চাকরির নিয়োগে চাই স্বচ্ছতা, প্রহসন নয়!
- Update Time : ০১:৪১:৪৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ অক্টোবর ২০২১
- / 288
এপিএম সুহেল:
করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে সারাবিশ্বে উন্নত দেশগুলো নিজেদের সামলে নিলেও পিছিয়ে পড়েছে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো। অর্থনীতির এই বিপর্যয় সামলে উঠতে অন্যান্য উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে, সেদিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটাই ভালো বলা যায়।
করোনা সংকট সত্ত্বেও গত অর্থবছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে দুই হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। একই সময়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। যদিও দুই অর্থবছরে করোনা মহামারির কারণে সরকারি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ কম অর্জন হয়েছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। করোনার কারণে গত অর্থবছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত চার মাস প্রায় স্থবির ছিল অর্থনীতি। অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও উৎপাদন কমে গিয়েছে। কাজ হারিয়েছে অনেক মানুষ।
করোনার এই মহামারীতে সরকারি চাকরীজীবি ব্যতিত অন্যান্য পেশাজীবির মানুষদের পড়তে হয়েছে বিড়ম্বনায়৷ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন এনজিও তাদের বহুসংখ্যক কর্মীকে ছাটাই করেছে। শুধুমাত্র সরকারি চাকরিজীবীরাই স্বস্তির মধ্য দিয়ে যেতে পেরেছেন। সামাজিক মর্যাদা, আর্থিক নিরাপত্তা ও সুন্দর জীবনমানের জন্য সরকারি চাকরির প্রতি তরুণদের আগ্রহ অতীতের তুলনায় বর্তমানে দিনদিন বাড়ছে।
করোনায় মহামারীতে এই প্রবণতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনা সংকটে বন্ধ ছিল অন্য সবকিছুর মতো চাকরিতে নিয়োগ পরীক্ষাও, যা আবার পুরোদমে শুরু হয়েছে। আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিভিন্ন চাকরির নিয়োগে নিয়োগ প্রত্যাশীদের অভিযোগের তীর!
সরকারি চাকরির নিয়োগে সরকার স্বচ্ছতা বজায় রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করলেও মাঠ পর্যায়ের চিত্রটা চাকরি প্রত্যাশীদের কাছে প্রহসনের নামান্তর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চাকরি প্রত্যাশীদের বিভিন্ন গ্রুপে নিয়মিত ঢুঁ মারলেই বিভিন্ন অনিয়ম সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে ৷
পিএসসির অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া পরীক্ষা ছাড়া অন্যান্য পরীক্ষার বিষয়ে অভিযোগের শেষ নেই চাকরি প্রত্যাশীদের। এর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়োগে দূর্নীতির অভিযোগে নিয়োগ বাতিল হতে দেখেছি আমরা। প্রথম আলো পত্রিকার অনুসন্ধানী সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের অনুসন্ধানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান ও কার্ডিওগ্রাফারের আড়াই হাজারের বেশি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগ উঠলে মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি অবশেষে সেই নিয়োগ বাতিল করে। এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রার্থীদের একটি অংশের কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা করে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করেছিলেন মন্ত্রণালয় গঠিত নিয়োগ কমিটিরই দুই সদস্য।
সম্প্রতি জীবন বিমা করপোরেশনের নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফলেও অস্বচ্ছতার অভিযোগ আমরা দেখেছি পত্র পত্রিকার মাধ্যমে। গত ৩ ও ৪ সেপ্টেম্বর জীবন বীমা করপোরেশনের উচ্চমান সহকারী, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক ও অফিস সহায়ক পদে ৫১২ জন নিয়োগের জন্য এমসিকিউ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জহুরুল হক এই নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে ‘নিয়োগ বাণিজ্যে’ জড়িত বলে অভিযোগ পায় দুদক। গত বছরের জানুয়ারিতে এ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় জীবন বীমা করপোরেশন। এরপর গত ১৩ নভেম্বর এমসিকিউ পরীক্ষা নেওয়ার সময়সূচি ঘোষণা করেও অনিয়মের অভিযোগে দুই দিন আগে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।
জীবন বীমা কর্পোরেশনের এই নিয়োগের অস্বচ্ছতার রেশ কাটতে না কাটতেই অভিযোগ আসে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বি আর ই বি) এর নিয়োগ জালিয়াতির৷ লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের ফলাফলের তালিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সেখানে কিছু রোল নাম্বার আগে থেকে আলাদাভাবে মার্ক করা ছিল।
পরবর্তীতে মৌখিক পরীক্ষায় সেই একই রোল নাম্বারদের উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়টি পরীক্ষায় জালিয়াতির বিষয়টিকে আরো সন্দেহজনক করে তোলে। পরীক্ষার্থীরা এই বিষয়ে প্রশ্ন তুললে পরবর্তীতে নতুন করে আলাদাভাবে ফলাফল দেওয়া হয় এবং পূর্বের বিজ্ঞপ্তিটি সরিয়ে ফেলা হয়, যা স্পষ্টতই অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়৷
