মানবিক কাজের ফেরিওয়ালা পারভেজ

  • Update Time : ০৮:১১:৪০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ মে ২০২১
  • / 348

 

মাত্র ১২ বছর বয়সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়া ছেলেটি এখন অসংখ্য অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান। ২০১৮ সালে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার অল্প সময়ের মধ্যে ৩১টি জেলায় করেছেন শাখা। সম্প্রতি সহমর্মিতা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও মানবিক মানুষ পারভেজ হাসানের সঙ্গে কথা হয় বিডিসমাচার এর। বিস্তারিত জানাচ্ছেন মো. আনিসুল ইসলাম—

শৈশব ও সংগ্রাম
পারভেজের শৈশব কাটে নানা বাড়িতে। পরিবার থাকে ঢাকায়। স্কুলে ভর্তি করানোর কথা বলে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। পড়াশোনা ও খেলাধুলায় পারদর্শী ছেলেটিকে দেওয়া হয় মামার চায়ের দোকানে। সেখানে বন্দিজীবন অসহ্য লাগে। এসব দেখে হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার ভূত চাপে মনে! ১২ বছর বয়সে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। চায়ের দোকানের পাশের ব্রিজে উঠে লাফ দেবেন, এমন সময় ছুটে আসে সমবয়সীরা পথশিশু। তাদের মধ্যে একজন ধরে নামায়। আস্তে আস্তে বন্ধুত্বের শুরু হয়।

No description available.

পারভেজ চায়ের দোকানে কাজ করার সুবাদে খাওয়া-থাকার জায়গা পায়। কিন্তু পথশিশুরা তা-ও পায় না। তাহলে তিনি ওদের থেকে ভালো আছেন। পত্রিকায় সফলতার গল্পগুলো পড়ে স্বপ্ন দেখতেন যদি পড়াশোনা করতে পারতেন। ডকুমেন্টরি বানানোর আশ্বাসে একজন স্কুলে ভর্তি করাবেন বলে আশা দেন। শুনে তিনি খুশি হন। আশায় থেকে প্রায় ২-৩ মাস ঘুমাননি। একসময় তিনি আর আসেননি।

No description available.

পারভেজের জন্মদিনে পথশিশুরা কেক কিনে আনে। তিনি এতে খুব বিস্মিত হন এবং কেঁদে ফেলেন। যেখানে পরিবার তার কথা ভাবে না; সেখানে তারা এতো ভালোবাসে। সবাই মিলে পার্কের কর্নারে কেক কাটতে যান। কেক ছুরি দিয়ে কাটতে হয় পথশিশুরা জানতো না। যে কারণে বটি দিয়ে কেক কাটার প্রস্তুতি নেয়। তখন টাই পরা এক ভদ্রলোক বলেন, ‘ফকিন্নির পোলার আবার জন্মদিন’। পারভেজের খুব খারাপ লাগে। মন খারাপ করে আর কেক কাটেননি।

সেই জেদ থেকে পারভেজ ভাবেন কিছু করার চেষ্টা করবে। দোকানের পাশে টেনিস ও গলফ ক্লাবে বলবয় হিসেবে ৫০ টাকা পেতেন। গ্যালারিতে চা-কফি বানানো থেকে শুরু করে সব করতেন। অনেকে খুশি হয়ে টাকা দিতেন। টাকা জমিয়ে ১৪ বছর বয়সে দেন চায়ের দোকান। কিছুদিন পর চটপটির দোকান দিয়ে ভালো আয় করতে থাকেন। শেষে ফাস্ট ফুডের ব্যবসায় জড়ান। দিন দিন উন্নতি হতে থাকে। ব্যবসার পাশাপাশি নিজেকে উন্নত করার চেষ্টা করতে থাকেন।

