দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনই অভীষ্ঠ লক্ষ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়

  • Update Time : ১১:৪১:০৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • / 58

{"remix_data":[],"remix_entry_point":"challenges","source_tags":["local"],"source_ids":{},"source_ids_track":{},"origin":"unknown","total_draw_time":0,"total_draw_actions":0,"layers_used":0,"brushes_used":0,"photos_added":0,"total_editor_actions":{},"tools_used":{"square_fit":1},"is_sticker":false,"edited_since_last_sticker_save":true,"containsFTESticker":false}

মোস্তাফিজুর রহমান

বাংলাদেশ আমাদের জন্মভূমি। অর্ধশতের বেশি বছর আমাদের দেশের বয়স। পিছনে তাকালে মনে হয়, আমরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছি। আবার সামনে তাকালে মনে হয়, আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। শাসকগোষ্ঠীর দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, কালো টাকা বানানো, ব্যাংক ডাকাতি, বিদেশে টাকা পাচার, বিদেশে বেগমপাড়া বানাতে দুর্নীতিবাজরা অনেক টাকা অপচয় করেছে। ফলে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়নি।

সর্বশেষ ১৬ বছরে হাসিনা সরকারের দুর্নীতি ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে এবং সবকিছুকে গ্রাস করেছে। পিয়নের ৪০০ কোটি টাকা, এস আলমের কাজের মেয়ের ২২টি ব্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকা। এ যেন মগেরমুল্লুক আর কাকে বলে। আমরা এর প্রতিকার চাই। বাঁচার মতো বাঁচতে চাই। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে চাই।

হাসিনা সরকারের অব্যবস্থাপনার কারণে ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে গত ৫ই আগস্ট গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করে। এক পর্যায়ে দুর্নীতিপরায়ণ প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পলায়ন করে। এর ফলে দেশের মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। গোটা দেশে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। মনে হয় দেশ নতুন জীবন পেল। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী বিচারিক ক্ষমতা পেয়েছে। এখন এর সদ্ব্যবহার করতে হবে।

দেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে। বর্তমানে উপদেষ্টাদের সংখ্যা ২১। দেড় মাসেরও বেশি সময় পার হলো। বিভিন্ন বিভাগে পরিবর্তন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ৬টি কমিশন গঠন করে দেশের বিভিন্ন বিভাগ সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে সরকার। আমরা তাদের সাফল্য কামনা করি।

দেশের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পুলিশ প্রশাসনে। তারা বড়ো থেকে ছোটো সবাই দুর্নীতিতে জড়িত হওয়ার কারণে থানাগুলো এখনো সচল হয়নি। ভয়ে অনেকেই কাজে যোগদান করেননি। আইজি থেকে শুরু করে অনেক অফিসার বদল হয়েছে। এখনো হচ্ছে। কিন্তু এখানে দ্রুত বদলির কাজ সম্পন্ন করতে হবে। কোনো থানায়ই আগের কোনো লোক রাখা যাবে না। এমনকি পিয়ন পর্যন্তও। আমরা বাস্তবে দেখছি এর কার্যকারিতা। অনতিবিলম্বে নতুন করে নিয়োগ দিতে হবে। সৎ, যোগ্য লোক নিয়োগ দিতে হবে। পূর্বের সব অফিসার বদলি করে; এমনকি যাদের বিরুদ্ধে গুম, খুন, গুলি করার অভিযোগ আছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

গার্মেন্টস সেক্টর আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার বড়ো সোর্স। এখানে তারা বাইরে থেকে উসকানি দিয়ে কাজ বন্ধ রাখার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে সরকারের ভূমিকা এবং সেনাবাহিনী গার্মেন্টসশিল্প সচল করার উদ্যোগ নিয়েছে; ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে। কোনোভাবেই এখানে বহিরাগত লোকের আনাগোনা সহ্য করা যাবে না।

