মুহাম্মাদ (সা.) বিশ্বমানবতার জন্য রহমত

  • Update Time : ০৪:২৪:৪৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১ নভেম্বর ২০২০
  • / 279

ফিচার ডেস্ক:

বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত এবং নবীকুল শিরোমণি হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন ছিল বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ। মানুষের মুক্তি সাধনায় তিনি সমগ্র জীবন অতিবাহিত করেছেন। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা, ঐক্য বিধান ও সুসভ্য করে গড়ে তোলার জন্যই সংগ্রাম করেছেন। তাঁর পুণ্যময় সত্ত্বা ছিলো অনুপম চরিত্র-মাধুরী, মহোত্তম গুণাবলী ও সার্বিক সৌন্দর্যে সুষমামণ্ডিত ও শ্রেষ্ঠ।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে বিশ্বের জাতিসমূহ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অনুগ্রহপ্রাপ্ত হয়েছেন। কারণ আগে কখনো মানব জাতির ওপর আল্লাহ তাআলার রহমত এরূপ ব্যাপক আকারে বর্ষিত হয়নি। হজরত নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও একই বক্তব্য বিভিন্ন হাদিসে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন-
– রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমাকে সাদা কালো নির্বিশেষে সবার জন্য পাঠানো হয়েছে’ (মুসনাদে আহমদ)

তিনি ছিলেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মাঝে ক্ষমার অনুপম দৃষ্টান্ত। হাদিসে এসেছে-
হজরত সাঈদ বিন আবি সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, তিনি হজরত আবু হুরায়রাহকে রাদিয়াল্লাহু আনহুকে একথা বলতে শুনেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নজদ অভিমূখে যুদ্ধ অভিযান প্রেরণ করেন আর তারা বনু হানিফার এক ব্যক্তি সুমামাহ বিন আসালকে বন্দী করে নিয়ে আসেন। সাহাবারা তাকে মসজিদে নববির খুটির সঙ্গে বেঁধে রাখেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছে এসে বলেন, হে সুমামাহ! তোমার কাছে কি অজুহাত আছে বা তোমার সঙ্গে কি ব্যবহার করা হবে বলে তুমি মনে কর। সে বললো আমার সুধারণা রয়েছে। যদি আপনি আমাকে হত্যা করেন তাহলে আপনি একজন খুনিকে হত্যা করবেন। আর যদি আপনি আমাকে ক্ষমা করেন তাহলে আপনি এমন এক ব্যক্তিকে ক্ষমা করবেন যে এর মূল্যায়ন করতে জানে। কিন্তু যদি আপনি সম্পদ চান তাহলে যত ইচ্ছে নিয়ে নিন। এভাবেই পরের দিনের আগমন ঘটে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবারও আসেন এবং সুমামাহকে জিজ্ঞাসা করেন, তোমার সংকল্প কি? সুমামাহ্ বলেন, আমিতো গতকালই আপনার সমীপে নিবদেন করেছি, যদি আপনি আমাকে ক্ষমা করেন তাহলে আপনি এমন এক ব্যক্তিকে ক্ষমা করবেন যে এ অনুগ্রহের মূল্যায়ন করতে জানে। তিনি এখানেই কথা বন্ধ করেন আর পরের দিন সূর্য উদয়ের পর পুনরায় বলেন- ‘হে সুমামাহ তোমার নিয়্যত কি? সে বললো, আমার যা কিছু বলার ছিলো তা বলেছি।’

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, একে মুক্ত করে দাও।

সুমামাহ মসজিদের কাছে খেজুর বাগানে যায়, গোসল করে মসজিদে প্রবেশ করে কলেমা শাহাদত পাঠ করে বলে, হে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আল্লাহর কসম, পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে বেশি অপছন্দ ছিল আপনার চেহারা আর বর্তমান অবস্থা এমন যে, আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় হচ্ছে আপনার চেহারা।
আল্লাহর কসম! পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে বেশি অপছন্দ ছিল আপনার ধর্ম আর বর্তমান অবস্থায় আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় হচ্ছে আপনার আনিত ধর্ম।

আল্লাহর কসম! পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করতাম আপনার শহরকে আর এখন এ শহরই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়। আপনার ঘোড় সওয়ারীরা তখন আমাকে ধরেছে যখন আমি ওমরাহ করতে চাচ্ছিলাম। এ ব্যাপারে আপনার নির্দেশনা কি?