নিয়োগে এসব জালিয়াতির সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে একই দিনে একাধিক চাকরির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি। গেল সপ্তাহে শুক্রবারে (৮অক্টোবর) একই দিনে মোট ১৪টি প্রতিষ্ঠানের চাকরির পরীক্ষা আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে কয়েকটি পরীক্ষা পড়েছে একই সময়ে।
এর আগে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২১টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ পরীক্ষার আয়োজন করেছিল। অনুমিতভাবেই চাকরি প্রত্যাশীদের চাপা ক্ষোভ বিরাজ করে এ বিষয়ে ৷ প্রতিটি চাকরি পরীক্ষায় ফি নেওয়া হয় গড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা৷ একইদিনে অনুষ্ঠিত এমন পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ২/৩টিতে চাকরি প্রত্যাশীরা অংশগ্রহণ করতে পারে।
পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা এসব শিক্ষার্থীদের সিংহভাগই বেকার৷এটি রীতিমতোই পরীক্ষার্থীদের সাথে অন্যায়৷ সমন্বিত নীতিমালা চাকরির নিয়োগে এখন জরুরি প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আগামী ২৯ শে অক্টোবর একইসাথে ৭টি চাকরির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে, তন্মধ্যে রয়েছে ৪৩ তম বিসিএসের গুরৃত্বপূর্ণ প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। বেকারদের সাথে রীতিমতো প্রহসন চলছে। তবে আশার বিষয় হল, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ইতোমধ্যে এই সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন৷
চাকরি প্রত্যাশীদের আরেকটি অভিযোগ হলো পরীক্ষার ফি। বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় ফি পরিশোধ করা পরীক্ষার্থীদের কাছে দিনদিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে৷ একে-তো দেশে শিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা বাড়ছে, তার উপরে রয়েছে যুগোপযোগী কর্মসংস্থান সংকট। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নামেমাত্র সার্টিফিকেট নিয়ে বের হয়ে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তেছে অধিকাংশ চাকরি প্রত্যাশী৷ একই কারণে শিক্ষিত অনেক শিক্ষার্থীরই আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়৷
বিভাগীয় শহরগুলোতে চাকরির পরীক্ষা না নেয়া, যা পিএসসি সফলভাবে সম্পাদন করে আসছে, তা চাকরি প্রত্যাশীদের আরো একটি বড় অভিযোগ। আমাদের ছোট্ট এই দেশের সবকিছুই রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রীক। যেকোন চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে সারাদেশ থেকে পরীক্ষার্থীদের ছুটতে হয় ঢাকায়। এতে অপচয় হয় একইসাথে সময় ও অর্থের। এই বিষয়ে নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের আরো বিশদ ভাবার সময় এসেছে। রাজধানী ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা এখন সময়ের দাবি।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও করোনায় চাকরির সুযোগ অনেকটাই কমে যাচ্ছে। করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের চাকরি খোঁজার পোর্টালে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক(এডিবি)।
এডিবি এর মতে, বাংলাদেশের অনলাইন জবপোর্টাল বিডিজবসে ২০১৯ সালে ৬০ হাজারের বেশি চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। এ পোর্টালটির ভিজিটর সংখ্যা প্রতিদিন গড়ে দুই লাখ।
গত এপ্রিল মাসে আগের বছরের এপ্রিল মাসের তুলনায় ৮৭ শতাংশ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি কমেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এর বদৌলতে বর্তমানে অনলাইনে পোর্টালের মাধ্যমে চাকরি খোঁজা তরুণ শিক্ষার্থীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সাপ্তাহিক চাকরির পত্রিকার থেকে এইসব অনলাইন মাধ্যমে চাকরিপ্রত্যাশীদের আনাগোনা থাকে প্রায় সব সময়ই৷
দেশে যেহেতু শিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে এবং একইসাথে সংকুচিত হচ্ছে চাকরি পাওয়ার সুযোগ, সেহেতু যুগোপযোগী কর্মসংস্থান তৈরি করা এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। এত বিপুল পরিমাণ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে কর্মবিমুখ করে রাখলে, একটা সময়ে আইন শৃঙখলার চরম অবনতি হবার আশংকা থেকেই যায়। এ অবস্থা থেকে পরিবর্তন চাইলে নিতে হবে সমন্বিত নীতিমালা যা দুর্ভোগ কমাবে চাকরি প্রত্যাশীদের। নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। নিয়োগ জালিয়াতিতে জড়িতদের কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে প্রতিটি জায়গায় সোনার মানুষ নির্বাচন করতে হবে। জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ প্রাপ্তরা দিনশেষে জালিয়াত হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইবে, এ সম্ভাবনাই বেশি। কাজেই চাকরির নিয়োগে প্রহসনের নিরসন করে স্বচ্ছতার জায়গা তৈরি করতে হবে, আর এই দায়িত্ব সরকারেরই৷
লেখক: আহবায়ক,বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ ও প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম আহবায়ক, কোটা সংস্কার আন্দোলন।