jagonews24

মানবিক কাজের শুরু
পারভেজ চিন্তা করলেন, অসহায় মানুষের জন্য কিছু করবেন। তখন রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে যাকে পেতেন; তাকেই নিয়ে যেতেন। ধানমন্ডিতে গেলেই পথশিশুদের খাওয়াতেন। একদিন এক পথশিশু ফুটপাতে অসুস্থ মায়ের মাথায় পানি ঢালছে দেখে পারভেজ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করান। কিছুদিনের মধ্যে তিনি সুস্থ হন। মাথায় পানি ঢালার দৃশ্যটি ভিডিও করে রাখেন। রাতে ফেসবুকে শেয়ার করে ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে উঠে দেখেন লাইক, কমেন্ট আর শেয়ারের বন্যায় ভেসে গেছে ভিডিও। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় দারুণ প্রশংসা পান। চলে আসেন আলোচনায়। তখনকার কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসন ওই পরিবারের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেন। নেটওয়ার্ক বড় হওয়ায় গুছিয়ে কাজ করবেন বলে ভাবেন পারভেজ। শুরু হলো ‘সহমর্মিতা ফাউন্ডেশন’র পথচলা।

সহমর্মিতার কার্যক্রম
‘সহমর্মিতা ফাউন্ডেশন’ যেকোনো খারাপ সময়ে মানুষের পাশে থাকে। বর্তমান সাহরি প্রজেক্টে ভাসমান মানুষদের খাবার দেওয়া হয়। লকডাউনের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ১০ হাজার মানুষকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত ১ লাখ মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছে। ১ টন কাঁচাবাজার, স্যানিটারি ন্যাপকিন, স্যালাইন, মেডিসিন, টিউবওয়েল ও টয়লেট তৈরি করে দিয়েছে। ‘ভাসমান হাসির দোকান’ খুলে ঈদে জামা-কাপড় দেওয়া হয়। পথশিশুদের ১ টাকায় নিজের পছন্দমতো নতুন পোশাক দেন। মেডিকেল ক্যাম্প, ব্লাড ডোনেশন, মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ ও অজ্ঞাত রোগী নিয়ে কাজ করেন। হাতিরঝিলে ১০০ জনের স্কুল চালু হবে। যেখানে পড়বে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা। নেশাগ্রস্ত পথশিশুদের ভিক্ষাভিত্তি থেকে ফিরিয়ে চায়ের ফ্লাক্স, ফুল বিক্রির বালতি ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে ছোট উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা হবে। তাদের খাবার, চিকিৎসাসহ স্কুলে ফ্রি পড়ানো হবে। মানবিক এ কাজের অর্থ তার ব্যবসার ৪০%, সংগঠনের সদস্যরা মাসিক চাঁদা দেন। পরিচিত অনেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিয়ে থাকেন।

jagonews24

সহমর্মিতার সাফল্য
সংগঠনের সফলতা অনেক। অসহায় মানুষ মন থেকে ভালোবাসে, নামাজ পড়ে দোয়া করে। অনেকেই তাকে বলেন, ‘বাবা, তোমার জন্য আমি বেঁচে থাকার অবলম্বন পেয়েছি।’ এটাই সফলতা। তিনি মনে করেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো মানুষের ভালোবাসা ও দোয়া। মানুষের প্রিয়জন হওয়া, অসহায় ও পথশিশুদের হাসিমুখই তার সফলতা।

আগামীর সহমর্মিতা
সহমর্মিতা ফাউন্ডেশনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার জন্মলগ্নে যে বাংলাদেশ দেখেছি; মৃত্যলগ্নে তার চেয়ে উত্তম বাংলাদেশ দেখতে চাই। সোনার বাংলাদেশ নির্মাণে অংশীদার হতে চাই। স্বপ্ন দেখি হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, মন্দির, সেল্টার রুম করবো। পথশিশুদের শিক্ষা থেকে শুরু করে সব সেবা দেওয়া হবে। বৃদ্ধাশ্রমে সন্তানহারা, অসহায় বাবা-মা থাকবেন।’

