ড্রাইভারের অবহেলায় গ্রীন সেন্টমার্টিনের বাস খাদে, মৃত্যু দুয়ার থেকে ফিরে আসলেন ঢাবি শিক্ষার্থীরা

  • Update Time : ১১:১৪:০৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • / 489

জাননাহ, বিশেষ প্রতিনিধি:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের বহনকারী গ্রীন সেন্টমার্টিন পরিহবণের একটি বাস খাদে পড়ে আহত হয়েছেন প্রায় ২১ জন শিক্ষার্থী । তাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী শিক্ষার্থী। বাসের অবস্থান থেকে বোঝা যায়, আরেকটু হলেই বাসের গেট সম্পূর্ণ পানির নিচে ডুবে যেতে পারত, আর তখন বাস থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় থাকতো না। এ যেন ঠিক মৃত্যু দুয়ার থেকে ফেরত আসা!

বাসের ড্রাইভার সম্পূর্ণ বেপরোয়াভাবে বাস চালাচ্ছিলেন। এমন ভাবে বাস চলছিল যেন বাসটির পিছনের অংশ পিছনে থাকা বাসের সম্মুখভাগকে ধাক্কা দিয়ে ফেলবে। এক্সিডেন্টের সামান্য কিছু সময় আগে এক শিক্ষার্থী ড্রাইভারকে সাবধান করেও দিয়েছিল যে, আপনি ধীরে চালান, দুর্ঘটনা ঘটবে। কিন্তু ড্রাইভার শুনেনি।

শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ধুমঘাট ব্রিজ এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। আহত শিক্ষার্থীরা স্থানীয় একটি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার পর রাত ৯ টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরে আসেন।

জানা গেছে, আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১ জনের মাথায় গুরুতর জখম হয়েছে। শেলাই করাতে হয়েছে অন্তত আরও ৮ জনের জখম হওয়া বিভিন্ন স্থানে৷ এছাড়া মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত কিছু শিক্ষার্থীর এখনো উন্নত চিকিৎসা নেওয়া বাকি।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, যাত্রার শুরু থেকেই প্রতারণা ও কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে আসছিল গ্রীন সেন্টমার্টিন পরিহবণ। আইন বিভাগের ৪৭ তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বার্ষিক শিক্ষা সফরে সেন্টমার্টিন যাওয়ার উদ্দেশ্যে গ্রীন সেন্টমার্টিন পরিহবণের ২ টি বিজনেস ক্লাসের বাস রিজার্ভ করে। আরামবাগের কাউন্টার থেকে বাস ২ টি ছাড়ার কথা ছিল ২৭ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭ টায়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টার মধ্যে সকল শিক্ষার্থী কাউন্টারে উপস্থিত হলেও রাত ৮ টা পর্যন্ত কাউন্টারে কোনো বাসই আসে নি। রাত ৮ টা ১৫ তে একটা বাস আসলেও সাড়ে ৯ টা পর্যন্ত আরেকটি বাসের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না ।

এদিকে, পরদিন (২৮ জানুয়ারি) শিক্ষার্থীদের কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য সকাল ৮ টার শিপের টিকেট কাটা ছিল। তাই দ্বিতীয় বাসটি না আসায় শিপ মিস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন উপস্থিত শিক্ষার্থীরা । শিক্ষার্থীরা বারবার বাসের অবস্থান জানতে চাইলে কাউন্টার থেকে নানা রকম কথা বলে সময়ক্ষেপণ করা হয়।

এসময় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে সুযোগ বুঝে গোপনে কাউন্টার থেকে সরে পড়েন কাউন্টার সুপার সুজন মিয়া। তাকে ফোন করা হলে সে জানায় যে, দ্বিতীয় বাসটি নষ্ট হয়ে স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেছে। সেটি ঠিক হওয়ার পর ট্রিপের জন্য পাঠানো হবে। বাস বিলম্ব হলে শিপ মিস হয়ে যাবে এ বিষয়টি উল্লেখ করে তাকে অন্য কোনো ভাবে বাস জোগাড় করে দেওয়ার কথা বললে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ” বাস নষ্ট হলে তার দায়ভার কার? ” এতে চরম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন উপস্থিত শিক্ষার্থীরা।

