খুনের আতঙ্কে মেহেন্দিগঞ্জ!

  • Update Time : ১২:১৩:১৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ মে ২০২১
  • / 187

বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে ৪০ দিনের ব্যবধানে ৪টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত হয়েছে আরও অনেকে। ভাংচুর হয়েছে অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি। আর এসব ঘটনায় পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করছেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও স্থানীয় সংসদ সদস্য পংকজ নাথ।

ভবিষ্যতে আরও হত্যাকাণ্ডের আশঙ্কা করছে এলাকাবাসী। তারা বলছেন দলীয়ভাবে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে যতো দেরি হবে ততো লাশের সংখ্যা বাড়বে। পুলিশও বলছে সব সমস্যার সমাধান প্রশাসনের হাতে নেই।

বিয়েবাড়িতে ইট নিক্ষেপ থেকে শুরু

গত ২০ এপ্রিল সকাল ১০টায় মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়ার উত্তর ইউনিয়নের সলদি লক্ষ্মীপুর গ্রামে এক তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দুই ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়। ঘটনার ৩৪ ঘণ্টা পরও কোনও মামলা হয়নি।

ঘটনাটি ঘটেছে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। নিহতরা হলেন, ধুলখোলা ইউনিয়ন যুবলীগের বহিষ্কৃত আহ্বায়ক জামাল ঢালী গ্রুপের সিদ্দিকুর রহমান ও ছত্তার ঢালি। নিহত ছত্তার জামাল ঢালীর চাচাতো ভাই এবং সিদ্দিক ওই বাড়িতে কাজ করেন।

স্থানীয়রা জানায়, ধুলখোলা ই্উনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জামাল ঢালী (জেলা আওয়ামী লীগের অনুসারী) আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী (স্বতন্ত্র) এবং ধুলখোলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কালাম বেপারী (পংকজ নাথের অনুসারী) নৌকার প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন।

নির্বাচনে দুজনই পরাজিত হন। জয়ী হন বিএনপি প্রার্থী। সেই থেকে দ্বন্দ্বের শুরু। কিছু ঘটলেই দুই পক্ষের অনুসারীরা জড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষে।

জামাল ঢালীর পাশের বাড়িতেই তার বোনের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছিল। কে বা কারা ওই বিয়ের বাড়িতে ইট নিক্ষেপ করতে শুরু করে। বিষয়টি জামাল ঢালী জানতে পেরে দলবল নিয়ে কালাম বেপারীর বাড়িতে হামলা চালায়। কালাম ও তার লোকজন পাল্টা হামলা চালালে ঘটনাস্থলেই মারা যান সিদ্দিকুর রহমান। বেশ কয়েকজন আহন হন। এদের মধ্যে ছত্তার ঢালী নামের এক ব্যক্তি গুরুতর আহত হন। বরিশাল নেওয়ার পথে তিনিও মারা যান।

১১ এপ্রিল মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ উলানিয়া ইউনিয়নের সুলতানী গ্রামে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের জেরে সংঘর্ষে দুইজন নিহত হন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১০ জন। সংঘর্ষে ১০/১২টি ঘর ও দোকানপাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

নিহতরা হচ্ছেন, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রুমা বেগমের সমর্থক সাইফুল সরদার (জেলা আওয়ামী লীগের অনুসারী) ও আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী মিলন চৌধুরীর চাচাতো ভাই সাঈদ চৌধুরী (পংকজ নাথের অনুসারী)।

স্থানীয়রা জানান, উলানিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারেক সরদার ও তার লোকজনদের সঙ্গে মিলন চৌধুরী, মিজান মোল্লা, নোমান মোল্লাদের দীর্ঘদিনের বিরোধ চলছে। যাকে কেন্দ্র করে উভয়পক্ষের মধ্যে একাধিক হামলা-মামলার ঘটনাও ঘটেছে।

এরই ধারাবাহিকতায় ঘটনার দিন ভোররাতে মিলন চৌধুরী, মিজান মোল্লা, নোমান মোল্লার নেতৃত্বে শতাধিক কথিত সন্ত্রাসী ধারালো অস্ত্র নিয়ে কালীগঞ্জ বাজার এবং আশপাশের এলাকার বাড়িঘরে অতর্কিতে হামলা চালায়।

এ সময় ধারালো অস্ত্রের কোপে সাইফুল ইসলাম নিহত এবং ১০/১২ জন আহত হন। এ সময় সন্ত্রাসীরা কয়েকটি বাড়ি ভাংচুর করে মালামাল লুট করে।

