“করোনা যোদ্ধা হতে চাইনা, মানবতার স্বীকৃতি চাই”

  • Update Time : ০৭:১০:৫০ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ জুলাই ২০২০
  • / 246
শেখ মোঃ জয়নাল আবদিন:

করোনার সর্বপ্রথম আত্মপ্রকাশ চায়নাতে হওয়ার পর থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, (WHO)চিকিৎসা বিজ্ঞান, ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসহ বিশ্বের বড় বড় ডাক্তারগণ প্রতিষেধক আবিষ্কারের ব্যাপারে গবেষণা শুরু করেন। কারণ ভাইরাসটি সারা বিশ্বের কাছে একেবারেই নতুন। প্রতিষেধক আবিষ্কার কিংবা এন্টিবডি তৈরি করা অবশ্যই সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আমরা জানি কোন ঔষধ বাজারজাত করার পূর্বে হাজার হাজার লোকের ওপর ঐ ঔষধের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয়। ওষুধের সাইড এফেক্ট কিংবা অন্য ওষুধের সাথে এর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করার জন্য।

অল্প সময়ের ব্যবধানে অবশ্য করোনা শনাক্তের কীট চায়না আবিষ্কার করার পর বাংলাদেশও সক্ষম হয়েছে। সাধুবাদ জানাই গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা পরিচারক ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে এবং তার সুস্থতা কামনা করছি।
তাতেও ঔষধ প্রশাসন এবং ডাক্তারদের সাথে ধাক্কাধাক্কি কম যায়নি।

আমাদের দেশে রাজনৈতিক খেলা ও বাণিজ্যের নেতিবাচক চিন্তা সব জায়গাতেই চলে। ঢাকা মেডিকেলের নাস্তা আর খাবারের বিল দেখে জাতি আজ হতবম্ব বাকরুদ্ধ। তার পর সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতালের করোনা সার্টিফিকেট জালিয়াতি, বিশ্ব বাসির কাছে পুরো জাতিকে কলংকিত করেছে।এ ভাবে আর কতোদিন চলবে ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় দুর্নীতিবাজদের মহড়া? এরাই আজ ফ্রন্টলাইনের করোনা যোদ্ধা হতে চায়!

রোগটি যেহেতু সংক্রমণ ব্যাধি নামে পরিচিত সেই হিসেবে ডাক্তার-নার্সরাও চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। আর এটা হওয়া সাভাবিক কারণ এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শত শত ডাক্তার করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। শুধু তাইনয় বাংলাদেশেও সর্বপ্রথম সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের একজন সিনিয়র ডাক্তার ডাঃ মঈনুদ্দিন দুনিয়া ত্যাগ করে পরপারে চলে গেছেন। এতে আমাদের দেশের ডাক্তারদের কাছে বিষয়টি আরও আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

দূরের কথা বলব কি আমাদের চাঁদপুরের এক রোগীর কাছে শুনা, ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে বসেছেন, আর সম্ভবত রোগির কাশি আসছে, ডাক্তার সাহেব চেয়ার থেকে উঠে পিছনের দরজা দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।ঐ রোগী ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেও চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ হয় নাই। কিছু কিছু ডাক্তার প্রাইভেট চেম্বারে রোগী ভীড়ানোর জন্য ভাড়া করা লোক কিংবা রিক্সার ড্রাইভার দালাল হিসেবে নিযুক্ত করতেন। তারাই করোনা কালীন সময়ে চেম্বারে ভাড়া করা লোক নিযুক্ত করেছেন রোগী থেকে ডাক্তারদের দূরে রাখার জন্য।কি আজিব!

কিছু ডাক্তারের সাথে আলাপ করলে তারা বলেন যে ভাই আমি বাঁচলে তো চিকিৎসা, আমি না বাঁচলে চিকিৎসা দিবে কে? আগে আমাকে বাঁচাতে হবে।

যাক বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আচঁ করতে পেরে ডাক্তারদের জন্য মোটা অঙ্কের প্রণোদনার অফার দিলেন। করোনায় আক্রান্ত হলে কি, মারা গেলে কি দিবেন তার বিস্তারিত উল্লেখ করলেন এবং কিছুটা হুমকি স্বরূপ বলে দিলেন, যে সমস্ত ডাক্তারগণ চেম্বার করবেন না তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। এর পরে কিছুটা হলেও চিকিৎসার বিষয়টা স্বাভাবিক হয়েছে।

এরই মধ্যে মৃত্যুর তালিকায় যোগ হতে থাকলো এ মহা দুর্যোগে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্বেরত ডাক্তার সেনাবাহিনী পুলিশ ও মিডিয়াকর্মীদের নাম।টকশোতে অনেক সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ এদেরকে করোণা যোদ্ধা হিসেবে সম্বোধন করেন, অনেকে স্বীকৃতিও দেন। করোনায় মৃত ব্যক্তির দাফন কাফনে যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের ব্যাপারে মিডিয়া পাড়ায় তেমন কোন মাতামাতি নেই।আমি মনে করি সর্বশেষ যে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তাহলো ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী দাফন বা সৎকার করা।কারন এখানে স্ব স্ব ধর্মের নিয়ম নীতি দোয়া কালাম বা মন্ত্রপাঠের বিষয় রয়েছে যা প্রশাসন বা স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্বারা নিয়ম রক্ষা করে দাফন বা সৎকার সন্ভব হবেনা।

জানাজা দাফনের এ বিভাগে যারা কাজ কেরছেন তারা সবাই নিজস্ব ধর্মীয় জ্ঞান নিয়ে নিয়ম মেনেই করছেন।
ইহাছাড়া সবাই এখানে সিভিল সোসাইটি। তারা সরকারের কোন পর্যায়ের এম্প্লয়ী নয় যে,তারা কোন প্রকার সরকারি প্রণোদনা বা প্রমোশনের প্রত্যাশী।

