করোনা পরবর্তী শ্বাসকষ্ট ও করণীয়

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ০৩:৩৫:৪২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২০
  • / ২৪৮ Time View

ডা. মোস্তাফিজুর রহমান

কোভিড-১৯ মহামারি সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প হিসেবে আবির্ভূত। এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানবজাতির জন্য বেঁচে থাকার এক নতুন চ্যালেঞ্জ। এই কঠিন মহামারি থেকে বেঁচে থাকা যেমন দুরূহ তেমনি যারা আক্রান্ত হয়ে সেরে উঠেছেন, তারা দীর্ঘমেয়াদি জটিল বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় আক্রান্তও হচ্ছেন।

১৯১৯-২০ সালের দিকে যে স্প্যানিশ ফ্লু হয়েছিল তার অনেক দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা আমরা জেনেছি। কিন্তু পোস্ট কোভিড জটিলতা যেন সেগুলোকেও হার মানিয়েছে। কঠিন এই রোগ থেকে মুক্তিলাভ করেও যেন মানুষ বন্দি হয়ে আছে পোস্ট কোভিডের বেড়াজালে। শারীরিক দুর্বলতা এবং শ্বাসকষ্ট কোভিড পরবর্তী জটিলতার মধ্যে অন্যতম।

আমি আজ আপনাদের পোস্ট কোভিড লাং ফ্রাইব্রোসিস (যা পরবর্তীতে শ্বাসকষ্ট তৈরি করে) নিয়ে কিছু কথা বলব। শ্বাসনালীর মাধ্যমে সার্স কভ-২ শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন অঙ্গে আক্রমণ করে বিভিন্ন উপসর্গ সৃষ্টি করে, ফুসফুস ছাড়াও হার্ট, রক্তনালী, লিভার, কিডনি, পাকস্থলী, হরমোনগ্রন্থি ইত্যাদি অঙ্গে আক্রান্ত করে, তবে যাদের ফুসফুস আক্রান্ত হয় তারা দ্রুত সিম্পটোমেটিক হয় (যেমন কাশি, শ্বাসকষ্ট), সে জন্য তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন দ্রুত। কিন্তু যারা হার্ট, লিভার, কিডনি বা হরমোনগ্রন্থি অথবা রক্তনালীর রোগে আক্রান্ত হন তারা হয় মৃদু উপসর্গ নিয়ে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার মাধ্যমে সেরে ওঠেন অথবা জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়ে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যান কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই।

সুতরাং আনপ্রেডিক্টেবল আউটকাম যে রোগের বৈশিষ্ট্য তাকে মোকাবিলা করা সত্যিই কঠিন ব্যাপার। চীনে ১০ জন রোগীর অটোপসি রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এদের ১০ জনেরই রক্তজমাট বেঁধে ফুসফুস বা হার্ট আক্রমণ করেছে। যারা একটু বেশি দিন পর্যন্ত সারভাইভ করেছেন তারা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। সঠিক সময়ে উপযুক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষাই দিতে পারে এই জটিল অবস্থায় পৌঁছানোর পূর্ববর্তী ক্লু। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সময়মতো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না, ফলে জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়।

যেহেতু এটা একটা ভাইরাসজনিত রোগ, হাঁচি-কাশির মাধ্যমে বায়ুবাহিত হয়েই অন্যকে ছড়ায়। আসলে কেউ এ রোগ থেকে শতভাগ ইমিউন না। অন্যান্য রোগ থাকুক আর না থাকুক, যে কেউ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে, তবে যারা বয়স্ক, শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম অথবা অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত তাদের এই রোগের জটিলতা অনেক বেশি হয়। সুতরাং এসব ভালনারেবল জনগোষ্ঠীকে সঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শ দিয়ে ভালো রাখার ব্যবস্থা করতে হবে, না হলে কোভিড হতে আমাদের যেমন মুক্তি মিলবে না, তেমনি হাসপাতালগুলোতে মৃত্যুর মিছিল চলতেই থাকবে।

