শেখ হাসিনা যেভাবে আস্থার প্রতীক

  • Update Time : ০৯:৩৯:২৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ জুলাই ২০২০
  • / 138

পঁচাত্তরের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ নির্বাসন শেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ওই বছর তাঁর অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে দলটির নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হয় তাঁর কাঁধে। সেই থেকে টানা প্রায় চার দশক ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তিনি। তাঁর নেতৃত্ব প্রশংসিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নিয়ে গেছেন চারবার। দলকে গতিশীল ও জনমুখী করতে নেতৃত্বে এনেছেন পরিবর্তন। অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্বে শক্তিশালী হয়েছে আওয়ামী লীগ।

টাইম ম্যাগাজিনে ২০১১ সালের আগস্ট সংখ্যায় জানানো হয়, শীর্ষে থাকা ১২ নারী নেতৃত্বের মধ্যে সপ্তম শেখ হাসিনা। এর আগে ২০০৬ সালে তিনি অর্জন করেন মাদার তেরেসা আজীবন সম্মাননা অ্যাওয়ার্ড। ২০১৬ সালের জুন সংখ্যায় ফোর্বস ম্যাগাজিন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাসম্পন্নদের মধ্যে ৩৬তম স্থানে রাখে শেখ হাসিনাকে। আর এ বছর সারা পৃথিবী যখন মহামারি করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে ক্লান্ত, তখন ফোর্বস তুলে ধরেছে শেখ হাসিনার অদম্য নেতৃত্বের বিষয়টি। ম্যাগাজিনের ২২ এপ্রিল সংখ্যায় করোনাভাইরাস মোকাবেলায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে চার দশক দলের প্রধানের দায়িত্বে থেকে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, কারাবরণ, জীবনের ঝুঁকি, এমনকি একাধিকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া ছাড়াও অনেক চড়াই-উতরাই, ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে আজকের অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছেন। মতিয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, পিতা-মাতা, ভাই ও স্বজনদের হারিয়ে এক কঠিন কষ্টের সময় পার করেছেন বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালে যখন দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন, তখন দলের ভাঙন দেখেছেন। দেখেছেন প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে একাধিক হামলা। এসব অভিজ্ঞতা তাঁকে তিলে তিলে তৈরি করেছে।

নির্বাসিত জীবনে ভারতে অবস্থানকালে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পান। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ প্রসঙ্গে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দলের মধ্যে নেতাকর্মীরা উৎসাহ পেয়েছিলেন। তৃণমূলের কর্মীরা অনেকটাই নেতৃত্বহীন ছিলেন, কারণ এই ধরনের দলে একজন ক্যারিসমেটিক নেতা না থাকলে দল খুব একটা এগোতে পারে না।’ প্রশ্নের জবাবে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, একটি দীর্ঘদিনের পুরনো ও গণমুখী রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার কর্মী বাহিনী। তাঁদের আস্থা অর্জন করাটা বড় বিষয়। সেটা তিনি করেছেন।

১৯৮৩ সালে এইচ এম এরশাদের মার্শাল লর বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থী ১৫ প্রগতিশীল দল নিয়ে জোট গঠন করে আন্দোলন শুরু করেন শেখ হাসিনা। ফলে পিতার মতোই জেল-জুলুমের শিকার হতে হয়। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি ও নভেম্বর মাসে সামরিক সরকার তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখে। ১৯৮৫ সালের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্তও তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়।

সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা দলের হাল ধরার আগে পঁচাত্তর-পরবর্তী ক্রান্তিকালে মহিউদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক করে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। কিছুদিন পর সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করে পুনর্গঠন করা হয় আওয়ামী লীগ। এই কমিটি প্রায় এক বছর দায়িত্ব পালন করে। পরবর্তী সময়ে দলে আবদুর রাজ্জাক প্রভাব বিস্তার করেন এবং সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে সরিয়ে তাঁর অনুসারী আবদুল মালেক উকিলকে সভাপতি করেন। আবদুর রাজ্জাক নিজে পুনরায় সাধারণ সম্পাদক হন। তোফায়েল আহমেদকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। এ সময় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে প্রকাশ্য দুই ধারায় বিভক্ত ছিলেন। ওই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগে ঐক্য ধরে রাখার প্রয়োজনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাঁকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এর পরও শেষ পর্যন্ত ভাঙন রোধ করা সম্ভব হয়নি। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব থেকে বেরিয়ে গিয়ে মহিউদ্দিন আহমদ (আগের কমিটির সভাপতি) এবং তত্কালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক তৈরি করেন ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ (বাকশাল)।

