প্রতারণার অভিযোগ এবি ব্যাংকের ইভিপি’র বিরুদ্ধে
- Update Time : ১০:২১:২৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩১ অগাস্ট ২০২৪
- / 21
এবি ব্যাংকের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (ইভিপি) সৈয়দ মহররম হোসেনের বিরুদ্ধে ব্ল্যাকমেইলিং ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন জাকির হোসেন নাম এক ব্যক্তি।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, এবি ব্যাংকের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মহররম হোসেনের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়েছেন বেশ কয়েকটি ব্যাংকের কর্মকর্তা, শীর্ষ নির্বাহী ও ব্যাংক পরিচালক। এই ব্ল্যাকমেইলিংয়ের কাজে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নীতিভ্রষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল কাদির মোল্লা, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারাল ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আজিম সৈয়দ মহররমের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়েছেন।
এছাড়া, তার অনেক সহকর্মী তার দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন। অনেক নারী সহকর্মী যৌন নির্যাতনেরও শিকার হয়েছেন। কিন্তু কেউই এ দুর্বৃত্তের ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না।
গত ১৫ বছরে যারা ব্যাংক খাতে লুটপাট চালিয়েছে তাদের সঙ্গে এই ব্যাংক কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ সখ্য ছিল। এদের মধ্যে ছিল শহিদুল আহসান (এনআরবিসি ব্যাংকের ঋণ লুটকারী), শাহিদ রেজা (পি কে হালদারের সহযোগী), সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল (অর্থ ও মানাবপাচারকারী, কুয়েতে কারাদণ্ড ভোগ করছেন), সালমান এফ রহমান (ব্যাংক ও শেয়ারবাজার লুটকারীদের নেতা)। বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও সখ্য গড়ে তুলেছিলেন, যাদের মধ্যে সাবেক নির্বাহী পরিচালক আবদুর রহীম, সাবেক ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল, সর্বাধিক বিতর্কিত সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামান, সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও নীতি উপদেষ্টা আবু ফারাহ মো. নাসের, আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বিএফআইইউর সাবেক প্রধান, বিতর্কিত কর্মকর্তা মাসুদ বিশ্বাসসহ অনেকে ছিলেন। তারা এখন কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকে না থাকায় নতুন শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে চেষ্টা চালাচ্ছেন মহররম।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, মহররম ব্ল্যাকমেইলিংয়ের জন্য কৌশল ব্যবহার করেন। ব্যাংক খাতের বিভিন্ন কর্মকর্তা ও উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে বেনামি অভিযোগ লিখে জমা দেন দুদকে ও বাংলাদেশ ব্যাংকে। নিজস্ব সিন্ডিকেটের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করান। এরপর নিজেই হয়রানির শিকার হওয়া ব্যক্তিদের কাছে যান তাদের হয়রানি থেকে বাঁচানোর প্রস্তাব নিয়ে। তাকে ঝামেলা থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব নেন মহররম। এর বিনিময়ে বৈদেশিক মুদ্রায় তাদের কাছ থেকে বড় অংকের অর্থ নেন। এভাবে নামে-বেনামে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে তিনি। তার আয়েশি জীবনযাপন আয়ের সঙ্গে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
ঢাকার সেগুনবাগিচায় দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। ঘরের আসবাবপত্র অধিকাংশই চীন থেকে আমদানি করা। ধানমন্ডি ও পূর্বাচলে জমি রয়েছে। দুটি দামি গাড়ি ব্যবহার করেন। লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে নিজ গ্রামে আড়াই কোটি টাকা খরচ করে ডুপ্লেক্স বাড়ি করেছেন। বিভিন্ন দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি পরেন যেগুলোর মূল্য আড়াই থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত। ব্লেজার, জুতা, জামাকাপড় কেনেন ভারতের দামি ব্র্যান্ডগুলো থেকে।
