জ্বালানি নিরাপত্তা: বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার অবদান

  • Update Time : ০৬:০২:৩০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ অগাস্ট ২০২০
  • / 170
ড. সেলিম মাহমুদ:

১৯৭৫ সালের ৯ই আগস্ট মৃত্যুর মাত্র ছয় দিন পূর্বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এই দিন তিনি জাতীয় স্বার্থে দেশের বৃহৎ পাঁচটি গ্যাস ক্ষেত্র-তিতাস, বাখরাবাদ, রশীদপুর, কৈলাশটীলা ও হবিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রভাবশালী বহুজাতিক তেল কোম্পানি শেল ইন্টারন্যাশনালের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে কিনে নিয়েছিলেন। জাতির পিতার এই পদক্ষেপ ছিল বাঙ্গালীর মুক্তি সংগ্রামের অংশ হিসেবে জাতীয় স্বার্থে তাঁরই গৃহীত সাংবিধানিক, আইনি ও নীতিগত সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত বাস্তবায়ন।

একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নীতি অনুযায়ী আমাদের মতো অর্থনীতিতে ১% জিডিপি বৃদ্ধির জন্য ১.৮%-২% জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির প্রয়োজন হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গৃহীত কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ ও তাঁর সরকার প্রণীত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক কিছু সাংবিধানিক বিধান, আইন ও নীতিমালা এদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার মূলস্তম্ভ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশীয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা (Permanent Sovereignty Over Natural Resources) প্রতিষ্ঠা করেন। এই আইনি অধিকারের ধারণাটি তৎকালীন সময়ে আন্তর্জাতিক আইন অঙ্গনে খুবই নতুন ছিল। ঔপনিবেশিক শক্তি ও বহুজাতিক কোম্পানী সমূহের অনুকূলে খনিজ ও জ্বালানি সম্পদের উপর প্রদত্ত ইজারা ভিত্তিক মালিকানা জাতীয় স্বার্থে বাতিল করে জারি করা বঙ্গবন্ধুর এই বিধান সমকালীন সময়ে পৃথিবীর খুব কম দেশই তাদের সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করতে পেরেছিল। বঙ্গবন্ধুর এই পদক্ষেপ ছিল তাঁরই নেতৃত্বে বাঙ্গালীর মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মাইলফলক অর্জন। জাতির পিতা গ্রামীণ উন্নয়ন এবং নগর ও গ্রামা লের জীবন যাত্রার মানের বৈষম্য দূর করার জন্য গ্রামা লে বিদ্যুতায়নের বিষয়টিকে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ঘোষনা করেন (অনুচ্ছেদ-১৬)। বঙ্গবন্ধুর এই বৈপ্লবিক ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তৎকালীন তৃতীয় বিশ্বে এটি একটি অনুসরণীয় মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-২৭ এর মাধ্যমে দেশের তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ খনিজ, তেল ও গ্যাস কর্পোরেশন (বিএমওজিসি) গঠন করেন। ১৯৭৪ সালে এর সংক্ষিপ্ত নামকরন করা হয় ‘পেট্রোবাংলা’। তিনি জ্বালানি খাতকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে পেট্রোলিয়াম আইন ও পেট্রোলিয়াম পলিসি প্রণয়ন করেন। উক্ত আইন ও পলিসির আওতায় তিনি দেশীয় কোন মূলধন বা বিনিয়োগ ছাড়াই বিদেশী/বহুজাতিক কোম্পানীর মাধ্যমে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনের লক্ষ্যে ‘উৎপাদন বন্টন চুক্তি’ পদ্ধতি বাংলাদেশে প্রবর্তন করেন। বর্তমানে সারা বিশ্বে এই মডেলটি বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় হলেও ঐ সময়ে পৃথিবীর অনেক দেশই এই মডেলটির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-৫৯ এর মাধ্যমে দেশের সর্বত্র বিদ্যুৎ সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য বিদ্যুৎখাত পূনঃগঠন করেন। জাতির পিতা ১৯৭৫ সালের ১৪ মার্চ The ESSO Undertaking Acquisition Ordinance 1975 এর মাধ্যমে বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ESSO Eastern Inc.- কে অধিগ্রহন করে এদেশে জ্বালানি তেল মজুদ, সরবরাহ ও বিতরনে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহন করেন। বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত এই সকল স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান সমূহই আজও এদেশের তেল সেক্টরের জ্বালানি নিরাপত্তা বলয় হিসেবে কাজ করছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর দৃঢ় মনোবল, মেধা, সাহস ও সুকৌশলের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ৯ আগষ্ট বহুজাতিক কোম্পানী শেল ইন্টারন্যাশনালকে পাঁচটি বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র (তিতাস, বাখরাবাদ, রশিদপুর, কৈলাশটিলা ও হবিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র) মাত্র ১৭.৮৬ কোটি টাকায় বাংলাদেশের কাছে বিক্রয় করতে বাধ্য করেছিলেন, যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে ১২ লক্ষ কোটি টাকা। এটি কেবল আর্থিক মূল্য; এর অর্থনৈতিক মূল্য তার চেয়ে বহুগুন বেশি। স্বাধীন বাংলাদেশে গত চার দশকে যতটুকু শিল্পায়ন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে, তার মূল চালিকা শক্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর নামমাত্র মূল্যে ক্রয় করা গ্যাস ক্ষেত্রগুলো। মোটা দাগে বলতে গেলে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশে এ যাবত যা কিছু উন্নয়ন হয়েছে, তার সবটুকুই বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রদত্ত গ্যাস সম্পদের কারণে। আজ বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতসহ যে কয়েকটি খাতে আমরা বিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছি, এর মূল কারণই ছিল জাতির পিতা দেয়া গ্যাস সম্পদ।

পঁচাত্তরের পর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিরোধী শক্তি ক্ষমতাসীন হওয়ার কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তা অবহেলার শিকার হয়। ১৯৯৬-২০০১ সালে শেখ হাসিনার সরকারের সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে পরিস্থিতির উন্নতি হয়। পরবর্তীতে বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় লুটপাটের ফলে আবারও জ্বালানি খাত মুখ থুবড়ে পড়ে। ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে দেশ আবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ঘোষিত রূপকল্প-২০২১ (মধ্যম আয়ের দেশ) ও রূপকল্প- ২০৪১ (উন্নত দেশের মর্যাদা) অর্জনে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, গোটা উন্নয়নশীল বিশ্বের একমাত্র সরকার প্রধান যিনি জ্বালানিনিরাপত্তার বিষয়টিকে জাতীয় নিরাপত্তার সমার্থক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি সরকার প্রধান হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র ও উন্নয়ন সহযোগী এই মডেলটির প্রশংসা করেছেন। শেখ হাসিনার সরকার এক দশকে দেশে ব্যাপক ভিত্তিক শিল্পায়ন, বিনিয়োগ, উন্নয়ন কর্মকান্ড ও নানামূখী পদক্ষেপের মাধ্যমে অব্যহতভাবে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের সকল ক্ষেত্রে নবদিগন্তের সূচনা করে বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধন করেছেন। এক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি নিরবিচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ অন্যতম প্রধান নিয়মক হিসেবে কাজ করেছে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার মাধ্যমে সরকারের উন্নয়নের এই ধারাকে অব্যহত রাখার ক্ষেত্রে এই সময়ে জ্বালানির সংস্থানই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শেখ হাসিনার সরকার সর্বোচ্চ আন্তরিকতা, সাহস, কৌশল ও দক্ষতার সাথে কর্মপদক্ষেপ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করেছে।

অতীতের সরকারগুলোর জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতার ভ্রান্তনীতি পরিবর্তন করে শেখ হাসিনার সরকার জ্বালানির বহুমুখীকরণের Diversification নীতি গ্রহণ করেছে। এই ব্যবস্থায় দেশের জ্বালানি মিশ্রনে দেশীয় গ্যাস সম্পদের পাশাপাশি কয়লা, আমদানীকৃত এলএনজি, পরমানবিক বিদ্যুৎ, তরল জ্বালানি, আন্ত:রাষ্ট্রীয় জ্বালানি বানিজ্যের মাধ্যমে আহরিত জ্বালানি/বিদ্যুৎ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে একটি টেকসই ‘জ্বালানি ঝুড়ি’ (Fuel Basket) গড়ে তোলা হচ্ছে। এটিই আন্তর্জাতিক বেষ্ট প্র্যাকটিস হিসেবে স্বীকৃত। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ যাতে কয়লা ভিত্তিক বৃহত্তর বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করতে না পারে, সেজন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। এ সকল প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার সরকার জাতীয় স্বার্থে বৃহৎ কয়লা ভিত্তিক প্রকল্পসহ প্রয়োজনীয় সকল প্রকল্প বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। জ্বালানি ভিত্তিক এই প্রকল্প গুলোর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার মহেশখালী ও মাতারবাড়ীতে একটি এবং পায়রাতে একটি ‘এনার্জি হাব’ গড়ে তুলছে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেক্টরে শেখ হাসিনার সরকার বৈপ্লবিক সাফল্য দেখিয়েছে। পৃথিবীর কম দেশই এতো অল্প সময়ে এ রকম সাফল্য দেখাতে পেরেছে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ২২৮ কিলোওয়াট যা বর্তমানে দাড়িয়েছে ৪৭০ কি:ও: (দ্বিগুনেরও বেশী)। একই সময়ে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতাভুক্ত ছিল মোট জনসংখ্যার ৪৭% যা বর্তমানে দাড়িয়েছে প্রায় ৯৮%। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ৩২৬৭ মে:ও: বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। বর্তমানে সরকারের বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষমতা ২০ ৮১৩ মে:ও:। শেখ হাসিনা সরকার সমগ্র উন্নয়নশীল বিশ্বকে তাক লাগিয়ে এ বছরের ডিসেম্বর এর মধ্যেই দেশের সকলের জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে যাচ্ছে।

ঐতিহাসিকভাবে জাতীয় ও আ লিক জ্বালানি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় আন্ত:রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বানিজ্য একটি গুরুত্বপূর্ন পদ্ধতি হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি ‘এনার্জি ডিপ্লোমেসি’-কে আন্তর্জাতিক, আ লিক, উপ-আ লিক ও দ্বি-পাক্ষিক পর্যায়ে প্রধান্য দিয়ে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ভারত থেকে নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ আনার জন্যে ভেড়ামারায় যে ক্রসবর্ডার ইন্টারকানেকশন স্থাপিত হয়েছে, সেটি শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিন এশিয়া তথা উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এছাড়া ভারতের ত্রিপুরার সাথেও ক্রসবর্ডার ইন্টারকানেকশন স্থাপিত হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের মোট সরবরাহকৃত বিদ্যুতের ৬-৭% (১১৬০ মে:ও:) ভারত থেকে আসছে যা দেশের উৎপাদিত বিদ্যুতের গড় মূল্যের তুলনায় অনেক সাশ্রয়ী। এছাড়া ভারতের ঝাড়খন্ড ও ত্রিপুরা থেকে যথাক্রমে ১৪৯৬ ও ৩৪০ মে:ও: বিদ্যুৎসহ মোট ১৮৩৬ মে:ও: বিদ্যুৎ আমদানীর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভারতের সাথে বাংলাদেশের যে ক্রসবর্ডার ইন্টারকানেকশন স্থাপিত হয়েছে, বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই ইন্টারকানেকশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া , ভুটার ও নেপাল থেকে জল বিদ্যুৎ আনার কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের এই উদ্যোগে ভারত অংশীদার বা পার্টনার হিসেবে থাকছে। আ লিক ও উপ-আ লিক পর্যায়ে জ্বালানি ভিত্তিক সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরীর লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ‘সার্ক ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট ফর এনার্জি কো-অপারেশন (ইলেকট্রিসিটি)’-তে যুক্ত হয় এবং বিম্সটেক এর সদস্য দেশগুলোর সাথে গ্রীড ইন্টারকানেকশন বিষয়ে সমঝোতা স্মারক চুক্তি স্বাক্ষর করে। শেখ হাসিনার এই উদ্যোগের ফলে ২০৪১ সাল নাগাদ আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ বানিজ্য ও রিজিওনাল গ্রীড থেকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পরিমান বিদ্যুৎ পাবে।

জাতির পিতা ১৯৭২ সালে সংবিধানের ১৪৩ (১) (খ) অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জলসীমার অন্তর্বর্তী মহাসাগর ও বাংলাদেশের মহিসোপানে অবস্থিত সকল খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের সমুদ্র ও সমুদ্রসীমা রক্ষার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে ‘The Territorial Waters and Maritime Zones Act’ প্রণয়ন করেন। পরবর্তীকালের সরকারগুলো এই বিষয়ে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সমুদ্র ও সমুদ্রসীমা রক্ষায় শেখ হাসিনা ২০০১ সালে জাতিসংঘের ১৯৮২ সালের সমুদ্র আইন (UNCLOS) অনুসমর্থন (Ratification) করেন। এই সমুদ্র আইন অনুসমর্থনের ফলেই বঙ্গোপসাগরে আমাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ ও সাহসী নেতৃৃত্ব এবং সফল এনার্জি ডিপ্লোমেসির কারণে আমরা মিয়ানমার ও ভারতের দাবীর বিরুদ্ধে বিশাল সমুদ্রসীমা অর্জন করেছি। আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পৃথিবীর খুব কম দেশই এত সফলভাবে সমুদ্রের উপর তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। শেখ হাসিনার এই সমুদ্র জয়ের ফলে ‘দক্ষিণ এশিয়ার নর্থ সী’ (North Sea of South Asia) খ্যাত বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস সম্পদ আহরণের মাধ্যমে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সরকার ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রম কার্যকরী ও সুদক্ষভাবে পরিচালনা করছে। বর্তমানে ৭টি সমুদ্র ব্লকে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীসমূহ একক ও যৌথভাবে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। দেশে তেল-গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার গ্যাসের দৈনিক উৎপাদন ১৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট (২০০৮ সালে) হতে ২৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীতকরণসহ মোট গ্যাস সরবরাহ ৩২৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে (এলএনজি সহ) উন্নীত করেছে। এ সময়ে সরকার ৪টি নতুন গ্যাসক্ষেত্র (শ্রীকাইল, সুন্দরপুর, রূপগঞ্জ, ভোলা নর্থ) আবিস্কার করেছে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার ২০১১ সালে ‘গ্যাস উন্নয়ন তহবিল’ গঠন করে, যার আওতায় দেশের গ্যাস সেক্টরে বর্তমানে ২১টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এছাড়া গ্যাস সেক্টরকে সার্বিক সহায়তার জন্য ২০১৫ সালে সরকার ‘এনার্জি সিকিউরিটি ফান্ড’ নামে আরেকটি তহবিল গঠন করে।

