শিক্ষানবিশ আইনজীবী নিয়ে নিজস্ব অভিজ্ঞতায় প্রাসঙ্গিক ভাবনা!

  • Update Time : ১১:২৮:৪৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ মার্চ ২০২৪
  • / 316

মোঃ জিশান মাহমুদ, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বিদেশী, দেশের সরকারি-বেসরকারি যে কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে একজন আইনের ছাত্র যখন কোন সিনিয়র আইনজীবীর অধীনে থেকে দিনে এক/দেড়/দুইশত টাকা উপার্জন করছেন তখন তার অন্য বিষয়ে পড়া বন্ধুটি কোন না কোন চাকুরি কিংবা ব্যবসায় নিযুক্ত হয়ে মাস শেষে সম্মানজনক উপার্জন করে থাকে, এটা সবারই কম-বেশি জানা কথা!
একজন প্রকৃত শিক্ষানবিশ আইনজীবী কে সকালে ঘুম থেকে উঠে কোর্ট চেম্বারে যেতে হয় সাড়ে আটটার মধ্যেই। কর্পোরেট চেম্বার হলে ৯/৯/৩০/১০ টার মধ্যে (চেম্বার ভেদে)। সাড়ে নয়টা/দশটার মধ্যে আদালতে উপস্থিত থাকতে হয়। একই সাথে অনেকগুলো আদালতের কার্যক্রম চলায় সিনিয়রকে জানান দিতে হয় নিজেদের মামলা আসার পূর্বে! বিকাল ৪ টা পর্যন্ত কোর্টে থাকতে হয়। কোর্ট শেষে অনেকে আবার সিনিয়র এর সান্ধ্যকালীন চেম্বারে রাত ৮/৯ টা অবধি পরবর্তী দিনের মামলার বিষয়াদি প্রস্তুত করেন। অতঃপর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। অন্যদিকে কর্পোরেট চেম্বারে কাজ করা শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা সারাদিন ডকুমেন্টেশন এর কাজ করে থাকেন। কোন কর্পোরেট চেম্বার রাত ৮ টার পূর্বে ছুটি দেয় বলে আমার জানা নেই। ধরে নিলাম একজন কাজ শিখতে চাওয়া প্রকৃত জুনিয়র সন্ধ্যা ৮ টায় চেম্বার থেকে বের হন। বাসায় যেতে অন্ততপক্ষে ৯ টা তো বাজেই! দূরে যাদের বসবাস তাদের অনেকেরই রাত ১১ টা ও বাজে!!

একজন শিক্ষানবিশ কে দুপুরে কোর্ট অংগনেই বা চেম্বারে খেয়ে নিতে হয়। রাতে বাসায় যেয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘুম দিয়ে আবার খুব ভোরে উঠে রুটিন মাফিক যাত্রা শুরু করতে হয়। এভাবেই সে কাজে সম্পৃক্ত থেকে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করতে থাকে। যে বয়সে একজন মানুষ সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়ার কথা সেসময় সে ১০০/১৫০/২০০ টাকা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ শিখে; ভবিষ্যৎ এর স্বপ্ন দেখে বলে!
একটা সময় ছিল (বোধকরি ১৯৯০ এর পূর্বেকার সময়গুলো), যখন খুব ভালো পরিবার (আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্থে) থেকে আসা ছেলে-মেয়েরাই শুধু ওকালতি তে আসতো। বাস্তবিকই এটা “রাজকীয় পেশা”। আমি অনেক সিনিয়র আইনজীবীর কাছ থেকে শুনেছি ৮০ এর দশকে কাজ শিখার জন্য অনেক জুনিয়র/শিক্ষানবিশ আইনজীবী সিনিয়র কে গুরুদক্ষিণাও নাকি দিত (আমি দেখিনি, শুনা কথা, সে সময়ের সিনিয়র রা ভালো বলতে পারবেন)!

এখন অবস্থা বদলিয়েছে, এখনকার জুনিয়র বা শিক্ষানবিশ আইনজীবীর ৯০%+ ই আর্থিক ভাবে তুলনামূলক ভাবে অস্বচ্ছল পরিবার থেকে আসা। তারা এই রাজকীয় পেশায় এসেছে, ইহাকে জয় করার ব্রত নিয়ে।
এখানে উল্লেখ্য যে, আমি নিজেও সামান্য একজন স্কুল মাষ্টারের ছেলে। বড় আইনজীবী হবার স্বপ্ন নিয়ে আইন পেশায় আসা। আমি নিজেও ২০০৬ সাল থেকে সেসময়কার ৫০ টাকা দৈনিক ভিত্তিতে একজন স্বনামধন্য সিনিয়র আইনজীবীর সাথে কাজ শিখেছি। মাস ছয় কাজ করার পর একটা কর্পোরেট চেম্বারে মাসিক ২৫০০ টাকার সেলামী তে কাজ শিখি। সেখানে বছর দুই কাজ করেছি। পর্যায়ক্রমে আমার সেলামী ও ৭০০০ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। অতঃপর আরো দুইটি কর্পোরেট চেম্বারে কাজ করেছি। ২০১০ সালে আমি যখন বিয়ে করি, তখন আমার সম্মানজনক সেলামী ছিল ১০০০০/- এবং ২০১২ সালে আমার পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছিল, তখন আমার সম্মানজনক সেলামী ছিল ১২০০০/-। এখানে উল্লেখ্য যে, বাচ্চার সিজারের টাকা এক সিনিয়র ভাই দিয়েছিলেন, সেটা আজও আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে আমি নিজে খুব ছোট পরিসরে একটা কর্পোরেট চেম্বার দিয়ে এককভাবে ওকালতি করা শুরু করি।

যেহেতু, শিক্ষানবিশ কে শিক্ষানবিশ আইনজীবী বা ক্ষেত্রভেদে জুনিয়র আইনজীবী বলা হয়, সেহেতু আমার মনে হয় “The Bangladesh Legal Practitionars and Bar Council Order and Rules-1972” এর Canons of Professional Conduct and Etiquette নামক অংশের চারটি অধ্যায়ের চতুর্থ অধ্যায়ের বিধি ০৮ (আট) মোতাবেক কোন আইনজীবী “ব্যবসা, চাকুরী বা অন্য পেশার সঙ্গে জড়িত হওয়া নিষিদ্ধ” অর্থ্যাৎ সাধারন নিয়ম মতে একজন আইনজীবী অন্য কোন পেশা বা ব্যবসা বা সক্রিয় অংশীদার বা বেতনভুক্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারী হিসেবে কোন ব্যবসা বা পেশার সঙ্গে জড়িত হইবেন না। উক্ত বিধিটি শিক্ষানবিশ আইনজীবী বা জুনিয়র আইনজীবীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। উক্ত বিধির আলোকে একজন জুনিয়র/শিক্ষানবীশ আইনজীবীর জুনিয়রশীপ করা ভিন্ন অন্য উপায়ে আইনত: আয়ের পথ বন্ধ।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সীমাহীন ব্যর্থতার কারণে বার কাউন্সিলের এনরোলমেন্ট পরীক্ষা সময়মত হয় না। সেক্ষেত্রে অনেক মেধাবী শিক্ষানবিশ আইনজীবীর এল.এল.বি শেষ করার পরও জীবনের ৩/৪/৫ টি বছর শুধু সনদের পরীক্ষার জন্য ব্যয়িত হয়ে যায়। আমি নিজেও ২ বার ভাইভা ফেল করে ৩য় বারে ২০০৮ সালে উত্তীর্ণ হই৷ জজ কোর্টের আইনজীবী সনদ পেতে আমার ৪+ বছর লেগেছিল। হাইকোর্ট পারমিশন এর লিখিত পরীক্ষা, ২০১০ এ ফেল করে ২০১২ তে লিখিত এবং ভাইভা তে উত্তীর্ণ হই। আমার মত এখন যারা দুই/তিনবার ফেল করে তাদের ৭/৮ বছর চলে যায়।

একমাত্র বার কাউন্সিলের কারণে বাংলাদেশে কয়েক লক্ষ শিক্ষানবিশ বেকার যাদের অন্যত্র কোন পেশা নেই অনেকের ক্ষেত্রে। অসংখ্য আইনের ছাত্র ছাত্রী তাদের লাইফ প্রফেশন ক্যারীয়ার নস্ট করেছে ল’প্রফেশনে এসে মানে এলএলবি আর এলএলএম করে। এই লক্ষ লক্ষ শিক্ষানবিশগণদের দুখের করুণ অবস্থার জবাব কি বার কাউন্সিল দিতে পারবে? উত্তরে আমি বলবো, “মোটেও না”।
ভাবতেও খারাপ লাগে বার কাউন্সিল যে কতোটুকু অমানবিক হয়ে গেলো এখানে অনেক পলিটিক্স ঢুকে গিয়েছে। এমসিকিউ দিয়ে অনেক স্টুডেন্ট ছাত্র ছাত্রীদের আটকিয়ে দেয়। আর এখন বলে হাইকোর্টের পারমিশন পরীক্ষায়ও শুনছি এমসিকিউ দিয়ে বসেছে। আর এমসিকিউ আর লিখিত পরীক্ষা যে কঠিন হতে কঠিনতর করেছে দিন দিন এর স্তর বৃদ্ধি আর বৃহতায়ন হচ্ছে। প্রতিবছর চল্লিশ না হয় পঞ্চাশ হাজারের মতন পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দেয়। আর পাশ করে মাত্র দুই অথবা তিন হাজার এটা কেমন ন্যায় বিচার? ফেল করার আধিক্য দেখে মনে হচ্ছে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ। নাহলে অধিক সংখ্যক পরীক্ষার্থী ফেল করে কিভাবে? যাক, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সদস্য জনাব এডভোকেট মোঃ ইব্রাহিম হোসেন এর একটি লেখা আমাকে আলোড়িত করেছে। লেখাটি এমন,
“শিক্ষানবিশদের নিয়ে সামান্য ভাবনা-
সবাই আইনজীবীদের কথা ভাবছে!!অনুদান,ঋন,সহায়তা,সহযোগিতা,প্রনোদনা কতকিছু কিন্তু আমরা ভুলে গেছি আমাদেরই একটা বড় অংশ শিক্ষানবিশ ভাইবোনদের কথা।যাদের প্রত্যেকের শিক্ষানবিশ কাল এক একটা জীবন্ত উপন্যাস।ঢাকা বারেই কয়েক হাজার শিক্ষানবিশ আইনজীবী সনদের অপেক্ষায়।প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্তির পর সনদ যুদ্ধে মাসের পর মাস বছরের পর বছর অপেক্ষার প্রহর গোনা। এই ভাইবোনদের কথা ভাবনার যেন কেউ নেই।অমানবিকতা আর অবহেলাই যেন তাদের নিয়তি।দেশের সমস্ত বার গুলো তার সদস্যদের সংকটে যখন কম বেশী এগিয়ে এসেছে তখন কেউ সামান্যতম সহমর্মিতা দেখায়নি এই আগামীর সহকর্মীদের প্রতি।
কোথায় আজ ঢাকা বার কেন্দ্রিক কয়েক শতাধিক তথাকথিত “আইনজীবী কল্যান”নামক সংগঠন গুলো ও তাদের নেতৃবৃন্দ ?
কোথায় আপনাদের অস্থিত্ব ?
কোথায় আপনাদের প্রতিশ্রুতি?
কোথায় আইনজীবীদের কল্যানের নমুনা?
নাকি সব ভুগাস!! সব বাহানা! সব নাটক!

