যা ঘটেছিল সেই ভয়াল ২১ আগস্টে
- Update Time : ০১:১৩:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ অগাস্ট ২০২১
- / 193
নিজস্ব প্রতিবেদক
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। দিনটি ছিল শনিবার। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখছিলেন দলের সভাপতি ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। বিকেল ৫টা ২২মিনিটে বক্তৃতা শেষে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ উচ্চারণ করে তিনি তার হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে এগুচ্ছিলেন মঞ্চ থেকে নামার সিঁড়ির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে একটি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটে।
এই গ্রেনেডটি মঞ্চের পাশে রাস্তার ওপর নিক্ষিপ্ত হয়। এরপর একে একে আরও ১৩টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। আতঙ্কে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে মানুষ। মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ।
বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের সেই শনিবারে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করেছিল বিরোধীদল আওয়ামী লীগ। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আয়োজিত সেই সমাবেশেই একের পর এক গ্রেনেডের বিস্ফোরণে এবং স্প্লিন্টারের আঘাতে মঞ্চের নিচে রাস্তার ওপরে বসা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ অসংখ্য মানুষ লুটিয়ে পড়েন। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পেরে মঞ্চে উপস্থিত ঢাকার তৎকালীন মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হানিফ এবং শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীরা তাৎক্ষণিকভাবে এক মানবঢাল তৈরি করেন এবং তাকে গ্রেনেডের হাত থেকে রক্ষা করেন।
সেদিন ঘটনাস্থলেই ১৬ জন নিহত এবং চার শতাধিক আহত হন। পরে মারা যান আইভি রহমানও। মেয়র হানিফের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়ায় অস্ত্রোপচার করার কথা থাকলেও গ্রেনেডের স্প্লিন্টার শরীরে থাকায় তা আর করা সম্ভব হয়নি। পরে তিনি থাইল্যান্ডের ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সব মিলিয়ে ন্যক্কারজনক এ হামলায় ২৪ জনের প্রাণহানি হয়।
রক্তাক্ত-বীভৎস ওই ভয়াল হামলায় নিহত অন্যরা হলেন শেখ হাসিনার দেহরক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রহমান, হাসিনা মমতাজ, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মোশতাক আহমেদ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসিরউদ্দিন, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম।
গ্রেনেড হামলার সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন জিল্লুর রহমান (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি), আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল জলিল, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কাজী জাফরউল্লাহ, মোহাম্মদ হানিফ ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ আরও কয়েকজন নেতা। আর ট্রাকের পাশেই নিচে ছিলেন ওবায়দুল কাদের, সাবের হোসেন চৌধুরীসহ দলের অন্যান্য নেতারা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ডাকা শান্তিপূর্ণ একটি সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পর মুহূর্তেই পাল্টে যায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ও তৎসংলগ্ন এলাকার দৃশ্য।পুরো এলাকা যেন রক্তগঙ্গায় পরিণত হয়।ছেঁড়া স্যান্ডেল, জুতা, পড়ে থাকা ব্যানার, প্ল্যাকার্ডে রক্ত, পতাকার সঙ্গে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা নারী-পুরুষের নিথর দেহ যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউকে। হামলার পর দেখা যায় কেউ গ্রেনেড বিস্ফোরণে পুড়ে হাত-পা বাঁকা হয়ে মরে আছেন, কেউবা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।
সমাবেশে অংশ নেয়া নেতাদের ভাষ্যে, গ্রেনেড হামলার সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকা দেহরক্ষীরা কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়েন। এ অবস্থায় মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ দেহরক্ষীরা তাকে ধরে ট্রাক থেকে দ্রুত নামিয়ে গাড়িতে তুলে দেন। স্টেডিয়ামের দিক থেকে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নেয়া হয় তাকে। শেখ হাসিনা যখন ঘটনাস্থল ত্যাগ করছিলেন তখনো একই দিক থেকে কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে গ্রেনেড এসে ঘটনাস্থলে বিস্ফোরিত হতে থাকে। একই সঙ্গে চলছিল গুলির শব্দ। এসব গুলি-গ্রেনেড ঠিক কোথা থেকে ছোড়া হচ্ছিল তা বোঝা যাচ্ছিল না। শেখ হাসিনাকে বহনকারী মার্সিডিজ বেঞ্জ তার বাসভবন ধানমন্ডির সুধাসদনে গিয়ে পৌঁছালে দেখা যায়, ওই গাড়ির সামনে-পেছনেও গ্রেনেড ও গুলির আঘাতের চিহ্ন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কী ঘটছে কিছুই বুঝতে না পেরে অনেক নেতাকর্মী এ সময় ছুটে দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে যান। আহতদের মধ্যেও অনেককে ধরে ভেতরে নেয়া হয়। অনেককে দেখা যায় পথে রক্তাক্ত অবস্থায় ছুটোছুটি করতে। গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনায় এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আহতদের হাসপাতালে পাঠাতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় দলীয় নেতাকর্মীদের। এ অবস্থায় রিকশা, অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেট কার, বেবি ট্যাক্সিতে করে আহতদের প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।