দক্ষিণ উলানিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান লিটন বলেন, রাত ৪টার দিকে কয়েক শ’লোক একত্রিত হয়ে দেশি অস্ত্র দিয়ে ওই গ্রামে হামলা চালায়। হামলাকারীরা এলাকার দোকান ও ঘরবাড়ি ভাংচুর করে। এলাকার বাসিন্দারা প্রতিরোধ করতে গেলে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে দু’পক্ষের দু’জন মারা যান। কমপক্ষে ১০-১২ জন আহত হন।

হামলাকারীরা উলানিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। তারা চেয়ারম্যান প্রার্থী মিলন চৌধুরীর লোক বলে দাবি করেন হাবিবুর রহমান লিটন।

গত বছর ৪ ডিসেম্বর মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ উলানিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থক ও পুলিশের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষে তিন পুলিশ সদস্যসহ ৩৩ জন আহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ওই সময় পুলিশ ৪৬ রাউন্ড গুলি বর্ষণ করে। দুই পক্ষের সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়। সংঘর্ষে আহত ১০ জনকে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

একই বছরের ৭ ডিসেম্বর উলানিয়া উত্তর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ নেতাসহ ৪ জনকে কুপিয়ে-পিটিয়ে জখম করা হয। এ সময় স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের বাড়িঘর ভাংচুর ও মালামাল লুট করার অভিযোগ রয়েছে।

৮ ডিসেম্বর উলানিয়ার পশ্চিম সুলতানী ও যাদুয়া গ্রামে আনারস মার্কার (বিদ্রোহী) প্রার্থীর নেতৃত্বে নৌকার সমর্থকদের ওপর হামলা চালানো হয়। এতে নৌকার সমর্থকদের ১৯টি বাড়ি, ২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুরসহ ধারালো অস্ত্রের কোপে ২০ জন আহত হন।

Barisal 4 Hotta PIc 21-05-21 [3]নাম প্রকাশ না করা শর্তে আওয়ামী লীগের এক প্রবীণ নেতা বলেন, এখানে আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপকে সরাসরি মদদ দিচ্ছে জেলা আওয়ামী লীগ। অপর গ্রুপটি নিয়ন্ত্রণ করছেন এমপি পংকজ নাথ। এ কারণে পংকজ নাথ জেলার নেতাদের গুরুত্ব দিচ্ছেন না। একইভাবে জেলার নেতারাও পংকজ নাথকে উপেক্ষা করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

ওই নেতা আরও বলেন, তৃণমূল আওয়ামী লীগের দাবি উপেক্ষা করে গত ৬ ডিসেম্বর উলানিয়া করোনেশন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা এক জনসভায় প্রকাশ্যে সংসদ সদস্য পংকজ নাথের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। এর পরেই উলানিয়া ইউনিয়নে চলতে থাকে হামলা-পাল্টা হামলা।

কেউই আলোচনায় আগ্রহী নয়

সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, আওয়ামী লীগ তাদের ক্ষমতা বিস্তারে তুচ্ছ ঘটনায় ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। যার ফলাফল একটি পর একটি হত্যাকাণ্ড।

সাধারণ মানুষ সারাক্ষণ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। সামান্য হাঁকডাক শুনলেই মানুষ এখন নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে। গতবছরের ডিসেম্বর থেকে এ ধরনের সংঘর্ষ ঘটতে থাকলেও সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে জেলা আওয়ামী লীগের কাউকে কোনও উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। কেন্দ্র থেকে উদ্যোগ নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে সমঝোতা বৈঠক করলে চারটি মানুষকে স্বজনরা হারাতো না।

এ ব্যাপারে বরিশালের জেলা পুলিশ সুপার মারুফ হাসান বলেন, রাজনৈতিক ও স্থানীয় প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করেই এ চার হত্যাকাণ্ড। এ ধরনের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় সে জন্য দুই ইউনিয়নে দুটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়েছে।

মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি খোরশেদ আলম ভুলু বলেন, স্থানীয়ভাবে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদকদের হস্তক্ষেপ দরকার। না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।

এ সকল ঘটনার জন্য সংসদ সদস্য পংকজ নাথকে দায়ী করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি তালুকদার মো. ইউনুস।

জবাবে পংকজ নাথ বলেন, ‘গতবছর সাত ডিসেম্বর উলানিয়ায় তালুকদার ইউনুস উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার পর থেকেই রক্তারক্তির শুরু মেহেন্দিগঞ্জে। ইউনুস, বরিশাল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঈদুল ইসলাম এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাড. আফজালুল করিমের ইন্ধনে ওই চার হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। তারা মেহেন্দিগঞ্জে আওয়ামী লীগ ধ্বংস করে বিএনপিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এ জন্য সড়ক দুর্ঘটনা এবং জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে নিহত হওয়ার বিষয়গুলোকে হত্যাকাণ্ড বানিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করছে।’

Please Share This Post in Your Social Media


খুনের আতঙ্কে মেহেন্দিগঞ্জ!