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


মানবিক কাজের ফেরিওয়ালা পারভেজ

Update Time : ০৮:১১:৪০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ মে ২০২১

 

মাত্র ১২ বছর বয়সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়া ছেলেটি এখন অসংখ্য অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান। ২০১৮ সালে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার অল্প সময়ের মধ্যে ৩১টি জেলায় করেছেন শাখা। সম্প্রতি সহমর্মিতা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও মানবিক মানুষ পারভেজ হাসানের সঙ্গে কথা হয় বিডিসমাচার এর। বিস্তারিত জানাচ্ছেন মো. আনিসুল ইসলাম—

শৈশব ও সংগ্রাম
পারভেজের শৈশব কাটে নানা বাড়িতে। পরিবার থাকে ঢাকায়। স্কুলে ভর্তি করানোর কথা বলে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। পড়াশোনা ও খেলাধুলায় পারদর্শী ছেলেটিকে দেওয়া হয় মামার চায়ের দোকানে। সেখানে বন্দিজীবন অসহ্য লাগে। এসব দেখে হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার ভূত চাপে মনে! ১২ বছর বয়সে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। চায়ের দোকানের পাশের ব্রিজে উঠে লাফ দেবেন, এমন সময় ছুটে আসে সমবয়সীরা পথশিশু। তাদের মধ্যে একজন ধরে নামায়। আস্তে আস্তে বন্ধুত্বের শুরু হয়।

No description available.

পারভেজ চায়ের দোকানে কাজ করার সুবাদে খাওয়া-থাকার জায়গা পায়। কিন্তু পথশিশুরা তা-ও পায় না। তাহলে তিনি ওদের থেকে ভালো আছেন। পত্রিকায় সফলতার গল্পগুলো পড়ে স্বপ্ন দেখতেন যদি পড়াশোনা করতে পারতেন। ডকুমেন্টরি বানানোর আশ্বাসে একজন স্কুলে ভর্তি করাবেন বলে আশা দেন। শুনে তিনি খুশি হন। আশায় থেকে প্রায় ২-৩ মাস ঘুমাননি। একসময় তিনি আর আসেননি।

No description available.

পারভেজের জন্মদিনে পথশিশুরা কেক কিনে আনে। তিনি এতে খুব বিস্মিত হন এবং কেঁদে ফেলেন। যেখানে পরিবার তার কথা ভাবে না; সেখানে তারা এতো ভালোবাসে। সবাই মিলে পার্কের কর্নারে কেক কাটতে যান। কেক ছুরি দিয়ে কাটতে হয় পথশিশুরা জানতো না। যে কারণে বটি দিয়ে কেক কাটার প্রস্তুতি নেয়। তখন টাই পরা এক ভদ্রলোক বলেন, ‘ফকিন্নির পোলার আবার জন্মদিন’। পারভেজের খুব খারাপ লাগে। মন খারাপ করে আর কেক কাটেননি।

সেই জেদ থেকে পারভেজ ভাবেন কিছু করার চেষ্টা করবে। দোকানের পাশে টেনিস ও গলফ ক্লাবে বলবয় হিসেবে ৫০ টাকা পেতেন। গ্যালারিতে চা-কফি বানানো থেকে শুরু করে সব করতেন। অনেকে খুশি হয়ে টাকা দিতেন। টাকা জমিয়ে ১৪ বছর বয়সে দেন চায়ের দোকান। কিছুদিন পর চটপটির দোকান দিয়ে ভালো আয় করতে থাকেন। শেষে ফাস্ট ফুডের ব্যবসায় জড়ান। দিন দিন উন্নতি হতে থাকে। ব্যবসার পাশাপাশি নিজেকে উন্নত করার চেষ্টা করতে থাকেন।