আমার জানামতে ঢাকা বারে বিভিন্ন ল’কলেজ,পাবলিক/ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি,জেলা/উপজেলা, বিভাগীয় আঞ্চলিক সংগঠন সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক,সামাজিক ও সমগোত্রিয় কয়েক শত সক্রিয় সংগঠন রয়েছে।প্রত্যেকটি সংঠনের মুল এজেন্ডাই হচ্ছে নিজ সদস্যদের কল্যানার্থে কাজ করা।কিন্তু কোথায় সেই মানবতার বুলি আওড়ানো সংগঠনের নেতা-নেত্রীরা? যাদের তর্জন গর্জনে প্রকম্পিত হতো ঢাকা বারের প্রাংগন।
করোনা নামক ভাইরাসের অভিশাপে যখন দিনের পর দিন অজানা শংকা, অর্থ সংকট, মৌলিক চাহিদার অপ্রতুলতায় শত শত শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের উৎকণ্ঠা,তাদের বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস ও আত্নর্নাদ কি ওই সকল সংগঠনগুলোর হর্তাকর্তাদের কানে পৌছায় না?তারা কি উপলব্ধি করেন না? কিসের নেতা?কিসের নেতৃত্ব? কিসের রাজনীতি?কার জন্যে রাজনীতি?
শুধুমাত্র ঢাকা বার কেন্দ্রিক প্রতি বছর এসকল সংগঠনগুলোর শতাধিক ইফতার পার্টির আয়োজন হয়। লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যায় হয় নেতাদের শো’অফের জন্যে অথচ দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আজ তারা নিশ্চুপ,ভাবনাহীন,বোবা,বধিরের ভাব ধরেছে।দেশের এই ক্রান্তিকালে আপনারা কি পারেন না ইফতারের আয়োজনে যে টাকা ব্যায় হতো তা দিয়ে সম্মিলিত ভাবে একটা আপোদকালীন ফান্ড তৈরি করে শিক্ষানবিশ আইনজীবী ভাইবোনদের পাশে দাড়াতে?তারা কি আপনার আমার ভাইবোন নয়? তারা কি এসমাজের কেউ নয়?নেতাদের মনে রাখা উচিত এসংকট কিন্তু চিরস্থায়ী নয়,অচিরেই হয়তো এই কালো অন্ধকার ফুড়ে সোনালি সুর্য উদিত হবে,আবার মুখোরিত হবে প্রিয় প্রাংগন,সেদিন আপনারাই আবার সম্মুখীন হবেন এই সকল ভাইবোনদের সামনে যাদের বিপদে মুখে তালা লাগিয়ে, ঘরের কপাট বন্ধ করে চুপচাপ ঘুমিয়ে ছিলেন।তখন কি লজ্জা পাবেন না?
বিবেক তাড়না দিবে না??
তাই অনুরোধ, দল মত নির্বিশেষে সকল সিনিয়র নেতৃবৃন্দ দায়িত্ব নিয়ে আইনজীবী কল্যান নামক সমস্ত সংগঠন গুলোর নেতাদের সহিত জরুরী ভিত্তিতে আলাপ আলোচনা করে অন্তত ইফতারের জন্যে প্রতি বছর যে টাকা সংগঠনগুলো খরচ করতো তা দিয়ে একটা আপদকালীন ফান্ড তৈরি করুন এবং অচিরেই আমাদের শিক্ষানবিশ আইনজীবী ভাইবোনদের প্রতি মানবতার হাত বাড়িয়ে দিন।
না-হলে হয়তো এ সংকট যেকোনো ভাবে কেটে যাবে কিন্তু ইতিহাস আপনাদের/আমাদের ক্ষমা করবে না।
আমার অভিব্যাক্তিতে ভুল হলে কিংবা কেহ আঘাত পেল ক্ষমা প্রার্থনায়..”
কথাগুলো অনেক যুক্তিযুক্ত ভাবে খুব সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে। বিজ্ঞ আইনজীবী মহোদয় এর বক্তব্যের আলোকে আমার ভাবনা হল, বাস্তবিক অর্থে এত এত শিক্ষানবিশ আইনজীবী বন্ধু কে কোনভাবেই প্রণোদনা বা আর্থিক অনুদানের কাঠামোয় আনা অসম্ভব। এডভোকেট মোঃ ইব্রাহিম হোসেন এর লেখা টি পড়ে আজ শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের অনেক গুলো গ্রুপ/পেজে ঘাটাঘাটি করে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে। কিছু কিছু শিক্ষানবিশ আইনজীবী বন্ধুর লেখায় আইনজীবীদের উপর ক্ষুব্ধতার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখেছি। সত্যিই তো, শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের অসহায়ত্ব দেখার কি কেউ নেই? এ কেমন মানবিকতা? সম্প্রতি ঢাকা আইনজীবী সমিতিসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলার আইনজীবীদের কোথাও সুদমুক্ত ঋণ বা কোথাও অফেরতযোগ্য এককালীন অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এতে তালিকাভুক্ত আইনজীবীরা আপাতত কিছু আর্থিক সহযোগিতা পেলেও শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের কথা কেউ ভাবছে না।
এখন কথা হল, ৪০/৫০ হাজার বা তার ও বেশি শিক্ষানবিশ আইনজীবী বন্ধুর মনের কষ্ট বা আর্থিক অসহায়ত্ব দেখার মত অবস্থা বর্তমানে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নেই। এ অজানা যুদ্ধ তো কেটেই যাবে, আমরাও হয়তো একদিন সব ভুলে যাবো। কিন্তু সীমাহীন সমস্যা রয়ে যাবে। শিক্ষানবিশ আইনজীবীর সংখ্যা ও সমস্যাগুলো দিনে দিনে বৃদ্ধি পাবে। সমস্যা থেকে উত্তোরনের সঠিক পথ বার কাউন্সিল কেই ঠিক করতে হবে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল যদি কার্যত আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হয়ে থাকে, বার কাউন্সিল নিশ্চয়ই এর সুষ্ঠু পথ বের করবে বলে আমি আশাবাদী।