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে শুভসংবাদ দেন আর তাকে ওমরাহ করার নির্দেশ দেন। যখন তিনি মক্কায় পৌঁছেন তখন কেউ বললো, তুমি কি সাবী হয়ে গেছো? উত্তরে সে বললো, না, আমি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি ঈমান এনেছি।’ (বুখারি)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন দিন পর্যন্ত তাকে ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে অবহিত করার প্রজ্ঞাপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করেন যাতে সে মুসলমানদের ইবাদতের রীতি-পদ্ধতি ও নিষ্ঠা এবং আপন প্রভুর সমীপে কিভাবে অনুনয় বিনয় করে তা দেখতে পায়। আর মুসলমানরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি কিভাবে ভালোবাসা ও প্রীতি প্রকাশ করে। আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার মান্যকারীদেরকে কি শিক্ষা প্রদান করেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামতাকে সরাসরি কোনো তবলীগ করেননি। কেবল প্রতিদিন জিজ্ঞাসা করতেন, তোমার সংকল্প কি? যাতে বুঝতে পারেন এর ওপর কোনো প্রভাব পড়েছে কিনা এবং তৃতীয় দিন তাঁর দিব্য শক্তি বুঝতে পেরেছে যে, এখন এর মধ্যে কোমলতা সৃষ্টি হয়েছে। তাই কোনো অঙ্গীকার ছাড়াই তাকে মুক্ত করে দেন তারপর যে ফলাফল সৃষ্টি হয়েছে অর্থাৎ তার ইসলাম গ্রহণই প্রমাণ করে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধারণাই সঠিক ছিল।

ক্ষমা ও মহানুভবতার এমন দৃষ্টান্ত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে আমরা আরও উজ্জ্বলভাবে দেখতে পাই। সেকালে আরবরা তাঁর পবিত্র দেহকে পাথরের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করেছে; বিষ প্রয়োগ করে তাকে হত্যার চক্রান্ত করেছে, হিংসা-ক্রোধ ও পাশবিকতায় উন্নত হয়ে তার চাচার হৃৎপিণ্ড প্রকাশ্যে চিবিয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর জন্মভূমি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি যে ব্যক্তির নির্মম আঘাতের কারণে তার প্রিয়তম কন্যার মৃত্যু ঘটেছিল, মক্কা বিজয়ের পরে তিনি সেই অত্যাচারীদের অকুণ্ঠচিত্তে এবং হাসিমুখে ক্ষমা করে দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে মহত্ত্বের সর্বোচ্চ নিদর্শন-ঔদার্য ও মহানুভবতার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

মক্কা বিজয়ের সময় আবু সুফিয়ানের একটি ঘটনাও ইতিহাসে সংরক্ষিত আছে। আবু সুফিয়ানকে যখন গ্রেফতার করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে উপস্থিত করা হয়, তখন তিনি তাকে বলেন, বলো কি চাও? সে বলে, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি কি আপনার জাতির প্রতি দয়া করবেন না। আপনিতো পরম দয়ালু ও মহানুভব; এছাড়া আমি আপনার আত্মীয়ও বটে, ভাই হই; তাই আমাকে সম্মান দেখানোও প্রয়োজন। কেননা, এখন আমি মুসলমান হয়ে গেছি।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- ঠিক আছে, যাও মক্কাতে ঘোষণা করে দাও; যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে তাকে নিরাপত্তা দেয়া হবে।
আবু সুফিয়ান বলল- হে আল্লাহর রাসুল! আমার ঘরে আর কতজনের সংকুলান হবে। এতবড় শহর তা আমার ঘরে আর কতজন আশ্রয় নিতে পারবে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- ঠিক আছে, যে ব্যক্তি কাবা শরিফে আশ্রয় নেবে তাকেও নিরাপত্তা দেয়া হবে।