ইদানীং কোভিড থেকে সেরে ওঠা অনেকেই বলছেন তারা অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠছেন বা শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, আগে যাদের এমন সমস্যা ছিল না। এসব রোগী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যারা হার্টের মায়োকার্ডাইটিস অথবা ফুসফুসের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন তারাই পরবর্তীতে এমন সমস্যার কথা বলছেন বেশি, বিশেষ করে যাদের নিউমোনিয়া ৩০% এর বেশি, যারা অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত তাদেরই দীর্ঘমেয়াদি পোস্ট কোভিড লাং ফ্রাইব্রোসিস বেশি হয়।

আরেকটা গ্রুপের রোগী যাদের হাইপারইমিউন রিয়েকশন, বেশি বেশি সাইটোকাইন রিলিজ হয় তাদের ক্ষেত্রে সাইটোকাইন স্টর্ম হয়, তাদের সার্স কভ-২ ভাইরাসকে মারার পাশাপাশি নিজের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ফলে নিউমোনিয়া দীর্ঘায়িত হয়, হার্টের মায়োকার্ডাইটিস হয়, লাংসের ফ্রাইব্রোসিস বেশি হয়। পরবর্তীতে ইনফেকশন কমে গেলেও, কোভিড টেস্ট নেগেটিভ হলেও, রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকে এবং তারা দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্ট উপলব্ধি করেন।

কোন রোগী পরবর্তীতে এমন উপসর্গে আক্রান্ত হতে পারেন তা কিন্তু আমরা আগে থেকেই একটু হলেও আন্দাজ করতে পারি। সঠিক সময়ে সঠিক পরীক্ষাই আমাদের এই ক্লু দিতে পারে, সেই সাথে রোগের সঠিক ইতিহাস। যেমন- কোনো রোগীর যদি আগে থেকে লাংসের দীর্ঘমেয়াদি কোনো রোগ থাকে (সিওপিডি, অ্যাজমা, ব্রংকিয়াক্টেসিস, ফ্রাইব্রোসিস) অথবা কোভিড আক্রমণের শুরুতেই যাদের ইনফ্লামেটরি মার্কার বেশি থাকে, বিশেষ করে ফেরিটিন লেভেল, সিআরপি, এলডিএইচ কিংবা রক্তে লিম্ফোপেনিয়া থাকে, তাদের জটিলতা বেশি হতে পারে। এছাড়া পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে দেখা যায় যাদের অর্গানিজম ৪০% এর ওপরে ডিটেকশন হয়, তাদের সিভিয়ার ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এসব ক্ষেত্রে আমরা আগে থেকেই ব্যবস্থা নিতে পারব, ফলে জটিলতা অনেকাংশে রোধ করা যাবে।

সমস্ত পৃথিবীতে করোনার ইনফেস্টিভিটি বাড়লেও মৃত্যুহার কিন্তু কমে গেছে, নতুন নতুন রিসার্চ হচ্ছে, চিকিৎসকরা এই নতুন রোগ সম্পর্কে বেশি বেশি জানতে পারছেন এবং সর্বোপরি রোগের আউটকাম নিয়ে কিছু ধারণা করতে পারছেন, যার ফলে আমরা কোভিড পরবর্তী জটিলতা সম্পর্কেও রোগীকে আগাম ধারণা দিতে পারছি।

যখনই কোনো রোগীর উপসর্গ দেখা দেবে (অনেকই বলে কোনো উপসর্গ নাই, আসলে তা হবার নয় একটু হলেও উপসর্গ হবে, হয়তো অন্য উপসর্গের সাথে মিলে গেছে বলে বুঝি না)। কিন্তু মৃদু বা একদিনের জন্য হলেও উপসর্গ হবে। আরটি পিসিআরে ভাইরাল লোভ দেখেও অনেক সময় এ রোগের সিভিয়ারিটি আন্দাজ করা যায়। সাধারণত এক থেকে তিনদিন জ্বর, সর্দি, গা-ব্যথা বা ম্যাজ ম্যাজ ভাব অথবা ঘ্রাণশক্তি কমে যেতে পারে, তারপর যখন কাশি বা শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তখনই শরীরের অক্সিজেনের মাত্রা দেখা জরুরি হয়ে পড়ে, যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা দেয়া যায়, তত তাড়াতাড়ি রোগ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে অথবা রোগ দীর্ঘায়িত হয় না। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা ইগনোর করি, যখন জটিল হতে জটিলতর রূপ ধারণ করে তখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই।