এ বিষয়ে, আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের অভিমত হল, সম্ভবত ২০০৩ সাল থেকে পাশের দেশ ভারতে সর্ব ভারতীয় আইনজীবী পারমিশন পরীক্ষা চালু হয়েছে। বাংলাদেশেও সম্ভবত ১৯৯৫ সাল থেকে প্রথম এনরোলমেন্ট পরীক্ষা শুরু হয়েছে। যদি বাংলাদেশের University Grants Commission এর নিয়ন্ত্রণাধীন ইউনিভার্সিটি থেকে একজন আইনের ডিগ্রি নিয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে বিনা পরীক্ষায় ৬ মাসের প্রকৃত শিক্ষানবিশ কে সনদ দেয়া যেতে পারে (ব্যাপক এবং উদার অর্থে)। এটাও ঠিক যে, ব্যাপক অর্থে আইনজীবী সনদ দেয়া হলে আইন পেশার গুণগত মান ঝুকিপূর্ণ হবে, সেক্ষেত্রে প্রতিবছর নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষাগুলি নিয়ে নেয়া বার কাউন্সিলের খুব জরুরি কর্তব্য।
অন্যদিকে, কিছু উন্নত দেশের বার কাউন্সিল এর রুটিন ওয়ার্ক হল, প্রকৃত শিক্ষানবিশ আইনজীবী সনাক্ত করা, তাদেরকে সিনিয়র এর এফিলিয়েশন বার কাউন্সিলগুলো ই ঠিক করে দেয়। আইনজীবীগণ জুনিয়র লাগবে মর্মে বারে নোটিশ দিলে, বারের প্রত্যক্ষ তদারকি তে জুনিয়র আইনজীবী চেম্বারে প্রবেশ করে। একজন জুনিয়র আইনজীবী কত কি পাবে তা বার কাউন্সিল কে অবহিত করা হয় (বার কাউন্সিল চাপিয়ে দেয় না, কিন্তু সেলারী শিট নেয়)। কেউ জুনিয়রশীপ কন্টিনিউ না করলে তার শিক্ষানবিশ কার্যাদি বাতিল ও হয়ে যায়। আমাদের এখানে যারা বারের পরীক্ষা দেয়, সে সংখ্যাটি ৫০ হাজারের আশেপাশে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জুনিয়রশীপ করছে হয়তো ১০/১৫ হাজার। আমরা আইনজীবীগণ যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি মুলক ভাবে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করি, আমার মনে হয়, শিক্ষানবিশ আইনজীবী এর তালিকা খুব বড় হবেনা। আমি এমন শত শত পরীক্ষার্থী চিনি, যারা চাকুরী বা ব্যবসা বা অন্য কোন কিছু করছেন, তারাও পরীক্ষার্থী। এদেরকে শিক্ষানবিশ আইনজীবী এর তালিকা থেকে বাদ দেয়া খুব কঠিন নয়।আইনজীবী বন্ধুগণ এবং বার কাউন্সিল চাইলে তা ১ মাসের মধ্যেই সম্ভব। দরকার সততা। অন্যকিছু করবেন আবার শিক্ষানবিশ আইনজীবী এর তকমা নিয়ে ঘুরবেন তা হতে পারে না।
যদি ১০/১৫ হাজার প্রকৃত শিক্ষানবিশ আইনজীবী হয়ে থাকে তখন বার কাউন্সিলের জন্য নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা নেয়াটা খুব সহজ ছিল। আমাদের গোড়ায় গলদ। বার কাউন্সিল যদি প্রকৃত তালিকা সংরক্ষণ করতো, তাহলে সম্ভবত বাংলাদেশ বার কাউন্সিল জুনিয়র আইনজীবী বা শিক্ষানবিশ আইনজীবী দের বর্তমান দুরবস্থায় নিজস্ব তহবিল থেকে আর্থিক অনুদান দিয়ে সাহায্য করতে পারতো। পাশাপাশি বিভিন্ন কল্যাণমুলক সংগঠন বার কাউন্সিল কে ডোনেশন বা উপহার দিয়ে শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতো। এখন শুনতে খারাপ লাগলেও সত্য যে, বর্তমান ব্যবস্থাপনায় ব্যক্তিগত ভাবে নিজ নিজ জুনিয়রদের/শিক্ষানবিশদের (আর্থিক সংগতি থাকা সাপেক্ষে) সাহায্য করা ছাড়া ভিন্ন কোন পথ নাই!
এখন সময় এসেছে শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের বিষয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়ার নচেত এর ফলাফল দিনে দিনে খারাপ ই হবে। ইতিমধ্যে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, শিক্ষানবিশ আইনজীবী বন্ধু রা এনরোলমেন্ট পরীক্ষা সহ নানান দাবীতে আন্দোলন করেছিল! এতে বার কাউন্সিলের সুনাম বাড়ছে না! সামনে আরো খারাপ যেন না হয়, কর্তাব্যক্তিরাই ভাববেন।
লেখক- অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সহ সভাপতি, বাংলাদেশ আইন সমিতি।
(বিঃদ্রঃ আমার লেখাটি সম্পুর্ন আমার ব্যক্তিগত মতামত। কাউকে আঘাত করা বা হেয় প্রতিপন্ন করা আমার উদ্দেশ্য নয়। বাস্তব অবস্থাদৃষ্টে আমার ব্যক্তিগত ভাবনা। তবুও কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে নিজ গুনে ক্ষমা করবেন বলে আশা করছি। আমি নিয়মিত লেখক না, লেখায় কোন ত্রুটি থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী।)
 