পরে কাউন্টারে উপস্থিত কর্মচারী মো ইব্রাহিম গ্রীন সেন্টমার্টিন পরিহবণের সম্পূর্ণ খরচে অন্য পরিহবণের বাস জোগার করে দেওয়া হবে এ মর্মে লিখিত দিলে শান্ত হন শিক্ষার্থীরা। অতঃপর রাত ১০ টার পর অন্য একটি পরিবহণ কোম্পানির বাসে করে শিক্ষার্থীদেরকে কক্সবাজারে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।

পরে শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) রাত ১২ টায় কক্সবাজার থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে একই গ্রীন সেন্টমার্টিন পরিহবণের বাসে ঢাকায় ফেরার কথা ছিল শিক্ষার্থীদের। এসময় আসা যাওয়ার খরচ বাবদ মোট বাকি ছিল ৭৭ হাজার টাকা।

সুজন মিয়ার সাথে কথা ছিল ঢাকায় পৌঁছে ২৭ হাজার দেওয়া হবে। আর ৫০ হাজার টাকা রওনা দেওয়ার সময় দিয়ে যাত্রা শুরু হবে। কিন্তু রাত ১২ টার পর বাস আসলে ওরা বলে পুরো ৭৭ হাজার টাকা না দিলে বাস ছাড়বে না। পরে স্থানীয় পুলিশ সদস্যারা এসে কথা বার্তা বলার পর ৭০ হাজার টাকা নিয়ে রাত ৩ টায় বাস ছাড়ে গ্রীন সেন্টমার্টিন পরিহবণ।

এদের মধ্যে ১ টি বাস সকাল ৮ টায় চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ধুমঘাট ব্রিজ এলাকায় এসে খাদে পড়ে যায়। খবর পেয়ে দ্বিতীয় বাসটি ওখানে আসলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের হস্তক্ষেপে (ওসি, মিরসরাই থানার উপস্থিতিতে) দুর্ঘটনা কবলিত বাস বাদ দিয়ে অন্য একটি বাস জোগার করে তাদের ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়৷

শিক্ষার্থীদের দেওয়া তথ্যানুসারে, খাদে পড়ে প্রায় ২০ টি মোবাইল ফোন নষ্ট হয়েছে, নষ্ট হয়েছে বেশ কয়েকটি হাত ঘড়ি সহ কক্সবাজার থেকে কেনা বিভিন্ন মূল্যবান (রেয়ার) সামগ্রী। আর এত সব কিছুর জন্য ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা গ্রীন সেন্টমার্টিন পরিহবণের ১ টি বাস ক্যাম্পাসে আটকে রেখেছে।

এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী হুজাইফ মুনতাসির নাহিয়ান ফেসবুকে লিখেছেন, চোখ খুলে দেখি বাসটা জাস্ট উড়ে ডান দিকে যাচ্ছে। এরপর আমরা বাসের ভেতরে কে যে কার গায়ের উপর উড়ে গিয়ে পড়লাম, কে কয়বার উপরে নিচে বাড়ি খেলাম কিছুই জানিনা। বাস থামার পর প্রথম যে কথাটা আমার মাথায় আসলো সেটা হলো “আল্লাহ আমি কি সত্যিই মারা যাই নাই?” কারণ বাস যেভাবে উড়ে পড়তেসিলো আমার ব্রেইন মোটামুটি এইটুক সেন্স করতে পারছিলো আমার মৃত্যু সুনিশ্চিত।

তিনি আরও লিখেছেন, বাসটা আরেকটু সামনে গিয়ে পড়লে কী হতো সেটা মোটামুটি আমাদের সবারই জানা। আল্লাহ আমাদেরকে এইটা সেকেন্ড লাইফ দিয়েছেন। হয়তো আজকে এই টাইমে এনেক্সের মাঠে আমরা ৪৭ ব্যাচের ২০ জন মেয়ে আর ৯ জন ছেলের জানাজাও পড়া হতে পারতো যদি আল্লাহ এত বড় রহম না করতেন।