সম্পূর্ণ আইন বহির্ভূতভাবে দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে সৈয়দ মহররম হোসেনে। বাংলাদেশি পাসপোর্টের পাশাপাশি ভারতীয় পাসপোর্টও রয়েছে তার।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, রাজধানীর মতিঝিলের ব্যাংক পাড়ার আলোচিত কর্মকর্তা মহররম হোসেনের চাকরি জীবন শুরু ২০০২ সালে, রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে। কিছু দিন পর সরকারি ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে যোগ দেন ঢাকা ব্যাংকে। ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি পেয়ে দায়িত্ব পেয়েছেন লোন রিকভারি বিভাগের। এসময় থেকেই শুরু ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতানোর কার্যক্রম। খেলাপি গ্রাহকদের চাপ দিয়ে তাদের কাছ থেকে নানা সুযোগ সুবিধা আদায় করতে থাকেন। এখান থেকে চাকরি যাওয়ার পরও এই কাজ অব্যাহত রাখেন তিনি। তার সংগ্রহে এখনো ঢাকা ব্যাংকের গ্রাহকদের তথ্য রয়েছে যা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার চরম লঙ্ঘন।
ঢাকা ব্যাংক থেকে চাকরি ছেড়ে যোগ দেন মার্কেন্টাইল ব্যাংকে। সেখানে সখ্য গড়ে তোলেন ব্যাংক খাতের আলোচিত লুটেরা শহিদুল আহসানের সঙ্গে, যিনি ঋণ কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়মের কারণে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক পদ হারিয়েছেন। মহররম হোসেনের পরামর্শে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে বেনামে শেয়ার কেনেন শহিদুল আহসান। এই শেয়ারের মাধ্যমে দুইজনকে ব্যাংকটির পর্ষদের পরিচালক বানান যাদের পেছনে ছিলেন মূলত শহিদুল আহসান। শহিদুল আহসানের স্বার্থ দেখার জন্য মার্কেন্টাইল ব্যাংক ছেড়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত এনআরবিসি ব্যাংকে যোগ দেন মহররম। এদিকে নিজে পরিচালক না হয়েও পরিচালনা পর্ষদের সভায় নিয়মিত যোগ দিতে থাকেন শহিদুল আহসান। ব্যাংকটি থেকে নামে-বেনামে হাতিয়ে নেন প্রায় ৮০০ কোটি টাকা, যা নবীন এই ব্যাংকটির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের শহিদুল আহসানের সকল স্বার্থ দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন সৈয়দ মহররম। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে শহিদুল আহসানের লুটপাট প্রকাশ হলে তার পরিচালক পদ বাতিল করে দেয়।
এনআরবিসি ব্যাংক থেকে শহিদুল আহসান কোণঠাসা হয়ে পড়লে মহররম ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন ব্যাংকটির আরেক পরিচালক কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের সঙ্গে। ব্যাংক কর্মকর্তা হয়েও পাপুলের ব্যবসা এমন কি সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক ক্যাম্পেইনও পরিচালনা করেন মহররম। এনআরবিসি ব্যাংকের হাতিরপুল শাখা ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন কালে পাপুলের ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করেন। তার শাখায় পাপুল এবং তার পরিবারের সদস্যদের নামে ৬৪৭টি অ্যাকাউন্ট খুলে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে অর্থ পাচারের সুযোগ করে দেয় মহররম। অর্থ পাচার ও মানব পাচারের অপরাধে কুয়েত সরকার পাপুলকে কারাদণ্ড দেয়। বাংলাদেশে সংসদ সদস্য পদ ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে ভাইস চেয়ারম্যানের পদ হারান পাপুল।
শহিদুল আহসান ও পাপুলের নানা অপকর্মের সঙ্গী হওয়ায় এনআরবিসি ব্যাংকের কোণঠাসা হয়ে পড়েন মহররম। চাকরি চলে যাওয়ার উপক্রম হলে এনআরবিসি ছেড়ে যোগ দেন সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকে (এসবিএসিবি)। নতুন চাকরির ক্ষেত্রে তিনি তদবির করান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আবদুর রহীম ও সাবেক ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালকে দিয়ে। এবার তিনি ভর করেন ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান ও বিতর্কিত ব্যবসায়ী আবদুল কাদির মোল্লার ওপর। কাদির মোল্লার জন্য ব্যাংকে ব্যাংকে ঋণের তদবির করেন। পরে একসময় কাদির মোল্লার সঙ্গে বনিবনা না হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তখনকার ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাসের ও বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের মাধ্যমে এবি ব্যাংকে যোগদান করেন।
অভিযোগের বিষয়ে সৈয়দ মহররম হোসেন বলেন, আমি যে পদে কাজ করি, সেখান থেকে কাউকে লোন দেওয়া সম্ভব নয়। যেসব অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে, তা সত্যি নয়। আর অভিযোগগুলো যদি প্রমাণিত সম্ভব হয়, তাহলে আমি তা মেনে নেব।