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


শিক্ষানবিশ আইনজীবী নিয়ে নিজস্ব অভিজ্ঞতায় প্রাসঙ্গিক ভাবনা!

Update Time : ১১:২৮:৪৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ মার্চ ২০২৪

মোঃ জিশান মাহমুদ, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বিদেশী, দেশের সরকারি-বেসরকারি যে কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে একজন আইনের ছাত্র যখন কোন সিনিয়র আইনজীবীর অধীনে থেকে দিনে এক/দেড়/দুইশত টাকা উপার্জন করছেন তখন তার অন্য বিষয়ে পড়া বন্ধুটি কোন না কোন চাকুরি কিংবা ব্যবসায় নিযুক্ত হয়ে মাস শেষে সম্মানজনক উপার্জন করে থাকে, এটা সবারই কম-বেশি জানা কথা!
একজন প্রকৃত শিক্ষানবিশ আইনজীবী কে সকালে ঘুম থেকে উঠে কোর্ট চেম্বারে যেতে হয় সাড়ে আটটার মধ্যেই। কর্পোরেট চেম্বার হলে ৯/৯/৩০/১০ টার মধ্যে (চেম্বার ভেদে)। সাড়ে নয়টা/দশটার মধ্যে আদালতে উপস্থিত থাকতে হয়। একই সাথে অনেকগুলো আদালতের কার্যক্রম চলায় সিনিয়রকে জানান দিতে হয় নিজেদের মামলা আসার পূর্বে! বিকাল ৪ টা পর্যন্ত কোর্টে থাকতে হয়। কোর্ট শেষে অনেকে আবার সিনিয়র এর সান্ধ্যকালীন চেম্বারে রাত ৮/৯ টা অবধি পরবর্তী দিনের মামলার বিষয়াদি প্রস্তুত করেন। অতঃপর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। অন্যদিকে কর্পোরেট চেম্বারে কাজ করা শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা সারাদিন ডকুমেন্টেশন এর কাজ করে থাকেন। কোন কর্পোরেট চেম্বার রাত ৮ টার পূর্বে ছুটি দেয় বলে আমার জানা নেই। ধরে নিলাম একজন কাজ শিখতে চাওয়া প্রকৃত জুনিয়র সন্ধ্যা ৮ টায় চেম্বার থেকে বের হন। বাসায় যেতে অন্ততপক্ষে ৯ টা তো বাজেই! দূরে যাদের বসবাস তাদের অনেকেরই রাত ১১ টা ও বাজে!!

একজন শিক্ষানবিশ কে দুপুরে কোর্ট অংগনেই বা চেম্বারে খেয়ে নিতে হয়। রাতে বাসায় যেয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘুম দিয়ে আবার খুব ভোরে উঠে রুটিন মাফিক যাত্রা শুরু করতে হয়। এভাবেই সে কাজে সম্পৃক্ত থেকে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করতে থাকে। যে বয়সে একজন মানুষ সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়ার কথা সেসময় সে ১০০/১৫০/২০০ টাকা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ শিখে; ভবিষ্যৎ এর স্বপ্ন দেখে বলে!
একটা সময় ছিল (বোধকরি ১৯৯০ এর পূর্বেকার সময়গুলো), যখন খুব ভালো পরিবার (আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্থে) থেকে আসা ছেলে-মেয়েরাই শুধু ওকালতি তে আসতো। বাস্তবিকই এটা “রাজকীয় পেশা”। আমি অনেক সিনিয়র আইনজীবীর কাছ থেকে শুনেছি ৮০ এর দশকে কাজ শিখার জন্য অনেক জুনিয়র/শিক্ষানবিশ আইনজীবী সিনিয়র কে গুরুদক্ষিণাও নাকি দিত (আমি দেখিনি, শুনা কথা, সে সময়ের সিনিয়র রা ভালো বলতে পারবেন)!

এখন অবস্থা বদলিয়েছে, এখনকার জুনিয়র বা শিক্ষানবিশ আইনজীবীর ৯০%+ ই আর্থিক ভাবে তুলনামূলক ভাবে অস্বচ্ছল পরিবার থেকে আসা। তারা এই রাজকীয় পেশায় এসেছে, ইহাকে জয় করার ব্রত নিয়ে।
এখানে উল্লেখ্য যে, আমি নিজেও সামান্য একজন স্কুল মাষ্টারের ছেলে। বড় আইনজীবী হবার স্বপ্ন নিয়ে আইন পেশায় আসা। আমি নিজেও ২০০৬ সাল থেকে সেসময়কার ৫০ টাকা দৈনিক ভিত্তিতে একজন স্বনামধন্য সিনিয়র আইনজীবীর সাথে কাজ শিখেছি। মাস ছয় কাজ করার পর একটা কর্পোরেট চেম্বারে মাসিক ২৫০০ টাকার সেলামী তে কাজ শিখি। সেখানে বছর দুই কাজ করেছি। পর্যায়ক্রমে আমার সেলামী ও ৭০০০ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। অতঃপর আরো দুইটি কর্পোরেট চেম্বারে কাজ করেছি। ২০১০ সালে আমি যখন বিয়ে করি, তখন আমার সম্মানজনক সেলামী ছিল ১০০০০/- এবং ২০১২ সালে আমার পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছিল, তখন আমার সম্মানজনক সেলামী ছিল ১২০০০/-। এখানে উল্লেখ্য যে, বাচ্চার সিজারের টাকা এক সিনিয়র ভাই দিয়েছিলেন, সেটা আজও আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে আমি নিজে খুব ছোট পরিসরে একটা কর্পোরেট চেম্বার দিয়ে এককভাবে ওকালতি করা শুরু করি।