jagonews24

মানবিক কাজের শুরু
পারভেজ চিন্তা করলেন, অসহায় মানুষের জন্য কিছু করবেন। তখন রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে যাকে পেতেন; তাকেই নিয়ে যেতেন। ধানমন্ডিতে গেলেই পথশিশুদের খাওয়াতেন। একদিন এক পথশিশু ফুটপাতে অসুস্থ মায়ের মাথায় পানি ঢালছে দেখে পারভেজ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করান। কিছুদিনের মধ্যে তিনি সুস্থ হন। মাথায় পানি ঢালার দৃশ্যটি ভিডিও করে রাখেন। রাতে ফেসবুকে শেয়ার করে ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে উঠে দেখেন লাইক, কমেন্ট আর শেয়ারের বন্যায় ভেসে গেছে ভিডিও। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় দারুণ প্রশংসা পান। চলে আসেন আলোচনায়। তখনকার কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসন ওই পরিবারের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেন। নেটওয়ার্ক বড় হওয়ায় গুছিয়ে কাজ করবেন বলে ভাবেন পারভেজ। শুরু হলো ‘সহমর্মিতা ফাউন্ডেশন’র পথচলা।

সহমর্মিতার কার্যক্রম
‘সহমর্মিতা ফাউন্ডেশন’ যেকোনো খারাপ সময়ে মানুষের পাশে থাকে। বর্তমান সাহরি প্রজেক্টে ভাসমান মানুষদের খাবার দেওয়া হয়। লকডাউনের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ১০ হাজার মানুষকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত ১ লাখ মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছে। ১ টন কাঁচাবাজার, স্যানিটারি ন্যাপকিন, স্যালাইন, মেডিসিন, টিউবওয়েল ও টয়লেট তৈরি করে দিয়েছে। ‘ভাসমান হাসির দোকান’ খুলে ঈদে জামা-কাপড় দেওয়া হয়। পথশিশুদের ১ টাকায় নিজের পছন্দমতো নতুন পোশাক দেন। মেডিকেল ক্যাম্প, ব্লাড ডোনেশন, মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ ও অজ্ঞাত রোগী নিয়ে কাজ করেন। হাতিরঝিলে ১০০ জনের স্কুল চালু হবে। যেখানে পড়বে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা। নেশাগ্রস্ত পথশিশুদের ভিক্ষাভিত্তি থেকে ফিরিয়ে চায়ের ফ্লাক্স, ফুল বিক্রির বালতি ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে ছোট উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা হবে। তাদের খাবার, চিকিৎসাসহ স্কুলে ফ্রি পড়ানো হবে। মানবিক এ কাজের অর্থ তার ব্যবসার ৪০%, সংগঠনের সদস্যরা মাসিক চাঁদা দেন। পরিচিত অনেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিয়ে থাকেন।

jagonews24

সহমর্মিতার সাফল্য
সংগঠনের সফলতা অনেক। অসহায় মানুষ মন থেকে ভালোবাসে, নামাজ পড়ে দোয়া করে। অনেকেই তাকে বলেন, ‘বাবা, তোমার জন্য আমি বেঁচে থাকার অবলম্বন পেয়েছি।’ এটাই সফলতা। তিনি মনে করেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো মানুষের ভালোবাসা ও দোয়া। মানুষের প্রিয়জন হওয়া, অসহায় ও পথশিশুদের হাসিমুখই তার সফলতা।

আগামীর সহমর্মিতা
সহমর্মিতা ফাউন্ডেশনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার জন্মলগ্নে যে বাংলাদেশ দেখেছি; মৃত্যলগ্নে তার চেয়ে উত্তম বাংলাদেশ দেখতে চাই। সোনার বাংলাদেশ নির্মাণে অংশীদার হতে চাই। স্বপ্ন দেখি হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, মন্দির, সেল্টার রুম করবো। পথশিশুদের শিক্ষা থেকে শুরু করে সব সেবা দেওয়া হবে। বৃদ্ধাশ্রমে সন্তানহারা, অসহায় বাবা-মা থাকবেন।’