি সরকারি তহবিলেও দান করেছিলেন। ১৮০৬ সালে মহসীন ফান্ড নামক একটি তহবিল তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই তহবিল থেকে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড, পেনশন, শিক্ষাবৃত্তি, দাতব্যের জন্য অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।
শুধু দাতা হিসেবেই নয়, একজন মানবিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারীও ছিলেন হাজী মুহাম্মদ মহসীন। দুঃখী মানুষের কল্যাণে যিনি নিজেকে সম্পূর্ণ নিঃস্ব করে সম্পত্তি উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন, তার সেই দানের রেশ ধরে, আজ প্রায় ২০০ বছর পরেও লাখ লাখ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে, অসহায় দরিদ্র বাঙালি উপকৃত হয়ে চলেছে। মানবিক চেতনার সামগ্রিক প্রতিফলনের ভেতর দিয়ে একজন মানুষ, ঔদার্যের পূর্ণতা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রগতিশীলতা, পাণ্ডিত্য এবং শিক্ষানুরাগের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। ১৮০৬ সালের ২০ এপ্রিল যে বিশাল ভূসম্পত্তি তিনি মানুষের কল্যাণে দান করেছিলেন, তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব আজও অসামান্য।
হাজী মুহাম্মদ মহসীনের দানকৃত সম্পত্তির তিন ভাগ মাদ্রাসা শিক্ষাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ব্যয় করার ক্ষেত্রে নির্দেশ করা হয়েছিল। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের অনুদান দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি চিকিৎসার জন্য ব্যয় করারও নির্দেশ রয়েছে। রাস্তাঘাট নির্মাণ, পুকুর খননের জন্য নির্দেশ রয়েছে। ১৮৩৫ সালে ব্রিটিশ গভর্নর চার্লস মেটকাফের তত্ত্বাবধানে গঠিত হয়েছিল মহসীন শিক্ষা তহবিল। তার দানকৃত অর্থের মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে এই তহবিল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
১৮১২ সালের ২৯ নভেম্বর হাজী মুহাম্মদ মহসীনের জীবনাবসান হয়। তিনি বেঁচে নেই কিন্তু তার উজ্জ্বল নাম সদগুণের জন্য চিরকাল বিখ্যাত হয়ে থাকবে। ভোগবিলাস বিমুখ এই মহান ত্যাগী পুরুষের জন্মদিনে তার প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।