এটি দুঃখজনক যে, ২০০৪-২০০৫ সালে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের ‘মিয়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত ত্রিদেশীয় গ্যাস পাইপলাইন’ প্রকল্প থেকে সরে আসার অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে প্রাপ্ত মিয়ানমারের গ্যাস থেকে বি ত হলো। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছিল। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ঐ সময়ে বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের সাথে দীর্ঘমেয়াদী গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পে অংশগ্রহন করলে মিয়ানমার পরবর্তীতে রোহিঙ্গা ইস্যুর মতো একটি প্রকট মানবিক সংকট চাপিয়ে দেয়ার মতো আচরণ আমাদের সাথে করতে পারতো না। কারণ আন্তর্জাতিক জ্বালানি আইন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতি অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদী আন্তঃরাষ্ট্রীয় জ্বালানি বানিজ্য ভূ-রাজনীতিকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। খালেদা জিয়ার সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে মিয়ানমার থেকে গ্যাস পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করলেও ২০০১ সালে নির্বাচনের পর দেশের সীমিত গ্যাস সম্পদ বিদেশে রপ্তানীর উদ্যোগ গ্রহন করেছিল। কারণ নির্বাচনের পূর্বে গ্যাস রপ্তানির মুচলেকা দিয়ে বিএনপি-জামাত ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল। অথচ শেখ হাসিনা ২০০০ সালে জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সীমিত জাতীয় সম্পদ গ্যাস রপ্তানীর সিদ্ধান্তের পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদে নিজস্ব ব্যবহারের জন্য গ্যাস মজুদের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দেশের স্বার্থে গৃহীত তাঁর এই সিদ্ধান্তের কারনেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে ২০০৩ সালের অক্টোবরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রতিরোধের মুখে খালেদা জিয়ার সরকার ইতোপূবে তাঁরই গৃহীত গ্যাস রপ্তানীর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।

জাতির পিতা যে গ্যাস সম্পদ আমাদেরকে দিয়ে গিয়েছিলেন, দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা তথা সার্বিক উন্নয়নের জন্য সেই সম্পদ রক্ষা করেছিলেন তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা। এই তথ্য বঙ্গবন্ধুর কাছে অজানা ছিল না যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর ঠাণ্ডা লড়াইয়ের (Cold War) সময়ে বিশ্বব্যাপি কিছু জাতীয়তাবাদী নেতা নিজেদের দেশে বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রাকৃতিক ও জ্বালানি সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন, তাদের কেও কেও হত্যার শিকারও হয়েছিলেন। সেটি জানা সত্ত্বেও, তিনি ঔপনিবেশিক শক্তি ও বহুজাতিক কোম্পানী সমূহের অনুকূলে খনিজ ও জ্বালানি সম্পদের উপর প্রদত্ত ইজারা ভিত্তিক মালিকানা জাতীয় স্বার্থে বাতিল করে সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদে এ সম্পর্কিত বিধান অন্তর্ভুক্ত করেন। এই ধরণের বিধান সমকালীন সময়ে পৃথিবীর খুব কম দেশই তাদের সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করতে পেরেছিল। জাতির পিতা প্রবর্তিত এই সাংবিধানিক বিধানের আলোকে পরবর্তীতে তিনিই নানামুখি আইনি, নীতিগত, নির্বাহী ও রেগুলেটরি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি আত্ম নির্ভরশীল ও শক্তিশালী জ্বালানি খাত তৈরি করে গিয়েছিলেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল এদেশকে অর্থনৈতিক ভাবে এগিয়ে নিয়ে মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করা। এটিই ছিল বঙ্গবন্ধু সূচিত বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম মূল লক্ষ্য। জাতির পিতার পরে শেখ হাসিনাই একমাত্র রাষ্ট্রনায়ক যিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও বাধা ঊপেক্ষা করে জাতির পিতার এই লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নানামূখী কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকারণের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে শুধু দুটি নাম দেদীপ্যমান – জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আর রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা।

লেখক: রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, গবেষক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


জ্বালানি নিরাপত্তা: বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার অবদান

Update Time : ০৬:০২:৩০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ অগাস্ট ২০২০
ড. সেলিম মাহমুদ:

১৯৭৫ সালের ৯ই আগস্ট মৃত্যুর মাত্র ছয় দিন পূর্বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এই দিন তিনি জাতীয় স্বার্থে দেশের বৃহৎ পাঁচটি গ্যাস ক্ষেত্র-তিতাস, বাখরাবাদ, রশীদপুর, কৈলাশটীলা ও হবিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রভাবশালী বহুজাতিক তেল কোম্পানি শেল ইন্টারন্যাশনালের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে কিনে নিয়েছিলেন। জাতির পিতার এই পদক্ষেপ ছিল বাঙ্গালীর মুক্তি সংগ্রামের অংশ হিসেবে জাতীয় স্বার্থে তাঁরই গৃহীত সাংবিধানিক, আইনি ও নীতিগত সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত বাস্তবায়ন।

একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নীতি অনুযায়ী আমাদের মতো অর্থনীতিতে ১% জিডিপি বৃদ্ধির জন্য ১.৮%-২% জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির প্রয়োজন হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গৃহীত কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ ও তাঁর সরকার প্রণীত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক কিছু সাংবিধানিক বিধান, আইন ও নীতিমালা এদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার মূলস্তম্ভ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশীয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা (Permanent Sovereignty Over Natural Resources) প্রতিষ্ঠা করেন। এই আইনি অধিকারের ধারণাটি তৎকালীন সময়ে আন্তর্জাতিক আইন অঙ্গনে খুবই নতুন ছিল। ঔপনিবেশিক শক্তি ও বহুজাতিক কোম্পানী সমূহের অনুকূলে খনিজ ও জ্বালানি সম্পদের উপর প্রদত্ত ইজারা ভিত্তিক মালিকানা জাতীয় স্বার্থে বাতিল করে জারি করা বঙ্গবন্ধুর এই বিধান সমকালীন সময়ে পৃথিবীর খুব কম দেশই তাদের সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করতে পেরেছিল। বঙ্গবন্ধুর এই পদক্ষেপ ছিল তাঁরই নেতৃত্বে বাঙ্গালীর মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মাইলফলক অর্জন। জাতির পিতা গ্রামীণ উন্নয়ন এবং নগর ও গ্রামা লের জীবন যাত্রার মানের বৈষম্য দূর করার জন্য গ্রামা লে বিদ্যুতায়নের বিষয়টিকে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ঘোষনা করেন (অনুচ্ছেদ-১৬)। বঙ্গবন্ধুর এই বৈপ্লবিক ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তৎকালীন তৃতীয় বিশ্বে এটি একটি অনুসরণীয় মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-২৭ এর মাধ্যমে দেশের তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ খনিজ, তেল ও গ্যাস কর্পোরেশন (বিএমওজিসি) গঠন করেন। ১৯৭৪ সালে এর সংক্ষিপ্ত নামকরন করা হয় ‘পেট্রোবাংলা’। তিনি জ্বালানি খাতকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে পেট্রোলিয়াম আইন ও পেট্রোলিয়াম পলিসি প্রণয়ন করেন। উক্ত আইন ও পলিসির আওতায় তিনি দেশীয় কোন মূলধন বা বিনিয়োগ ছাড়াই বিদেশী/বহুজাতিক কোম্পানীর মাধ্যমে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনের লক্ষ্যে ‘উৎপাদন বন্টন চুক্তি’ পদ্ধতি বাংলাদেশে প্রবর্তন করেন। বর্তমানে সারা বিশ্বে এই মডেলটি বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় হলেও ঐ সময়ে পৃথিবীর অনেক দেশই এই মডেলটির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-৫৯ এর মাধ্যমে দেশের সর্বত্র বিদ্যুৎ সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য বিদ্যুৎখাত পূনঃগঠন করেন। জাতির পিতা ১৯৭৫ সালের ১৪ মার্চ The ESSO Undertaking Acquisition Ordinance 1975 এর মাধ্যমে বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ESSO Eastern Inc.- কে অধিগ্রহন করে এদেশে জ্বালানি তেল মজুদ, সরবরাহ ও বিতরনে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহন করেন। বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত এই সকল স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান সমূহই আজও এদেশের তেল সেক্টরের জ্বালানি নিরাপত্তা বলয় হিসেবে কাজ করছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর দৃঢ় মনোবল, মেধা, সাহস ও সুকৌশলের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ৯ আগষ্ট বহুজাতিক কোম্পানী শেল ইন্টারন্যাশনালকে পাঁচটি বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র (তিতাস, বাখরাবাদ, রশিদপুর, কৈলাশটিলা ও হবিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র) মাত্র ১৭.৮৬ কোটি টাকায় বাংলাদেশের কাছে বিক্রয় করতে বাধ্য করেছিলেন, যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে ১২ লক্ষ কোটি টাকা। এটি কেবল আর্থিক মূল্য; এর অর্থনৈতিক মূল্য তার চেয়ে বহুগুন বেশি। স্বাধীন বাংলাদেশে গত চার দশকে যতটুকু শিল্পায়ন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে, তার মূল চালিকা শক্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর নামমাত্র মূল্যে ক্রয় করা গ্যাস ক্ষেত্রগুলো। মোটা দাগে বলতে গেলে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশে এ যাবত যা কিছু উন্নয়ন হয়েছে, তার সবটুকুই বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রদত্ত গ্যাস সম্পদের কারণে। আজ বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতসহ যে কয়েকটি খাতে আমরা বিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছি, এর মূল কারণই ছিল জাতির পিতা দেয়া গ্যাস সম্পদ।

পঁচাত্তরের পর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিরোধী শক্তি ক্ষমতাসীন হওয়ার কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তা অবহেলার শিকার হয়। ১৯৯৬-২০০১ সালে শেখ হাসিনার সরকারের সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে পরিস্থিতির উন্নতি হয়। পরবর্তীতে বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় লুটপাটের ফলে আবারও জ্বালানি খাত মুখ থুবড়ে পড়ে। ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে দেশ আবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ঘোষিত রূপকল্প-২০২১ (মধ্যম আয়ের দেশ) ও রূপকল্প- ২০৪১ (উন্নত দেশের মর্যাদা) অর্জনে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, গোটা উন্নয়নশীল বিশ্বের একমাত্র সরকার প্রধান যিনি জ্বালানিনিরাপত্তার বিষয়টিকে জাতীয় নিরাপত্তার সমার্থক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি সরকার প্রধান হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র ও উন্নয়ন সহযোগী এই মডেলটির প্রশংসা করেছেন। শেখ হাসিনার সরকার এক দশকে দেশে ব্যাপক ভিত্তিক শিল্পায়ন, বিনিয়োগ, উন্নয়ন কর্মকান্ড ও নানামূখী পদক্ষেপের মাধ্যমে অব্যহতভাবে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের সকল ক্ষেত্রে নবদিগন্তের সূচনা করে বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধন করেছেন। এক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি নিরবিচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ অন্যতম প্রধান নিয়মক হিসেবে কাজ করেছে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার মাধ্যমে সরকারের উন্নয়নের এই ধারাকে অব্যহত রাখার ক্ষেত্রে এই সময়ে জ্বালানির সংস্থানই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শেখ হাসিনার সরকার সর্বোচ্চ আন্তরিকতা, সাহস, কৌশল ও দক্ষতার সাথে কর্মপদক্ষেপ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করেছে।

অতীতের সরকারগুলোর জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতার ভ্রান্তনীতি পরিবর্তন করে শেখ হাসিনার সরকার জ্বালানির বহুমুখীকরণের Diversification নীতি গ্রহণ করেছে। এই ব্যবস্থায় দেশের জ্বালানি মিশ্রনে দেশীয় গ্যাস সম্পদের পাশাপাশি কয়লা, আমদানীকৃত এলএনজি, পরমানবিক বিদ্যুৎ, তরল জ্বালানি, আন্ত:রাষ্ট্রীয় জ্বালানি বানিজ্যের মাধ্যমে আহরিত জ্বালানি/বিদ্যুৎ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে একটি টেকসই ‘জ্বালানি ঝুড়ি’ (Fuel Basket) গড়ে তোলা হচ্ছে। এটিই আন্তর্জাতিক বেষ্ট প্র্যাকটিস হিসেবে স্বীকৃত। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ যাতে কয়লা ভিত্তিক বৃহত্তর বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করতে না পারে, সেজন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। এ সকল প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার সরকার জাতীয় স্বার্থে বৃহৎ কয়লা ভিত্তিক প্রকল্পসহ প্রয়োজনীয় সকল প্রকল্প বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। জ্বালানি ভিত্তিক এই প্রকল্প গুলোর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার মহেশখালী ও মাতারবাড়ীতে একটি এবং পায়রাতে একটি ‘এনার্জি হাব’ গড়ে তুলছে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেক্টরে শেখ হাসিনার সরকার বৈপ্লবিক সাফল্য দেখিয়েছে। পৃথিবীর কম দেশই এতো অল্প সময়ে এ রকম সাফল্য দেখাতে পেরেছে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ২২৮ কিলোওয়াট যা বর্তমানে দাড়িয়েছে ৪৭০ কি:ও: (দ্বিগুনেরও বেশী)। একই সময়ে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতাভুক্ত ছিল মোট জনসংখ্যার ৪৭% যা বর্তমানে দাড়িয়েছে প্রায় ৯৮%। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ৩২৬৭ মে:ও: বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। বর্তমানে সরকারের বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষমতা ২০ ৮১৩ মে:ও:। শেখ হাসিনা সরকার সমগ্র উন্নয়নশীল বিশ্বকে তাক লাগিয়ে এ বছরের ডিসেম্বর এর মধ্যেই দেশের সকলের জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে যাচ্ছে।

ঐতিহাসিকভাবে জাতীয় ও আ লিক জ্বালানি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় আন্ত:রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বানিজ্য একটি গুরুত্বপূর্ন পদ্ধতি হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি ‘এনার্জি ডিপ্লোমেসি’-কে আন্তর্জাতিক, আ লিক, উপ-আ লিক ও দ্বি-পাক্ষিক পর্যায়ে প্রধান্য দিয়ে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ভারত থেকে নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ আনার জন্যে ভেড়ামারায় যে ক্রসবর্ডার ইন্টারকানেকশন স্থাপিত হয়েছে, সেটি শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিন এশিয়া তথা উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এছাড়া ভারতের ত্রিপুরার সাথেও ক্রসবর্ডার ইন্টারকানেকশন স্থাপিত হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের মোট সরবরাহকৃত বিদ্যুতের ৬-৭% (১১৬০ মে:ও:) ভারত থেকে আসছে যা দেশের উৎপাদিত বিদ্যুতের গড় মূল্যের তুলনায় অনেক সাশ্রয়ী। এছাড়া ভারতের ঝাড়খন্ড ও ত্রিপুরা থেকে যথাক্রমে ১৪৯৬ ও ৩৪০ মে:ও: বিদ্যুৎসহ মোট ১৮৩৬ মে:ও: বিদ্যুৎ আমদানীর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভারতের সাথে বাংলাদেশের যে ক্রসবর্ডার ইন্টারকানেকশন স্থাপিত হয়েছে, বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই ইন্টারকানেকশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া , ভুটার ও নেপাল থেকে জল বিদ্যুৎ আনার কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের এই উদ্যোগে ভারত অংশীদার বা পার্টনার হিসেবে থাকছে। আ লিক ও উপ-আ লিক পর্যায়ে জ্বালানি ভিত্তিক সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরীর লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ‘সার্ক ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট ফর এনার্জি কো-অপারেশন (ইলেকট্রিসিটি)’-তে যুক্ত হয় এবং বিম্সটেক এর সদস্য দেশগুলোর সাথে গ্রীড ইন্টারকানেকশন বিষয়ে সমঝোতা স্মারক চুক্তি স্বাক্ষর করে। শেখ হাসিনার এই উদ্যোগের ফলে ২০৪১ সাল নাগাদ আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ বানিজ্য ও রিজিওনাল গ্রীড থেকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পরিমান বিদ্যুৎ পাবে।

জাতির পিতা ১৯৭২ সালে সংবিধানের ১৪৩ (১) (খ) অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জলসীমার অন্তর্বর্তী মহাসাগর ও বাংলাদেশের মহিসোপানে অবস্থিত সকল খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের সমুদ্র ও সমুদ্রসীমা রক্ষার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে ‘The Territorial Waters and Maritime Zones Act’ প্রণয়ন করেন। পরবর্তীকালের সরকারগুলো এই বিষয়ে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সমুদ্র ও সমুদ্রসীমা রক্ষায় শেখ হাসিনা ২০০১ সালে জাতিসংঘের ১৯৮২ সালের সমুদ্র আইন (UNCLOS) অনুসমর্থন (Ratification) করেন। এই সমুদ্র আইন অনুসমর্থনের ফলেই বঙ্গোপসাগরে আমাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ ও সাহসী নেতৃৃত্ব এবং সফল এনার্জি ডিপ্লোমেসির কারণে আমরা মিয়ানমার ও ভারতের দাবীর বিরুদ্ধে বিশাল সমুদ্রসীমা অর্জন করেছি। আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পৃথিবীর খুব কম দেশই এত সফলভাবে সমুদ্রের উপর তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। শেখ হাসিনার এই সমুদ্র জয়ের ফলে ‘দক্ষিণ এশিয়ার নর্থ সী’ (North Sea of South Asia) খ্যাত বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস সম্পদ আহরণের মাধ্যমে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সরকার ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রম কার্যকরী ও সুদক্ষভাবে পরিচালনা করছে। বর্তমানে ৭টি সমুদ্র ব্লকে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীসমূহ একক ও যৌথভাবে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। দেশে তেল-গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার গ্যাসের দৈনিক উৎপাদন ১৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট (২০০৮ সালে) হতে ২৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীতকরণসহ মোট গ্যাস সরবরাহ ৩২৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে (এলএনজি সহ) উন্নীত করেছে। এ সময়ে সরকার ৪টি নতুন গ্যাসক্ষেত্র (শ্রীকাইল, সুন্দরপুর, রূপগঞ্জ, ভোলা নর্থ) আবিস্কার করেছে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার ২০১১ সালে ‘গ্যাস উন্নয়ন তহবিল’ গঠন করে, যার আওতায় দেশের গ্যাস সেক্টরে বর্তমানে ২১টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এছাড়া গ্যাস সেক্টরকে সার্বিক সহায়তার জন্য ২০১৫ সালে সরকার ‘এনার্জি সিকিউরিটি ফান্ড’ নামে আরেকটি তহবিল গঠন করে।

এটি দুঃখজনক যে, ২০০৪-২০০৫ সালে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের ‘মিয়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত ত্রিদেশীয় গ্যাস পাইপলাইন’ প্রকল্প থেকে সরে আসার অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে প্রাপ্ত মিয়ানমারের গ্যাস থেকে বি ত হলো। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছিল। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ঐ সময়ে বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের সাথে দীর্ঘমেয়াদী গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পে অংশগ্রহন করলে মিয়ানমার পরবর্তীতে রোহিঙ্গা ইস্যুর মতো একটি প্রকট মানবিক সংকট চাপিয়ে দেয়ার মতো আচরণ আমাদের সাথে করতে পারতো না। কারণ আন্তর্জাতিক জ্বালানি আইন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতি অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদী আন্তঃরাষ্ট্রীয় জ্বালানি বানিজ্য ভূ-রাজনীতিকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। খালেদা জিয়ার সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে মিয়ানমার থেকে গ্যাস পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করলেও ২০০১ সালে নির্বাচনের পর দেশের সীমিত গ্যাস সম্পদ বিদেশে রপ্তানীর উদ্যোগ গ্রহন করেছিল। কারণ নির্বাচনের পূর্বে গ্যাস রপ্তানির মুচলেকা দিয়ে বিএনপি-জামাত ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল। অথচ শেখ হাসিনা ২০০০ সালে জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সীমিত জাতীয় সম্পদ গ্যাস রপ্তানীর সিদ্ধান্তের পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদে নিজস্ব ব্যবহারের জন্য গ্যাস মজুদের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দেশের স্বার্থে গৃহীত তাঁর এই সিদ্ধান্তের কারনেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে ২০০৩ সালের অক্টোবরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রতিরোধের মুখে খালেদা জিয়ার সরকার ইতোপূবে তাঁরই গৃহীত গ্যাস রপ্তানীর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।

জাতির পিতা যে গ্যাস সম্পদ আমাদেরকে দিয়ে গিয়েছিলেন, দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা তথা সার্বিক উন্নয়নের জন্য সেই সম্পদ রক্ষা করেছিলেন তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা। এই তথ্য বঙ্গবন্ধুর কাছে অজানা ছিল না যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর ঠাণ্ডা লড়াইয়ের (Cold War) সময়ে বিশ্বব্যাপি কিছু জাতীয়তাবাদী নেতা নিজেদের দেশে বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রাকৃতিক ও জ্বালানি সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন, তাদের কেও কেও হত্যার শিকারও হয়েছিলেন। সেটি জানা সত্ত্বেও, তিনি ঔপনিবেশিক শক্তি ও বহুজাতিক কোম্পানী সমূহের অনুকূলে খনিজ ও জ্বালানি সম্পদের উপর প্রদত্ত ইজারা ভিত্তিক মালিকানা জাতীয় স্বার্থে বাতিল করে সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদে এ সম্পর্কিত বিধান অন্তর্ভুক্ত করেন। এই ধরণের বিধান সমকালীন সময়ে পৃথিবীর খুব কম দেশই তাদের সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করতে পেরেছিল। জাতির পিতা প্রবর্তিত এই সাংবিধানিক বিধানের আলোকে পরবর্তীতে তিনিই নানামুখি আইনি, নীতিগত, নির্বাহী ও রেগুলেটরি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি আত্ম নির্ভরশীল ও শক্তিশালী জ্বালানি খাত তৈরি করে গিয়েছিলেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল এদেশকে অর্থনৈতিক ভাবে এগিয়ে নিয়ে মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করা। এটিই ছিল বঙ্গবন্ধু সূচিত বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম মূল লক্ষ্য। জাতির পিতার পরে শেখ হাসিনাই একমাত্র রাষ্ট্রনায়ক যিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও বাধা ঊপেক্ষা করে জাতির পিতার এই লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নানামূখী কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকারণের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে শুধু দুটি নাম দেদীপ্যমান – জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আর রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা।

লেখক: রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, গবেষক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।