কয়েকটি সেচ্ছাসেবী সংগঠন এ কাজের আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর আমির হযরত পীরসাহেব হুজুর চরমোনাইর নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনের নেতা কর্মীরা অত্যন্ত আন্তরিকতা ও দক্ষতার সাথে দেশব্যাপী এ কাজের আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। চাঁদপুরের কথাই যদি আমি বলি করোনার সূচনালগ্নে অনেক রাজনৈতিক ও সেচ্ছাসেবী সংগঠন জীবনঝুঁকিপূর্ন এ সেবামূলক কাজ করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুত দিয়েছিলেন। পিপিএ পরিহিত অবস্থায় যাদের ছবি সোশ্যাল মিডিয়া ও পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে। কিন্তুু দূঃখের বিষয় হলো চাঁদপুরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর সেচ্ছাসেবক টিমের মাধ্যমে একশর অধিক লাশ দাফন হয়ে গেল, আজ পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলনের কর্মী ব্যাতিত উল্লেখ করার মতো কাহাকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি।তারপরেও এ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যাহারা আগ্রহ দেখিয়েছেন কিংবা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে যে যার অবস্থান থেকে যতটুকু করছেন আমরা সকালের কাছেই কৃতজ্ঞ।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ চাঁদপুর জেলার নেতৃত্বে ৮টি উপজেলায় ১১টি টিমে মোট ১৫০ জন সেচ্ছাসেবক নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। টিম গঠনের ক্ষেত্রে উৎসাহ ও সহযোগীতা যুগিয়েছন, বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটি চাঁদপুর জেলার সম্মানিত সাধারণ সম্পাদক, মাওলানা যোবায়ের আহমাদ।

তারা কোন বিনিময়ের আসায় নয়। বিবেকের তাড়নায়,সামাজিক দায়বদ্ধতা,মানবিক দায়িত্ববোধ সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে এ মহান দায়িত্বটি পালন করে যাচ্ছেন। যত গভীর রাতই হোক না কেন, সিভিল সার্জন অথবা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বা কোন জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে মৃত্যুর সংবাদ আসামাত্রই (আই,এ,বি) সেচ্ছাসেবী টিম নিজের বাবা-মা ভাই-বোন এর মতো অতি আপনজনের ন্যায় দরদমাখা সেবার মনোভাব নিয়ে ছুটেযান হাসপাতাল কিংবা মৃত ব্যক্তির বাড়িতে।

এ কাজের ব্যাপারে প্রত্যেকের পরিবার থেকেই কমবেশি বাঁধা ছিল বা আছে। কে কি ভাবে পরিবারকে ম্যানেজ করেছেন জানিনা। আমি যে ভাবে ম্যানেজ করেছি একটু শেয়ার না করলেই নয়। বিগত ১৬/০৪/২০২০ সর্বপ্রথম আমাদের পাশের গ্রাম কমলাপুর আব্দুর রহমান মিন্টুর লাশ দাফন করতে হবে। সদর উপজেলা টিম সমন্বয়কারী আনোয়ার ভাইকে বললাম যোগাযোগ করেন কে কে যেতে আগ্রহী। অনেকের সাথেই যোগাযোগ হয়েছিল বিভিন্ন ওজর আপত্তিতে অনেকেই পাশকাটিয়ে গেছেন । শেষ পর্যন্ত আমি,মাওঃ আনোয়ার আল নোমান , শাহ জামাল গাজি সোহাগ, মাওঃ আক্তার হোসাইন ও আসাদ উল্লাহ সুমন এ পাঁচজন। সবাই আমার আল কারিম টাওয়ার এর অফিসে এসে পরামর্শ করলাম। মহব্বতের কারনেই অনেকে বললো ভাই আপনার যাওয়ার প্রয়োজন নাই, আপনি দূর থেকে দিকনির্দেশনা দিলেই আমরা কাজ করতে পারবো।তখন আমি বললাম আমার দায়িত্ব যাইহোক আমিও আপনাদের মতো একজন কর্মী। অবশ্যই আমি আপনাদের সাথে টিম প্রধান হিসাবে যাব এবং কাজও করবো।

যাক দুপুর ১টায় আমাদের টিম উপজেলা সাস্থ্য কর্মকর্তার কাছে যাওয়ার পর আমাদের জন্য সাস্থ্য সুরক্ষা সরাঞ্জামাদী রেডি করতে আমরা জোহরের নামাজ আদায় করে নিলাম। সিভিল সার্জন অফিস থেকে গাড়ি আসলো আমাদেরকে নিয়ে চললো মৃত ব্যাক্তির বাড়ীতে।সেখানে গিয়ে পিপিএ পরলাম, আসলে পিপিএ জীবনে পড়াতো দুরের কথা চিনিওনা!
করোনা হয়তো পিপিই ‘র” সাথে আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।যাক আমার প্রথম কাজটিতে যাওয়ার মূলকারণ হলো, করোনর লাশ দাফন নিয়ে যে আতঙ্ক সেই আতঙ্কের দেয়াল ভেঙ্গে দেয়া এবং কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করা।

মূলত এ আতংকের দেয়ালের মজবুতি কোন অংশেই কম ছিলানা। যেমন আমার ছোট মেয়ে সাড়ে তিন বছর বয়স, সে আমাকে বলে বাবা তুমি বাইরে যেও না, বাইরে গেলে তোমার খবর আছে! আমাদের আর একজন স্বেচ্ছাসেবক সোহাগ তার পাচঁ বছরের ছেলে তাকে বলে বাবা করোনায় আমরা মারা গেলে তোমার উপর দাবি আছে!বুঝা গেল এর প্রভাব শুধু বড়দের মাঝেই নয় ছোটদের মাঝেও পড়েছে।যাক দাফন শেষে পিপিই খোলার পর প্রতিবেশী অনেক আত্মীয়-স্বজন আবেগাপ্লুত হয়েছেন এবং আপ্যায়নের জন্য দাবী জানিয়েছেন, ওদের সংক্ষিপ্ত আবদার রক্ষা করে,একটি অটো রিজার্ভ করে চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হই যেহেতু প্রশাসনের গাড়ি আমাদেরকে রেখেই চলে গেছেন।

পরেরদিন অবশ্য সদর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের UHFPO ডাঃ সাজেদা বেগম পলিন আমাদেরকে রেখে আশার কারনে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং আমাদের যাতায়াত ভাড়া বাবদ সোহাগের মাধ্যমে ১০০০ টাকা দেওয়ার কথা বলেছিলেন, আমরা তা গ্রহন না করে বলেছি, আলহামদুলিল্লাহ আমাদের মাধ্যমেই তা ব্যাবস্থা হয়েছে অসুবিধা নেই।

 

ঐ দাফনের কিছু ফুটেজ এবং আমার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের ভিডিও আমার মোবাইলে ধারণ করা ছিল। পরের দিন দুপুরে আমার ছোট মেয়ে আমার মোবাইল ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে ওই ভিডিওটা অন করে দিছে ওর আম্মুও কাছে ছিল কন্ঠ শুনে বুঝতে পারছে আমি, কিন্তুু চিনতে পারে নাই কারন পিপিই সহ সুরক্ষা সেফটি দ্বারা পুরো দেহ আবৃত। আমাকে বললো তুমি কি দাফনে গিয়েছিলে?

মনে হয়, এ কথা শুনার পর হঠাৎ পাশের রুমে গিয়ে অচেতন হয়ে পড়েগেল।মাথায় তেলপানি দিয়েও হুশ পিরাতে সময় লেগেছে ৯ ঘণ্টা। মূলত স্বামীর মহব্বত আর করোনা আতংকের কারনেই এ ঘটনা ঘটেছে। একটু হুশ ফেরার পর বললো আমি এমনিতেই অসুস্থ তোমায় চিন্তায় আরো আগেই মরে যাব। তুমি দাফনে না গেলে হয়না?
আমি বললাম,এতবড় নেকের কাজে না যাওয়া কি ঠিক হবে? এ সময়ের সবচেয়ে মানবতার কাজ হলো এটা। এতবড় সাওয়াবের কাজে আমাকে নিরুৎসাহিত করিওনা।আমরা শতভাগ সাস্থ্যবিধি মেনে আল্লাহর রাসুলের শিখানো দোয়া পড়ে,তারপর আল্লাহর উপর পূর্ন ভরসা করছি। অতএব দোয়া করতে থাক এ কাজ করার তৌফিক আল্লাহ্ যেন আমাকে দান করেন। তারপর তুমিতো আমার তবিয়ত জান, ভালো কাজ বা নেকের কাজের ক্ষেত্রে দুনিয়ার স্রোতের উলটো দিকে চলাই আমার অভ্যাস, আলহামদুলিল্লাহ এটা ছোট বয়স থেকেই।

 

শুকরিয়ার বিষয় হলো তারপর থেকে ধারাবাহিক কাজে সে আমাকে যে সহযোগীতা করেছ বনর্নায় শেষ হবেনা। যেমন, বাহিরে থাকলে বাসায় আসার আগে যদি জানতো কোন দাফন সেরে আসছি তাহলে, গোসলের গরমপানি,খাবারের গরমপানি এমনকি রং চা সবই প্রস্তুত রাখতো। আলহামদুলিল্লাহ, এখনতো কাজের একটা ধারাবাহিকতা আসছে। ইসলামী আন্দোলন ও সহযোগী সংগঠনের অনেক দায়িত্বশীল, সদস্যরা কাজের সাথে যুক্ত হয়েছেন।এখন অধিক রাতে কাজ করালাগেনা। গভীর রাতের কয়েকটি কাজ এবং সেচ্ছাসেবকদের কষ্টের বিষয়টা যখন সিভিল সার্জন এর সাথে আলাপ করলাম তখন সিভিল সার্জনও আমাকে বললো ভাই রাত ১০টার পর আর কোন দাফনের বিষয়ে বলবোনা সকাল থেকে হবে,এতে আপনাদের অনেক কষ্ট হয়। আমি বললাম এটাই ভালো হবে।

সুন্দর বা রুচিশীল কোন বাক্য আমাদের সামনে আসলেই আমরা মূহুর্তের মধ্যে ভাইরাল করে দেই।এর অর্থ বুঝার সময়টুকুও আমাদের কাছে থাকে না। যেমন করোনার শুরুতে বলা হয়েছিল সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সব কাজ করতে হবে। পরে দেড় দুই মাস পরে একজন ডাক্তার বললেন সামাজিক দূরত্ব নয় শারিরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। সমাজ থেকে সমাজের দূরত্বতো এমনিতেই আছে। ব্যাক্তি থেকে ব্যাক্তির দূরত্ব প্রয়োজন।

যেমন এখন খুব বেশি মাতামাতি করোনা যোদ্ধা নিয়ে। কে প্রথম সারির, কে মধ্য সারির, কে পীচনের সারির। আমাদের জানা প্রয়োজন যু্দ্ধ ছাড়া যোদ্ধা হওয়া যায়না। কোন যুদ্ধ সংঘঠিত হওয়ার জন্য প্রথম শর্ত হলো দৃশ্যমান প্রতিপক্ষ থাকা। উভয়ে যুদ্ধের জন্য ঐক্যমত্য হয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহন করা। এখানে কে কারসাথে যুদ্ধ করে যোদ্ধা হতে চাচ্ছেন? একদিন টকশোতে একজন সন্মানিত অতিথি বললেন, করোনা এমন একটি শক্তি, যা দেখা যায়না, ধরা যায়না,ছোঁয়া যায়না অথচ এটোম বোমার মতো আমাদের সামনে বসে আছে!
আজ এ মহাবিশ্বের নভোমন্ডল ভূমন্ডল, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, আসমান জমিন,পাহাড় পর্বত, সমূদ্র অরণ্য যা কিছু আছে আমাদের দেখার বাহিরেই মহান আল্লাহ্ পাক রাব্বুল আলামিন সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিক ভাবে পরিচালনা করে আসছেন।

করোনাতো এমনই এক বৈশ্বিক মহা-শক্তি যার কাছে বিশ্বের সকল পরাশক্তি পরাজিত । বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতিরা আত্মসমর্পণ করেছে। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা স্বয়ং আল্লাহর সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করার শামিল। করোনার মোকাবেলা করা স্বয়ং আল্লাহর সাথে মোকাবেলা করার নামান্তর। গোলাম কখনো মালিকের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে না কারণ গোলামের রিজিক মালিকের পায়ের তলার সাথে সম্পৃক্ত। যেদিন মালিক নাখোশ হয়ে যাবে এক লাথি মেরে তার বাসভবন থেকে বের করে দিবে। আমাদের উপর মাওলার অফুরন্ত রহমত দ্বারা আবৃত্ত থাকার কারনে দৈনন্দিন শত অবাধ্যতার কারনেও আমাদেরকে ধ্বংস করেন না!
তাই আমরা করোনা যুদ্ধা হতে চাইনা,মানবতার কাণ্ডারি হতে চাই।

 

যারা জীবন সঙ্গিনীর প্রিয়তম ব্যাক্তিকে মানব সেবায় উজাড় করে দিতে পারেন! যারা করোনাকালীন বাস্তব জীবনঝুকিমিশ্রিত সময়ে বিছানাকে পৃথক করে নেয়নি! যারা আমার ঐ স্বার্থপর বোনের মতো স্বামীর করোনা পজেটিভ দেখে বাপের বাড়ী চলে যায়নি!যারা ঐ পাষণ্ড নারীর মতো স্বামীকে নির্জন কক্ষে রেখে বাহির থেকে তালা মেরে মৃতুর মুখে ঠেলে দেয়নি! যারা স্বামীর পজেটিভ রিপোর্ট দেখে স্বামীকে তার নিজের ঘরের দরজায় প্রবেশ করতে দেয়নি,মৃতুর পরমান দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে স্বামীর বোনের বাড়ীতে!

যারা নিজের কলিজার টুকরা সন্তানকে এ কাজের জন্য ওয়াকফ্ করে দিয়েছেন! যারা নিজের স্বামীকে মানবতার জন্য উজাড় করে দিয়েছেন! যে মহিয়শী নারী স্বামী করোনা পজেটিভ নিয়ে আইশোলেশন ওয়াডে থাকা কালে জাগতিক আইন কানুন ও মৃত্যুভয় যাকে সেই বেড থেকে সরাতে পারেনি। রাত্রিযাপন হতো একই বেডে পিঠেপিঠ লাগিয়ে!

 

তার উক্তি ছিল পৃথিবীর পারিবারিক বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্নকারী মহিলাদের শিক্ষা দেয়ার মতো। “স্বামী থাকলে আমার অনেক মূল্য, স্বামী না থাকলে আমার দু পয়সার মূল্য নেই”এ কথা সে মহিলাই বলতে পারে যে স্বামীকে পরম শ্রদ্ধার সাথে অন্তর থেকে ভালোবাসে।এ সমস্ত দম্পতির কাছে পৃথিবীর অঢাল টাকা আর সোনা রুপার বিশাল মজুদ না থাকলেও তাদের কাছে আছে শান্তি সুখের বিশাল হিমালয়। যার আসল বাস্তবতা হলো ইসলামী পারিবারিক জিন্দেগী।

করোনা কালীন সেবার ক্ষেত্রে প্রশাসন, ডাক্তার, নার্স ও বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর কিছু বিধিবদ্ধ আইনি দায়বদ্ধতা ও বর্ধিত অর্থের বিষয় ছিল।কিন্তুু, আমার মা বোন যারা সকল লোভ লালসার উর্ধ্বে উঠে, নিজের নফ্স বা মনের সাথে জিহাদ করে, দেশের চরম সংকটকালীন সময়ে, মানবতার কল্যানে মরনব্যাধি করোনার দুয়ারে আমাদেরকে বিলিয়ে দিয়েছন, আমাদের আগে, তাদেরকে মানবিক যুদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া যেতে পারে।

তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সহযোগীতার কারনেই আমাদের জন্য এ কাজ করা সহজ হয়েছে। তাই করোনা যুদ্ধা নয় মানবতার স্বীকৃতি চাই। মানবাধীকার সংগঠন করে সভা, সমাবেশ, সেমিনার সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে মানবতাবাদী হওয়া যায়না। সংকটকালীন মূহুর্তে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ ভাবে তাদরকে কাঙ্খিত সেবা দিতে হয়।
.

লেখক : সভাপতি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ চাঁদপুর জেলা ও টিম প্রধান, দাফন-কাফনে নিয়োজিত সেচ্ছাসেবক টিম চাঁদপুর, জেলা।
joynal.abdin2007@gmail.com

.

