ফল চাষেও স্বনির্ভর হতে পারে বাংলাদেশ 

  • Update Time : ০৫:৫৯:১৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ এপ্রিল ২০২১
  • / 270
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। যেকোনো ফল চাষের জন্য আবহাওয়া ও জলবায়ু এখানকার পরিবেশের অনুকূলে। বাংলাদেশে ফলের বৈচিত্র্য রয়েছে।
.
বাণিজ্যিকভাবে আবাদের জন্য অবমুক্ত করা ফলের জাতের সংখ্যা ১৪১টি। এর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক ফলের জাত ছাড়করণ করা হয়েছে মোট ৬৬টি। এর মধ্যে ৫৩টি হলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ফলের জাত।
.
এসব ফলের জাত প্রাকৃতিক সংকরায়নের মাধ্যমে সৃষ্ট। এসব সংরক্ষণ করছেন কৃষকরাই। ১১টি ফলের জাত বিদেশ থেকে অভিযোজন ও মূল্যায়ন শেষে অবমুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে জমির পরিমাণ ও উৎপাদন বিবেচনায় যেসব ফল বেশি পরিমাণে জন্মে সেগুলো হলো- কাঁঠাল, আম, লিচু, লেবুজাতীয় ফল, আনারস, কলা, কুল, তরমুজ, পেঁপে, পেয়ারা এবং নারিকেল। এগুলোই এখানে প্রধান ফল হিসেবে বিবেচিত।
.
দেশি ফলের পাশাপাশি বিদেশি ফলও চাষাবাদ হচ্ছে। বিদেশি ফলগুলো হলো- রাম্বুটান, স্ট্রবেরি, ডুমুর, মাল্টা, আঁশফল, ড্রাগন ফল, জামরুল ফল, পার্সিমন, প্যাশন, নাশপাতি, আলুবোখারা ও সৌদি খেজুর। দেশে বর্তমানে বিদেশি ফলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। একজন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে দৈনিক কমপক্ষে ৮৫ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দৈনিক গড় প্রাপ্যতা হচ্ছে ৩৫ গ্রাম। প্রয়োজনের তুলনায় যার পরিমাণ খুবই নগণ্য।
.
এর ফলে বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠী পুষ্টিহীনতায় ভোগেন। বাংলাদেশে ফলের বার্ষিক চাহিদা ১১৬.৮০ লাখ মেট্রিক টন। দেশে ১.৩৭ লাখ হেক্টর জমি থেকে প্রায় ৪৩.৪৭ লাখ মেট্রিক টন ফল উৎপাদিত হয় (সূত্র: বিবিএস, ২০১২)। এই হিসেবে বর্তমান উৎপাদিত ফলে আমাদের চাহিদার মাত্র ৩৭.২২% পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে।
.
অপরদিকে আমাদের দেশে উৎপাদিত ফলের ৬১ ভাগ পাওয়া যায় মে থেকে আগস্ট মাসে। বাকি আট মাস উৎপাদিত হয় অবশিষ্ট ফলের ৩৯ ভাগ। সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল এই আট মাসে মাথাপিছু আরও কম ফল পাওয়া যায়। সব অঞ্চলে আবার সব রকমের ফল জন্মে না। অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন রকমের ফল জন্মে।
.
উপকূলীয় অঞ্চলে ভালো হয়- নারিকেল, বাতাবিলেবু, পেয়ারা, সফেদা, চালতা, কদবেল, আমড়া, চুকুর, ক্ষুদিজাম, তরমুজ, আমরুল, বিলাতি গাব, হরীতকী, বহেড়া, আমলকী, তাল, পানিফল, তেঁতুল ইত্যাদি।
.
উত্তরাঞ্চলে ভালো হয়- আম, লিচু, কলা, কাঁঠাল, পেয়ারা, কুল, তরমুজ, আলুবোখারা, পিচফল ইত্যাদি।
.
মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলে ভালো হয়- আম, জাম, গোলাপজাম, জামরুল, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, কুল, কলা, বেল, আনারস, হরীতকী, বহেড়া, আমলকী, তাল, খেজুর, ডেউয়া, চালতা, জলপাই, করমচা, কামরাঙা ইত্যাদি।
.
পূর্বাঞ্চলে ভালো হয়- আনারস, লেবু, মাল্টা, কমলা, পেয়ারা, ডেউয়া, কুল, কামরাঙা, অরবরই, ইত্যাদি।
.
