১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্ট একসূত্রে গাঁথা; দায়ী একটি পরিবার
- Update Time : ০৫:৪৮:৪৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২১ অগাস্ট ২০২২
- / 304
ডা. মুরাদ হাসান:
আগস্ট মাস শোকের মাস। আগস্ট এলে একদিকে যেমন কোটি মানুষের মন বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়, তেমনি আরেকদল নরপিশাচের মনে পশুবৃত্তি জেগে ওঠে। রক্তের নেশায় মত্ত সেই পশুরা মেতে ওঠে রক্তের হোলিখেলায়। আগস্ট মাস এলেই যেন তারা রক্তের নেশায় উন্মাদ হয়ে যায়।
আজ ২১ আগস্ট, ইতিহাসের আরেকটি জঘন্য কালো অধ্যায়ের জন্ম হয় ২০০৪ সালের এই দিনে। পৃথিবীর বুকে আরেকটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের নজির স্থাপন করে তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা। তাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও পৃষ্ঠপোকতায় এই হামলা সংগঠিত হয়। সরাসরি রাজনৈতিক সমাবেশে ক্ষমতাসীন দলের হামলা পৃথিবীর আর কোন দেশের ইতিহাসে আছে কিনা জানা নাই।
‘৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কিত একটা দিন। ভোরের সূর্যের আলো ফোটার সাথে সাথে অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল জাতির ভাগ্যাকাশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তে রঞ্জিত হয় ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বাড়ি আর স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করা শুধু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ছিল না, এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে খুনিরা মূলত তাদের ‘৭১ সালের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছিল। স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিনবছরে ধ্বংসস্তুপমস একটি দেশকে বঙ্গবন্ধু যেভাবে চালিত করেছিলেন তা খুনীদের চক্ষুশুল ছিল। জাতির পিতাকে হত্যা করার পর থেমে যায় উন্নয়নের চাকা, দেশের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়।
এই হত্যাকাণ্ডের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল সমূলে বাংলাদেশ আওয়ীমী লীগকে নির্মূল করা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করা। তাই হত্যাকারীরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেই ক্ষান্ত দেয় নাই, হত্যা করেছিল বঙ্গবন্ধুর রক্ত আদর্শের উত্তরাধিকারদের। সমূলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নির্মূল করার মিশন বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল, বঙ্গবন্ধু’র আদর্শকে নির্মূল করতে চেয়েছিল তাই তাদের লক্ষ্য শুধু বঙ্গবন্ধু ছিলো না, বঙ্গবন্ধু পরিবারের বাইরেও তাঁর নিকট আত্নীয়দের হত্যা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বর জেলখানার আটক চারনেতাকে হত্যা করা হয়। এছাড়াও সারাদেশব্যাপী গুম ও হত্যার স্বীকার হন নিবেদিত প্রাণ অগণিত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থক। হত্যা করা হয় প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কর্মরত চৌকস অফিসারদের।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীন হওয়া বাঙালির ওপর তাদের মূল ক্ষোভ ছিল। তাই তারা চায়নি বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ বেঁচে থাকুক কারণ খুনীরা ভাল করেই জানত এই রক্ত বেঁচে থাকলে একদিন মাথাচাড়া দিয়ে উঠবেই।
সৌভাগ্যক্রমে সেদিন বঙ্গবন্ধু’র বড় মেয়ে শেখ হাসিনা ও ছোট মেয়ে শেখ রেহানা সে সময় পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান। পরিবারের সকল সদস্যকে হারিয়ে ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে শুরু হয় বড় বোন শেখ হাসিনার নতুন এক সংগ্রামী জীবন। দীর্ঘ ৬ বছর তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ে ভারতে অবস্থান করেন। এরপর ১৯৮০ সালে ইংল্যান্ড থেকে তিনি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁকে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষ করে অবশেষে তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে প্রিয় স্বদেশের মাটিতে ফিরে আসেন। তিনি ফিরে আসেন এদেশের মানুষের জীবনে মুক্তির বার্তা নিয়ে এবং বঙ্গবন্ধু’র অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করা দৃঢ়সংকল্প নিয়ে। আশায় বুক বেঁধে লাখো মানুষ তাঁর ফিরে আসাকে স্বাগত জানিয়ে রাজপথে নেমে আসেন।
বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশে ফিরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামের ডাক দেন, তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশপ্রেমিক জনগনও রাজপথে নেমে আসেন। এর পরপরই তিনি শাসকগোষ্ঠির রোষানলে পড়েন। তাঁকে বারবার কারান্তরীণ করা হয়। তাঁকে হত্যা করার জন্য কমপক্ষে ২২ বার সশস্ত্র হামলা করা হয়। দেশের এমন কোন প্রান্ত নাই যেখানে গিয়ে শেখ হাসিনা হামলার শিকার হন নাই। যেখানেই সুযোগ পেয়েছে দেশদ্রোহী-খুনীচক্র মরণ কামড় বসানোর চেষ্টা করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিএনপির দুঃশাসনামলে ক্ষমতাসীনদের প্রত্যক্ষ মদদে গ্রেনেড হামলা করা হয়।
বঙ্গবন্ধু এভিন্যুতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বক্তব্য শেষ করার পরপরই তাঁকে লক্ষ্য করে এক ডজনেরও বেশি আর্জেস গ্রেনেড ছোঁড়া হয়। লোমহর্ষক সেই হামলার সময় নেতারা মানববর্ম তৈরী করে রক্ষা করেন তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীকে। সেদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং তৎকালীন বিরোধীদলের নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও আইভি রহমানসহ তাঁর দলের ২২ নেতাকর্মী নিহত হন এবং ৫০০ এর বেশি মানুষ আহত হন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিজেও কানে আঘাত পান।
লেখক: সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী।