কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশাল
- Update Time : ১২:৫৫:২০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ মে ২০২১
- / 197
মো. আশিকুর রহমান সৈকত:
তৎকালীন ভারতের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নিলেও বিদ্রোহী নটরাজ কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। চার সন্তানের অকালমৃত্যুর পর জন্ম হওয়ায় নজরুলের নাম রাখা হয় দুখু মিয়া। বাল্যকালেই পিতা-মাতাকে হারিয়ে নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েন তিনি। এই সময় লেটো গানের দলে গীত রচনা ও সুর সংযোজন করার প্রয়াসের মধ্য দিয়ে নজরুল প্রতিভার প্রথম বিকাশ ঘটে।
১৯১৪ সালে নজরুল প্রতিভায় বিমুগ্ধ দারোগা রফিজউল্লাহর মাধ্যমে প্রথম ময়মনসিংহ আসেন। আলাউদ্দিন আল আজাদের লেখায় পাওয়া যায়, ১৯১৪ সালে কাজী রফিজউল্লাহ দারোগা নজরুলকে ভর্তি করানোর জন্য তাঁর পাশের বাড়ির ছেলে কাজী ইসমাইলের সাথে ময়মনসিংহের সিটি স্কুলে পাঠান। নজরুলের না-কি স্কুলটি পছন্দ হয়েছিল কিন্তু জায়গীর না পাওয়ায় ওই স্কুলে পড়ার সৌভাগ্য হয়নি নজরুলের। একই সালের জুন মাসে কাজী নজরুল ইসলাম ও ছোট ভাই কাজী আবুল হোসেনকে দরিরামপুর ইংরেজি হাইস্কুলে (বর্তমানে নজরুল একাডেমি) ভর্তি করান দারোগা সাহেব।
কাজীর শিমলা গ্রাম থেকে ত্রিশালের দরিরামপুরের দূরত্ব ছিল পাঁচ কিলোমিটার। এই পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে হতো নজরুলকে স্কুলে ক্লাস করার জন্য। বর্ষাকালে রাস্তা চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ত। ফলে স্কুলে যাতায়াতে খুব কষ্ট হতো নজরুলের। এই অসুবিধা লাঘব করার জন্য দারোগা সাহেব ত্রিশালের নামাপাড়ায় তাঁর আত্মীয় কাজী হামিদুল্লাহর বাড়িতে জায়গীর রাখেন নজরুলকে। কিন্তু হামিদুল্লাহ ছিলেন ধার্মিক, পরহেজগার ও গম্ভীর প্রকৃতির লোক। নজরুল নামাজ পড়তেন না, এজন্য তিনি নজরুলকে ঘৃণা করতেন এবং শাসনে রাখতেন।
বিভিন্ন লেখকের লেখা থেকে পাওয়া যায়, কাজীর শিমলায় নজরুল তিন মাস অবস্থান করেছেন। সেখানে অনেক স্বাধীনতা ছিল নজরুলের। কিন্তু জায়গীর বাড়িতে এতো স্বাধীনতা ছিল না। তাই নজরুল বাঁশি বাজানো, গান গাওয়া, রাস্তাঘাট, বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো, একটি বটগাছে চড়ে বাঁশি বাজানো ইত্যাদি করতেন। নজরুল তখন তেমন পড়াশোনা করতেন না। তাই নজরুলকে আশ্রয়হীন হতে হয়। পরে তিনি বিচুতিয়া বেপারীর বাড়িতে জায়গীর থাকেন। বেপারী বাড়ির পূর্ব দিকে একটি ছোট পুকুর ছিল। সেই ঘরেই নজরুল থাকতেন। অবশ্য পুকুরটিতে নজরুল গোসল করতেন না। পাশের বাড়ির আরেকটা পরিষ্কার পানির পুকুরে তিনি গোসল করেছেন। কবির স্মৃতিবিজড়িত এ বাড়িতেই তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে তিনতলা বিশিষ্ট ‘নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র’। প্রথম তলায় অডিটোরিয়াম, দ্বিতীয় তলায় অফিস রুম এবং তৃতীয় তলায় লাইব্রেরি রয়েছে। এছাড়াও কবি যে ঘরে ঘুমাতেন; সেই ঘরটি পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছে। পাশেই একটি পুকুর খনন করা হয়েছে।
নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত দরিরামপুর হাই স্কুলের নাম এখন নজরুল একাডেমি। কবি জীবিত থাকা অবস্থায় এবং জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার আগেই ১৯৬৫ সাল থেকে এ বিদ্যালয় মাঠে জাঁকজমকপূর্ণ নজরুল জন্মজয়ন্তী পালন শুরু হয়। ১৯৯০ সালে এ স্কুল মাঠে রাষ্ট্রীয়ভাবে জন্মজয়ন্তী পালন শুরু হয়। ২০১৮ সালে মাধ্যমিক বিদ্যালয়টিকে সরকারিকরণ করা হয়। এছাড়াও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে রফিজউল্লাহ দারোগা বাড়ির আঙিনায় নির্মাণ করা হয়েছে নজরুল পাঠাগার ও স্মৃতি ভবন। সংরক্ষণ করা হয়েছে নজরুল যে খাটে ঘুমাতেন; সেই খাটটিও।
নজরুল ত্রিশালের নামাপাড়ায় শুকনি বিলের কাছে যে বটগাছে চড়ে বাঁশি বাজাতেন; সেই বটগাছের পাশেই শুকনি বিলের মাঝে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কবির নামে বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। নজরুলের সাহিত্যকর্মের ওপরে গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নজরুল ইনস্টিটিউট। জাতীয় কবির বিভিন্ন গান, কবিতা, উপন্যাস, নাটক সর্বোপরি তার জীবনী এবং জীবনকর্মের ওপর গবেষণা চলমান রাখার জন্য বিভিন্ন শাখায় পিএইচডি এবং এমফিল প্রোগ্রাম কোর্স চালু রয়েছে।
এ ছাড়াও নজরুল চেতনা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে প্রতিটি বিভাগে বাধ্যতামূলক নজরুল স্টাডিজ নামে একটি কোর্স পড়ানো হয়। ক্যাম্পাসজুড়েই যেন নজরুলের ছোঁয়া, নজরুলের স্মৃতি। ‘চির উন্নত মম শির’ নামক স্মৃতিসৌধ আর ‘চক্রবাক’ নামক ক্যাফেটেরিয়াই নয়; বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি আবাসিক হলের নামও নজরুলের সৃষ্টিকর্মের নামে। ‘প্রভাতি’, ‘ঝিঙেফুল’, ‘বিদ্রোহী’ ও ‘প্রলয়শিখা’ বাসের নাম আর দুটি মঞ্চের নাম ‘চুরুলিয়া’, ‘গাহি সাম্যের গান’র পাশাপাশি একমাত্র মেডিকেল সেন্টারের নামও নজরুলের বইয়ের নামে ‘ব্যথার দান’। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রচলিত বৃত্তিগুলোর নামকরণ করা হয়েছে কবিপরিবারের সদস্যদের নামানুসারে, ‘প্রমিলা বৃত্তি’, ‘বুলবুল বৃত্তি’, ‘কাজী অনিরুদ্ধ বৃত্তি’। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে রয়েছে নজরুলের বইয়ের আলাদা কর্নার।
কবি নজরুলের ওপর গবেষণাসহ তার চেতনা, কর্মকে আরও বিস্তৃত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে চলেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ২০১৮ সালের জুলাই মাসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে দুই বঙ্গে কবি নজরুলের নামাঙ্কিত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় সমঝোতা চুক্তি; যার মাধ্যমে নজরুল বিষয়ক গবেষণা বিনিময়, গবেষক বিনিময়, যৌথ গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ, যৌথ নজরুল গবেষণা জার্নাল প্রকাশ, যৌথ নজরুল আর্কাইভস প্রতিষ্ঠিত, যৌথ স্টুডিও ইত্যাদি আরও অনেক বিষয়ের ওপর কাজ হচ্ছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ এবং ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানের ফেরদৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক চুক্তি, যার মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকর্ম ও মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
নজরুল ত্রিশাল থেকে চলে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। কেউ কেউ মনে করেন, নজরুল সপ্তম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে প্রথম কি দ্বিতীয় হয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ফারসি বিষয়ে আটানব্বই পেয়েছিলেন নজরুল। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ফেল করেছিলেন ফারসি বিষয়ে। তাই প্রধান শিক্ষক গ্রেস মার্ক দিয়ে পাস করে দিতে বললে নজরুলও গ্রেস মার্ক দাবি করেন। মার্ক না পেয়ে নজরুল বলেন, ‘যে স্কুলে ন্যায় বিচার নেই, সেই স্কুলে নজরুল পড়বে না।’ এ ঘটনার দু’দিন পরে নজরুল ও আবুল হোসেন ময়মনসিংহে যান। সন্ধ্যা নাগাদ আবুল হোসেন ফিরে এলে নজরুল আর আসেননি।