এই দুর্ঘটনার জন্য সম্পূর্ণ বাস কর্তৃপক্ষ দায়ী উল্লেখ করে হুজাইফ লিখেন, ওরা শুরু থেকেই আমাদের হ্যারাস করছিলো। ঢাকায় ব্যাক করার দিনও গাড়ি আসছে রাত ১২ টায় কিন্তু ছাড়সে ৩ টায়। কক্সবাজার থাকতেই ওরা যে এমাউন্ট বলছিলো সেটা না দিলে গাড়ি ছাড়বেই না। এক পর্যায়ে আমরা মেয়েদের কথা চিন্তা করে নিজেরা সারেন্ডার করলাম যে – যেভাবেই হোক তাড়াতাড়ি রওনা দিই। না হয় মেয়েদের ফ্যামিলি টেনশন করবে। আমাদেরকে এক প্রকার জিম্মি করেই তারা গাড়ি কক্সবাজারে থাকতেই আমাদের থেকে ফুল পেমেন্ট আদায় করে নেয়।

এ বাসের ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আবির নুরুজ্জামান শিকদার বলেন, বাসের ড্রাইভার সম্পূর্ণ বেপরোয়াভাবে বাস চালাচ্ছিলেন। এমন ভাবে বাস চলছিল যেন বাসটির পিছনের অংশ পিছনে থাকা বাসের সম্মুখভাগকে ধাক্কা দিয়ে ফেলবে। এক্সিডেন্টের সামান্য কিছু সময় আগে এক শিক্ষার্থী ড্রাইভারকে সাবধান করেও দিয়েছিল যে, আপনি ধীরে চালান, দুর্ঘটনা ঘটবে। কিন্তু ড্রাইভার শুনেনি।

আবির নুরুজ্জামান শিকদার আরও বলেন, আমার মনে হয় এক্সিডেন্টের সময় বাসের গতি ১২০ এর কম ছিল না। কারণ এত গতি না থাকলে কখনোই ওমন শক্ত রোড ডিভাইডার ভেঙ্গে গিয়ে গাড়ি খাদে পড়তো না।

শীঘ্রই বাস কোম্পানির বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা ও ক্ষতিপূরণের আলাদা আলদা মামলা করা হবে বলে জানান শিক্ষার্থীরা।

ভুক্তভোগী আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ড্রাইভারকে বারবার করে সাবধান করা হলেও সে একটুও ধীরে চালায় নি। ড্রাইভার ও বাসের স্টাফের কথোপকথন থেকে বোঝা যাচ্ছিল তাদের বাসটির সকালে ঢাকা থেকে আবার ট্রিপ দেওয়ার কথা। এই ট্রিপ সময়মতো দেওয়ার জন্যই তারা ঢাকায় ফেরার এত তাড়া দেখাচ্ছিল।

এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, বাসটি এত গতিতে ছিল যে রাস্তার মাঝখানের ডিভাইডার ভেঙ্গে গিয়ে (ডান দিকে) রাস্তার অপর পাশের খাদে গিয়ে পড়ে। ভাগ্যক্রমে অপর পাশ থেকে আসন্ন কোনো পরিবহণের সাথে সংঘর্ষ হয় নি।

এদিকে ক্যাম্পাসে আটককৃত বাস ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গ্রীন সেন্টমার্টিন পরিহবণের মালিক রানা (১ ফেব্রুয়ারি) রাত ১২ টায় ক্যাম্পাসে আসেন। নিজেকে শিক্ষার্থীদের কাছে বাস কোম্পানির জি এম সৈয়দ আব্দুল্লাহ হিসেবে পরিচয় দেন তিনি। তিনি ক্ষতিপূরণ দিয়ে বাস নিয়ে যাওয়ার কথা বললে সকল শিক্ষার্থীর সাথে কথা না বলে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া বা ক্ষতিপূরণ কত তা বলে হবে না বলে জানিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আইন সমিতির (বিএলএ) অন্তর্বকালীন কমিটির সদস্য সচিব এডভোকেট মাহবুবুর রহমান খান বিডি সমাচার কে বলেন, রাতে যিনি এসেছিলেন তিনিই বাসের মালিক। উনি ক্ষতিপূরণ দিয়ে বাস নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। আমরা ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে তাদের দাবি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিব। শিক্ষার্থীদের যে কোনো ন্যায্য দাবি আদায়ে আমরা বদ্ধপরিকর।

জানতে চাইলে আইন ২০ ব্যাচের ছাত্র ব্যারিস্টার শিবলী সাদিক বলেন, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা আমার সাথে যোগাযোগ করেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের রমনা জোনকে বিষয়টা জানিয়েছি। শিক্ষার্থীদের যুক্তিযুক্ত দাবি দাওয়া ও ক্ষতিপূরণ আদায়ে সবসময় পাশে থাকার আশ্বাস দেন তিনি।