সংখ্যালঘুদের কাজে লাগিয়ে সুযোগসন্ধানী লোকেরা দেশ-বিদেশের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করছে। তাদের শাহবাগে জড়ো করে নানা অভিযোগ করে বেড়াচ্ছে। আমাদের স্পষ্ট ঘোষণা, বাংলাদেশে কোনো সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরুর স্থান নেই। সরকারি ও বিরোধীদলের সবাই আমরা তাদের পাশে আছি এবং থাকবো। কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে দেওয়া যাবে না। আমি নিজে আমার এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে যোগাযোগ রাখছি, যাতে তাদের কোনো অসুবিধা না হয়।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের যেকোনো ষড়যন্ত্রকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হবে। কোনো কুচক্রীমহলকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। শক্ত হাতে তাদের মোকাবিলা করতে হবে। চাঁদাবাজি সর্বক্ষেত্রে ঢুকে পড়েছে। গ্রামের বাজার থেকে শুরু করে শহরের বড়ো বড়ো জায়গায় চাঁদাবাজি যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে গেছে। চাঁদা না দিলে কোনো কাজই দ্রুত করা সম্ভব হয় না।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে কিছু জায়গায় চাঁদাবাজি কিছুটা কমলেও এর সুফল এখনো সমাজে পর্যাপ্ত নয়। এখানে আমাদের দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কঠোর হাতে চাঁদাবাজি বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। কাউকেই ছাড় দেওয়া যাবে না। চাঁদাবাজদের ধরে আইনের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। প্রশাসনকে এ ব্যাপারে তৎপর থাকতে হবে। আমরাও যারা সমাজে বসবাস করি, প্রতিবেশীদের সংগঠিত করে চাঁদাবাজির টুঁটি চেপে ধরতে হবে। সমাজের এ কলঙ্কিত পথ বন্ধ করতেই হবে।

চাঁদাবাজি বন্ধ করতে বাজারের কমিটিগুলোকে সক্রিয় করতে হবে। এলাকার গণ্যমান্য লোকদের এক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে। দল-মত নির্বিশেষে সবাইকেই এ কাজে ব্যবহার করতে হবে। কমিউনিটি পুলিশকে এ কাজে ব্যবহার করতে হবে। যুবসমাজকেও এ ধরনের কাজে লাগাতে হবে। আইন নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। মসজিদের ইমাম সাহেবদেরও এ কাজে লাগাতে হবে। মসজিদ কমিটিগুলোকে মসজিদে সাধারণ সভা করে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে।

সমাজে অসৎ লোকদের চিহ্নিত করে তাদের ভালো কাজে লাগাতে হবে। সৎ লোকদের সংগঠিত করতে হবে। সমাজে খারাপ লোকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবে তারা ভোকাল। তাই যুবসমাজকে সাথে নিয়ে সৎ লোকদের সংগঠিত করতে পারলে অসৎ লোকেরা সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। আমাদের সমাজে ভূমিকা রাখতে হবে। ভালো কাজের সাথে লোক পাওয়া যাবে, যদি সাহস করে দাঁড়ানো যায়।

ব্যাংক লুটেরাদের সমাজে অপাঙতেয় ঘোষণা করতে হবে। টাকা পাচার, বেগমপাড়াওয়ালাদের চিহ্নিত করে সমাজে দুর্নীতিগ্রস্ত লোকের তালিকা করে সমাজকে অবহিত করতে হবে। তাদের ঘৃণা করতে হবে। চেষ্টা করতে হবে তাদের ভালো কাজে ফিরিয়ে আনার। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশি-বিদেশি লোকদের সাহায্যে পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা সামর্থ্যানুযায়ী তাদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো। অস্থায়ী সরকার যে সংস্কারের কাজে হাতে নিয়েছে, যার যার পক্ষ থেকে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সহযোগিতা করতে হবে।