কোনো রোগী যদি অন্যান্য কোমরবিডিটি নিয়ে ভর্তি হয়, অথবা ভাইরাল লোভ (পিসিআর টেস্টে) বেশি থাকে অথবা ইনফ্লামেটরি মার্কার অনেক বেশি থাকে অথবা এইচআরসিটিতে ৩০% বেশি ইনভল্বড থাকে, সেসব রোগীর ক্ষেত্রে আমরা আগে থেকে সাবধান থাকব প্রটোকল অনুসারে খুব দ্রুত অ্যান্টিভাইরাল, স্টেরয়েড, ইন্টারলিউকিন ইনহিবিটর ইত্যাদির সাথে প্রোফাইলেকটিক অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিকোগুলেন্ট, রেগুলার অক্সিজেন থেরাপি ইত্যাদি শুরু করা উচিত।

সেই সাথে ভাইটাল সাইনগুলো নিয়মিত দেখা উচিত, তিন-চার দিনের মধ্যেই এসব রোগী ইমপ্রুভড হওয়া শুরু করে। যাদের ইমপ্রুভমেন্ট দেরি হয় তাদের জটিলতাও বেশি হয় এবং কোভিড পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে ১৪ দিনের চিকিৎসার পরও যাদের অক্সিজেন ডিপেন্ডেসি যায় না, এইচআরসিটির ইনভল্বমেন্ট অপরিবর্তিত থাকে তাদের ক্ষেত্রে পোস্ট কোভিড ফাইব্রোসিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, সেক্ষেত্রে উপরের ওষুধের পাশাপাশি অ্যান্টিফাইব্রোটিক এজেন্ট যোগ করলে দ্রুত উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। স্টেরয়েড একটু দীর্ঘমেয়াদি এবং সেই সাথে অ্যান্টিফাইব্রোটিক ড্রাগ কোভিড রোগীদের পরবর্তী জটিলতা মুক্তজীবন দানে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

পোস্ট কোভিড জটিলতায় বক্ষব্যাধি ডাক্তারদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। নতুন নতুন অ্যান্টিফাইব্রোটিক ড্রাগ যেমন রোগীকে নতুন আলোর হাতছানি দেয়, ঠিক তেমনি পালমোনারি রিহেবিলিটেশন রোগীকে নতুন জীবনে খাপ খাওয়াতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে আর এর দায়দায়িত্ব অবশ্যম্ভাবী বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের ওপর এসে পড়ে। তাই বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞদের প্রতি অনুরোধ সব রোগীকে ব্রিদিং এক্সারসাইজ করতে বলুন পালমোনারি রিহেবিলিটেশনের আওতায় আনুন এবং পোস্ট কোভিড শ্বাসকষ্ট থেকে রোগীকে মুক্তি দিতে সাহায্য করুন।

বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশন বিভিন্ন ওয়েবিনারের মাধ্যমে জনসাধারণকে প্রশিক্ষিত করছে, স্বাস্থ্যকর্মীদের সরাসরি ট্রেনিং দিচ্ছে, আপনারা যেখানে আছেন সেখান থেকে এগিয়ে আসুন, সম্মিলিতভাবে এ রোগকে মোকাবিলা করুন। আপনার ফুসফুসের যত্ন নিন, সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করুন। বেঁচে থাক, সুস্থ থাক আমরা আপনারা আর আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম।

কোভিড হাসপাতালে কাজ করার অভিজ্ঞতা হতে লেখা, মতবিরোধ থাকবেই, সঠিক যুক্তি-তর্কই দিতে পারে নতুন আলোর সন্ধান।

লেখক : যক্ষ্মা ও বক্ষব্যাধি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক (রেসপিরেটরি মেডিসিন), শেখ রাসেল জাতীয় গ্যান্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাওপাতাল।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

করোনা পরবর্তী শ্বাসকষ্ট ও করণীয়

Update Time : ০৩:৩৫:৪২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২০

ডা. মোস্তাফিজুর রহমান

কোভিড-১৯ মহামারি সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প হিসেবে আবির্ভূত। এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানবজাতির জন্য বেঁচে থাকার এক নতুন চ্যালেঞ্জ। এই কঠিন মহামারি থেকে বেঁচে থাকা যেমন দুরূহ তেমনি যারা আক্রান্ত হয়ে সেরে উঠেছেন, তারা দীর্ঘমেয়াদি জটিল বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় আক্রান্তও হচ্ছেন।

১৯১৯-২০ সালের দিকে যে স্প্যানিশ ফ্লু হয়েছিল তার অনেক দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা আমরা জেনেছি। কিন্তু পোস্ট কোভিড জটিলতা যেন সেগুলোকেও হার মানিয়েছে। কঠিন এই রোগ থেকে মুক্তিলাভ করেও যেন মানুষ বন্দি হয়ে আছে পোস্ট কোভিডের বেড়াজালে। শারীরিক দুর্বলতা এবং শ্বাসকষ্ট কোভিড পরবর্তী জটিলতার মধ্যে অন্যতম।

আমি আজ আপনাদের পোস্ট কোভিড লাং ফ্রাইব্রোসিস (যা পরবর্তীতে শ্বাসকষ্ট তৈরি করে) নিয়ে কিছু কথা বলব। শ্বাসনালীর মাধ্যমে সার্স কভ-২ শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন অঙ্গে আক্রমণ করে বিভিন্ন উপসর্গ সৃষ্টি করে, ফুসফুস ছাড়াও হার্ট, রক্তনালী, লিভার, কিডনি, পাকস্থলী, হরমোনগ্রন্থি ইত্যাদি অঙ্গে আক্রান্ত করে, তবে যাদের ফুসফুস আক্রান্ত হয় তারা দ্রুত সিম্পটোমেটিক হয় (যেমন কাশি, শ্বাসকষ্ট), সে জন্য তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন দ্রুত। কিন্তু যারা হার্ট, লিভার, কিডনি বা হরমোনগ্রন্থি অথবা রক্তনালীর রোগে আক্রান্ত হন তারা হয় মৃদু উপসর্গ নিয়ে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার মাধ্যমে সেরে ওঠেন অথবা জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়ে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যান কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই।

সুতরাং আনপ্রেডিক্টেবল আউটকাম যে রোগের বৈশিষ্ট্য তাকে মোকাবিলা করা সত্যিই কঠিন ব্যাপার। চীনে ১০ জন রোগীর অটোপসি রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এদের ১০ জনেরই রক্তজমাট বেঁধে ফুসফুস বা হার্ট আক্রমণ করেছে। যারা একটু বেশি দিন পর্যন্ত সারভাইভ করেছেন তারা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। সঠিক সময়ে উপযুক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষাই দিতে পারে এই জটিল অবস্থায় পৌঁছানোর পূর্ববর্তী ক্লু। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সময়মতো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না, ফলে জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়।

যেহেতু এটা একটা ভাইরাসজনিত রোগ, হাঁচি-কাশির মাধ্যমে বায়ুবাহিত হয়েই অন্যকে ছড়ায়। আসলে কেউ এ রোগ থেকে শতভাগ ইমিউন না। অন্যান্য রোগ থাকুক আর না থাকুক, যে কেউ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে, তবে যারা বয়স্ক, শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম অথবা অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত তাদের এই রোগের জটিলতা অনেক বেশি হয়। সুতরাং এসব ভালনারেবল জনগোষ্ঠীকে সঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শ দিয়ে ভালো রাখার ব্যবস্থা করতে হবে, না হলে কোভিড হতে আমাদের যেমন মুক্তি মিলবে না, তেমনি হাসপাতালগুলোতে মৃত্যুর মিছিল চলতেই থাকবে।