বিস্ফোরণের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে আওয়ামী লীগের কর্মীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। একদিকে যখন আহতদের উদ্ধার চলছিল, আরেকদিকে বিক্ষুব্ধ কর্মীরা রাস্তায় যানবাহনে হামলা করছিলেন। বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেল ছুড়ে ভাঙচুর করা হয় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের সিটি ভবনসহ আশপাশের আরও কয়েকটি ভবনের জানালা-দরজা। বাস, মিনিবাস, গাড়ি সামনে যা পাচ্ছিলেন তাই ভাঙতে থাকেন তারা। ২০-২৫টি যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এ সময় শেখ হাসিনার নিরাপত্তাকর্মী বাদে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত কোনো পুলিশ ছিল না। পুলিশ ছিল স্টেডিয়াম প্রান্ত এবং গোলাপ শাহ মাজারের কাছে। বিস্ফোরণের শব্দ শুনে দু-একটি এলাকা থেকে পুলিশ ছুটে আসে এবং ঘটনাস্থল লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে বিক্ষুব্ধ কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে থাকে।
গ্রেনেড হামলায় নিহত ও আহতদের উদ্ধার করতে গিয়ে উদ্ধারকারীরাও আহতদের শরীর থেকে বের হওয়া রক্তে ভিজে যান। ফলে পাশে দাঁড়িয়েও শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না কে আহত আর কে উদ্ধারকর্মী। আহতদের চিৎকার, উদ্ধারকর্মীদের হইচই আর বিক্ষোভকারীদের স্লোগানের শব্দে মিশে যাচ্ছিল অ্যাম্বুলেন্স আর পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দ। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যখন উদ্ধার কাজ চালাচ্ছিলেন এবং স্লোগান দিচ্ছিলেন, তখন উল্টো পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে টিয়ারগ্যাস ছুড়তে থাকে।
বিকেলের পর থেকে রাত যত গভীর হচ্ছিল, পুরো ঢাকা শহরে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। গ্রেনেড হামলার পরই মহানগর পুলিশ সদরদফতরের পক্ষ থেকে নগরীর ২২টি থানা এলাকাতেই টহল ব্যবস্থা আরও জোরালো করার জন্য মাঠপর্যায়ের পুলিশকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপরই শুরু হয় নগরীর অলিগলিতে যানবাহন তল্লাশি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সড়ক এবং স্পর্শকাতর স্থাপনার সামনে অতিরিক্তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এসব এলাকায় বিডিআর টহলও জোরদার করা হয়।
যদিও নেতাকর্মীদের মানবঢাল আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে ঘটনাস্থল থেকে নিরাপদে বাসভবনে পৌঁছে দিয়েছে। তবে তিনি যেন প্রাণ নিয়ে ফিরতে না পারেন তার সব চেষ্টাই করেছিল হামলাকারীরা। তার গাড়ির কাঁচে কমপক্ষে সাতটি বুলেটের দাগ, গ্রেনেড ছুড়ে মারার চিহ্ন ও বুলেটের আঘাতে দুটি চাকা পাংচার হয়ে যাওয়া সেটাই প্রমাণ করে। সুধাসদনে শেখ হাসিনার বাসভবনে গাড়িটি রেখে সাংবাদিকদের দেখান দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও দলীয় সভাপতির রাজনৈতিক সচিব সাবের হোসেন চৌধুরী।
গ্রেনেড হামলার পর থেকে আওয়ামী লীগ প্রতি বছরই এই দিনটি বিশেষভাবে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পালন করে আসছে।
আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ছিল ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাতে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতা; সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও আদর্শের উত্তরসূরি শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক বিএনপি-জামায়াত অশুভ জোটের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান, একাত্তরের ঘাতক মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী (মৃত্যুদণ্ডিত) মতিউর রহমান নিজামী, (মৃত্যুদণ্ডিত) আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি নেতা সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, জঙ্গি নেতা (মৃত্যুদণ্ডিত) মুফতি হান্নানসহ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর নীলনকশায় সংঘটিত হয় নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞ।
আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্য, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এ সংক্রান্ত মামলার সঠিক তদন্ত হয়নি, ষড়যন্ত্রের হোতাদের রক্ষার উদ্দেশ্যে মামলাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে এবং আলামত ধ্বংস করার নানাবিধ ষড়যন্ত্র হয়েছে। এমনকি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় গ্রেনেড হামলা মামলাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজানো হয়।
সময়ের পরিক্রমায় এ ঘটনা নিয়ে দুইটি মামলা চলমান থাকে। একটি হত্যা মামলা এবং অপরটি বিস্ফোরক দ্রব্যাদি আইনের মামলা। দীর্ঘ ১৪ বছর পর ২০১৮ সালে আদালত ২১ আগস্ট দুই মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে জীবিত মোট ৪৯ আসামির মধ্যে ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনের যাবজ্জীবন এবং বাকি ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়।
মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাস্টারমাইন্ড বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ পালাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে আদালতের রায় কার্যকর করতে সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।