আবু সুফিয়ান বলল- হে আল্লাহর রাসুল! কাবা শরিফও ছোট্ট একটি জায়গা সেখানেইবা কতজন আশ্রয় নেবে তারপরও লোক বাকি থেকে যাবে।

তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- যে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখবে, তাকেও নিরাপত্তা দেয়া হবে।

এবার আবু সুফিয়ান বলল- হে আল্লাহর রাসুল! যারা রাস্তা-ঘাটে বসবাস করে তারা কোথায় যাবে?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- ঠিক আছে, তারপর তিনি একটি পতাকা বানান এবং বলেন, এটি বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর পতাকা। তাকে সঙ্গে নিয়ে এ পতাকাসহ চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করো, যে এ পতাকার নিচে এসে দাঁড়াবে, পতাকার নিচে আশ্রয় নেবে তাকেও প্রাণ ভিক্ষা দেয়া হবে।

আবু সুফিয়ান বলল, ঠিক আছে এবার যথেষ্ট হয়েছে। আমাকে গিয়ে ঘোষণা করার অনুমতি দিন। যেহেতু মক্কার কুরাইশ নেতারাই অস্ত্র সমর্পণ করেছিল। তাই ভয় পাবার কোনো কারণই ছিল না।

আবু সুফিয়ান মক্কায় প্রবেশ করে ঘোষণা করেন- নিজ নিজ ঘরের দরজা বন্ধ রাখো আর কেউ বাইরে এসো না। কাবা শরিফে চলে যাও এবং হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর পতাকার নিচে যারা আশ্রয় নেবে তাদের সবাইকে নিরাপত্তা দেয়া হবে। তাদের সবার প্রাণ ভিক্ষা দেয়া হবে এবং কিছুই বলা হবে না। আর তোমাদের অস্ত্র সমর্পণ কর। ফলে মানুষ তাদের অস্ত্র সমর্পণ করা আরম্ভ করে আর হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর পতাকা তলে সমবতে হতে আরম্ভ করে।

এরূপ প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্ত হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর পতাকা তলে আশ্রয় গ্রহণকারীদের এটিও জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তোমরা যাকে দাস মনে করতে, তিনি যার কোনো গোত্র বা আত্মীয়স্বজন মক্কায় ছিল না। তিনি একেবারেই নিঃস্ব এবং পায়ে ঠেলার মত মানুষ মনে করে তোমরা তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছ।

আজ শুন এবং দেখে নাও! তোমরা শক্তিশালী নও, তোমরা সফলকামী নও, পরাক্রমশালী তোমরা নও বরং প্রবল পরাক্রমের অধিকারী হচ্ছেন হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর আল্লাহ। মহা পরাক্রমশালী হচ্ছেন মুহাম্মাদু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আল্লাহ। আর মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রবল পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহর বৈশিষ্ট্যাবলী অবলম্বন করেছেন এবং এ গুণাবলী ধারণ করেছেন। এভাবে বিজয় লাভের পর প্রতিশোধ নেন, যার মাঝে ছিল না কোন অহংকার বা গর্ব।

ক্ষমার যে দৃষ্টান্ত হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তা ছিল অসাধারণ। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা এবং শ্রেষ্ঠনবির আদর্শ মোতাবেক জীবন পরিচালনা এবং তার প্রতি অসংখ্য দরূদ ও সালাম- ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিঁউ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন, কামা সাল্লায়তা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলি ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিঁউ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা বারাকতা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলি ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ।’ পাঠ করার তাওফিক দান করুন, আমিন।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