পাহাড়ি অঞ্চলে ভালো হয়- আনারস, কাঁঠাল, মাল্টা, আম্রপালি ও রাঙ্গোয়াই আম, প্যাশন ফল, কাজুবাদাম, গোলাপজাম, লুকলুকি, আমিলা, বেল, মাল্টা, কমলালেবু, লেবু, তেঁতুল ইত্যাদি।
.
বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্নতা ভেদে প্রায় সব ফলই দেশের মাটিতে উৎপাদন করা সম্ভব। তাছাড়া যেকেউ গাছ নির্বাচন করে বসতবাড়ির আঙিনায় বারো মাসে বারোটি ফলের গাছ লাগাতে পারবে। এসব ফলের মধ্য থেকে সাধারণভাবে বসতবাড়িতে লাগানোর জন্য আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, মাল্টা, কুল, বেল, তরমুজ, আমড়া, জলপাই, ডালিম ও কমলালেবু নির্বাচন করতে পারবে।
.
এছাড়া বছরের যেকোনো সময় ফল পাওয়ার জন্য বেছে নেয়া যেতে পারে নারিকেল, পেঁপে, কলা, আনারস, সফেদা ইত্যাদি ফল। এখন পেয়ারাও ১২ মাস ধরছে। জাত বুঝে গাছ লাগাতে পারলে আমও ৭ মাস ধরে পাওয়া সম্ভব। গবেষণার ও উন্নত প্রযুক্তির সুবাদে এখন ১২ মাস আনারস পাওয়াও সম্ভব আমাদের দেশে।
.
এত সম্ভাবনা থাকার পরও ফলের যে উৎপাদন তা আমাদের প্রয়োজনের মাত্র ৪০ শতাংশ পূরণ করতে পারে। চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর বিদেশ থেকে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ফল আমদানি করতে হয়। এসব ফলের মধ্যে রয়েছে আঙুর, আপেল, কমলা, নাশপাতি, স্ট্রবেরি, ড্রাগন, রেড মিলান, সাম্মাম ও মোছাম্বির মতো অনেক বিদেশি ফল যা দেশের বাজার ভরে গেছে।
.
বেশি দাম দিয়ে কেনা এসব ফল থেকে কিন্তু আমরা খুব কম পুষ্টিই পাই। আর সেটা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা, এসব ফল আমরা যখন বাজার থেকে কিনি তা কখনোই টাটকা থাকে না। অনেক দিন আগে গাছ থেকে পেড়ে নানা রকম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ দেশের বাজারে আসে। গাছ থেকে ফল পাড়ার পর থেকেই পুষ্টি কমতে থাকে, পুষ্টি উপাদানের পরিবর্তন হতে থাকে। তাছাড়া বেশির ভাগ ফলই বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। এজন্য এসব ফল দেহের জন্য ক্ষতিকর। তাছাড়া বিদেশ থেকে ফল কেনার ফলে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে।
.
দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফল চাষাবাদের জায়গা রয়েছ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস, ২০১৮) প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ব্যবহৃত জমির পরিমাণ ২২৬ কোটি ৫১ লাখ ৭৪ হাজার শতক। এসব জমির মধ্যে বসতবাড়ি, পুকুর, স্থায়ী ফসলি জমি, অস্থায়ী ফসলি জমির পাশাপাশি পতিত জমিও রয়েছে। পতিত (স্থায়ী ও অস্থায়ী পতিত) জমি রয়েছে প্রায় ১০ কোটি ৮৫ লাখ ১৫ হাজার শতক, যা দেশের মোট জমির প্রায় ৫ শতাংশ। এই বিশাল পরিমাণ জমিতে কোনো চাষাবাদ করা হয় না।
.
প্রতি বছর অনেক জমি অযথা অনাবাদি হিসেবে পড়ে থাকে। খালি জমিতে চাষাবাদ করা হলে ফলের চাহিদা মেটানো সম্ভব। সেক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থার উচিত দেশের সাধারণ কৃষকদের ফল চাষে আরও আগ্রহী করে তোলা। তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও কৃষি উপকরণ দিয়ে সহায়তা করতে হবে।
.
দেশি ও বিদেশি ফলের জাত কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। বর্তমানে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ। এই বেকার যুবকদের ফলের প্রক্রিয়াজাতরণের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে ফলদ কারখানায় চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া যাবে। পাশাপাশি তরুণদের সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি, কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা দেয়া যেতে পারে। এভাবেই বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে ফল আমদানি করতে হবে না আর।
.
গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থার পাশাপাশি নগর চাষাবাদের দিকেও নজর দিতে হবে। ঢাকায় কমপক্ষে প্রায় সাড়ে চার লাখ ছাদ রয়েছে (সাড়ে চার হাজার হেক্টরের বেশি) যা দেশের একটি উপজেলার সমান। এছাড়া দেশের বিভিন্ন নগরে বিপুল সংখ্যক ছাদ রয়েছে।নগরে ফল চাষের জন্য ছাদবাগান জনপ্রিয় করতে হবে।
.
নগর কৃষি বললে উল্লম্ব বা ভার্টিক্যাল ফার্মিংই সামনে চলে আসে। এই প্রক্রিয়ায় চীন, জাপান, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড চাষাবাদ করে সফল হয়েছে। সম্প্রতি গ্রিন সেভারস সংস্থা নগর কৃষি প্রকল্প চালু করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় ঢাকা শহরে ছাদে বাগান করার কাজ শুরু হয়েছে। এতে ভার্টিকেল ফার্ম প্রক্রিয়ায় ফল চাষাবাদ করা যাবে। ঢাকা ছাড়াও দেশের সব নগরে এই প্রক্রিয়ায় চাষাবাদ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এছাড়া হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে মাটিবিহীন চাষাবাদ নগরের ক্ষেত্রে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে।
.
এক্ষেত্রে আরও গবেষণা ও কৃষি উপকরণ পাওয়া গেলে মাটিবিহীন ফল চাষাবাদ সফল হবে। তাছাড়া আমাদের দেশে একদল উদ্যোমী অ-কৃষিবিদ আছেন যাদের সঙ্গে কাজ করলে দেশে বাণিজ্যিক নগর চাষে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। সরকার, কৃষি মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে উচিৎ ফল চাষাবাদে কৃষক ও যুবকদের উদ্বুদ্ধ করা। যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে ফল চাষাবাদে দক্ষ করে তুলতে হবে তাদের। প্রয়োজনে তাদেরকে কৃষি সরঞ্জাম ও উন্নত ফলের বীজ দিয়ে সহায়তা করতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বসতবাড়ি, অনাবাদি জমি ও নগরীতে ফল চাষাবাদ সফল করা সম্ভব।
.
লেখক: 
আনিসুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ।
.

Please Share This Post in Your Social Media


ফল চাষেও স্বনির্ভর হতে পারে বাংলাদেশ 

Update Time : ০৫:৫৯:১৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ এপ্রিল ২০২১
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। যেকোনো ফল চাষের জন্য আবহাওয়া ও জলবায়ু এখানকার পরিবেশের অনুকূলে। বাংলাদেশে ফলের বৈচিত্র্য রয়েছে।
.
বাণিজ্যিকভাবে আবাদের জন্য অবমুক্ত করা ফলের জাতের সংখ্যা ১৪১টি। এর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক ফলের জাত ছাড়করণ করা হয়েছে মোট ৬৬টি। এর মধ্যে ৫৩টি হলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ফলের জাত।
.
এসব ফলের জাত প্রাকৃতিক সংকরায়নের মাধ্যমে সৃষ্ট। এসব সংরক্ষণ করছেন কৃষকরাই। ১১টি ফলের জাত বিদেশ থেকে অভিযোজন ও মূল্যায়ন শেষে অবমুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে জমির পরিমাণ ও উৎপাদন বিবেচনায় যেসব ফল বেশি পরিমাণে জন্মে সেগুলো হলো- কাঁঠাল, আম, লিচু, লেবুজাতীয় ফল, আনারস, কলা, কুল, তরমুজ, পেঁপে, পেয়ারা এবং নারিকেল। এগুলোই এখানে প্রধান ফল হিসেবে বিবেচিত।
.
দেশি ফলের পাশাপাশি বিদেশি ফলও চাষাবাদ হচ্ছে। বিদেশি ফলগুলো হলো- রাম্বুটান, স্ট্রবেরি, ডুমুর, মাল্টা, আঁশফল, ড্রাগন ফল, জামরুল ফল, পার্সিমন, প্যাশন, নাশপাতি, আলুবোখারা ও সৌদি খেজুর। দেশে বর্তমানে বিদেশি ফলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। একজন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে দৈনিক কমপক্ষে ৮৫ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দৈনিক গড় প্রাপ্যতা হচ্ছে ৩৫ গ্রাম। প্রয়োজনের তুলনায় যার পরিমাণ খুবই নগণ্য।
.
এর ফলে বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠী পুষ্টিহীনতায় ভোগেন। বাংলাদেশে ফলের বার্ষিক চাহিদা ১১৬.৮০ লাখ মেট্রিক টন। দেশে ১.৩৭ লাখ হেক্টর জমি থেকে প্রায় ৪৩.৪৭ লাখ মেট্রিক টন ফল উৎপাদিত হয় (সূত্র: বিবিএস, ২০১২)। এই হিসেবে বর্তমান উৎপাদিত ফলে আমাদের চাহিদার মাত্র ৩৭.২২% পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে।
.
অপরদিকে আমাদের দেশে উৎপাদিত ফলের ৬১ ভাগ পাওয়া যায় মে থেকে আগস্ট মাসে। বাকি আট মাস উৎপাদিত হয় অবশিষ্ট ফলের ৩৯ ভাগ। সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল এই আট মাসে মাথাপিছু আরও কম ফল পাওয়া যায়। সব অঞ্চলে আবার সব রকমের ফল জন্মে না। অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন রকমের ফল জন্মে।
.
উপকূলীয় অঞ্চলে ভালো হয়- নারিকেল, বাতাবিলেবু, পেয়ারা, সফেদা, চালতা, কদবেল, আমড়া, চুকুর, ক্ষুদিজাম, তরমুজ, আমরুল, বিলাতি গাব, হরীতকী, বহেড়া, আমলকী, তাল, পানিফল, তেঁতুল ইত্যাদি।
.
উত্তরাঞ্চলে ভালো হয়- আম, লিচু, কলা, কাঁঠাল, পেয়ারা, কুল, তরমুজ, আলুবোখারা, পিচফল ইত্যাদি।
.
মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলে ভালো হয়- আম, জাম, গোলাপজাম, জামরুল, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, কুল, কলা, বেল, আনারস, হরীতকী, বহেড়া, আমলকী, তাল, খেজুর, ডেউয়া, চালতা, জলপাই, করমচা, কামরাঙা ইত্যাদি।
.
পূর্বাঞ্চলে ভালো হয়- আনারস, লেবু, মাল্টা, কমলা, পেয়ারা, ডেউয়া, কুল, কামরাঙা, অরবরই, ইত্যাদি।
.
পাহাড়ি অঞ্চলে ভালো হয়- আনারস, কাঁঠাল, মাল্টা, আম্রপালি ও রাঙ্গোয়াই আম, প্যাশন ফল, কাজুবাদাম, গোলাপজাম, লুকলুকি, আমিলা, বেল, মাল্টা, কমলালেবু, লেবু, তেঁতুল ইত্যাদি।
.
বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্নতা ভেদে প্রায় সব ফলই দেশের মাটিতে উৎপাদন করা সম্ভব। তাছাড়া যেকেউ গাছ নির্বাচন করে বসতবাড়ির আঙিনায় বারো মাসে বারোটি ফলের গাছ লাগাতে পারবে। এসব ফলের মধ্য থেকে সাধারণভাবে বসতবাড়িতে লাগানোর জন্য আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, মাল্টা, কুল, বেল, তরমুজ, আমড়া, জলপাই, ডালিম ও কমলালেবু নির্বাচন করতে পারবে।
.
এছাড়া বছরের যেকোনো সময় ফল পাওয়ার জন্য বেছে নেয়া যেতে পারে নারিকেল, পেঁপে, কলা, আনারস, সফেদা ইত্যাদি ফল। এখন পেয়ারাও ১২ মাস ধরছে। জাত বুঝে গাছ লাগাতে পারলে আমও ৭ মাস ধরে পাওয়া সম্ভব। গবেষণার ও উন্নত প্রযুক্তির সুবাদে এখন ১২ মাস আনারস পাওয়াও সম্ভব আমাদের দেশে।
.
এত সম্ভাবনা থাকার পরও ফলের যে উৎপাদন তা আমাদের প্রয়োজনের মাত্র ৪০ শতাংশ পূরণ করতে পারে। চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর বিদেশ থেকে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ফল আমদানি করতে হয়। এসব ফলের মধ্যে রয়েছে আঙুর, আপেল, কমলা, নাশপাতি, স্ট্রবেরি, ড্রাগন, রেড মিলান, সাম্মাম ও মোছাম্বির মতো অনেক বিদেশি ফল যা দেশের বাজার ভরে গেছে।
.
বেশি দাম দিয়ে কেনা এসব ফল থেকে কিন্তু আমরা খুব কম পুষ্টিই পাই। আর সেটা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা, এসব ফল আমরা যখন বাজার থেকে কিনি তা কখনোই টাটকা থাকে না। অনেক দিন আগে গাছ থেকে পেড়ে নানা রকম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ দেশের বাজারে আসে। গাছ থেকে ফল পাড়ার পর থেকেই পুষ্টি কমতে থাকে, পুষ্টি উপাদানের পরিবর্তন হতে থাকে। তাছাড়া বেশির ভাগ ফলই বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। এজন্য এসব ফল দেহের জন্য ক্ষতিকর। তাছাড়া বিদেশ থেকে ফল কেনার ফলে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে।
.
দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফল চাষাবাদের জায়গা রয়েছ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস, ২০১৮) প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ব্যবহৃত জমির পরিমাণ ২২৬ কোটি ৫১ লাখ ৭৪ হাজার শতক। এসব জমির মধ্যে বসতবাড়ি, পুকুর, স্থায়ী ফসলি জমি, অস্থায়ী ফসলি জমির পাশাপাশি পতিত জমিও রয়েছে। পতিত (স্থায়ী ও অস্থায়ী পতিত) জমি রয়েছে প্রায় ১০ কোটি ৮৫ লাখ ১৫ হাজার শতক, যা দেশের মোট জমির প্রায় ৫ শতাংশ। এই বিশাল পরিমাণ জমিতে কোনো চাষাবাদ করা হয় না।
.
প্রতি বছর অনেক জমি অযথা অনাবাদি হিসেবে পড়ে থাকে। খালি জমিতে চাষাবাদ করা হলে ফলের চাহিদা মেটানো সম্ভব। সেক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থার উচিত দেশের সাধারণ কৃষকদের ফল চাষে আরও আগ্রহী করে তোলা। তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও কৃষি উপকরণ দিয়ে সহায়তা করতে হবে।
.
দেশি ও বিদেশি ফলের জাত কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। বর্তমানে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ। এই বেকার যুবকদের ফলের প্রক্রিয়াজাতরণের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে ফলদ কারখানায় চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া যাবে। পাশাপাশি তরুণদের সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি, কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা দেয়া যেতে পারে। এভাবেই বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে ফল আমদানি করতে হবে না আর।
.
গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থার পাশাপাশি নগর চাষাবাদের দিকেও নজর দিতে হবে। ঢাকায় কমপক্ষে প্রায় সাড়ে চার লাখ ছাদ রয়েছে (সাড়ে চার হাজার হেক্টরের বেশি) যা দেশের একটি উপজেলার সমান। এছাড়া দেশের বিভিন্ন নগরে বিপুল সংখ্যক ছাদ রয়েছে।নগরে ফল চাষের জন্য ছাদবাগান জনপ্রিয় করতে হবে।
.
নগর কৃষি বললে উল্লম্ব বা ভার্টিক্যাল ফার্মিংই সামনে চলে আসে। এই প্রক্রিয়ায় চীন, জাপান, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড চাষাবাদ করে সফল হয়েছে। সম্প্রতি গ্রিন সেভারস সংস্থা নগর কৃষি প্রকল্প চালু করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় ঢাকা শহরে ছাদে বাগান করার কাজ শুরু হয়েছে। এতে ভার্টিকেল ফার্ম প্রক্রিয়ায় ফল চাষাবাদ করা যাবে। ঢাকা ছাড়াও দেশের সব নগরে এই প্রক্রিয়ায় চাষাবাদ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এছাড়া হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে মাটিবিহীন চাষাবাদ নগরের ক্ষেত্রে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে।
.
এক্ষেত্রে আরও গবেষণা ও কৃষি উপকরণ পাওয়া গেলে মাটিবিহীন ফল চাষাবাদ সফল হবে। তাছাড়া আমাদের দেশে একদল উদ্যোমী অ-কৃষিবিদ আছেন যাদের সঙ্গে কাজ করলে দেশে বাণিজ্যিক নগর চাষে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। সরকার, কৃষি মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে উচিৎ ফল চাষাবাদে কৃষক ও যুবকদের উদ্বুদ্ধ করা। যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে ফল চাষাবাদে দক্ষ করে তুলতে হবে তাদের। প্রয়োজনে তাদেরকে কৃষি সরঞ্জাম ও উন্নত ফলের বীজ দিয়ে সহায়তা করতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বসতবাড়ি, অনাবাদি জমি ও নগরীতে ফল চাষাবাদ সফল করা সম্ভব।
.
লেখক: 
আনিসুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ।
.