Update Time : ১২:১৩:১৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ মে ২০২১

বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে ৪০ দিনের ব্যবধানে ৪টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত হয়েছে আরও অনেকে। ভাংচুর হয়েছে অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি। আর এসব ঘটনায় পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করছেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও স্থানীয় সংসদ সদস্য পংকজ নাথ।

ভবিষ্যতে আরও হত্যাকাণ্ডের আশঙ্কা করছে এলাকাবাসী। তারা বলছেন দলীয়ভাবে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে যতো দেরি হবে ততো লাশের সংখ্যা বাড়বে। পুলিশও বলছে সব সমস্যার সমাধান প্রশাসনের হাতে নেই।

বিয়েবাড়িতে ইট নিক্ষেপ থেকে শুরু

গত ২০ এপ্রিল সকাল ১০টায় মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়ার উত্তর ইউনিয়নের সলদি লক্ষ্মীপুর গ্রামে এক তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দুই ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়। ঘটনার ৩৪ ঘণ্টা পরও কোনও মামলা হয়নি।

ঘটনাটি ঘটেছে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। নিহতরা হলেন, ধুলখোলা ইউনিয়ন যুবলীগের বহিষ্কৃত আহ্বায়ক জামাল ঢালী গ্রুপের সিদ্দিকুর রহমান ও ছত্তার ঢালি। নিহত ছত্তার জামাল ঢালীর চাচাতো ভাই এবং সিদ্দিক ওই বাড়িতে কাজ করেন।

স্থানীয়রা জানায়, ধুলখোলা ই্উনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জামাল ঢালী (জেলা আওয়ামী লীগের অনুসারী) আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী (স্বতন্ত্র) এবং ধুলখোলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কালাম বেপারী (পংকজ নাথের অনুসারী) নৌকার প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন।

নির্বাচনে দুজনই পরাজিত হন। জয়ী হন বিএনপি প্রার্থী। সেই থেকে দ্বন্দ্বের শুরু। কিছু ঘটলেই দুই পক্ষের অনুসারীরা জড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষে।

জামাল ঢালীর পাশের বাড়িতেই তার বোনের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছিল। কে বা কারা ওই বিয়ের বাড়িতে ইট নিক্ষেপ করতে শুরু করে। বিষয়টি জামাল ঢালী জানতে পেরে দলবল নিয়ে কালাম বেপারীর বাড়িতে হামলা চালায়। কালাম ও তার লোকজন পাল্টা হামলা চালালে ঘটনাস্থলেই মারা যান সিদ্দিকুর রহমান। বেশ কয়েকজন আহন হন। এদের মধ্যে ছত্তার ঢালী নামের এক ব্যক্তি গুরুতর আহত হন। বরিশাল নেওয়ার পথে তিনিও মারা যান।

১১ এপ্রিল মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ উলানিয়া ইউনিয়নের সুলতানী গ্রামে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের জেরে সংঘর্ষে দুইজন নিহত হন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১০ জন। সংঘর্ষে ১০/১২টি ঘর ও দোকানপাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

নিহতরা হচ্ছেন, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রুমা বেগমের সমর্থক সাইফুল সরদার (জেলা আওয়ামী লীগের অনুসারী) ও আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী মিলন চৌধুরীর চাচাতো ভাই সাঈদ চৌধুরী (পংকজ নাথের অনুসারী)।

স্থানীয়রা জানান, উলানিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারেক সরদার ও তার লোকজনদের সঙ্গে মিলন চৌধুরী, মিজান মোল্লা, নোমান মোল্লাদের দীর্ঘদিনের বিরোধ চলছে। যাকে কেন্দ্র করে উভয়পক্ষের মধ্যে একাধিক হামলা-মামলার ঘটনাও ঘটেছে।

এরই ধারাবাহিকতায় ঘটনার দিন ভোররাতে মিলন চৌধুরী, মিজান মোল্লা, নোমান মোল্লার নেতৃত্বে শতাধিক কথিত সন্ত্রাসী ধারালো অস্ত্র নিয়ে কালীগঞ্জ বাজার এবং আশপাশের এলাকার বাড়িঘরে অতর্কিতে হামলা চালায়।

এ সময় ধারালো অস্ত্রের কোপে সাইফুল ইসলাম নিহত এবং ১০/১২ জন আহত হন। এ সময় সন্ত্রাসীরা কয়েকটি বাড়ি ভাংচুর করে মালামাল লুট করে।

দক্ষিণ উলানিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান লিটন বলেন, রাত ৪টার দিকে কয়েক শ’লোক একত্রিত হয়ে দেশি অস্ত্র দিয়ে ওই গ্রামে হামলা চালায়। হামলাকারীরা এলাকার দোকান ও ঘরবাড়ি ভাংচুর করে। এলাকার বাসিন্দারা প্রতিরোধ করতে গেলে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে দু’পক্ষের দু’জন মারা যান। কমপক্ষে ১০-১২ জন আহত হন।

হামলাকারীরা উলানিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। তারা চেয়ারম্যান প্রার্থী মিলন চৌধুরীর লোক বলে দাবি করেন হাবিবুর রহমান লিটন।

গত বছর ৪ ডিসেম্বর মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ উলানিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থক ও পুলিশের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষে তিন পুলিশ সদস্যসহ ৩৩ জন আহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ওই সময় পুলিশ ৪৬ রাউন্ড গুলি বর্ষণ করে। দুই পক্ষের সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়। সংঘর্ষে আহত ১০ জনকে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

একই বছরের ৭ ডিসেম্বর উলানিয়া উত্তর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ নেতাসহ ৪ জনকে কুপিয়ে-পিটিয়ে জখম করা হয। এ সময় স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের বাড়িঘর ভাংচুর ও মালামাল লুট করার অভিযোগ রয়েছে।

৮ ডিসেম্বর উলানিয়ার পশ্চিম সুলতানী ও যাদুয়া গ্রামে আনারস মার্কার (বিদ্রোহী) প্রার্থীর নেতৃত্বে নৌকার সমর্থকদের ওপর হামলা চালানো হয়। এতে নৌকার সমর্থকদের ১৯টি বাড়ি, ২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুরসহ ধারালো অস্ত্রের কোপে ২০ জন আহত হন।

Barisal 4 Hotta PIc 21-05-21 [3]নাম প্রকাশ না করা শর্তে আওয়ামী লীগের এক প্রবীণ নেতা বলেন, এখানে আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপকে সরাসরি মদদ দিচ্ছে জেলা আওয়ামী লীগ। অপর গ্রুপটি নিয়ন্ত্রণ করছেন এমপি পংকজ নাথ। এ কারণে পংকজ নাথ জেলার নেতাদের গুরুত্ব দিচ্ছেন না। একইভাবে জেলার নেতারাও পংকজ নাথকে উপেক্ষা করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

ওই নেতা আরও বলেন, তৃণমূল আওয়ামী লীগের দাবি উপেক্ষা করে গত ৬ ডিসেম্বর উলানিয়া করোনেশন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা এক জনসভায় প্রকাশ্যে সংসদ সদস্য পংকজ নাথের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। এর পরেই উলানিয়া ইউনিয়নে চলতে থাকে হামলা-পাল্টা হামলা।

কেউই আলোচনায় আগ্রহী নয়

সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, আওয়ামী লীগ তাদের ক্ষমতা বিস্তারে তুচ্ছ ঘটনায় ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। যার ফলাফল একটি পর একটি হত্যাকাণ্ড।

সাধারণ মানুষ সারাক্ষণ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। সামান্য হাঁকডাক শুনলেই মানুষ এখন নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে। গতবছরের ডিসেম্বর থেকে এ ধরনের সংঘর্ষ ঘটতে থাকলেও সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে জেলা আওয়ামী লীগের কাউকে কোনও উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। কেন্দ্র থেকে উদ্যোগ নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে সমঝোতা বৈঠক করলে চারটি মানুষকে স্বজনরা হারাতো না।

এ ব্যাপারে বরিশালের জেলা পুলিশ সুপার মারুফ হাসান বলেন, রাজনৈতিক ও স্থানীয় প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করেই এ চার হত্যাকাণ্ড। এ ধরনের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় সে জন্য দুই ইউনিয়নে দুটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়েছে।

মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি খোরশেদ আলম ভুলু বলেন, স্থানীয়ভাবে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদকদের হস্তক্ষেপ দরকার। না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।

এ সকল ঘটনার জন্য সংসদ সদস্য পংকজ নাথকে দায়ী করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি তালুকদার মো. ইউনুস।

জবাবে পংকজ নাথ বলেন, ‘গতবছর সাত ডিসেম্বর উলানিয়ায় তালুকদার ইউনুস উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার পর থেকেই রক্তারক্তির শুরু মেহেন্দিগঞ্জে। ইউনুস, বরিশাল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঈদুল ইসলাম এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাড. আফজালুল করিমের ইন্ধনে ওই চার হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। তারা মেহেন্দিগঞ্জে আওয়ামী লীগ ধ্বংস করে বিএনপিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এ জন্য সড়ক দুর্ঘটনা এবং জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে নিহত হওয়ার বিষয়গুলোকে হত্যাকাণ্ড বানিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করছে।’