যেহেতু, শিক্ষানবিশ কে শিক্ষানবিশ আইনজীবী বা ক্ষেত্রভেদে জুনিয়র আইনজীবী বলা হয়, সেহেতু আমার মনে হয় “The Bangladesh Legal Practitionars and Bar Council Order and Rules-1972” এর Canons of Professional Conduct and Etiquette নামক অংশের চারটি অধ্যায়ের চতুর্থ অধ্যায়ের বিধি ০৮ (আট) মোতাবেক কোন আইনজীবী “ব্যবসা, চাকুরী বা অন্য পেশার সঙ্গে জড়িত হওয়া নিষিদ্ধ” অর্থ্যাৎ সাধারন নিয়ম মতে একজন আইনজীবী অন্য কোন পেশা বা ব্যবসা বা সক্রিয় অংশীদার বা বেতনভুক্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারী হিসেবে কোন ব্যবসা বা পেশার সঙ্গে জড়িত হইবেন না। উক্ত বিধিটি শিক্ষানবিশ আইনজীবী বা জুনিয়র আইনজীবীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। উক্ত বিধির আলোকে একজন জুনিয়র/শিক্ষানবীশ আইনজীবীর জুনিয়রশীপ করা ভিন্ন অন্য উপায়ে আইনত: আয়ের পথ বন্ধ।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সীমাহীন ব্যর্থতার কারণে বার কাউন্সিলের এনরোলমেন্ট পরীক্ষা সময়মত হয় না। সেক্ষেত্রে অনেক মেধাবী শিক্ষানবিশ আইনজীবীর এল.এল.বি শেষ করার পরও জীবনের ৩/৪/৫ টি বছর শুধু সনদের পরীক্ষার জন্য ব্যয়িত হয়ে যায়। আমি নিজেও ২ বার ভাইভা ফেল করে ৩য় বারে ২০০৮ সালে উত্তীর্ণ হই৷ জজ কোর্টের আইনজীবী সনদ পেতে আমার ৪+ বছর লেগেছিল। হাইকোর্ট পারমিশন এর লিখিত পরীক্ষা, ২০১০ এ ফেল করে ২০১২ তে লিখিত এবং ভাইভা তে উত্তীর্ণ হই। আমার মত এখন যারা দুই/তিনবার ফেল করে তাদের ৭/৮ বছর চলে যায়।

একমাত্র বার কাউন্সিলের কারণে বাংলাদেশে কয়েক লক্ষ শিক্ষানবিশ বেকার যাদের অন্যত্র কোন পেশা নেই অনেকের ক্ষেত্রে। অসংখ্য আইনের ছাত্র ছাত্রী তাদের লাইফ প্রফেশন ক্যারীয়ার নস্ট করেছে ল’প্রফেশনে এসে মানে এলএলবি আর এলএলএম করে। এই লক্ষ লক্ষ শিক্ষানবিশগণদের দুখের করুণ অবস্থার জবাব কি বার কাউন্সিল দিতে পারবে? উত্তরে আমি বলবো, “মোটেও না”।
ভাবতেও খারাপ লাগে বার কাউন্সিল যে কতোটুকু অমানবিক হয়ে গেলো এখানে অনেক পলিটিক্স ঢুকে গিয়েছে। এমসিকিউ দিয়ে অনেক স্টুডেন্ট ছাত্র ছাত্রীদের আটকিয়ে দেয়। আর এখন বলে হাইকোর্টের পারমিশন পরীক্ষায়ও শুনছি এমসিকিউ দিয়ে বসেছে। আর এমসিকিউ আর লিখিত পরীক্ষা যে কঠিন হতে কঠিনতর করেছে দিন দিন এর স্তর বৃদ্ধি আর বৃহতায়ন হচ্ছে। প্রতিবছর চল্লিশ না হয় পঞ্চাশ হাজারের মতন পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দেয়। আর পাশ করে মাত্র দুই অথবা তিন হাজার এটা কেমন ন্যায় বিচার? ফেল করার আধিক্য দেখে মনে হচ্ছে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ। নাহলে অধিক সংখ্যক পরীক্ষার্থী ফেল করে কিভাবে? যাক, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সদস্য জনাব এডভোকেট মোঃ ইব্রাহিম হোসেন এর একটি লেখা আমাকে আলোড়িত করেছে। লেখাটি এমন,
“শিক্ষানবিশদের নিয়ে সামান্য ভাবনা-
সবাই আইনজীবীদের কথা ভাবছে!!অনুদান,ঋন,সহায়তা,সহযোগিতা,প্রনোদনা কতকিছু কিন্তু আমরা ভুলে গেছি আমাদেরই একটা বড় অংশ শিক্ষানবিশ ভাইবোনদের কথা।যাদের প্রত্যেকের শিক্ষানবিশ কাল এক একটা জীবন্ত উপন্যাস।ঢাকা বারেই কয়েক হাজার শিক্ষানবিশ আইনজীবী সনদের অপেক্ষায়।প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্তির পর সনদ যুদ্ধে মাসের পর মাস বছরের পর বছর অপেক্ষার প্রহর গোনা। এই ভাইবোনদের কথা ভাবনার যেন কেউ নেই।অমানবিকতা আর অবহেলাই যেন তাদের নিয়তি।দেশের সমস্ত বার গুলো তার সদস্যদের সংকটে যখন কম বেশী এগিয়ে এসেছে তখন কেউ সামান্যতম সহমর্মিতা দেখায়নি এই আগামীর সহকর্মীদের প্রতি।
কোথায় আজ ঢাকা বার কেন্দ্রিক কয়েক শতাধিক তথাকথিত “আইনজীবী কল্যান”নামক সংগঠন গুলো ও তাদের নেতৃবৃন্দ ?
কোথায় আপনাদের অস্থিত্ব ?
কোথায় আপনাদের প্রতিশ্রুতি?
কোথায় আইনজীবীদের কল্যানের নমুনা?
নাকি সব ভুগাস!! সব বাহানা! সব নাটক!