ইদানীং কোভিড থেকে সেরে ওঠা অনেকেই বলছেন তারা অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠছেন বা শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, আগে যাদের এমন সমস্যা ছিল না। এসব রোগী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যারা হার্টের মায়োকার্ডাইটিস অথবা ফুসফুসের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন তারাই পরবর্তীতে এমন সমস্যার কথা বলছেন বেশি, বিশেষ করে যাদের নিউমোনিয়া ৩০% এর বেশি, যারা অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত তাদেরই দীর্ঘমেয়াদি পোস্ট কোভিড লাং ফ্রাইব্রোসিস বেশি হয়।

আরেকটা গ্রুপের রোগী যাদের হাইপারইমিউন রিয়েকশন, বেশি বেশি সাইটোকাইন রিলিজ হয় তাদের ক্ষেত্রে সাইটোকাইন স্টর্ম হয়, তাদের সার্স কভ-২ ভাইরাসকে মারার পাশাপাশি নিজের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ফলে নিউমোনিয়া দীর্ঘায়িত হয়, হার্টের মায়োকার্ডাইটিস হয়, লাংসের ফ্রাইব্রোসিস বেশি হয়। পরবর্তীতে ইনফেকশন কমে গেলেও, কোভিড টেস্ট নেগেটিভ হলেও, রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকে এবং তারা দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্ট উপলব্ধি করেন।

কোন রোগী পরবর্তীতে এমন উপসর্গে আক্রান্ত হতে পারেন তা কিন্তু আমরা আগে থেকেই একটু হলেও আন্দাজ করতে পারি। সঠিক সময়ে সঠিক পরীক্ষাই আমাদের এই ক্লু দিতে পারে, সেই সাথে রোগের সঠিক ইতিহাস। যেমন- কোনো রোগীর যদি আগে থেকে লাংসের দীর্ঘমেয়াদি কোনো রোগ থাকে (সিওপিডি, অ্যাজমা, ব্রংকিয়াক্টেসিস, ফ্রাইব্রোসিস) অথবা কোভিড আক্রমণের শুরুতেই যাদের ইনফ্লামেটরি মার্কার বেশি থাকে, বিশেষ করে ফেরিটিন লেভেল, সিআরপি, এলডিএইচ কিংবা রক্তে লিম্ফোপেনিয়া থাকে, তাদের জটিলতা বেশি হতে পারে। এছাড়া পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে দেখা যায় যাদের অর্গানিজম ৪০% এর ওপরে ডিটেকশন হয়, তাদের সিভিয়ার ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এসব ক্ষেত্রে আমরা আগে থেকেই ব্যবস্থা নিতে পারব, ফলে জটিলতা অনেকাংশে রোধ করা যাবে।

সমস্ত পৃথিবীতে করোনার ইনফেস্টিভিটি বাড়লেও মৃত্যুহার কিন্তু কমে গেছে, নতুন নতুন রিসার্চ হচ্ছে, চিকিৎসকরা এই নতুন রোগ সম্পর্কে বেশি বেশি জানতে পারছেন এবং সর্বোপরি রোগের আউটকাম নিয়ে কিছু ধারণা করতে পারছেন, যার ফলে আমরা কোভিড পরবর্তী জটিলতা সম্পর্কেও রোগীকে আগাম ধারণা দিতে পারছি।

যখনই কোনো রোগীর উপসর্গ দেখা দেবে (অনেকই বলে কোনো উপসর্গ নাই, আসলে তা হবার নয় একটু হলেও উপসর্গ হবে, হয়তো অন্য উপসর্গের সাথে মিলে গেছে বলে বুঝি না)। কিন্তু মৃদু বা একদিনের জন্য হলেও উপসর্গ হবে। আরটি পিসিআরে ভাইরাল লোভ দেখেও অনেক সময় এ রোগের সিভিয়ারিটি আন্দাজ করা যায়। সাধারণত এক থেকে তিনদিন জ্বর, সর্দি, গা-ব্যথা বা ম্যাজ ম্যাজ ভাব অথবা ঘ্রাণশক্তি কমে যেতে পারে, তারপর যখন কাশি বা শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তখনই শরীরের অক্সিজেনের মাত্রা দেখা জরুরি হয়ে পড়ে, যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা দেয়া যায়, তত তাড়াতাড়ি রোগ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে অথবা রোগ দীর্ঘায়িত হয় না। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা ইগনোর করি, যখন জটিল হতে জটিলতর রূপ ধারণ করে তখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই।

