ছাত্র রাজনীতিকে নির্যাতক বানানোর মেশিনে পরিণত করা হয়েছে : আসিফ নজরুল
- Update Time : ১১:৫৪:০৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
- / 82
জাননাহ, ঢাবি প্রতিনিধি
ছাত্র রাজনীতিকে নির্যাতক বানানোর মেশিনে পরিণত করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকটা হলকে ‘হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’র সাথেও তুলনা করেছেন তিনি।
শনিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ সময় রাত ৯ টায় অনলাইন প্লাটফর্ম জুমে ‘সোচ্চার’ নামে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংগঠনের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। এতে আরও উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনজীবী ও জাস্টিস অ্যাব্রোড (ইউকে) এর পরিচালক ব্যারিস্টার মাইকেল পোলাক, বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন, বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ প্রমুখ।
অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, সারা পৃথিবীতে কোথাও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দ্বারা শিক্ষার্থী নির্যাতনের মতো বর্বর ঘটনা ঘটে না। বিশ্বের কোনো ছাত্র সংগঠন এভাবে কাজ করে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ে, তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, তারাই দেশটা গড়ে তুলবে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে, তাদের বিরুদ্ধে যাতে আন্দোলন না হয়, প্রতিবাদ না হয়, তা নিশ্চিত করার স্বার্থে তরুণ প্রজন্মকে ব্যবহার করে এবং তারা হলে আসন সংকটকে ব্যবহার করে এমনটা করছে।
অসিফ নজরুল আরও বলেন, সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে নির্যাতন নিষিদ্ধ, কনভেনশন এগেইনস্ট টর্চারের পক্ষ রাষ্ট্র আমরা। অথচ নির্যাতকরা এখানে অবাধে থাকে। এর পেছনের কারিগর কারা? ছাত্র রাজনীতিকে নির্যাতক বানানোর মেশিনে পরিণত করা হয়েছে। আমি সোচ্চারের কাছে অনুরোধ করবো, অন্যান্য মানবাধিকারের বিষয়গুলোর চাইতে আপনারা কেবল ক্যাম্পাস নির্যাতনের ব্যাপারে সোচ্চার হোন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনজীবী ও জাস্টিস অ্যাব্রোড (ইউকে) এর পরিচালক ব্যারিস্টার মাইকেল পোলাক তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশে অপহরণের ঘটনা আমরা জানি। এর সঙ্গে সরকারের বাহিনী কিংবা এজেন্টদেরও জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। আমরা দেখেছি, এসব ঘটনায় র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছিলো। কিন্তু দেশে তাদের বিচারের আওতায় আনার সুযোগ সামান্য। এখানেই আমরা অসহায়। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক মানবাধিকার পরিস্থিতি খুবই খারাপ। সেজন্যই সোচ্চারের মতো সংগঠনগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন তার বক্তব্যে বলেন, স্বাধীনতার পর আমরা ক্যাম্পাসের এক ধরনের অবস্থা দেখেছি, আর বিগত এক দুই দশকে দেখছি আরেক পরিস্থিতি। শাসন নিয়ে যাতে কোনো ধরনের প্রশ্ন তোলা না হয়, সেজন্যই এই ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ করে শিবির ট্যাগ দিয়ে নির্যাতন করা হয়। আমার প্রশ্ন হলো, দেশের আইনে যারা নিষিদ্ধ নয়, তাদের কীভাবে এ ধরনের নির্যাতন জায়েজ হতে পারে। ‘সোচ্চার’ সংশ্লিষ্ট আপনারা যেহেতু দেশের বাইরে থেকে কাজ করছেন, উন্নত পড়াশোনা করেছেন, আপনারা এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন। আমরা এমন সমাজ চাই যেখানে ন্যায্যতা থাকবে, মানবাধিকার সমুন্নত থাকবে, সহনশীল পরিবেশ বিরাজ করবে।
অনুষ্ঠানে সংগঠনটির রিসার্চ এন্ড ইভালুয়েশন ডিরেক্টর ও যুক্তরাষ্ট্রের পিএইচডি গবেষক সাব্বির আহমেদ বলেন, ক্যাম্পাসে নির্যাতিতদের না বলা গল্পগুলো নীরবতা ভেঙ্গে আমরা সামনে নিয়ে আসতে চাই এবং তাদের গল্পগুলো আমরা শেয়ার করতে চাই। গত এক দশক ধরে কিংবা তারও আগে যারা নির্যাতিত হয়েছে তাদের গল্পগুলো আমরা ‘সোচ্চারে’ প্রকাশ করবো। একইসঙ্গে সংগঠনটি এসব ঘটনা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করবে। আমরা বিশ্বাস করি, একদিন না একদিন এসব ঘটনার বিচার পাবে নির্যাতিতরা।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতনের শিকার মুকুল আহমেদ বলেন, আমি ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আমার ঘটনাটা হয় ছয় মাস হয়েছে। পিটিয়ে আমার হাত ভেঙে দেওয়া হয়েছে। গোপনাঙ্গে সিগারেটের ছেঁকা দেওয়া হয়েছে। আমি পানি চেয়েছি খেতে দেওয়া হয়নি। অবশেষে মৃত ভেবে তারা চলে যায়। গত ছয় মাস চিকিৎসার পর আমি ক্যাম্পাসে এসেছি। এখনও ভীতির মধ্যে আছি।
আবরার ফাহাদের ভাই আবরার ফাইয়াজ বলেন, এমন উদ্যোগের জন্য আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বুয়েটে এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। ২০০২ সালে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে সাবিকুন্নাহার সনিও নিহত হয়। মাঝে অনেক বছর কেটে গেলেও আবার সংঘর্ষ ফিরে আসে। ভাইয়ার ২০১৯ সালের ঘটনার পর এখন বুয়েট শান্ত থাকলেও কতদিন এ অবস্থা থাকবে আমরা জানি না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্যাতনের শিকার বুয়েটের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৮ সালে আমার সঙ্গে আবরার ফাহাদের মতোই ঘটনা ঘটে। পরের বছরই বুয়েটে আবরার ফাহাদকে হত্যা করা হয়। আবরার ফাহাদের হয়তো এমন পরিণতি হতো না, যদি না আমার ঘটনায় বিচার হতো। দুঃখের বিষয় হলো, আমাকে আমার শিক্ষকই নির্যাতনকারীদের হাতে তুলে দিয়েছিল।
এছাড়া অনুষ্ঠানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টস রাইটস এসোসিয়েশন এর সভাপতি মেহেদী সঞ্জিব বক্তব্য দেন।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন সোচ্চারের নির্বাহী পরিচালক, যুক্তরাষ্ট্রের ফিল্যান্ডার স্মিথ ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ড. মাহফুজুল হাসান। মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন সংগঠনটির আরেক নির্বাহী পরিচালক, যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ের পিএইচডি গবেষক রাহনুমা সিদ্দিকি ।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, ‘সোচ্চার টর্চার ওয়াচডগ, বাংলাদেশ’ – এর কাজের পরিধি বড় হলেও প্রাথমিকভাবে ক্যাম্পাস টর্চারের ভিক্টিমদের পাশে দাঁড়ানো, টর্চার বন্ধে অ্যাডভোকেসি করা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে তাদের এই সংগঠনটির পথ চলার সূচনা হচ্ছে।