আমার জানামতে ঢাকা বারে বিভিন্ন ল’কলেজ,পাবলিক/ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি,জেলা/উপজেলা, বিভাগীয় আঞ্চলিক সংগঠন সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক,সামাজিক ও সমগোত্রিয় কয়েক শত সক্রিয় সংগঠন রয়েছে।প্রত্যেকটি সংঠনের মুল এজেন্ডাই হচ্ছে নিজ সদস্যদের কল্যানার্থে কাজ করা।কিন্তু কোথায় সেই মানবতার বুলি আওড়ানো সংগঠনের নেতা-নেত্রীরা? যাদের তর্জন গর্জনে প্রকম্পিত হতো ঢাকা বারের প্রাংগন।
করোনা নামক ভাইরাসের অভিশাপে যখন দিনের পর দিন অজানা শংকা, অর্থ সংকট, মৌলিক চাহিদার অপ্রতুলতায় শত শত শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের উৎকণ্ঠা,তাদের বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস ও আত্নর্নাদ কি ওই সকল সংগঠনগুলোর হর্তাকর্তাদের কানে পৌছায় না?তারা কি উপলব্ধি করেন না? কিসের নেতা?কিসের নেতৃত্ব? কিসের রাজনীতি?কার জন্যে রাজনীতি?
শুধুমাত্র ঢাকা বার কেন্দ্রিক প্রতি বছর এসকল সংগঠনগুলোর শতাধিক ইফতার পার্টির আয়োজন হয়। লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যায় হয় নেতাদের শো’অফের জন্যে অথচ দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আজ তারা নিশ্চুপ,ভাবনাহীন,বোবা,বধিরের ভাব ধরেছে।দেশের এই ক্রান্তিকালে আপনারা কি পারেন না ইফতারের আয়োজনে যে টাকা ব্যায় হতো তা দিয়ে সম্মিলিত ভাবে একটা আপোদকালীন ফান্ড তৈরি করে শিক্ষানবিশ আইনজীবী ভাইবোনদের পাশে দাড়াতে?তারা কি আপনার আমার ভাইবোন নয়? তারা কি এসমাজের কেউ নয়?নেতাদের মনে রাখা উচিত এসংকট কিন্তু চিরস্থায়ী নয়,অচিরেই হয়তো এই কালো অন্ধকার ফুড়ে সোনালি সুর্য উদিত হবে,আবার মুখোরিত হবে প্রিয় প্রাংগন,সেদিন আপনারাই আবার সম্মুখীন হবেন এই সকল ভাইবোনদের সামনে যাদের বিপদে মুখে তালা লাগিয়ে, ঘরের কপাট বন্ধ করে চুপচাপ ঘুমিয়ে ছিলেন।তখন কি লজ্জা পাবেন না?
বিবেক তাড়না দিবে না??
তাই অনুরোধ, দল মত নির্বিশেষে সকল সিনিয়র নেতৃবৃন্দ দায়িত্ব নিয়ে আইনজীবী কল্যান নামক সমস্ত সংগঠন গুলোর নেতাদের সহিত জরুরী ভিত্তিতে আলাপ আলোচনা করে অন্তত ইফতারের জন্যে প্রতি বছর যে টাকা সংগঠনগুলো খরচ করতো তা দিয়ে একটা আপদকালীন ফান্ড তৈরি করুন এবং অচিরেই আমাদের শিক্ষানবিশ আইনজীবী ভাইবোনদের প্রতি মানবতার হাত বাড়িয়ে দিন।
না-হলে হয়তো এ সংকট যেকোনো ভাবে কেটে যাবে কিন্তু ইতিহাস আপনাদের/আমাদের ক্ষমা করবে না।
আমার অভিব্যাক্তিতে ভুল হলে কিংবা কেহ আঘাত পেল ক্ষমা প্রার্থনায়..”
কথাগুলো অনেক যুক্তিযুক্ত ভাবে খুব সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে। বিজ্ঞ আইনজীবী মহোদয় এর বক্তব্যের আলোকে আমার ভাবনা হল, বাস্তবিক অর্থে এত এত শিক্ষানবিশ আইনজীবী বন্ধু কে কোনভাবেই প্রণোদনা বা আর্থিক অনুদানের কাঠামোয় আনা অসম্ভব। এডভোকেট মোঃ ইব্রাহিম হোসেন এর লেখা টি পড়ে আজ শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের অনেক গুলো গ্রুপ/পেজে ঘাটাঘাটি করে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে। কিছু কিছু শিক্ষানবিশ আইনজীবী বন্ধুর লেখায় আইনজীবীদের উপর ক্ষুব্ধতার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখেছি। সত্যিই তো, শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের অসহায়ত্ব দেখার কি কেউ নেই? এ কেমন মানবিকতা? সম্প্রতি ঢাকা আইনজীবী সমিতিসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলার আইনজীবীদের কোথাও সুদমুক্ত ঋণ বা কোথাও অফেরতযোগ্য এককালীন অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এতে তালিকাভুক্ত আইনজীবীরা আপাতত কিছু আর্থিক সহযোগিতা পেলেও শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের কথা কেউ ভাবছে না।
এখন কথা হল, ৪০/৫০ হাজার বা তার ও বেশি শিক্ষানবিশ আইনজীবী বন্ধুর মনের কষ্ট বা আর্থিক অসহায়ত্ব দেখার মত অবস্থা বর্তমানে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নেই। এ অজানা যুদ্ধ তো কেটেই যাবে, আমরাও হয়তো একদিন সব ভুলে যাবো। কিন্তু সীমাহীন সমস্যা রয়ে যাবে। শিক্ষানবিশ আইনজীবীর সংখ্যা ও সমস্যাগুলো দিনে দিনে বৃদ্ধি পাবে। সমস্যা থেকে উত্তোরনের সঠিক পথ বার কাউন্সিল কেই ঠিক করতে হবে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল যদি কার্যত আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হয়ে থাকে, বার কাউন্সিল নিশ্চয়ই এর সুষ্ঠু পথ বের করবে বলে আমি আশাবাদী।