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


“করোনা যোদ্ধা হতে চাইনা, মানবতার স্বীকৃতি চাই”

Update Time : ০৭:১০:৫০ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ জুলাই ২০২০
শেখ মোঃ জয়নাল আবদিন:

করোনার সর্বপ্রথম আত্মপ্রকাশ চায়নাতে হওয়ার পর থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, (WHO)চিকিৎসা বিজ্ঞান, ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসহ বিশ্বের বড় বড় ডাক্তারগণ প্রতিষেধক আবিষ্কারের ব্যাপারে গবেষণা শুরু করেন। কারণ ভাইরাসটি সারা বিশ্বের কাছে একেবারেই নতুন। প্রতিষেধক আবিষ্কার কিংবা এন্টিবডি তৈরি করা অবশ্যই সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আমরা জানি কোন ঔষধ বাজারজাত করার পূর্বে হাজার হাজার লোকের ওপর ঐ ঔষধের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয়। ওষুধের সাইড এফেক্ট কিংবা অন্য ওষুধের সাথে এর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করার জন্য।

অল্প সময়ের ব্যবধানে অবশ্য করোনা শনাক্তের কীট চায়না আবিষ্কার করার পর বাংলাদেশও সক্ষম হয়েছে। সাধুবাদ জানাই গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা পরিচারক ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে এবং তার সুস্থতা কামনা করছি।
তাতেও ঔষধ প্রশাসন এবং ডাক্তারদের সাথে ধাক্কাধাক্কি কম যায়নি।

আমাদের দেশে রাজনৈতিক খেলা ও বাণিজ্যের নেতিবাচক চিন্তা সব জায়গাতেই চলে। ঢাকা মেডিকেলের নাস্তা আর খাবারের বিল দেখে জাতি আজ হতবম্ব বাকরুদ্ধ। তার পর সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতালের করোনা সার্টিফিকেট জালিয়াতি, বিশ্ব বাসির কাছে পুরো জাতিকে কলংকিত করেছে।এ ভাবে আর কতোদিন চলবে ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় দুর্নীতিবাজদের মহড়া? এরাই আজ ফ্রন্টলাইনের করোনা যোদ্ধা হতে চায়!

রোগটি যেহেতু সংক্রমণ ব্যাধি নামে পরিচিত সেই হিসেবে ডাক্তার-নার্সরাও চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। আর এটা হওয়া সাভাবিক কারণ এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শত শত ডাক্তার করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। শুধু তাইনয় বাংলাদেশেও সর্বপ্রথম সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের একজন সিনিয়র ডাক্তার ডাঃ মঈনুদ্দিন দুনিয়া ত্যাগ করে পরপারে চলে গেছেন। এতে আমাদের দেশের ডাক্তারদের কাছে বিষয়টি আরও আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

দূরের কথা বলব কি আমাদের চাঁদপুরের এক রোগীর কাছে শুনা, ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে বসেছেন, আর সম্ভবত রোগির কাশি আসছে, ডাক্তার সাহেব চেয়ার থেকে উঠে পিছনের দরজা দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।ঐ রোগী ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেও চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ হয় নাই। কিছু কিছু ডাক্তার প্রাইভেট চেম্বারে রোগী ভীড়ানোর জন্য ভাড়া করা লোক কিংবা রিক্সার ড্রাইভার দালাল হিসেবে নিযুক্ত করতেন। তারাই করোনা কালীন সময়ে চেম্বারে ভাড়া করা লোক নিযুক্ত করেছেন রোগী থেকে ডাক্তারদের দূরে রাখার জন্য।কি আজিব!

কিছু ডাক্তারের সাথে আলাপ করলে তারা বলেন যে ভাই আমি বাঁচলে তো চিকিৎসা, আমি না বাঁচলে চিকিৎসা দিবে কে? আগে আমাকে বাঁচাতে হবে।

যাক বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আচঁ করতে পেরে ডাক্তারদের জন্য মোটা অঙ্কের প্রণোদনার অফার দিলেন। করোনায় আক্রান্ত হলে কি, মারা গেলে কি দিবেন তার বিস্তারিত উল্লেখ করলেন এবং কিছুটা হুমকি স্বরূপ বলে দিলেন, যে সমস্ত ডাক্তারগণ চেম্বার করবেন না তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। এর পরে কিছুটা হলেও চিকিৎসার বিষয়টা স্বাভাবিক হয়েছে।

এরই মধ্যে মৃত্যুর তালিকায় যোগ হতে থাকলো এ মহা দুর্যোগে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্বেরত ডাক্তার সেনাবাহিনী পুলিশ ও মিডিয়াকর্মীদের নাম।টকশোতে অনেক সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ এদেরকে করোণা যোদ্ধা হিসেবে সম্বোধন করেন, অনেকে স্বীকৃতিও দেন। করোনায় মৃত ব্যক্তির দাফন কাফনে যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের ব্যাপারে মিডিয়া পাড়ায় তেমন কোন মাতামাতি নেই।আমি মনে করি সর্বশেষ যে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তাহলো ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী দাফন বা সৎকার করা।কারন এখানে স্ব স্ব ধর্মের নিয়ম নীতি দোয়া কালাম বা মন্ত্রপাঠের বিষয় রয়েছে যা প্রশাসন বা স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্বারা নিয়ম রক্ষা করে দাফন বা সৎকার সন্ভব হবেনা।

জানাজা দাফনের এ বিভাগে যারা কাজ কেরছেন তারা সবাই নিজস্ব ধর্মীয় জ্ঞান নিয়ে নিয়ম মেনেই করছেন।
ইহাছাড়া সবাই এখানে সিভিল সোসাইটি। তারা সরকারের কোন পর্যায়ের এম্প্লয়ী নয় যে,তারা কোন প্রকার সরকারি প্রণোদনা বা প্রমোশনের প্রত্যাশী।

কয়েকটি সেচ্ছাসেবী সংগঠন এ কাজের আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর আমির হযরত পীরসাহেব হুজুর চরমোনাইর নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনের নেতা কর্মীরা অত্যন্ত আন্তরিকতা ও দক্ষতার সাথে দেশব্যাপী এ কাজের আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। চাঁদপুরের কথাই যদি আমি বলি করোনার সূচনালগ্নে অনেক রাজনৈতিক ও সেচ্ছাসেবী সংগঠন জীবনঝুঁকিপূর্ন এ সেবামূলক কাজ করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুত দিয়েছিলেন। পিপিএ পরিহিত অবস্থায় যাদের ছবি সোশ্যাল মিডিয়া ও পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে। কিন্তুু দূঃখের বিষয় হলো চাঁদপুরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর সেচ্ছাসেবক টিমের মাধ্যমে একশর অধিক লাশ দাফন হয়ে গেল, আজ পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলনের কর্মী ব্যাতিত উল্লেখ করার মতো কাহাকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি।তারপরেও এ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যাহারা আগ্রহ দেখিয়েছেন কিংবা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে যে যার অবস্থান থেকে যতটুকু করছেন আমরা সকালের কাছেই কৃতজ্ঞ।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ চাঁদপুর জেলার নেতৃত্বে ৮টি উপজেলায় ১১টি টিমে মোট ১৫০ জন সেচ্ছাসেবক নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। টিম গঠনের ক্ষেত্রে উৎসাহ ও সহযোগীতা যুগিয়েছন, বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটি চাঁদপুর জেলার সম্মানিত সাধারণ সম্পাদক, মাওলানা যোবায়ের আহমাদ।

তারা কোন বিনিময়ের আসায় নয়। বিবেকের তাড়নায়,সামাজিক দায়বদ্ধতা,মানবিক দায়িত্ববোধ সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে এ মহান দায়িত্বটি পালন করে যাচ্ছেন। যত গভীর রাতই হোক না কেন, সিভিল সার্জন অথবা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বা কোন জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে মৃত্যুর সংবাদ আসামাত্রই (আই,এ,বি) সেচ্ছাসেবী টিম নিজের বাবা-মা ভাই-বোন এর মতো অতি আপনজনের ন্যায় দরদমাখা সেবার মনোভাব নিয়ে ছুটেযান হাসপাতাল কিংবা মৃত ব্যক্তির বাড়িতে।

এ কাজের ব্যাপারে প্রত্যেকের পরিবার থেকেই কমবেশি বাঁধা ছিল বা আছে। কে কি ভাবে পরিবারকে ম্যানেজ করেছেন জানিনা। আমি যে ভাবে ম্যানেজ করেছি একটু শেয়ার না করলেই নয়। বিগত ১৬/০৪/২০২০ সর্বপ্রথম আমাদের পাশের গ্রাম কমলাপুর আব্দুর রহমান মিন্টুর লাশ দাফন করতে হবে। সদর উপজেলা টিম সমন্বয়কারী আনোয়ার ভাইকে বললাম যোগাযোগ করেন কে কে যেতে আগ্রহী। অনেকের সাথেই যোগাযোগ হয়েছিল বিভিন্ন ওজর আপত্তিতে অনেকেই পাশকাটিয়ে গেছেন । শেষ পর্যন্ত আমি,মাওঃ আনোয়ার আল নোমান , শাহ জামাল গাজি সোহাগ, মাওঃ আক্তার হোসাইন ও আসাদ উল্লাহ সুমন এ পাঁচজন। সবাই আমার আল কারিম টাওয়ার এর অফিসে এসে পরামর্শ করলাম। মহব্বতের কারনেই অনেকে বললো ভাই আপনার যাওয়ার প্রয়োজন নাই, আপনি দূর থেকে দিকনির্দেশনা দিলেই আমরা কাজ করতে পারবো।তখন আমি বললাম আমার দায়িত্ব যাইহোক আমিও আপনাদের মতো একজন কর্মী। অবশ্যই আমি আপনাদের সাথে টিম প্রধান হিসাবে যাব এবং কাজও করবো।

যাক দুপুর ১টায় আমাদের টিম উপজেলা সাস্থ্য কর্মকর্তার কাছে যাওয়ার পর আমাদের জন্য সাস্থ্য সুরক্ষা সরাঞ্জামাদী রেডি করতে আমরা জোহরের নামাজ আদায় করে নিলাম। সিভিল সার্জন অফিস থেকে গাড়ি আসলো আমাদেরকে নিয়ে চললো মৃত ব্যাক্তির বাড়ীতে।সেখানে গিয়ে পিপিএ পরলাম, আসলে পিপিএ জীবনে পড়াতো দুরের কথা চিনিওনা!
করোনা হয়তো পিপিই ‘র” সাথে আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।যাক আমার প্রথম কাজটিতে যাওয়ার মূলকারণ হলো, করোনর লাশ দাফন নিয়ে যে আতঙ্ক সেই আতঙ্কের দেয়াল ভেঙ্গে দেয়া এবং কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করা।

মূলত এ আতংকের দেয়ালের মজবুতি কোন অংশেই কম ছিলানা। যেমন আমার ছোট মেয়ে সাড়ে তিন বছর বয়স, সে আমাকে বলে বাবা তুমি বাইরে যেও না, বাইরে গেলে তোমার খবর আছে! আমাদের আর একজন স্বেচ্ছাসেবক সোহাগ তার পাচঁ বছরের ছেলে তাকে বলে বাবা করোনায় আমরা মারা গেলে তোমার উপর দাবি আছে!বুঝা গেল এর প্রভাব শুধু বড়দের মাঝেই নয় ছোটদের মাঝেও পড়েছে।যাক দাফন শেষে পিপিই খোলার পর প্রতিবেশী অনেক আত্মীয়-স্বজন আবেগাপ্লুত হয়েছেন এবং আপ্যায়নের জন্য দাবী জানিয়েছেন, ওদের সংক্ষিপ্ত আবদার রক্ষা করে,একটি অটো রিজার্ভ করে চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হই যেহেতু প্রশাসনের গাড়ি আমাদেরকে রেখেই চলে গেছেন।

পরেরদিন অবশ্য সদর উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের UHFPO ডাঃ সাজেদা বেগম পলিন আমাদেরকে রেখে আশার কারনে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং আমাদের যাতায়াত ভাড়া বাবদ সোহাগের মাধ্যমে ১০০০ টাকা দেওয়ার কথা বলেছিলেন, আমরা তা গ্রহন না করে বলেছি, আলহামদুলিল্লাহ আমাদের মাধ্যমেই তা ব্যাবস্থা হয়েছে অসুবিধা নেই।

 

ঐ দাফনের কিছু ফুটেজ এবং আমার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের ভিডিও আমার মোবাইলে ধারণ করা ছিল। পরের দিন দুপুরে আমার ছোট মেয়ে আমার মোবাইল ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে ওই ভিডিওটা অন করে দিছে ওর আম্মুও কাছে ছিল কন্ঠ শুনে বুঝতে পারছে আমি, কিন্তুু চিনতে পারে নাই কারন পিপিই সহ সুরক্ষা সেফটি দ্বারা পুরো দেহ আবৃত। আমাকে বললো তুমি কি দাফনে গিয়েছিলে?

মনে হয়, এ কথা শুনার পর হঠাৎ পাশের রুমে গিয়ে অচেতন হয়ে পড়েগেল।মাথায় তেলপানি দিয়েও হুশ পিরাতে সময় লেগেছে ৯ ঘণ্টা। মূলত স্বামীর মহব্বত আর করোনা আতংকের কারনেই এ ঘটনা ঘটেছে। একটু হুশ ফেরার পর বললো আমি এমনিতেই অসুস্থ তোমায় চিন্তায় আরো আগেই মরে যাব। তুমি দাফনে না গেলে হয়না?
আমি বললাম,এতবড় নেকের কাজে না যাওয়া কি ঠিক হবে? এ সময়ের সবচেয়ে মানবতার কাজ হলো এটা। এতবড় সাওয়াবের কাজে আমাকে নিরুৎসাহিত করিওনা।আমরা শতভাগ সাস্থ্যবিধি মেনে আল্লাহর রাসুলের শিখানো দোয়া পড়ে,তারপর আল্লাহর উপর পূর্ন ভরসা করছি। অতএব দোয়া করতে থাক এ কাজ করার তৌফিক আল্লাহ্ যেন আমাকে দান করেন। তারপর তুমিতো আমার তবিয়ত জান, ভালো কাজ বা নেকের কাজের ক্ষেত্রে দুনিয়ার স্রোতের উলটো দিকে চলাই আমার অভ্যাস, আলহামদুলিল্লাহ এটা ছোট বয়স থেকেই।

 

শুকরিয়ার বিষয় হলো তারপর থেকে ধারাবাহিক কাজে সে আমাকে যে সহযোগীতা করেছ বনর্নায় শেষ হবেনা। যেমন, বাহিরে থাকলে বাসায় আসার আগে যদি জানতো কোন দাফন সেরে আসছি তাহলে, গোসলের গরমপানি,খাবারের গরমপানি এমনকি রং চা সবই প্রস্তুত রাখতো। আলহামদুলিল্লাহ, এখনতো কাজের একটা ধারাবাহিকতা আসছে। ইসলামী আন্দোলন ও সহযোগী সংগঠনের অনেক দায়িত্বশীল, সদস্যরা কাজের সাথে যুক্ত হয়েছেন।এখন অধিক রাতে কাজ করালাগেনা। গভীর রাতের কয়েকটি কাজ এবং সেচ্ছাসেবকদের কষ্টের বিষয়টা যখন সিভিল সার্জন এর সাথে আলাপ করলাম তখন সিভিল সার্জনও আমাকে বললো ভাই রাত ১০টার পর আর কোন দাফনের বিষয়ে বলবোনা সকাল থেকে হবে,এতে আপনাদের অনেক কষ্ট হয়। আমি বললাম এটাই ভালো হবে।

সুন্দর বা রুচিশীল কোন বাক্য আমাদের সামনে আসলেই আমরা মূহুর্তের মধ্যে ভাইরাল করে দেই।এর অর্থ বুঝার সময়টুকুও আমাদের কাছে থাকে না। যেমন করোনার শুরুতে বলা হয়েছিল সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সব কাজ করতে হবে। পরে দেড় দুই মাস পরে একজন ডাক্তার বললেন সামাজিক দূরত্ব নয় শারিরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। সমাজ থেকে সমাজের দূরত্বতো এমনিতেই আছে। ব্যাক্তি থেকে ব্যাক্তির দূরত্ব প্রয়োজন।

যেমন এখন খুব বেশি মাতামাতি করোনা যোদ্ধা নিয়ে। কে প্রথম সারির, কে মধ্য সারির, কে পীচনের সারির। আমাদের জানা প্রয়োজন যু্দ্ধ ছাড়া যোদ্ধা হওয়া যায়না। কোন যুদ্ধ সংঘঠিত হওয়ার জন্য প্রথম শর্ত হলো দৃশ্যমান প্রতিপক্ষ থাকা। উভয়ে যুদ্ধের জন্য ঐক্যমত্য হয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহন করা। এখানে কে কারসাথে যুদ্ধ করে যোদ্ধা হতে চাচ্ছেন? একদিন টকশোতে একজন সন্মানিত অতিথি বললেন, করোনা এমন একটি শক্তি, যা দেখা যায়না, ধরা যায়না,ছোঁয়া যায়না অথচ এটোম বোমার মতো আমাদের সামনে বসে আছে!
আজ এ মহাবিশ্বের নভোমন্ডল ভূমন্ডল, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, আসমান জমিন,পাহাড় পর্বত, সমূদ্র অরণ্য যা কিছু আছে আমাদের দেখার বাহিরেই মহান আল্লাহ্ পাক রাব্বুল আলামিন সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিক ভাবে পরিচালনা করে আসছেন।

করোনাতো এমনই এক বৈশ্বিক মহা-শক্তি যার কাছে বিশ্বের সকল পরাশক্তি পরাজিত । বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতিরা আত্মসমর্পণ করেছে। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা স্বয়ং আল্লাহর সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করার শামিল। করোনার মোকাবেলা করা স্বয়ং আল্লাহর সাথে মোকাবেলা করার নামান্তর। গোলাম কখনো মালিকের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে না কারণ গোলামের রিজিক মালিকের পায়ের তলার সাথে সম্পৃক্ত। যেদিন মালিক নাখোশ হয়ে যাবে এক লাথি মেরে তার বাসভবন থেকে বের করে দিবে। আমাদের উপর মাওলার অফুরন্ত রহমত দ্বারা আবৃত্ত থাকার কারনে দৈনন্দিন শত অবাধ্যতার কারনেও আমাদেরকে ধ্বংস করেন না!
তাই আমরা করোনা যুদ্ধা হতে চাইনা,মানবতার কাণ্ডারি হতে চাই।

 

যারা জীবন সঙ্গিনীর প্রিয়তম ব্যাক্তিকে মানব সেবায় উজাড় করে দিতে পারেন! যারা করোনাকালীন বাস্তব জীবনঝুকিমিশ্রিত সময়ে বিছানাকে পৃথক করে নেয়নি! যারা আমার ঐ স্বার্থপর বোনের মতো স্বামীর করোনা পজেটিভ দেখে বাপের বাড়ী চলে যায়নি!যারা ঐ পাষণ্ড নারীর মতো স্বামীকে নির্জন কক্ষে রেখে বাহির থেকে তালা মেরে মৃতুর মুখে ঠেলে দেয়নি! যারা স্বামীর পজেটিভ রিপোর্ট দেখে স্বামীকে তার নিজের ঘরের দরজায় প্রবেশ করতে দেয়নি,মৃতুর পরমান দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে স্বামীর বোনের বাড়ীতে!

যারা নিজের কলিজার টুকরা সন্তানকে এ কাজের জন্য ওয়াকফ্ করে দিয়েছেন! যারা নিজের স্বামীকে মানবতার জন্য উজাড় করে দিয়েছেন! যে মহিয়শী নারী স্বামী করোনা পজেটিভ নিয়ে আইশোলেশন ওয়াডে থাকা কালে জাগতিক আইন কানুন ও মৃত্যুভয় যাকে সেই বেড থেকে সরাতে পারেনি। রাত্রিযাপন হতো একই বেডে পিঠেপিঠ লাগিয়ে!

 

তার উক্তি ছিল পৃথিবীর পারিবারিক বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্নকারী মহিলাদের শিক্ষা দেয়ার মতো। “স্বামী থাকলে আমার অনেক মূল্য, স্বামী না থাকলে আমার দু পয়সার মূল্য নেই”এ কথা সে মহিলাই বলতে পারে যে স্বামীকে পরম শ্রদ্ধার সাথে অন্তর থেকে ভালোবাসে।এ সমস্ত দম্পতির কাছে পৃথিবীর অঢাল টাকা আর সোনা রুপার বিশাল মজুদ না থাকলেও তাদের কাছে আছে শান্তি সুখের বিশাল হিমালয়। যার আসল বাস্তবতা হলো ইসলামী পারিবারিক জিন্দেগী।

করোনা কালীন সেবার ক্ষেত্রে প্রশাসন, ডাক্তার, নার্স ও বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর কিছু বিধিবদ্ধ আইনি দায়বদ্ধতা ও বর্ধিত অর্থের বিষয় ছিল।কিন্তুু, আমার মা বোন যারা সকল লোভ লালসার উর্ধ্বে উঠে, নিজের নফ্স বা মনের সাথে জিহাদ করে, দেশের চরম সংকটকালীন সময়ে, মানবতার কল্যানে মরনব্যাধি করোনার দুয়ারে আমাদেরকে বিলিয়ে দিয়েছন, আমাদের আগে, তাদেরকে মানবিক যুদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া যেতে পারে।

তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সহযোগীতার কারনেই আমাদের জন্য এ কাজ করা সহজ হয়েছে। তাই করোনা যুদ্ধা নয় মানবতার স্বীকৃতি চাই। মানবাধীকার সংগঠন করে সভা, সমাবেশ, সেমিনার সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে মানবতাবাদী হওয়া যায়না। সংকটকালীন মূহুর্তে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ ভাবে তাদরকে কাঙ্খিত সেবা দিতে হয়।
.

লেখক : সভাপতি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ চাঁদপুর জেলা ও টিম প্রধান, দাফন-কাফনে নিয়োজিত সেচ্ছাসেবক টিম চাঁদপুর, জেলা।
joynal.abdin2007@gmail.com

.