Please Share This Post in Your Social Media


ড্রাইভারের অবহেলায় গ্রীন সেন্টমার্টিনের বাস খাদে, মৃত্যু দুয়ার থেকে ফিরে আসলেন ঢাবি শিক্ষার্থীরা

Update Time : ১১:১৪:০৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

জাননাহ, বিশেষ প্রতিনিধি:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের বহনকারী গ্রীন সেন্টমার্টিন পরিহবণের একটি বাস খাদে পড়ে আহত হয়েছেন প্রায় ২১ জন শিক্ষার্থী । তাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী শিক্ষার্থী। বাসের অবস্থান থেকে বোঝা যায়, আরেকটু হলেই বাসের গেট সম্পূর্ণ পানির নিচে ডুবে যেতে পারত, আর তখন বাস থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় থাকতো না। এ যেন ঠিক মৃত্যু দুয়ার থেকে ফেরত আসা!

বাসের ড্রাইভার সম্পূর্ণ বেপরোয়াভাবে বাস চালাচ্ছিলেন। এমন ভাবে বাস চলছিল যেন বাসটির পিছনের অংশ পিছনে থাকা বাসের সম্মুখভাগকে ধাক্কা দিয়ে ফেলবে। এক্সিডেন্টের সামান্য কিছু সময় আগে এক শিক্ষার্থী ড্রাইভারকে সাবধান করেও দিয়েছিল যে, আপনি ধীরে চালান, দুর্ঘটনা ঘটবে। কিন্তু ড্রাইভার শুনেনি।

শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ধুমঘাট ব্রিজ এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। আহত শিক্ষার্থীরা স্থানীয় একটি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার পর রাত ৯ টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরে আসেন।

জানা গেছে, আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১ জনের মাথায় গুরুতর জখম হয়েছে। শেলাই করাতে হয়েছে অন্তত আরও ৮ জনের জখম হওয়া বিভিন্ন স্থানে৷ এছাড়া মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত কিছু শিক্ষার্থীর এখনো উন্নত চিকিৎসা নেওয়া বাকি।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, যাত্রার শুরু থেকেই প্রতারণা ও কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে আসছিল গ্রীন সেন্টমার্টিন পরিহবণ। আইন বিভাগের ৪৭ তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বার্ষিক শিক্ষা সফরে সেন্টমার্টিন যাওয়ার উদ্দেশ্যে গ্রীন সেন্টমার্টিন পরিহবণের ২ টি বিজনেস ক্লাসের বাস রিজার্ভ করে। আরামবাগের কাউন্টার থেকে বাস ২ টি ছাড়ার কথা ছিল ২৭ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭ টায়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টার মধ্যে সকল শিক্ষার্থী কাউন্টারে উপস্থিত হলেও রাত ৮ টা পর্যন্ত কাউন্টারে কোনো বাসই আসে নি। রাত ৮ টা ১৫ তে একটা বাস আসলেও সাড়ে ৯ টা পর্যন্ত আরেকটি বাসের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না ।

এদিকে, পরদিন (২৮ জানুয়ারি) শিক্ষার্থীদের কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য সকাল ৮ টার শিপের টিকেট কাটা ছিল। তাই দ্বিতীয় বাসটি না আসায় শিপ মিস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন উপস্থিত শিক্ষার্থীরা । শিক্ষার্থীরা বারবার বাসের অবস্থান জানতে চাইলে কাউন্টার থেকে নানা রকম কথা বলে সময়ক্ষেপণ করা হয়।

এসময় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে সুযোগ বুঝে গোপনে কাউন্টার থেকে সরে পড়েন কাউন্টার সুপার সুজন মিয়া। তাকে ফোন করা হলে সে জানায় যে, দ্বিতীয় বাসটি নষ্ট হয়ে স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেছে। সেটি ঠিক হওয়ার পর ট্রিপের জন্য পাঠানো হবে। বাস বিলম্ব হলে শিপ মিস হয়ে যাবে এ বিষয়টি উল্লেখ করে তাকে অন্য কোনো ভাবে বাস জোগাড় করে দেওয়ার কথা বললে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ” বাস নষ্ট হলে তার দায়ভার কার? ” এতে চরম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন উপস্থিত শিক্ষার্থীরা।

