জীবন আর চলেনা দেলোয়ারের!

  • Update Time : ০৯:২৯:১৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২
  • / 323

মিনহাজুল ইসলাম :

“চাইলের দাম ৬০, মাছ-মুরগির কাছে তো যাওনের উপায় নাই। সব সবজির দামও হুট কইরা ১০-২০ টাকা বাড়তি। এক লিটার তেল কিনতে লাইগা যায় ২০০ টাকা। সবমিলে জীবন আর চলে না!” বড় আক্ষেপের সুরেই কথাগুলো বলছিলেন দেলোয়ার হোসেন। রিক্সা চালান পুরান ঢাকায়। সারাদিনে আয় হয় ৫০০ টাকার মতো। চারজনের সংসারে প্রতিদিন চাল কিনতেই যায় ১০০ টাকার মতো। ডাল, তেল, সবজি, মাছ, মাংস, ডিম সবকিছুর চড়াদামে ৫০০ টাকায় হয়ে ওঠেনা বাজার করা। ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। এদিকে টিনশেড বাসায় মাসে ভাড়া গুনতে হয় আড়াই হাজার টাকা। আছে ছেলেমেয়ের খরচও। সবকিছু মিলিয়ে যেন পেটে পাথর বাঁধার মতো অবস্থা!

দেলোয়ার হোসেন বলেন, “বছরে ঈদ ছাড়া গরুর গোশত খাইতে পারিনা। মুরগি খাইতাম। তার দামও বাড়তি। চাল ডাল আলু খাইয়া যে বাঁইচা থাকমু তার দামও বাড়তেই আছে। জীবনে এক লিটার সয়াবিন তেল ২০০ টাকা দিয়ে কিনা লাগবে কোনোদিন ভাবিনি। এখন তা স্বচক্ষে দেখতাছি। সবমিলিয়ে আমাগো মতো গরীবের মইরা যাওয়া ছাড়া উপায় নাই।”

দেলোয়ারের মতো এমন দুরবস্থা যেন এখন সারাদেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জীবনে গাঢ় আঁধারের মতো জেঁকে বসেছে। বিশেষত ঢাকা শহরের মানুষের অবস্থা আরও বেশি শোচনীয়। বাসাভাড়া, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম, বাসের বাড়তি ভাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া গতি সবমিলিয়ে যেন এক নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জীবনে। সহসাই এ দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তির পথও দেখছেন না কেউ।

পুরান ঢাকার ধূপখোলা কাঁচাবাজার, শ্যামবাজার, সূত্রাপুর কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় সব খাদ্যসামগ্রীর দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। চিকন চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়, মোটা চাল ৫০-৬০ টাকা, ডাল মানভেদে ১২০-১৫০ টাকা, আটা ৬৫ টাকা, ময়দা ৭০-৭৫ টাকা, সয়াবিন তেল লিটার ১৯৫ টাকা, গরুর মাংস কেজি ৭০০ টাকা, খাসির মাংস ১০৫০ টাকা, পোল্ট্রি মুরগি ১৮০-২০০ টাকা, সোনালি মুরগি ৩০০ টাকা, তেলাপিয়া মাছ ২২০ টাকা, রুই মাছ ৬০০ টাকা। এছাড়াও তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর সকল সবজির দামও বেড়েছে ১০-২০ টাকা করে। বেগুনের কেজি ৬০ টাকা, টমেটো ১০০ টাকা, পটল ৪০-৫০ টাকা, কাঁচামরিচ ১২০ টাকা।

সবকিছুর এই অনিয়ন্ত্রিত মূল্যের ফলে ক্রয়ক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমেছে মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষের। এই বাড়তি দামের বাজার যেন সাধারণ মানুষের জন্য ‘মড়ার উপর খড়ার ঘা’ হয়ে নেমে এসেছে। পুরান ঢাকার ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রফিক মিয়া বলেন, সারাদিনে রোজগার করতে পারি ৪০০-৬০০ টাকা। বাজার করতেই এইটাকা দরকার পড়ে৷ তাহলে বাসাভাড়া, গ্যাস, বিদ্যুতের বিল দিবো কীভাবে? ঢাকার জীবনে আজ অব্দি এতটা সঙ্কটে কখনও পড়তে হয়নি।

বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করা আহসান হাবিব বলেন, “স্ত্রী সন্তান নিয়ে ফ্ল্যাটে থাকি। কিন্তু তেলের দাম বাড়ার পর সবকিছুর দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। অফিসে আসা যাওয়ার খরচও দেড়গুণ বেড়ে গেছে। আগে বাজারে ৫০০ টাকা নিয়ে গেলেই হয়ে যেত। এখন হাজার টাকা নিয়ে বাজারে যাওয়া লাগে। সবমিলিয়ে ভাবছি স্ত্রী সন্তানকে গ্রামে পাঠিয়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে কোনো মেসে উঠবো। নইলে আর খেয়ে বাঁচা সম্ভব নয়।”