দেশের অর্থনীতি সচল করতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান সহজ হবে। রেমিট্যান্স আসার পরিমণ্ডল বেড়েছে। কয়েকদিন পূর্বে মার্কিন প্রতিনিধি উপদেষ্টাদের সাথে আলাপ করে সার্বিক সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে। লেগে থাকতে হবে বিদেশি সংস্থাগুলোকে দেশের উন্নয়নে সম্পৃক্ত করার জন্য। যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেছে, এগুলো তদন্ত করতে হবে। শুধু বড়ো প্রকল্প হাতে নিলেই হবে না। জনগণ তাতে কতটুকু উপকৃত হচ্ছে বা হবে, তার দিকে নজর দিতে হবে।

ছোটো হলেও আমাদের দেশ সমতল। চাষাবাদের জন্য উপযোগী। তাই দেশের কৃষি বিশ^বিদ্যালয় ও কৃষি বিভাগকে তৎপর করতে পারলে সমতলভূমিকে যথাযথ কাজের আওতায় এনে উন্নতমানের ফসল ফলানোর চেষ্টা করতে হবে। একই জমিতে সাথী ফসলের চাষ করে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। বিদেশি ফল দেশে প্রচুর উৎপাদন হচ্ছে। এক্ষেত্রেও কৃষকদের উৎসাহিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও সামুদ্রিক সম্পদ কাজে লাগাতে হবে। সামুদ্রিক মাছ থেকে শুরু করে খনিজসম্পদ আহরণের চেষ্টা করতে হবে। সব সম্পদ কাজে লাগানোর প্রযুক্তি আমদানি করতে হবে। দেশের মানুষকে দেশদরদির ভূমিকায় আসতে হবে। আমাদের জন্মভূমি, আমাদেরই গড়তে হবে। প্রয়োজনে বিদেশি প্রযুক্তি আমদানি করতে হবে।

সর্বক্ষেত্রে প্রতিজ্ঞা করতে হবে আমরা ভালো হবো। দুর্নীতি করবো না। মানুষকে প্রতারিত করবো না। মানুষকে আপন মনে করে তাদের দেশ গঠনে কাজে লাগাবো। পান দোকানদার থেকে প্লেন ব্যবসায়ীকে সততার সাথে সব ব্যবসার আঞ্জাম দিতে হবে। নিজে ভালো হবো, অন্যকে ভালো করার চেষ্টা করবো। সবাই মিলেই আমরা দেশের হবো। দেশকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবো।

চিকিৎসা ব্যবস্থা দেশে অনেক উন্নত। তাই ছুঁতা-নাতায় বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়া বন্ধ করতে হবে। এখানে বিদেশি অভিজ্ঞ ডাক্তার আনা যেতে পারে; বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে। কোনোভাবেই চিকিৎসার জন্য বিদেশে না যাওয়ার প্রতিজ্ঞা নিতে হবে। ওষুধশিল্প দেশে অনেক উন্নতি হয়েছে। শতকরা আটানব্বই ভাগ ওষুধ দেশে উৎপাদিত হয়। উন্নত দেশসহ প্রায় ৪০ দেশে আমাদের উৎপাদিত ওষুধ রফতানি হয়। উদ্যোগ নিলেই দেশের মেধা কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় শিল্প গড়ে তুলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করা সম্ভব। শুধু সরকারের সদিচ্ছাই উন্নত দেশ গড়তে সাহায্য করতে পারে।

ড. ইউনূস উদ্যমী মানুষ। কাজের অভিজ্ঞতা আছে। বিদেশে ভাবমূর্তি ভালো। চোর-বাটপারির অভিযোগ নেই। তাকে সাহায্য করতে হবে। সহযোগিতা করতে হবে। উপদেষ্টারা ভিন্ন মতের হলেও তাদের দেশের প্রতি দরদ দিয়ে কাজে উৎসাহ দিতে হবে। সমালোচনার সাথে ভালো পরামর্শও দিতে হবে। ইতোমধ্যেই অল্পসময়ে তারা সব মন্ত্রণালয় গোছানোর চেষ্টা করছেন। জঞ্জাল অনেকদিনের, তাই সময় তো লাগবেই। তাড়াহুড়া করা যাবে না। সংস্কারের যে কাজ এ সরকার নিয়েছে। দ্রুতগতিতে কাজ শেষ করতে হবে। বেশিদিন সময় নিলে জনগণের ধৈর্যচ্যুতি হতে পারে। দল-মত নির্বিশেষে সরকারকে যৌক্তিক সহযোগিতা করতে হবে।

জনগণের অংশগ্রহণে জাতীয় নির্বাচন অতি জরুরি। গত কয়েকটি নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল না। ফলে সরকারের লোকেরা মাস্তানিকেই প্রাধান্য দিয়ে পুলিশি রাষ্ট্র বানিয়ে দুর্নীতিকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। মানুষের বা জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল; গুম, খুন, আয়নাঘরের মাধ্যমে মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন করেছিল। বছরের পর বছর বিরোধী নেতাদের জেলে রেখে নির্যাতন চালিয়েছে।

আমরা এখন ৫ই আগস্ট ২০২৪ থেকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বাধীন, মুক্ত বাতাসে চলাফেরা করতে পারছি- আমাদের মনের কথা জনতার কাছে পৌঁছাতে পারছি। সাংবাদিকরা তাদের লেখনির মাধ্যমে দেশের ভালোর পরামর্শ দিতে পারছে। দলের লোকেরা তাদের দলের ইশতেহার প্রকাশ করতে পারছে। জনগণ যাদের ভালো মনে করবে তাদের দিকে ঝুঁকে পড়বে। তাদের ক্ষমতায় আনবে। ভালো কাজ করলে ক্ষমতায় থাকতে পারবে।

গত ৫৩ বছরে জনগণ অনেক দলকে তাদের কর্মক্ষমতায় দেখার সুযোগ পেয়েছে। এতদিন মানুষ শুধু হতাশই হয়েছে। এখন সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের রাজনৈতিক দলকে মানুষ ক্ষমতায় দেখতে চায়। ভালো নেতৃত্বগুণের মানুষকে সকলে ক্ষমতায় দেখতে চায়। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। আমরা চাই যোগ্য নেতৃত্বের নবগঠিত এক নতুন দেশ সৃষ্টি হবে- যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে।

মোস্তাফিজুর রহমান: কলাম লেখক ও প্রেসিডেন্ট, হিউম্যান রাইটস ফোরাম

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনই অভীষ্ঠ লক্ষ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়

Update Time : ১১:৪১:০৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মোস্তাফিজুর রহমান

বাংলাদেশ আমাদের জন্মভূমি। অর্ধশতের বেশি বছর আমাদের দেশের বয়স। পিছনে তাকালে মনে হয়, আমরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছি। আবার সামনে তাকালে মনে হয়, আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। শাসকগোষ্ঠীর দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, কালো টাকা বানানো, ব্যাংক ডাকাতি, বিদেশে টাকা পাচার, বিদেশে বেগমপাড়া বানাতে দুর্নীতিবাজরা অনেক টাকা অপচয় করেছে। ফলে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়নি।

সর্বশেষ ১৬ বছরে হাসিনা সরকারের দুর্নীতি ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে এবং সবকিছুকে গ্রাস করেছে। পিয়নের ৪০০ কোটি টাকা, এস আলমের কাজের মেয়ের ২২টি ব্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকা। এ যেন মগেরমুল্লুক আর কাকে বলে। আমরা এর প্রতিকার চাই। বাঁচার মতো বাঁচতে চাই। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে চাই।

হাসিনা সরকারের অব্যবস্থাপনার কারণে ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে গত ৫ই আগস্ট গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করে। এক পর্যায়ে দুর্নীতিপরায়ণ প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পলায়ন করে। এর ফলে দেশের মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। গোটা দেশে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। মনে হয় দেশ নতুন জীবন পেল। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী বিচারিক ক্ষমতা পেয়েছে। এখন এর সদ্ব্যবহার করতে হবে।

দেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে। বর্তমানে উপদেষ্টাদের সংখ্যা ২১। দেড় মাসেরও বেশি সময় পার হলো। বিভিন্ন বিভাগে পরিবর্তন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ৬টি কমিশন গঠন করে দেশের বিভিন্ন বিভাগ সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে সরকার। আমরা তাদের সাফল্য কামনা করি।

দেশের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পুলিশ প্রশাসনে। তারা বড়ো থেকে ছোটো সবাই দুর্নীতিতে জড়িত হওয়ার কারণে থানাগুলো এখনো সচল হয়নি। ভয়ে অনেকেই কাজে যোগদান করেননি। আইজি থেকে শুরু করে অনেক অফিসার বদল হয়েছে। এখনো হচ্ছে। কিন্তু এখানে দ্রুত বদলির কাজ সম্পন্ন করতে হবে। কোনো থানায়ই আগের কোনো লোক রাখা যাবে না। এমনকি পিয়ন পর্যন্তও। আমরা বাস্তবে দেখছি এর কার্যকারিতা। অনতিবিলম্বে নতুন করে নিয়োগ দিতে হবে। সৎ, যোগ্য লোক নিয়োগ দিতে হবে। পূর্বের সব অফিসার বদলি করে; এমনকি যাদের বিরুদ্ধে গুম, খুন, গুলি করার অভিযোগ আছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

গার্মেন্টস সেক্টর আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার বড়ো সোর্স। এখানে তারা বাইরে থেকে উসকানি দিয়ে কাজ বন্ধ রাখার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে সরকারের ভূমিকা এবং সেনাবাহিনী গার্মেন্টসশিল্প সচল করার উদ্যোগ নিয়েছে; ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে। কোনোভাবেই এখানে বহিরাগত লোকের আনাগোনা সহ্য করা যাবে না।

সংখ্যালঘুদের কাজে লাগিয়ে সুযোগসন্ধানী লোকেরা দেশ-বিদেশের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করছে। তাদের শাহবাগে জড়ো করে নানা অভিযোগ করে বেড়াচ্ছে। আমাদের স্পষ্ট ঘোষণা, বাংলাদেশে কোনো সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরুর স্থান নেই। সরকারি ও বিরোধীদলের সবাই আমরা তাদের পাশে আছি এবং থাকবো। কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে দেওয়া যাবে না। আমি নিজে আমার এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে যোগাযোগ রাখছি, যাতে তাদের কোনো অসুবিধা না হয়।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের যেকোনো ষড়যন্ত্রকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হবে। কোনো কুচক্রীমহলকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। শক্ত হাতে তাদের মোকাবিলা করতে হবে। চাঁদাবাজি সর্বক্ষেত্রে ঢুকে পড়েছে। গ্রামের বাজার থেকে শুরু করে শহরের বড়ো বড়ো জায়গায় চাঁদাবাজি যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে গেছে। চাঁদা না দিলে কোনো কাজই দ্রুত করা সম্ভব হয় না।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে কিছু জায়গায় চাঁদাবাজি কিছুটা কমলেও এর সুফল এখনো সমাজে পর্যাপ্ত নয়। এখানে আমাদের দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কঠোর হাতে চাঁদাবাজি বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। কাউকেই ছাড় দেওয়া যাবে না। চাঁদাবাজদের ধরে আইনের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। প্রশাসনকে এ ব্যাপারে তৎপর থাকতে হবে। আমরাও যারা সমাজে বসবাস করি, প্রতিবেশীদের সংগঠিত করে চাঁদাবাজির টুঁটি চেপে ধরতে হবে। সমাজের এ কলঙ্কিত পথ বন্ধ করতেই হবে।

চাঁদাবাজি বন্ধ করতে বাজারের কমিটিগুলোকে সক্রিয় করতে হবে। এলাকার গণ্যমান্য লোকদের এক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে। দল-মত নির্বিশেষে সবাইকেই এ কাজে ব্যবহার করতে হবে। কমিউনিটি পুলিশকে এ কাজে ব্যবহার করতে হবে। যুবসমাজকেও এ ধরনের কাজে লাগাতে হবে। আইন নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। মসজিদের ইমাম সাহেবদেরও এ কাজে লাগাতে হবে। মসজিদ কমিটিগুলোকে মসজিদে সাধারণ সভা করে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে।

সমাজে অসৎ লোকদের চিহ্নিত করে তাদের ভালো কাজে লাগাতে হবে। সৎ লোকদের সংগঠিত করতে হবে। সমাজে খারাপ লোকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবে তারা ভোকাল। তাই যুবসমাজকে সাথে নিয়ে সৎ লোকদের সংগঠিত করতে পারলে অসৎ লোকেরা সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। আমাদের সমাজে ভূমিকা রাখতে হবে। ভালো কাজের সাথে লোক পাওয়া যাবে, যদি সাহস করে দাঁড়ানো যায়।

ব্যাংক লুটেরাদের সমাজে অপাঙতেয় ঘোষণা করতে হবে। টাকা পাচার, বেগমপাড়াওয়ালাদের চিহ্নিত করে সমাজে দুর্নীতিগ্রস্ত লোকের তালিকা করে সমাজকে অবহিত করতে হবে। তাদের ঘৃণা করতে হবে। চেষ্টা করতে হবে তাদের ভালো কাজে ফিরিয়ে আনার। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশি-বিদেশি লোকদের সাহায্যে পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা সামর্থ্যানুযায়ী তাদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো। অস্থায়ী সরকার যে সংস্কারের কাজে হাতে নিয়েছে, যার যার পক্ষ থেকে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সহযোগিতা করতে হবে।

দেশের অর্থনীতি সচল করতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান সহজ হবে। রেমিট্যান্স আসার পরিমণ্ডল বেড়েছে। কয়েকদিন পূর্বে মার্কিন প্রতিনিধি উপদেষ্টাদের সাথে আলাপ করে সার্বিক সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে। লেগে থাকতে হবে বিদেশি সংস্থাগুলোকে দেশের উন্নয়নে সম্পৃক্ত করার জন্য। যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেছে, এগুলো তদন্ত করতে হবে। শুধু বড়ো প্রকল্প হাতে নিলেই হবে না। জনগণ তাতে কতটুকু উপকৃত হচ্ছে বা হবে, তার দিকে নজর দিতে হবে।

ছোটো হলেও আমাদের দেশ সমতল। চাষাবাদের জন্য উপযোগী। তাই দেশের কৃষি বিশ^বিদ্যালয় ও কৃষি বিভাগকে তৎপর করতে পারলে সমতলভূমিকে যথাযথ কাজের আওতায় এনে উন্নতমানের ফসল ফলানোর চেষ্টা করতে হবে। একই জমিতে সাথী ফসলের চাষ করে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। বিদেশি ফল দেশে প্রচুর উৎপাদন হচ্ছে। এক্ষেত্রেও কৃষকদের উৎসাহিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও সামুদ্রিক সম্পদ কাজে লাগাতে হবে। সামুদ্রিক মাছ থেকে শুরু করে খনিজসম্পদ আহরণের চেষ্টা করতে হবে। সব সম্পদ কাজে লাগানোর প্রযুক্তি আমদানি করতে হবে। দেশের মানুষকে দেশদরদির ভূমিকায় আসতে হবে। আমাদের জন্মভূমি, আমাদেরই গড়তে হবে। প্রয়োজনে বিদেশি প্রযুক্তি আমদানি করতে হবে।

সর্বক্ষেত্রে প্রতিজ্ঞা করতে হবে আমরা ভালো হবো। দুর্নীতি করবো না। মানুষকে প্রতারিত করবো না। মানুষকে আপন মনে করে তাদের দেশ গঠনে কাজে লাগাবো। পান দোকানদার থেকে প্লেন ব্যবসায়ীকে সততার সাথে সব ব্যবসার আঞ্জাম দিতে হবে। নিজে ভালো হবো, অন্যকে ভালো করার চেষ্টা করবো। সবাই মিলেই আমরা দেশের হবো। দেশকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবো।

চিকিৎসা ব্যবস্থা দেশে অনেক উন্নত। তাই ছুঁতা-নাতায় বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাওয়া বন্ধ করতে হবে। এখানে বিদেশি অভিজ্ঞ ডাক্তার আনা যেতে পারে; বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে। কোনোভাবেই চিকিৎসার জন্য বিদেশে না যাওয়ার প্রতিজ্ঞা নিতে হবে। ওষুধশিল্প দেশে অনেক উন্নতি হয়েছে। শতকরা আটানব্বই ভাগ ওষুধ দেশে উৎপাদিত হয়। উন্নত দেশসহ প্রায় ৪০ দেশে আমাদের উৎপাদিত ওষুধ রফতানি হয়। উদ্যোগ নিলেই দেশের মেধা কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় শিল্প গড়ে তুলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করা সম্ভব। শুধু সরকারের সদিচ্ছাই উন্নত দেশ গড়তে সাহায্য করতে পারে।

ড. ইউনূস উদ্যমী মানুষ। কাজের অভিজ্ঞতা আছে। বিদেশে ভাবমূর্তি ভালো। চোর-বাটপারির অভিযোগ নেই। তাকে সাহায্য করতে হবে। সহযোগিতা করতে হবে। উপদেষ্টারা ভিন্ন মতের হলেও তাদের দেশের প্রতি দরদ দিয়ে কাজে উৎসাহ দিতে হবে। সমালোচনার সাথে ভালো পরামর্শও দিতে হবে। ইতোমধ্যেই অল্পসময়ে তারা সব মন্ত্রণালয় গোছানোর চেষ্টা করছেন। জঞ্জাল অনেকদিনের, তাই সময় তো লাগবেই। তাড়াহুড়া করা যাবে না। সংস্কারের যে কাজ এ সরকার নিয়েছে। দ্রুতগতিতে কাজ শেষ করতে হবে। বেশিদিন সময় নিলে জনগণের ধৈর্যচ্যুতি হতে পারে। দল-মত নির্বিশেষে সরকারকে যৌক্তিক সহযোগিতা করতে হবে।

জনগণের অংশগ্রহণে জাতীয় নির্বাচন অতি জরুরি। গত কয়েকটি নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল না। ফলে সরকারের লোকেরা মাস্তানিকেই প্রাধান্য দিয়ে পুলিশি রাষ্ট্র বানিয়ে দুর্নীতিকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। মানুষের বা জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল; গুম, খুন, আয়নাঘরের মাধ্যমে মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন করেছিল। বছরের পর বছর বিরোধী নেতাদের জেলে রেখে নির্যাতন চালিয়েছে।

আমরা এখন ৫ই আগস্ট ২০২৪ থেকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বাধীন, মুক্ত বাতাসে চলাফেরা করতে পারছি- আমাদের মনের কথা জনতার কাছে পৌঁছাতে পারছি। সাংবাদিকরা তাদের লেখনির মাধ্যমে দেশের ভালোর পরামর্শ দিতে পারছে। দলের লোকেরা তাদের দলের ইশতেহার প্রকাশ করতে পারছে। জনগণ যাদের ভালো মনে করবে তাদের দিকে ঝুঁকে পড়বে। তাদের ক্ষমতায় আনবে। ভালো কাজ করলে ক্ষমতায় থাকতে পারবে।

গত ৫৩ বছরে জনগণ অনেক দলকে তাদের কর্মক্ষমতায় দেখার সুযোগ পেয়েছে। এতদিন মানুষ শুধু হতাশই হয়েছে। এখন সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের রাজনৈতিক দলকে মানুষ ক্ষমতায় দেখতে চায়। ভালো নেতৃত্বগুণের মানুষকে সকলে ক্ষমতায় দেখতে চায়। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। আমরা চাই যোগ্য নেতৃত্বের নবগঠিত এক নতুন দেশ সৃষ্টি হবে- যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে।

মোস্তাফিজুর রহমান: কলাম লেখক ও প্রেসিডেন্ট, হিউম্যান রাইটস ফোরাম