পরে কাউন্টারে উপস্থিত কর্মচারী মো ইব্রাহিম গ্রীন সেন্টমার্টিন পরিহবণের সম্পূর্ণ খরচে অন্য পরিহবণের বাস জোগার করে দেওয়া হবে এ মর্মে লিখিত দিলে শান্ত হন শিক্ষার্থীরা। অতঃপর রাত ১০ টার পর অন্য একটি পরিবহণ কোম্পানির বাসে করে শিক্ষার্থীদেরকে কক্সবাজারে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।

পরে শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) রাত ১২ টায় কক্সবাজার থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে একই গ্রীন সেন্টমার্টিন পরিহবণের বাসে ঢাকায় ফেরার কথা ছিল শিক্ষার্থীদের। এসময় আসা যাওয়ার খরচ বাবদ মোট বাকি ছিল ৭৭ হাজার টাকা।

সুজন মিয়ার সাথে কথা ছিল ঢাকায় পৌঁছে ২৭ হাজার দেওয়া হবে। আর ৫০ হাজার টাকা রওনা দেওয়ার সময় দিয়ে যাত্রা শুরু হবে। কিন্তু রাত ১২ টার পর বাস আসলে ওরা বলে পুরো ৭৭ হাজার টাকা না দিলে বাস ছাড়বে না। পরে স্থানীয় পুলিশ সদস্যারা এসে কথা বার্তা বলার পর ৭০ হাজার টাকা নিয়ে রাত ৩ টায় বাস ছাড়ে গ্রীন সেন্টমার্টিন পরিহবণ।

এদের মধ্যে ১ টি বাস সকাল ৮ টায় চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ধুমঘাট ব্রিজ এলাকায় এসে খাদে পড়ে যায়। খবর পেয়ে দ্বিতীয় বাসটি ওখানে আসলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের হস্তক্ষেপে (ওসি, মিরসরাই থানার উপস্থিতিতে) দুর্ঘটনা কবলিত বাস বাদ দিয়ে অন্য একটি বাস জোগার করে তাদের ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়৷

শিক্ষার্থীদের দেওয়া তথ্যানুসারে, খাদে পড়ে প্রায় ২০ টি মোবাইল ফোন নষ্ট হয়েছে, নষ্ট হয়েছে বেশ কয়েকটি হাত ঘড়ি সহ কক্সবাজার থেকে কেনা বিভিন্ন মূল্যবান (রেয়ার) সামগ্রী। আর এত সব কিছুর জন্য ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা গ্রীন সেন্টমার্টিন পরিহবণের ১ টি বাস ক্যাম্পাসে আটকে রেখেছে।

এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী হুজাইফ মুনতাসির নাহিয়ান ফেসবুকে লিখেছেন, চোখ খুলে দেখি বাসটা জাস্ট উড়ে ডান দিকে যাচ্ছে। এরপর আমরা বাসের ভেতরে কে যে কার গায়ের উপর উড়ে গিয়ে পড়লাম, কে কয়বার উপরে নিচে বাড়ি খেলাম কিছুই জানিনা। বাস থামার পর প্রথম যে কথাটা আমার মাথায় আসলো সেটা হলো “আল্লাহ আমি কি সত্যিই মারা যাই নাই?” কারণ বাস যেভাবে উড়ে পড়তেসিলো আমার ব্রেইন মোটামুটি এইটুক সেন্স করতে পারছিলো আমার মৃত্যু সুনিশ্চিত।

তিনি আরও লিখেছেন, বাসটা আরেকটু সামনে গিয়ে পড়লে কী হতো সেটা মোটামুটি আমাদের সবারই জানা। আল্লাহ আমাদেরকে এইটা সেকেন্ড লাইফ দিয়েছেন। হয়তো আজকে এই টাইমে এনেক্সের মাঠে আমরা ৪৭ ব্যাচের ২০ জন মেয়ে আর ৯ জন ছেলের জানাজাও পড়া হতে পারতো যদি আল্লাহ এত বড় রহম না করতেন।