মুহাম্মাদ (সা.) বিশ্বমানবতার জন্য রহমত

Update Time : ০৪:২৪:৪৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১ নভেম্বর ২০২০

ফিচার ডেস্ক:

বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত এবং নবীকুল শিরোমণি হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন ছিল বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ। মানুষের মুক্তি সাধনায় তিনি সমগ্র জীবন অতিবাহিত করেছেন। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা, ঐক্য বিধান ও সুসভ্য করে গড়ে তোলার জন্যই সংগ্রাম করেছেন। তাঁর পুণ্যময় সত্ত্বা ছিলো অনুপম চরিত্র-মাধুরী, মহোত্তম গুণাবলী ও সার্বিক সৌন্দর্যে সুষমামণ্ডিত ও শ্রেষ্ঠ।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে বিশ্বের জাতিসমূহ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অনুগ্রহপ্রাপ্ত হয়েছেন। কারণ আগে কখনো মানব জাতির ওপর আল্লাহ তাআলার রহমত এরূপ ব্যাপক আকারে বর্ষিত হয়নি। হজরত নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও একই বক্তব্য বিভিন্ন হাদিসে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন-
– রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমাকে সাদা কালো নির্বিশেষে সবার জন্য পাঠানো হয়েছে’ (মুসনাদে আহমদ)

তিনি ছিলেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মাঝে ক্ষমার অনুপম দৃষ্টান্ত। হাদিসে এসেছে-
হজরত সাঈদ বিন আবি সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, তিনি হজরত আবু হুরায়রাহকে রাদিয়াল্লাহু আনহুকে একথা বলতে শুনেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নজদ অভিমূখে যুদ্ধ অভিযান প্রেরণ করেন আর তারা বনু হানিফার এক ব্যক্তি সুমামাহ বিন আসালকে বন্দী করে নিয়ে আসেন। সাহাবারা তাকে মসজিদে নববির খুটির সঙ্গে বেঁধে রাখেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছে এসে বলেন, হে সুমামাহ! তোমার কাছে কি অজুহাত আছে বা তোমার সঙ্গে কি ব্যবহার করা হবে বলে তুমি মনে কর। সে বললো আমার সুধারণা রয়েছে। যদি আপনি আমাকে হত্যা করেন তাহলে আপনি একজন খুনিকে হত্যা করবেন। আর যদি আপনি আমাকে ক্ষমা করেন তাহলে আপনি এমন এক ব্যক্তিকে ক্ষমা করবেন যে এর মূল্যায়ন করতে জানে। কিন্তু যদি আপনি সম্পদ চান তাহলে যত ইচ্ছে নিয়ে নিন। এভাবেই পরের দিনের আগমন ঘটে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবারও আসেন এবং সুমামাহকে জিজ্ঞাসা করেন, তোমার সংকল্প কি? সুমামাহ্ বলেন, আমিতো গতকালই আপনার সমীপে নিবদেন করেছি, যদি আপনি আমাকে ক্ষমা করেন তাহলে আপনি এমন এক ব্যক্তিকে ক্ষমা করবেন যে এ অনুগ্রহের মূল্যায়ন করতে জানে। তিনি এখানেই কথা বন্ধ করেন আর পরের দিন সূর্য উদয়ের পর পুনরায় বলেন- ‘হে সুমামাহ তোমার নিয়্যত কি? সে বললো, আমার যা কিছু বলার ছিলো তা বলেছি।’

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, একে মুক্ত করে দাও।

সুমামাহ মসজিদের কাছে খেজুর বাগানে যায়, গোসল করে মসজিদে প্রবেশ করে কলেমা শাহাদত পাঠ করে বলে, হে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আল্লাহর কসম, পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে বেশি অপছন্দ ছিল আপনার চেহারা আর বর্তমান অবস্থা এমন যে, আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় হচ্ছে আপনার চেহারা।
আল্লাহর কসম! পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে বেশি অপছন্দ ছিল আপনার ধর্ম আর বর্তমান অবস্থায় আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় হচ্ছে আপনার আনিত ধর্ম।

আল্লাহর কসম! পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করতাম আপনার শহরকে আর এখন এ শহরই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়। আপনার ঘোড় সওয়ারীরা তখন আমাকে ধরেছে যখন আমি ওমরাহ করতে চাচ্ছিলাম। এ ব্যাপারে আপনার নির্দেশনা কি?