এ বিষয়ে, আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের অভিমত হল, সম্ভবত ২০০৩ সাল থেকে পাশের দেশ ভারতে সর্ব ভারতীয় আইনজীবী পারমিশন পরীক্ষা চালু হয়েছে। বাংলাদেশেও সম্ভবত ১৯৯৫ সাল থেকে প্রথম এনরোলমেন্ট পরীক্ষা শুরু হয়েছে। যদি বাংলাদেশের University Grants Commission এর নিয়ন্ত্রণাধীন ইউনিভার্সিটি থেকে একজন আইনের ডিগ্রি নিয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে বিনা পরীক্ষায় ৬ মাসের প্রকৃত শিক্ষানবিশ কে সনদ দেয়া যেতে পারে (ব্যাপক এবং উদার অর্থে)। এটাও ঠিক যে, ব্যাপক অর্থে আইনজীবী সনদ দেয়া হলে আইন পেশার গুণগত মান ঝুকিপূর্ণ হবে, সেক্ষেত্রে প্রতিবছর নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষাগুলি নিয়ে নেয়া বার কাউন্সিলের খুব জরুরি কর্তব্য।
অন্যদিকে, কিছু উন্নত দেশের বার কাউন্সিল এর রুটিন ওয়ার্ক হল, প্রকৃত শিক্ষানবিশ আইনজীবী সনাক্ত করা, তাদেরকে সিনিয়র এর এফিলিয়েশন বার কাউন্সিলগুলো ই ঠিক করে দেয়। আইনজীবীগণ জুনিয়র লাগবে মর্মে বারে নোটিশ দিলে, বারের প্রত্যক্ষ তদারকি তে জুনিয়র আইনজীবী চেম্বারে প্রবেশ করে। একজন জুনিয়র আইনজীবী কত কি পাবে তা বার কাউন্সিল কে অবহিত করা হয় (বার কাউন্সিল চাপিয়ে দেয় না, কিন্তু সেলারী শিট নেয়)। কেউ জুনিয়রশীপ কন্টিনিউ না করলে তার শিক্ষানবিশ কার্যাদি বাতিল ও হয়ে যায়। আমাদের এখানে যারা বারের পরীক্ষা দেয়, সে সংখ্যাটি ৫০ হাজারের আশেপাশে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জুনিয়রশীপ করছে হয়তো ১০/১৫ হাজার। আমরা আইনজীবীগণ যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি মুলক ভাবে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করি, আমার মনে হয়, শিক্ষানবিশ আইনজীবী এর তালিকা খুব বড় হবেনা। আমি এমন শত শত পরীক্ষার্থী চিনি, যারা চাকুরী বা ব্যবসা বা অন্য কোন কিছু করছেন, তারাও পরীক্ষার্থী। এদেরকে শিক্ষানবিশ আইনজীবী এর তালিকা থেকে বাদ দেয়া খুব কঠিন নয়।আইনজীবী বন্ধুগণ এবং বার কাউন্সিল চাইলে তা ১ মাসের মধ্যেই সম্ভব। দরকার সততা। অন্যকিছু করবেন আবার শিক্ষানবিশ আইনজীবী এর তকমা নিয়ে ঘুরবেন তা হতে পারে না।
যদি ১০/১৫ হাজার প্রকৃত শিক্ষানবিশ আইনজীবী হয়ে থাকে তখন বার কাউন্সিলের জন্য নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা নেয়াটা খুব সহজ ছিল। আমাদের গোড়ায় গলদ। বার কাউন্সিল যদি প্রকৃত তালিকা সংরক্ষণ করতো, তাহলে সম্ভবত বাংলাদেশ বার কাউন্সিল জুনিয়র আইনজীবী বা শিক্ষানবিশ আইনজীবী দের বর্তমান দুরবস্থায় নিজস্ব তহবিল থেকে আর্থিক অনুদান দিয়ে সাহায্য করতে পারতো। পাশাপাশি বিভিন্ন কল্যাণমুলক সংগঠন বার কাউন্সিল কে ডোনেশন বা উপহার দিয়ে শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতো। এখন শুনতে খারাপ লাগলেও সত্য যে, বর্তমান ব্যবস্থাপনায় ব্যক্তিগত ভাবে নিজ নিজ জুনিয়রদের/শিক্ষানবিশদের (আর্থিক সংগতি থাকা সাপেক্ষে) সাহায্য করা ছাড়া ভিন্ন কোন পথ নাই!
এখন সময় এসেছে শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের বিষয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়ার নচেত এর ফলাফল দিনে দিনে খারাপ ই হবে। ইতিমধ্যে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, শিক্ষানবিশ আইনজীবী বন্ধু রা এনরোলমেন্ট পরীক্ষা সহ নানান দাবীতে আন্দোলন করেছিল! এতে বার কাউন্সিলের সুনাম বাড়ছে না! সামনে আরো খারাপ যেন না হয়, কর্তাব্যক্তিরাই ভাববেন।
লেখক- অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সহ সভাপতি, বাংলাদেশ আইন সমিতি।
(বিঃদ্রঃ আমার লেখাটি সম্পুর্ন আমার ব্যক্তিগত মতামত। কাউকে আঘাত করা বা হেয় প্রতিপন্ন করা আমার উদ্দেশ্য নয়। বাস্তব অবস্থাদৃষ্টে আমার ব্যক্তিগত ভাবনা। তবুও কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে নিজ গুনে ক্ষমা করবেন বলে আশা করছি। আমি নিয়মিত লেখক না, লেখায় কোন ত্রুটি থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী।)