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুল কাদের নাগিব পুরান ঢাকায় মেস বাসায় থাকেন। তিনি বলেন, সবকিছুর দাম এতটা বেড়েছে যে এখন আমরা কেবল ডাল, ভাত, আলু ও কমদামি সবজি খেয়ে বেঁচে আছি। মাছ মাংস সবকিছুর দামে যেন আগুন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে সকালবেলা রেস্তোরাঁয় দুইটা রুটি আর সবজি খেতাম। রাতারাতি পাঁচ টাকার রুটি দশ টাকা হয়ে গেছে। তবে কি আটার দাম দ্বিগুণ বেড়েছে? পাঁচটাকা থেকে বেড়ে সাতটাকা হতে পারত। মনের দুঃখে এখন আর রুটিও খাইনা।”

দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে রাজধানীর শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম বলেন, “তেলের দাম বাড়ার পর ট্রাকের ভাড়া অনেক বেড়ে গেছে। তাই সবকিছুর দামই বেড়েছে। এতে আমাদের কিছু করার নেই। তেলের দাম আগের মতো করে দিলেই সবকিছু ঠিক হবে। তাছাড়া সম্ভব নয়।”

দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের মহাপরিচালক জনাব এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান দৈনিক মানবকণ্ঠকে বলেন, “বাজার নিয়ন্ত্রণে আমাদের কার্যক্রম চলছে। আমরা ডিম নিয়ে কাজ করেছি। এখন চাল নিয়ে করছি। তবুও কথা হচ্ছে আমাদের তৎপরতাও আসলে যথেষ্ট নয়। কারণ আমাদের সক্ষমতার ব্যাপার রয়েছে। তাছাড়া আমরা যদি সক্ষমতার দশগুণও কাজ করি সেখানে খুব বেশি রেজাল্ট আসবে বলে মনে করি না। কারণ এখানে অনেকগুলো ফ্যাক্টর জড়িত। বৈশ্বিক পরিস্থিতি, ডলারের দাম, তেলের দাম বৃদ্ধিসহ অনেককিছুই আছে এখানে। তবুও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি বাজার নিয়ন্ত্রণের।” ###

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


জীবন আর চলেনা দেলোয়ারের!

Update Time : ০৯:২৯:১৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২

মিনহাজুল ইসলাম :

“চাইলের দাম ৬০, মাছ-মুরগির কাছে তো যাওনের উপায় নাই। সব সবজির দামও হুট কইরা ১০-২০ টাকা বাড়তি। এক লিটার তেল কিনতে লাইগা যায় ২০০ টাকা। সবমিলে জীবন আর চলে না!” বড় আক্ষেপের সুরেই কথাগুলো বলছিলেন দেলোয়ার হোসেন। রিক্সা চালান পুরান ঢাকায়। সারাদিনে আয় হয় ৫০০ টাকার মতো। চারজনের সংসারে প্রতিদিন চাল কিনতেই যায় ১০০ টাকার মতো। ডাল, তেল, সবজি, মাছ, মাংস, ডিম সবকিছুর চড়াদামে ৫০০ টাকায় হয়ে ওঠেনা বাজার করা। ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। এদিকে টিনশেড বাসায় মাসে ভাড়া গুনতে হয় আড়াই হাজার টাকা। আছে ছেলেমেয়ের খরচও। সবকিছু মিলিয়ে যেন পেটে পাথর বাঁধার মতো অবস্থা!

দেলোয়ার হোসেন বলেন, “বছরে ঈদ ছাড়া গরুর গোশত খাইতে পারিনা। মুরগি খাইতাম। তার দামও বাড়তি। চাল ডাল আলু খাইয়া যে বাঁইচা থাকমু তার দামও বাড়তেই আছে। জীবনে এক লিটার সয়াবিন তেল ২০০ টাকা দিয়ে কিনা লাগবে কোনোদিন ভাবিনি। এখন তা স্বচক্ষে দেখতাছি। সবমিলিয়ে আমাগো মতো গরীবের মইরা যাওয়া ছাড়া উপায় নাই।”

দেলোয়ারের মতো এমন দুরবস্থা যেন এখন সারাদেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জীবনে গাঢ় আঁধারের মতো জেঁকে বসেছে। বিশেষত ঢাকা শহরের মানুষের অবস্থা আরও বেশি শোচনীয়। বাসাভাড়া, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম, বাসের বাড়তি ভাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া গতি সবমিলিয়ে যেন এক নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জীবনে। সহসাই এ দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তির পথও দেখছেন না কেউ।