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে শুভসংবাদ দেন আর তাকে ওমরাহ করার নির্দেশ দেন। যখন তিনি মক্কায় পৌঁছেন তখন কেউ বললো, তুমি কি সাবী হয়ে গেছো? উত্তরে সে বললো, না, আমি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি ঈমান এনেছি।’ (বুখারি)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন দিন পর্যন্ত তাকে ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে অবহিত করার প্রজ্ঞাপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করেন যাতে সে মুসলমানদের ইবাদতের রীতি-পদ্ধতি ও নিষ্ঠা এবং আপন প্রভুর সমীপে কিভাবে অনুনয় বিনয় করে তা দেখতে পায়। আর মুসলমানরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি কিভাবে ভালোবাসা ও প্রীতি প্রকাশ করে। আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার মান্যকারীদেরকে কি শিক্ষা প্রদান করেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামতাকে সরাসরি কোনো তবলীগ করেননি। কেবল প্রতিদিন জিজ্ঞাসা করতেন, তোমার সংকল্প কি? যাতে বুঝতে পারেন এর ওপর কোনো প্রভাব পড়েছে কিনা এবং তৃতীয় দিন তাঁর দিব্য শক্তি বুঝতে পেরেছে যে, এখন এর মধ্যে কোমলতা সৃষ্টি হয়েছে। তাই কোনো অঙ্গীকার ছাড়াই তাকে মুক্ত করে দেন তারপর যে ফলাফল সৃষ্টি হয়েছে অর্থাৎ তার ইসলাম গ্রহণই প্রমাণ করে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধারণাই সঠিক ছিল।

ক্ষমা ও মহানুভবতার এমন দৃষ্টান্ত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে আমরা আরও উজ্জ্বলভাবে দেখতে পাই। সেকালে আরবরা তাঁর পবিত্র দেহকে পাথরের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করেছে; বিষ প্রয়োগ করে তাকে হত্যার চক্রান্ত করেছে, হিংসা-ক্রোধ ও পাশবিকতায় উন্নত হয়ে তার চাচার হৃৎপিণ্ড প্রকাশ্যে চিবিয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর জন্মভূমি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি যে ব্যক্তির নির্মম আঘাতের কারণে তার প্রিয়তম কন্যার মৃত্যু ঘটেছিল, মক্কা বিজয়ের পরে তিনি সেই অত্যাচারীদের অকুণ্ঠচিত্তে এবং হাসিমুখে ক্ষমা করে দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে মহত্ত্বের সর্বোচ্চ নিদর্শন-ঔদার্য ও মহানুভবতার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

মক্কা বিজয়ের সময় আবু সুফিয়ানের একটি ঘটনাও ইতিহাসে সংরক্ষিত আছে। আবু সুফিয়ানকে যখন গ্রেফতার করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে উপস্থিত করা হয়, তখন তিনি তাকে বলেন, বলো কি চাও? সে বলে, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি কি আপনার জাতির প্রতি দয়া করবেন না। আপনিতো পরম দয়ালু ও মহানুভব; এছাড়া আমি আপনার আত্মীয়ও বটে, ভাই হই; তাই আমাকে সম্মান দেখানোও প্রয়োজন। কেননা, এখন আমি মুসলমান হয়ে গেছি।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- ঠিক আছে, যাও মক্কাতে ঘোষণা করে দাও; যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে তাকে নিরাপত্তা দেয়া হবে।
আবু সুফিয়ান বলল- হে আল্লাহর রাসুল! আমার ঘরে আর কতজনের সংকুলান হবে। এতবড় শহর তা আমার ঘরে আর কতজন আশ্রয় নিতে পারবে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- ঠিক আছে, যে ব্যক্তি কাবা শরিফে আশ্রয় নেবে তাকেও নিরাপত্তা দেয়া হবে।