এর আগে আওয়ামী লীগে ভাঙন ধরান মিজানুর রহমান চৌধুরী। আওয়ামী লীগ (মিজান) তৈরি করেন তিনি। সিলেটের দেওয়ান ফরিদ গাজীরও একটি আওয়ামী লীগ ছিল—আওয়ামী লীগ (ফরিদ গাজী)। অবশ্য শেষ পর্যন্ত মিজানুর রহমান চৌধুরী ও দেওয়ান ফরিদ গাজী আওয়ামী লীগেই ফিরে আসেন।

আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে দলে ভাঙন সত্ত্বেও ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেয় এবং জনতার বিপুল রায় পায়। প্রশংসিত হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্ব। কিন্তু সামরিক জান্তা এরশাদ ওই ফল পাল্টে জাতীয় পার্টিকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। সারা দেশের পুকুর-জলাশয়ে পাওয়া যায় জনতার প্রকৃত রায় নৌকার ব্যালটভর্তি বাক্স। এরপর স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে তুমুল গণ-আন্দোলন শুরু হয় শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বে। নব্বইয়ে পতন হয় এরশাদের। এরপর একানব্বই সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় যেতে না পারলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সুসংগঠিত সংগঠনে পরিণত হয় আওয়ামী লীগ। পরে বাকশাল বিলুপ্ত করে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন আবদুর রাজ্জাক। এ সময় প্রবীণ রাজনীতিক ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে তৈরি করেন ‘গণফোরাম’।

১৯৯৪ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে বিরোধী দল সংসদ ত্যাগ করে এবং সবাই সংসদ থেকে ইস্তফা দেন। তাদের জোটে থাকা অন্যান্য দলও নির্বাচন বয়কট করে। ১৯৯৫ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ ও জোটে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো। ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। ফলে তত্কালীন বিএনপি সরকার বাধ্য হয় পার্লামেন্টে এই বিল পাস করতে। তিন মাসের মধ্যে এই পার্লামেন্ট বাতিল করে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ২৩ জুন দেশের দশম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে আওয়ামী লীগের সেই শুরু। বর্তমানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায়।

২০০১ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে শুরু হয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন। সে সময় নেতাকর্মীদের রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা নেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। শুধু নেতাকর্মীদের হত্যা, দমন-পীড়ন নয়, ২০০৪ সালে শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান গ্রেনেড হামলা থেকে। ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তাঁর ওপর গ্রেনেড হামলার পাশাপাশি গুলিও চালানো হয়। এ ঘটনায় তিনি গুরুতর আহত হন। তা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বে গঠিত হয় ১৪ দল। রাজপথে তীব্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ।

পরবর্তী সময়ে আরো কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হয় আওয়ামী লীগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে। প্রায় এক বছর তিনি জেলে কাটান। আর ‘সংস্কার’ ইস্যুতে আওয়ামী লীগের প্রায় সব প্রথম সারির নেতা শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। এ সময় সারা দেশের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সভাপতি শেখ হাসিনার পাশে এসে দাঁড়ান। তীব্র গণ-আন্দোলনে মুক্তি পান তিনি। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে নির্বাসনে রাখার চেষ্টা করে। ওই অবস্থায় দৃঢ়চিত্তে সব ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করে ২৩০ আসনে। দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে ১৯৮১ সালে দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর শেখ হাসিনা পুরনো ধারা ভেঙে প্রবীণদের সঙ্গে নিবেদিতপ্রাণ ও তরুণ এবং তৃণমূল কর্মীদের দলের নেতৃত্বে নিয়ে আসেন। অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং সর্বশেষ ওবায়দুল কাদেরকে বেছে নিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। প্রবীণদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে এসেছেন অনেক তরুণ। এই সময়ে উল্লেখযোগ্যভাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন নারী নেতৃত্ব। আওয়ামী লীগকে বিভিন্ন ধারা-উপধারা থেকে তিনি যেমন মুক্ত করেছেন, তেমনি সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনেও এনেছেন গতিশীল নেতৃত্ব।

কালের কণ্ঠ

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


শেখ হাসিনা যেভাবে আস্থার প্রতীক

Update Time : ০৯:৩৯:২৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ জুলাই ২০২০

পঁচাত্তরের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ নির্বাসন শেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ওই বছর তাঁর অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে দলটির নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হয় তাঁর কাঁধে। সেই থেকে টানা প্রায় চার দশক ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তিনি। তাঁর নেতৃত্ব প্রশংসিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নিয়ে গেছেন চারবার। দলকে গতিশীল ও জনমুখী করতে নেতৃত্বে এনেছেন পরিবর্তন। অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্বে শক্তিশালী হয়েছে আওয়ামী লীগ।

টাইম ম্যাগাজিনে ২০১১ সালের আগস্ট সংখ্যায় জানানো হয়, শীর্ষে থাকা ১২ নারী নেতৃত্বের মধ্যে সপ্তম শেখ হাসিনা। এর আগে ২০০৬ সালে তিনি অর্জন করেন মাদার তেরেসা আজীবন সম্মাননা অ্যাওয়ার্ড। ২০১৬ সালের জুন সংখ্যায় ফোর্বস ম্যাগাজিন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাসম্পন্নদের মধ্যে ৩৬তম স্থানে রাখে শেখ হাসিনাকে। আর এ বছর সারা পৃথিবী যখন মহামারি করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে ক্লান্ত, তখন ফোর্বস তুলে ধরেছে শেখ হাসিনার অদম্য নেতৃত্বের বিষয়টি। ম্যাগাজিনের ২২ এপ্রিল সংখ্যায় করোনাভাইরাস মোকাবেলায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে চার দশক দলের প্রধানের দায়িত্বে থেকে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, কারাবরণ, জীবনের ঝুঁকি, এমনকি একাধিকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া ছাড়াও অনেক চড়াই-উতরাই, ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে আজকের অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছেন। মতিয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, পিতা-মাতা, ভাই ও স্বজনদের হারিয়ে এক কঠিন কষ্টের সময় পার করেছেন বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালে যখন দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন, তখন দলের ভাঙন দেখেছেন। দেখেছেন প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে একাধিক হামলা। এসব অভিজ্ঞতা তাঁকে তিলে তিলে তৈরি করেছে।

নির্বাসিত জীবনে ভারতে অবস্থানকালে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পান। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ প্রসঙ্গে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দলের মধ্যে নেতাকর্মীরা উৎসাহ পেয়েছিলেন। তৃণমূলের কর্মীরা অনেকটাই নেতৃত্বহীন ছিলেন, কারণ এই ধরনের দলে একজন ক্যারিসমেটিক নেতা না থাকলে দল খুব একটা এগোতে পারে না।’ প্রশ্নের জবাবে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, একটি দীর্ঘদিনের পুরনো ও গণমুখী রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার কর্মী বাহিনী। তাঁদের আস্থা অর্জন করাটা বড় বিষয়। সেটা তিনি করেছেন।

১৯৮৩ সালে এইচ এম এরশাদের মার্শাল লর বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থী ১৫ প্রগতিশীল দল নিয়ে জোট গঠন করে আন্দোলন শুরু করেন শেখ হাসিনা। ফলে পিতার মতোই জেল-জুলুমের শিকার হতে হয়। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি ও নভেম্বর মাসে সামরিক সরকার তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখে। ১৯৮৫ সালের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্তও তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়।

সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা দলের হাল ধরার আগে পঁচাত্তর-পরবর্তী ক্রান্তিকালে মহিউদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক করে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। কিছুদিন পর সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করে পুনর্গঠন করা হয় আওয়ামী লীগ। এই কমিটি প্রায় এক বছর দায়িত্ব পালন করে। পরবর্তী সময়ে দলে আবদুর রাজ্জাক প্রভাব বিস্তার করেন এবং সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে সরিয়ে তাঁর অনুসারী আবদুল মালেক উকিলকে সভাপতি করেন। আবদুর রাজ্জাক নিজে পুনরায় সাধারণ সম্পাদক হন। তোফায়েল আহমেদকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। এ সময় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে প্রকাশ্য দুই ধারায় বিভক্ত ছিলেন। ওই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগে ঐক্য ধরে রাখার প্রয়োজনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাঁকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এর পরও শেষ পর্যন্ত ভাঙন রোধ করা সম্ভব হয়নি। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব থেকে বেরিয়ে গিয়ে মহিউদ্দিন আহমদ (আগের কমিটির সভাপতি) এবং তত্কালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক তৈরি করেন ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ (বাকশাল)।

এর আগে আওয়ামী লীগে ভাঙন ধরান মিজানুর রহমান চৌধুরী। আওয়ামী লীগ (মিজান) তৈরি করেন তিনি। সিলেটের দেওয়ান ফরিদ গাজীরও একটি আওয়ামী লীগ ছিল—আওয়ামী লীগ (ফরিদ গাজী)। অবশ্য শেষ পর্যন্ত মিজানুর রহমান চৌধুরী ও দেওয়ান ফরিদ গাজী আওয়ামী লীগেই ফিরে আসেন।

আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে দলে ভাঙন সত্ত্বেও ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেয় এবং জনতার বিপুল রায় পায়। প্রশংসিত হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্ব। কিন্তু সামরিক জান্তা এরশাদ ওই ফল পাল্টে জাতীয় পার্টিকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। সারা দেশের পুকুর-জলাশয়ে পাওয়া যায় জনতার প্রকৃত রায় নৌকার ব্যালটভর্তি বাক্স। এরপর স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে তুমুল গণ-আন্দোলন শুরু হয় শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বে। নব্বইয়ে পতন হয় এরশাদের। এরপর একানব্বই সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় যেতে না পারলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সুসংগঠিত সংগঠনে পরিণত হয় আওয়ামী লীগ। পরে বাকশাল বিলুপ্ত করে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন আবদুর রাজ্জাক। এ সময় প্রবীণ রাজনীতিক ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে তৈরি করেন ‘গণফোরাম’।

১৯৯৪ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে বিরোধী দল সংসদ ত্যাগ করে এবং সবাই সংসদ থেকে ইস্তফা দেন। তাদের জোটে থাকা অন্যান্য দলও নির্বাচন বয়কট করে। ১৯৯৫ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ ও জোটে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো। ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। ফলে তত্কালীন বিএনপি সরকার বাধ্য হয় পার্লামেন্টে এই বিল পাস করতে। তিন মাসের মধ্যে এই পার্লামেন্ট বাতিল করে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ২৩ জুন দেশের দশম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে আওয়ামী লীগের সেই শুরু। বর্তমানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায়।

২০০১ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে শুরু হয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন। সে সময় নেতাকর্মীদের রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা নেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। শুধু নেতাকর্মীদের হত্যা, দমন-পীড়ন নয়, ২০০৪ সালে শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান গ্রেনেড হামলা থেকে। ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তাঁর ওপর গ্রেনেড হামলার পাশাপাশি গুলিও চালানো হয়। এ ঘটনায় তিনি গুরুতর আহত হন। তা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বে গঠিত হয় ১৪ দল। রাজপথে তীব্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ।

পরবর্তী সময়ে আরো কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হয় আওয়ামী লীগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে। প্রায় এক বছর তিনি জেলে কাটান। আর ‘সংস্কার’ ইস্যুতে আওয়ামী লীগের প্রায় সব প্রথম সারির নেতা শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। এ সময় সারা দেশের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সভাপতি শেখ হাসিনার পাশে এসে দাঁড়ান। তীব্র গণ-আন্দোলনে মুক্তি পান তিনি। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে নির্বাসনে রাখার চেষ্টা করে। ওই অবস্থায় দৃঢ়চিত্তে সব ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করে ২৩০ আসনে। দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে ১৯৮১ সালে দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর শেখ হাসিনা পুরনো ধারা ভেঙে প্রবীণদের সঙ্গে নিবেদিতপ্রাণ ও তরুণ এবং তৃণমূল কর্মীদের দলের নেতৃত্বে নিয়ে আসেন। অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং সর্বশেষ ওবায়দুল কাদেরকে বেছে নিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। প্রবীণদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে এসেছেন অনেক তরুণ। এই সময়ে উল্লেখযোগ্যভাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন নারী নেতৃত্ব। আওয়ামী লীগকে বিভিন্ন ধারা-উপধারা থেকে তিনি যেমন মুক্ত করেছেন, তেমনি সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনেও এনেছেন গতিশীল নেতৃত্ব।

কালের কণ্ঠ