এই দুর্ঘটনার জন্য সম্পূর্ণ বাস কর্তৃপক্ষ দায়ী উল্লেখ করে হুজাইফ লিখেন, ওরা শুরু থেকেই আমাদের হ্যারাস করছিলো। ঢাকায় ব্যাক করার দিনও গাড়ি আসছে রাত ১২ টায় কিন্তু ছাড়সে ৩ টায়। কক্সবাজার থাকতেই ওরা যে এমাউন্ট বলছিলো সেটা না দিলে গাড়ি ছাড়বেই না। এক পর্যায়ে আমরা মেয়েদের কথা চিন্তা করে নিজেরা সারেন্ডার করলাম যে – যেভাবেই হোক তাড়াতাড়ি রওনা দিই। না হয় মেয়েদের ফ্যামিলি টেনশন করবে। আমাদেরকে এক প্রকার জিম্মি করেই তারা গাড়ি কক্সবাজারে থাকতেই আমাদের থেকে ফুল পেমেন্ট আদায় করে নেয়।

এ বাসের ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আবির নুরুজ্জামান শিকদার বলেন, বাসের ড্রাইভার সম্পূর্ণ বেপরোয়াভাবে বাস চালাচ্ছিলেন। এমন ভাবে বাস চলছিল যেন বাসটির পিছনের অংশ পিছনে থাকা বাসের সম্মুখভাগকে ধাক্কা দিয়ে ফেলবে। এক্সিডেন্টের সামান্য কিছু সময় আগে এক শিক্ষার্থী ড্রাইভারকে সাবধান করেও দিয়েছিল যে, আপনি ধীরে চালান, দুর্ঘটনা ঘটবে। কিন্তু ড্রাইভার শুনেনি।

আবির নুরুজ্জামান শিকদার আরও বলেন, আমার মনে হয় এক্সিডেন্টের সময় বাসের গতি ১২০ এর কম ছিল না। কারণ এত গতি না থাকলে কখনোই ওমন শক্ত রোড ডিভাইডার ভেঙ্গে গিয়ে গাড়ি খাদে পড়তো না।

শীঘ্রই বাস কোম্পানির বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা ও ক্ষতিপূরণের আলাদা আলদা মামলা করা হবে বলে জানান শিক্ষার্থীরা।

ভুক্তভোগী আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ড্রাইভারকে বারবার করে সাবধান করা হলেও সে একটুও ধীরে চালায় নি। ড্রাইভার ও বাসের স্টাফের কথোপকথন থেকে বোঝা যাচ্ছিল তাদের বাসটির সকালে ঢাকা থেকে আবার ট্রিপ দেওয়ার কথা। এই ট্রিপ সময়মতো দেওয়ার জন্যই তারা ঢাকায় ফেরার এত তাড়া দেখাচ্ছিল।

এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, বাসটি এত গতিতে ছিল যে রাস্তার মাঝখানের ডিভাইডার ভেঙ্গে গিয়ে (ডান দিকে) রাস্তার অপর পাশের খাদে গিয়ে পড়ে। ভাগ্যক্রমে অপর পাশ থেকে আসন্ন কোনো পরিবহণের সাথে সংঘর্ষ হয় নি।

এদিকে ক্যাম্পাসে আটককৃত বাস ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গ্রীন সেন্টমার্টিন পরিহবণের মালিক রানা (১ ফেব্রুয়ারি) রাত ১২ টায় ক্যাম্পাসে আসেন। নিজেকে শিক্ষার্থীদের কাছে বাস কোম্পানির জি এম সৈয়দ আব্দুল্লাহ হিসেবে পরিচয় দেন তিনি। তিনি ক্ষতিপূরণ দিয়ে বাস নিয়ে যাওয়ার কথা বললে সকল শিক্ষার্থীর সাথে কথা না বলে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া বা ক্ষতিপূরণ কত তা বলে হবে না বলে জানিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আইন সমিতির (বিএলএ) অন্তর্বকালীন কমিটির সদস্য সচিব এডভোকেট মাহবুবুর রহমান খান বিডি সমাচার কে বলেন, রাতে যিনি এসেছিলেন তিনিই বাসের মালিক। উনি ক্ষতিপূরণ দিয়ে বাস নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। আমরা ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে তাদের দাবি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিব। শিক্ষার্থীদের যে কোনো ন্যায্য দাবি আদায়ে আমরা বদ্ধপরিকর।

জানতে চাইলে আইন ২০ ব্যাচের ছাত্র ব্যারিস্টার শিবলী সাদিক বলেন, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা আমার সাথে যোগাযোগ করেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের রমনা জোনকে বিষয়টা জানিয়েছি। শিক্ষার্থীদের যুক্তিযুক্ত দাবি দাওয়া ও ক্ষতিপূরণ আদায়ে সবসময় পাশে থাকার আশ্বাস দেন তিনি।