কোনো রোগী যদি অন্যান্য কোমরবিডিটি নিয়ে ভর্তি হয়, অথবা ভাইরাল লোভ (পিসিআর টেস্টে) বেশি থাকে অথবা ইনফ্লামেটরি মার্কার অনেক বেশি থাকে অথবা এইচআরসিটিতে ৩০% বেশি ইনভল্বড থাকে, সেসব রোগীর ক্ষেত্রে আমরা আগে থেকে সাবধান থাকব প্রটোকল অনুসারে খুব দ্রুত অ্যান্টিভাইরাল, স্টেরয়েড, ইন্টারলিউকিন ইনহিবিটর ইত্যাদির সাথে প্রোফাইলেকটিক অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিকোগুলেন্ট, রেগুলার অক্সিজেন থেরাপি ইত্যাদি শুরু করা উচিত।

সেই সাথে ভাইটাল সাইনগুলো নিয়মিত দেখা উচিত, তিন-চার দিনের মধ্যেই এসব রোগী ইমপ্রুভড হওয়া শুরু করে। যাদের ইমপ্রুভমেন্ট দেরি হয় তাদের জটিলতাও বেশি হয় এবং কোভিড পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে ১৪ দিনের চিকিৎসার পরও যাদের অক্সিজেন ডিপেন্ডেসি যায় না, এইচআরসিটির ইনভল্বমেন্ট অপরিবর্তিত থাকে তাদের ক্ষেত্রে পোস্ট কোভিড ফাইব্রোসিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, সেক্ষেত্রে উপরের ওষুধের পাশাপাশি অ্যান্টিফাইব্রোটিক এজেন্ট যোগ করলে দ্রুত উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। স্টেরয়েড একটু দীর্ঘমেয়াদি এবং সেই সাথে অ্যান্টিফাইব্রোটিক ড্রাগ কোভিড রোগীদের পরবর্তী জটিলতা মুক্তজীবন দানে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

পোস্ট কোভিড জটিলতায় বক্ষব্যাধি ডাক্তারদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। নতুন নতুন অ্যান্টিফাইব্রোটিক ড্রাগ যেমন রোগীকে নতুন আলোর হাতছানি দেয়, ঠিক তেমনি পালমোনারি রিহেবিলিটেশন রোগীকে নতুন জীবনে খাপ খাওয়াতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে আর এর দায়দায়িত্ব অবশ্যম্ভাবী বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের ওপর এসে পড়ে। তাই বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞদের প্রতি অনুরোধ সব রোগীকে ব্রিদিং এক্সারসাইজ করতে বলুন পালমোনারি রিহেবিলিটেশনের আওতায় আনুন এবং পোস্ট কোভিড শ্বাসকষ্ট থেকে রোগীকে মুক্তি দিতে সাহায্য করুন।

বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশন বিভিন্ন ওয়েবিনারের মাধ্যমে জনসাধারণকে প্রশিক্ষিত করছে, স্বাস্থ্যকর্মীদের সরাসরি ট্রেনিং দিচ্ছে, আপনারা যেখানে আছেন সেখান থেকে এগিয়ে আসুন, সম্মিলিতভাবে এ রোগকে মোকাবিলা করুন। আপনার ফুসফুসের যত্ন নিন, সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করুন। বেঁচে থাক, সুস্থ থাক আমরা আপনারা আর আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম।

কোভিড হাসপাতালে কাজ করার অভিজ্ঞতা হতে লেখা, মতবিরোধ থাকবেই, সঠিক যুক্তি-তর্কই দিতে পারে নতুন আলোর সন্ধান।

লেখক : যক্ষ্মা ও বক্ষব্যাধি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক (রেসপিরেটরি মেডিসিন), শেখ রাসেল জাতীয় গ্যান্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাওপাতাল।