আত্মরক্ষা অপরাধ নাকি অধিকার?
- Update Time : ১২:২৫:০৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১ জুলাই ২০২০
- / 141
জিসান তাসফিক:
মানুষ একটি জীব মানে এর জীবন আছে সেই সাথে জন্ম ও মৃত্যু আছে। এর পরে নিথর দেহ কে সমাহিত করা হয় অথবা পোড়ানো হয়। এটা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু বর্তমানে সমাজে বসবাসকারী মানুষের আচরণ এমন হয়েছে যে, একজন আরেকজনকে হত্যা করা শুরু করেছে। এটাও এখন দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে। শুধু তাই নয় হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন, শারীরিক যখম, ধর্ষণ প্রতিনিয়ত হয়। কিন্তু আমরা কি এমন সমাজ চেয়েছিলাম যে মানুষ মানুষকে হত্যা করবে, এরূপ পাশবিক আচরণ করবে কিংবা আমাদের প্রতিনিয়ত জীবনের ভয়ে থাকবে ?
.
বিবিসি বাংলার এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়,
২০১৮ সালে ধর্ষণের চেষ্টা ৫৩, হত্যা ও হত্যার চেষ্টা ২৭৬, অপহরণ ৯৮। পরিসংখ্যানে ছিনতাইকারীদের শাস্তির এমন চিত্র উঠে এলেও পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি, মাঝে মধ্যে কিছু ঘটনা ঘটলেও পুলিশের তৎপরতার কারণে ছিনতাইয়ের হার কমে আসছে। ২০১৪ সালে ঢাকায় ২৫৬টি মামলা হলেও পরের বছর ১৭২টি মামলা হয়েছে। ২০১৬ সালে ১৫০টি ছিনতাই মামলা হলেও গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১৪২টি ছিনতাই মামলা রেকর্ড করা হয়েছে।
.
এছাড়া নানান ধরনের ফৌজদারী অপরাধ আছে যা সমাজে প্রতিনিয়ত হতে থাকে এবং মানুষ ভাবতে পারে না আসলে এমন ঘটনা ঘটলে কি করবে? যার ফলে সেও ভুক্তভোগী হয়ে। এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা।
.
ধরুন, রাতে আপনি বাসায় ফিরতেছেন, দূর্বৃত্তরা আপনাকে যখম করে আপনার জিনিস পত্র নিয়ে গেল, আপনার কি কিছু করার থাকবে না। কিংবা আপনার প্রতিবেশি আপনাকে মারতে আসল, তবে সেক্ষেত্রে আপনার কি করণীয় ? আসলে মুভির মত ভাবলে চলবে না, কারণ কল্পণা আর বাস্তবতা এক না।
.
তবে বাংলাদেশের আইনে আপনাকে আত্মরক্ষার করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আপনার জীবন এর কোনো প্রকার ক্ষতি যাতে না হয় এবং আইনের আশ্রয় লাভ করতে পারেন তার জন্য সরকারি সহযোগিতার ব্যবস্থা ও আছে। এগুলো আপনার জানা প্রয়োজন।
.
আত্মরক্ষার আইনঃ
বাংলাদেশের দন্ডবিধি ( ১৮৬০) এর ৯৬ ধারা মতে ব্যক্তিগত আত্মরক্ষা আইনত অধিকার। আপনার উপর কেউ হামলা করলে আপনি নিজের আত্মরক্ষার করতে পারবেন। আবার ৯৭ ধারা অনুযায়ী আপনি নিজেকে অথবা অন্য যে কোনো ব্যক্তিকে আত্মরক্ষা বা সম্পত্তি অধিকার আছে এছাড়াও
(১) এমন আঘাত বা আক্রমন যা প্রতিহত না করলে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুই হবে অনুরূপ আক্রমনের পরিনতি।
(২) এমন আঘাত বা আক্রমন যা প্রতিহত না করলে গুরুতর জখমের আশংকা অনিবার্য।
(৩) ধর্ষণের অভিপ্রায়ে আক্রমণ।
(৪) অস্বাভাবিক বা অপ্রাকৃত কাম লালসা চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে আক্রমণ।
(৫) মনুষ্যহরণ বা অপহরণের অভিপ্রায়ে আক্রমণ।
.
কিন্তু ৯৯ ধারাতে আবার বলা আছে যে সরকারি কোনো আদেশ বা আদালতের কোনো আদেশে সরকারি ব্যক্তি পালন করতে আসে এরূপ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার কোনো অনুমতি নাই। উদাহরণ সরুপ কোনো দন্ডিত বা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে আসলে সেক্ষেত্রে আত্মসমর্পণ করতে হবে, বাধা দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। যদি বাধা প্রদান করে তবে যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণকরা আইন যোগ্য হবে। আবার সরকারি কাজের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম আছে যা সাংবিধানিকে উল্লেখ আছে সেটা হল সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ মোতাবেক কোন গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে গ্রেফতারের কারন জ্ঞাপন না করে প্রহরায় আটক রাখা যাবে না এবং উক্ত ব্যাক্তিকে তার মনোনিত আইনজীবীর সাথে পরামর্শ ও তার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হতে বঞ্চিত করা যাবে না। গ্রেফতারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের ২৪ ঘন্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে এবং আদালতের আদেশ ব্যতীত তাকে উক্ত সময়ের অধিককাল আটক রাখা যাবে না। এছাড়া ও দন্ডবিধিতে আরও একাধিক ধারাও উল্লেখ আছে যাতে আরও বিস্তারিত কথা উল্লেখ আছে, আপনাদের অবগতিতে যতটুকু প্রয়োজন উল্লেখ করেছি।
.
আবার একটি আত্মরক্ষার যেমনি আইনত অধিকার তেমনি হত্যা করা বা এর চেষ্টা করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যু দন্ড ( পেনাল কোড, ২৯৯ – ৩০২ )। এ নিয়ে বিখ্যাত মামলা আছে যা আইনের শিক্ষার্থীদের পড়ে থাকে সেটা হলঃ (পেশোয়ার মামলা), আসামী তার আত্মরক্ষার জন্য প্রথমে রিভলবার হতে একটি গুলি ছোড়েন। অতঃপর তিনি আরেকটি গুলি তার আক্রমণকারীর দিকে ছোড়েন।
.
কিন্তু আদালত হতে সিদ্ধান্ত হয় যে আসামী তার প্রথমগুলি আত্মরক্ষার্থে করেছিল এবং এতে কোনো দোষ হয় নি। গুলি ছোড়ার পরে আক্রমণকারীর আর তার দিকে অগ্রসর হওয়ার মত সামর্থ্য ছিল না। সুতরাং দ্বিতীয় গুলিটি আসামীর আত্মরক্ষার মধ্যে পরে না। তাতে তিনি ৩০৪ ধারায় অপরাধ করছেন।
.
দন্ডবিধি ৩০৪ ধারা অনুযায়ীঃ ২৯৯ ও ৩০০ ধারা অনুযায়ী খুন নয়, এর নরহত্যার ক্ষেত্রে আসামী যাবৎজীবন কারাদণ্ড অথবা যে কোনো মেয়াদের কারাদণ্ড সেই সাথে অর্থদণ্ড ও দন্ডিত হতে পারেন।
.
আবার কোনো ব্যক্তি যদি যাবৎজীবন কারাদণ্ড পেয়ে থাকে এবং পরবর্তীকালে সে এরূপ অভিযোগে অভিযুক্ত ও এটা প্রমাণিত হয় তবে পরবর্তীকালে তার সাজা মৃত্যুদণ্ড (পেনাল কোড – ৩০৩)। সুতরাং আত্মরক্ষার নামে কেউ যদি আইনের অপপ্রয়োগ করে তবে সে আইনের শাস্তি অবশ্যই পাবে। কেন না আসামী পক্ষ আর ভুক্তভোগী উভয়ের পক্ষে আইনজীবী ও নিরপেক্ষ হিসেবে বিচারক থাকে, এছাড়াও পুলিশের তদন্ত থাকে, আবার বিচারক নিজেও আলাদা ভাবে অন্যদের মাধ্যমে ইনকোয়ারি করাতে পারে। সুতরাং আত্মরক্ষামূলক আইন হয়েছে আত্মরক্ষার জন্য, অপপ্রয়োগের জন্য নয়। আইন লঙ্ঘন দন্ডনীয় অপরাধ।
.
শুধু এখানেই নয়, যে কেউ আপনাকে যদি হত্যা বা ক্ষতিকরার বা এমন কিছু হুমকি প্রদান যা আইনত নিষিদ্ধ তবে থানায় জিডি কিংবা মামলা করতে পারেন। এর জন্য কোনো সরকারি খরচ নেই। যদি থানায় সম্ভব না হয় তবে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন। এখানে আপনার মামলা দাখিল হবেই। এছাড়াও আপনার কাছে জীবননাশের হুমকি ও উপযুক্ত কারণ থাকে তবে সরকারিভাবে সুরক্ষা চেয়ে আবেদন করতে পারেন। সেক্ষেত্রে, পুলিশ সুপার অথবা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার অথবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন। তবে নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে অবশ্যই কোনো বিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ নিবেন, কেননা আপনার একটি ভুল পদক্ষেপ সারাজীবনের জন্য আপনার ক্ষতির কারণ হতে পারে।
.
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ,বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
.
Tag :