নজরুল তার বাকি জীবনে পূর্ববঙ্গে (বাংলাদেশে) বহুবার এলেও কখনো আসেননি ময়মনসিংহের ত্রিশাল। এমনকি গফরগাঁওয়ে ১৯২৬ সালের ১৭ ও ১৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ময়মনসিংহ জেলা কৃষক-শ্রমিক সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়েও আসতে পারেননি। তবে শুধু ত্রিশালই নয়, নজরুল সুস্থাবস্থায় এরপর জন্মস্থান চুরুলিয়ায়ও যাননি।
১৯১৭ সালে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে যুদ্ধে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে ফেরতও আসেন। তবে এরপর তিনি একবারের জন্যও চুরুলিয়া যাননি। চুরুলিয়ার সেই বাড়িতে দেয়ালে টাঙানো ছবি বলছে, নজরুল আরও দুবার চুরুলিয়া এসেছিলেন; কিন্তু সে দু’বার তিনি ছিলেন রোগ-পরবর্তী জীবনের। পরিবারের সদস্যরা তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন চুরুলিয়ায়, কিন্তু তিনি জানতেন না যে তিনি চুরুলিয়ায় গিয়েছিলেন।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বারবার পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছুটে আসেন। বরিশাল, কুমিল্লা, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, ফরিদপুর, রংপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, চুয়াডাঙ্গা প্রভৃতি অবিভক্ত বাংলার পশ্চাৎপদ জনপদসমূহের মানুষের কাছে এসেছেন, সভা ও অনুষ্ঠান করেছেন। ওইসব জমায়েতে তিনি জাগরণের কথা বলেছেন, স্বাধীনতার বাণী শুনিয়েছেন, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মন্ত্র দিয়েছেন। অর্থাৎ কাজী নজরুল ইসলাম অবিভক্ত বাংলার বৃহৎ অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে জাগিয়ে তুলেছেন বক্তৃতায়, গানে, আবৃত্তিতে এবং তাঁর বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে। ‘সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবের গানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম যে কলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈবা। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।’ এভাবেই নিজের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে তার সাহিত্যকর্মে ধারণ করেছিলেন।
ধর্মীয় গোঁড়ামি, মানবিকতা, মূল্যবোধ, ভালোবাসাকে যিনি বেঁধেছেন একই সুতোয়, সেই কবি কাজী নজরুলের সাহিত্য অনুপ্রাণিত করবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। তাদের হাত ধরেই কবির স্বপ্নের সোনার বাংলা রূপ ধারণ করবে বাস্তবে। বিদ্রোহী কবি সমাজে যে অনির্বাণ প্রদীপ জ্বালিয়েছেন, তার আলোকচ্ছটায় দূরীভুত হবে সব অন্ধকার। তিনি আজীবন অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন, দেখিয়েছিলেন। তার জীবনাদর্শ অনুসরণ করে একটি অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শান্তিপূর্ণ, সুখী-সমৃদ্ধ ও আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ হোক- বাঙালির আবেগ, অনুভূতিতে জড়িয়ে থাকা চির বিদ্রোহী এ কবির ১২২তম জন্মজয়ন্তীতে এটাই আমার প্রত্যাশা।
লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন ও সরকার পরিচালনা বিদ্যা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।