পুরান ঢাকার ধূপখোলা কাঁচাবাজার, শ্যামবাজার, সূত্রাপুর কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় সব খাদ্যসামগ্রীর দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। চিকন চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়, মোটা চাল ৫০-৬০ টাকা, ডাল মানভেদে ১২০-১৫০ টাকা, আটা ৬৫ টাকা, ময়দা ৭০-৭৫ টাকা, সয়াবিন তেল লিটার ১৯৫ টাকা, গরুর মাংস কেজি ৭০০ টাকা, খাসির মাংস ১০৫০ টাকা, পোল্ট্রি মুরগি ১৮০-২০০ টাকা, সোনালি মুরগি ৩০০ টাকা, তেলাপিয়া মাছ ২২০ টাকা, রুই মাছ ৬০০ টাকা। এছাড়াও তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর সকল সবজির দামও বেড়েছে ১০-২০ টাকা করে। বেগুনের কেজি ৬০ টাকা, টমেটো ১০০ টাকা, পটল ৪০-৫০ টাকা, কাঁচামরিচ ১২০ টাকা।

সবকিছুর এই অনিয়ন্ত্রিত মূল্যের ফলে ক্রয়ক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমেছে মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষের। এই বাড়তি দামের বাজার যেন সাধারণ মানুষের জন্য ‘মড়ার উপর খড়ার ঘা’ হয়ে নেমে এসেছে। পুরান ঢাকার ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রফিক মিয়া বলেন, সারাদিনে রোজগার করতে পারি ৪০০-৬০০ টাকা। বাজার করতেই এইটাকা দরকার পড়ে৷ তাহলে বাসাভাড়া, গ্যাস, বিদ্যুতের বিল দিবো কীভাবে? ঢাকার জীবনে আজ অব্দি এতটা সঙ্কটে কখনও পড়তে হয়নি।

বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করা আহসান হাবিব বলেন, “স্ত্রী সন্তান নিয়ে ফ্ল্যাটে থাকি। কিন্তু তেলের দাম বাড়ার পর সবকিছুর দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। অফিসে আসা যাওয়ার খরচও দেড়গুণ বেড়ে গেছে। আগে বাজারে ৫০০ টাকা নিয়ে গেলেই হয়ে যেত। এখন হাজার টাকা নিয়ে বাজারে যাওয়া লাগে। সবমিলিয়ে ভাবছি স্ত্রী সন্তানকে গ্রামে পাঠিয়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে কোনো মেসে উঠবো। নইলে আর খেয়ে বাঁচা সম্ভব নয়।”

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুল কাদের নাগিব পুরান ঢাকায় মেস বাসায় থাকেন। তিনি বলেন, সবকিছুর দাম এতটা বেড়েছে যে এখন আমরা কেবল ডাল, ভাত, আলু ও কমদামি সবজি খেয়ে বেঁচে আছি। মাছ মাংস সবকিছুর দামে যেন আগুন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে সকালবেলা রেস্তোরাঁয় দুইটা রুটি আর সবজি খেতাম। রাতারাতি পাঁচ টাকার রুটি দশ টাকা হয়ে গেছে। তবে কি আটার দাম দ্বিগুণ বেড়েছে? পাঁচটাকা থেকে বেড়ে সাতটাকা হতে পারত। মনের দুঃখে এখন আর রুটিও খাইনা।”

দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে রাজধানীর শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম বলেন, “তেলের দাম বাড়ার পর ট্রাকের ভাড়া অনেক বেড়ে গেছে। তাই সবকিছুর দামই বেড়েছে। এতে আমাদের কিছু করার নেই। তেলের দাম আগের মতো করে দিলেই সবকিছু ঠিক হবে। তাছাড়া সম্ভব নয়।”

দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের মহাপরিচালক জনাব এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান দৈনিক মানবকণ্ঠকে বলেন, “বাজার নিয়ন্ত্রণে আমাদের কার্যক্রম চলছে। আমরা ডিম নিয়ে কাজ করেছি। এখন চাল নিয়ে করছি। তবুও কথা হচ্ছে আমাদের তৎপরতাও আসলে যথেষ্ট নয়। কারণ আমাদের সক্ষমতার ব্যাপার রয়েছে। তাছাড়া আমরা যদি সক্ষমতার দশগুণও কাজ করি সেখানে খুব বেশি রেজাল্ট আসবে বলে মনে করি না। কারণ এখানে অনেকগুলো ফ্যাক্টর জড়িত। বৈশ্বিক পরিস্থিতি, ডলারের দাম, তেলের দাম বৃদ্ধিসহ অনেককিছুই আছে এখানে। তবুও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি বাজার নিয়ন্ত্রণের।” ###