আবু সুফিয়ান বলল- হে আল্লাহর রাসুল! কাবা শরিফও ছোট্ট একটি জায়গা সেখানেইবা কতজন আশ্রয় নেবে তারপরও লোক বাকি থেকে যাবে।

তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- যে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখবে, তাকেও নিরাপত্তা দেয়া হবে।

এবার আবু সুফিয়ান বলল- হে আল্লাহর রাসুল! যারা রাস্তা-ঘাটে বসবাস করে তারা কোথায় যাবে?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- ঠিক আছে, তারপর তিনি একটি পতাকা বানান এবং বলেন, এটি বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর পতাকা। তাকে সঙ্গে নিয়ে এ পতাকাসহ চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করো, যে এ পতাকার নিচে এসে দাঁড়াবে, পতাকার নিচে আশ্রয় নেবে তাকেও প্রাণ ভিক্ষা দেয়া হবে।

আবু সুফিয়ান বলল, ঠিক আছে এবার যথেষ্ট হয়েছে। আমাকে গিয়ে ঘোষণা করার অনুমতি দিন। যেহেতু মক্কার কুরাইশ নেতারাই অস্ত্র সমর্পণ করেছিল। তাই ভয় পাবার কোনো কারণই ছিল না।

আবু সুফিয়ান মক্কায় প্রবেশ করে ঘোষণা করেন- নিজ নিজ ঘরের দরজা বন্ধ রাখো আর কেউ বাইরে এসো না। কাবা শরিফে চলে যাও এবং হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর পতাকার নিচে যারা আশ্রয় নেবে তাদের সবাইকে নিরাপত্তা দেয়া হবে। তাদের সবার প্রাণ ভিক্ষা দেয়া হবে এবং কিছুই বলা হবে না। আর তোমাদের অস্ত্র সমর্পণ কর। ফলে মানুষ তাদের অস্ত্র সমর্পণ করা আরম্ভ করে আর হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর পতাকা তলে সমবতে হতে আরম্ভ করে।

এরূপ প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্ত হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর পতাকা তলে আশ্রয় গ্রহণকারীদের এটিও জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তোমরা যাকে দাস মনে করতে, তিনি যার কোনো গোত্র বা আত্মীয়স্বজন মক্কায় ছিল না। তিনি একেবারেই নিঃস্ব এবং পায়ে ঠেলার মত মানুষ মনে করে তোমরা তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছ।

আজ শুন এবং দেখে নাও! তোমরা শক্তিশালী নও, তোমরা সফলকামী নও, পরাক্রমশালী তোমরা নও বরং প্রবল পরাক্রমের অধিকারী হচ্ছেন হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর আল্লাহ। মহা পরাক্রমশালী হচ্ছেন মুহাম্মাদু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আল্লাহ। আর মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রবল পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহর বৈশিষ্ট্যাবলী অবলম্বন করেছেন এবং এ গুণাবলী ধারণ করেছেন। এভাবে বিজয় লাভের পর প্রতিশোধ নেন, যার মাঝে ছিল না কোন অহংকার বা গর্ব।

ক্ষমার যে দৃষ্টান্ত হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তা ছিল অসাধারণ। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা এবং শ্রেষ্ঠনবির আদর্শ মোতাবেক জীবন পরিচালনা এবং তার প্রতি অসংখ্য দরূদ ও সালাম- ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিঁউ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন, কামা সাল্লায়তা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলি ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিঁউ ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা বারাকতা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলি ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ।’ পাঠ করার তাওফিক দান করুন, আমিন।